পদ্মপাতা - পর্ব ০৭ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!১৯!!

সূর্যটা আস্তে আস্তে তার আধিপত্য হারাচ্ছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে এক অজানাতে।দেমাগ কিন্তু তার এখনো কাটেনি। নিজের সর্বোচ্চ দিয়েও গরম ছড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। গাছগুলো যেন হাফ ছেড়েছে একটু।এই সূর্যটা ভিষণ পচাঁ।কিন্তু সে উপকারীও।তার উপকার আর অপকারের হার যেন সমানুপাতিক। মাটি আর গাছগুলো ভেবে পায়না সূর্যকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত না অভিশাপ। এ এক গভীর ভাবনার বিষয়। 

আবিরদের বাড়ির সামনে কিছুদূর পেরিয়ে গ্রামীণ মেঠোপথ।দুইধারে ধানক্ষেতের সমাহার।রাস্তার দুইধারে হরেক রকমের গাছপালা। আপাতত সে রাস্তায় হাঁটছে আবির, চাঁদ,নিতি,প্রমা,রুমা আর দিমা। রুমা আর দিমা আপনবোন।তারা ছয় ভাইবোন। স্বামীর ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো না যাওয়ায় দুলালি বুদ্ধি করে ছোট দুই মেয়েকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।এই বছর পাঁচেক হবে তারা চৌধুরী বাড়িতে থাকে।

রুমা আর দিমা একসাথেই হাঁটছে।রুমা মেয়েটাকে চাঁদের অনেক ভালোলাগে।তবে কি এক কারণ বশত রুমা অনেক কম কথা বলে।সবার সাথেই এমন।তাই চাঁদও আর আগ বাড়িয়ে কথা বলেনা।চাঁদের মতে দিমা মেয়েটা ভালো।চাঁদের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করে।তবে সহজ সরল চাঁদ কি আর দিমার কূটবুদ্ধি ধরতে পারে!দিমা আর চাঁদ সমান বয়সী।মাঝে একবছর পড়াশোনা করতে পারেনি বিধায় চাঁদ এখন নবম শ্রেণিতে আর দিমা দশম।আপাতত চাঁদের মনটা অনেক খারাপ।সে মেঠোপথ ধরে প্রমার পাশাপাশি হাঁটছে।তার সামনে আবির আর নিতি।পিছনে দিমা আর রুমা।চাঁদ মাথা নিচু করে হাঁটছে। সে আসতে চায়নি। আবির ভাই মারের ভয় দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। চাঁদ নিতির দিকে তাকালো।নিতি একটা নীল শাড়ি পড়েছে।যখনই সে হাত নেড়ে নেড়ে হাসিমুখে আবিরের সাথে কথা বলছে তখনই হাতের নীল চুড়ির রিনিকঝিনিক শব্দ হচ্ছে।চুলগুলো ঘাড় পর্যন্ত ছেড়ে রেখেছে।গেজ দাঁতগুলো যেন তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইস্,চাঁদ ছেলে হলে নিতি আপুর প্রেমে পড়ে যেত।পাশেই তার আবির ভাই।লোকটা কি জানে সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে যে অসম্ভব সুন্দর লাগছে!

!!২০!!

সূর্যের শেষবেলার আলো এসে নিতি আর আবিরের মুখে পড়েছে।চাঁদের মনে হলো নিতি আর আবিরকে একসাথে অনেক ভালোলাগে অনেক।তবে তার পুড়ছে কেন?তার অদৃশ্য মনে কে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ আগুন কি পানি দিলেও নিভবে?

প্রমা অনেকক্ষণ যাবত চাঁদকে খেয়াল করছে।মেয়েটা কেমন মুখ গোমরা করে রেখেছে।

-তোর কি মন খারাপরে চাঁদ? 
চাঁদ অনেকটা অন্যমনস্ক ছিলো। হঠাৎ প্রমার ডাকে হকচকিয়ে গেলো মেয়েটা।
-না,আপু।
-মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?ভাই বকেছে বলে।
-আরে না,আপু।এমনিতেই ভালোলাগছেনা।

আবির পিছু ঘুরে জিজ্ঞেসা করলো, 
-কিছু হয়েছে? 
-না,ভাই।চাঁদের নাকি ভালোলাগছেনা।
-হুমম।তার এসব ভালোলাগবে কেনো।তার তো বাদরের মতো গাছে চড়তে ভালোলাগবে।

আবিরের কথায় চারপাশে উচ্চহাসির শব্দ শোনা গেল। দিমা হাসছে সাথে নিতিও।আর প্রমাও মুখ লুকিয়ে হাসছে।অভিমানটা যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো চাঁদের।সে মাথা নিচু করে হাঁটায় মত্ত।
বাজারের পাশটায় একটা খোলা মাঠ আছে। সেখানেই মেলা বসেছে।আবিরদের বাড়ি থেকে আধাঘন্টার পথ।হেঁটেই যাওয়া যায়।বিকালটাতে জমজমাট হয়ে উঠেছে গ্রামীণ মেলা।গ্রীষ্মের সময় প্রতিবছরই মেলা বসে।মাঠের একপাশে নদীর তীর আর চারিদিকে বিস্তৃত হরেক রকম ক্ষেত।ধানেরক্ষেতটা অবশ্য বেশি।সবুজে সবুজময়।নানা রকমের মানুষে মুখরিত চারপাশ।দূরে মাঠটার এককোণে নাগরদোলা বসেছে।আবির সবাইকে নিয়ে মেলায় প্রবেশ করলো।নিতি তাদের অতিথি।অনেকদিন যাবত তার সাথে দেখা হয়না আর নিতি এমনভাবে তার সাথে কথা বলছে আর হাঁটছে যে আবির মানাও করতে পারছেনা।আবির বুঝতে পারছে তার প্রিয়তমার কষ্টটা।নিতিকে আজ রাতেই সব খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিলো আবির।

মেলার ভিতর হাটঁতে ভালোই লাগছে চাঁদের।মনটা যেনো একটু হলেও ভালো হচ্ছে। কত মানুষ, কত দোকান।হঠাৎ পাশে পরিচিত গন্ধ পেয়ে ফিরে তাকালো চাঁদ। প্রমা পাশে নেই আবির তার পাশে।দৃষ্টি সামনের দিকে।

-ব্যাঙের মতো মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস কেনো?
-জানিনা।
-তবে কি জানিস?
-তাও জানিনা।
-দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস চাঁদ।

চাঁদ মুখটা বাঁকিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো।নানা রঙের কাঁচের চুড়ি সাজিয়ে রাখা।সে সাথে আলতা,পায়েল, কানের দুল আরো কত কি।চাঁদের পড়নে লাল-সাদা সেলোয়ার-কামিজ।চাঁদ এক জোড়া ছোট কানের দুল হাতে নিল।আবির পাশে দাঁড়িয়ে। চাঁদ দোকানীকে জিজ্ঞেসা করলো,
-কত দাম চাচা?
-১২০ টাকা।
-ওহ্।
বলে চাঁদ দুলটা রেখে দিলো।সাথে ৫০ টাকা আছে।বড়মামা স্কুলে যাওয়ার সময় যে টাকা দেয় সেখান থেকেই বাঁচিয়ে রেখেছিল চাঁদ।সে ফিরে চলে যেতে চাইলো।তবে বেণীতে টান পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। 
-দেখি হাতটা দেতো চাঁদ। 
-কেনো আবির ভাই?
-এতো কেনো করতে বলেছি।হাত দে।

হাত বাড়িয়ে দেয় চাঁদ। আবির খুবই সন্তর্পণে লাল কাচের চুড়ি পরিয়ে দেয় চাঁদকে।চাঁদ একদৃষ্টিতে আবিরকে পর্যবেক্ষণ করে।কে বলবে এই লোকটাই তাকে কথায় কথায় বকা দিবে আর বেশি রাগলে মার।

-এই নে প্যাকেট টা ধর।আমার থেকে কথা লুকানোর শাস্তি জানিস তো চাঁদ।

চাঁদ মাথা নাড়ে। অর্থাৎ সে জানে।

-গুড।মনে রাখবি এই আবিরের সব কিছুই চাঁদের। সেটা হোক টাকা আর অন্যকিছু।

চাঁদ কিছু একটা বলবে তার আগেই সেখানে চলে আসে নিতি।
-এই আবির চলতো নাগরদোলায় চড়বো।
-আমার এসব ভালোলাগে না নিতি।প্রমারা কোথায়?
-ওরা তো ফুচকার দোকানে।রুমা নাকি ফুচকা খাবে।
-আচ্ছা। চল আমারাও সেদিকেই যাই।চাঁদ চল।

বলে চাঁদের হাতটা ধরে আবির। নিতি তাকিয়ে থাকে।

!!২১!!

পরক্ষণেই ভাবে এতিম মেয়েটাকে তো আবির নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে।সে নিজেও গিয়ে আবিরের বা হাতটা আলতো করে ধরে।আবিরের কি করা উচিত বুঝে পায়না সে।

-আবির এমন করছিস কেন?চল না নাগরদোলায় উঠি।
-এমনিতেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে।আজ না উঠলে হয়না। 
-না, চল উঠি।

প্রমা আর দিমা একটা দোকানে গিয়ে কিনাকাটা করছে।রুমা বসে ফুচকা খাচ্ছে। চারপাশে অন্ধকার হতে শুরু করেছে সেই কখন থেকে।মাগরিবের আজান শুনে মাথায় উড়না দিলো চাঁদ।তারও ইচ্ছে করছে নাগরদোলায় চড়তে।মনে তার আরেকটা অদ্ভুত ইচ্ছেও জাগছে।আবির ভাইয়ের পাশে বসে নাগরদোলায় চড়তে ইচ্ছে করছে তার।কি ভয়ংকর ইচ্ছে! ভাবা যায়!

-আবির ভাই।আমিও নাগরদোলায় উঠবো।
আবির জানে চাঁদের নাগরদোলায় উঠলে অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আগেরবার তো বমি করতে করতে অবস্থা শেষ। 

-তোর উঠার প্রয়োজন নেই।নিতি উঠতে চাচ্ছে ও উঠুক।
-আবির ভাই।
-না মানে না।আর কথা বাড়ালে গালে থাপ্পড় পড়বে।

চুপসে গেলো চাঁদ।সাথে মনের অভিমানটা যেন আরো গাঢ় হলো তার।চাঁদ আর রুমা ফুচকার দোকানে বসে রইল।আর আবির নিতিকে নিয়ে এগিয়ে গেলো নাগরদোলার দিকে।

চারিদিকে লাইট জ্বলছে। লাইটের আলোতে সব স্পষ্ট। মেলার লোকসমাগম যেনো আরো বেড়ে গিয়েছে। চাঁদ বিষণ্ণ মনে রুমাকে বললো,
-তুই খা। আমি একটু নদীর পাড় থেকে আসি।

রুমা কেবল মাথা নাড়ল।এর অর্থ কি হ্যা নাকি না বোধগম্য হলোনা চাঁদের। 

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদ।নদীটা শান্ত হয়ে আছে।মাঝেমাঝে ছোটছোট ঢেউ খেলে যাচ্ছে।মনটা ভিষণ খারাপ চাঁদের।নিতি আপুর সাথে আবির ভাইকে দেখলেই অজানা কারণে মন খারাপ হয় তার।

-লম্বা চুলের ফুলটুসি। 

হঠাৎ এমন কথায় পিছন ফিরে তাকায় চাঁদ।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন