!!২২!!
তিনজন ছেলে দাঁড়িয়ে।অদ্ভুতভাবে দুলছে তারা।চোখদ্বয় লাল বর্ণ তাদের। চাঁদ অনেকটা হকচকিয়ে গেলো।এই লোকগুলো নিশ্চিত নেশাদ্রব্য পান করেছে।
-আহা এ দেখি হুরপরী।চাইরে চাইরে চাইরে পরীটারে চাই।
বলে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো লাল গেঞ্জি পড়া ছেলেটি।কেমন অদ্ভুতভাবে হাসছে।ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে এলো চাঁদের। এদিকটায় লোক সমাগম কম।নেই বললেই চলে।চাঁদ চিৎকারও করতে পারছেনা।হাত পা কাপঁছে তার।ছেলেটা খপ করে একটা হাত ধরলো চাঁদের।চাঁদ এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো।
-আমাকে ছেড়ে দিন।দয়া করুন।আমাকে ছেড়ে দিন।
-তা বললে হয় পরী।চলো তো চলো। আমরা মজা করবো কেমন।প্রমিস একটুও ব্যথা দিবোনা।
চাঁদ চমকে উঠলো।এই লোক কি বলছে এসব!বাকি ছেলে দুটোও এগিয়ে এসে চাঁদের সামনে দাঁড়ালো।তন্মধ্যে একজন খপ করে চাঁদের আরেকটি হাত ধরলো।লাল কাঁচের চুড়িগুলো হাতের মধ্যে বিঁধে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বের হচ্ছে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো চাঁদ।ছেলে তিনটি তাকে ধানক্ষেতের দিকে টেনে হিঁছড়ে নিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ চিৎকার করার সুযোগও পাচ্ছেনা।মুখে চাপ দিয়ে রেখেছে দানবীয় একটি হাত।ছেলে তিনটি একসুরে গান ধরেছে,
"পরীর মুখে মিষ্টি হাসি
দেখতে চমৎকার
এক নিমিষে কাইড়া নিলো
মনটা যে আমার।
চাইরে চাইরে পরীটারে চাই"
তারপরেই বিদঘুটে এক হাসি দিলো তারা।কি বিশ্রি সে হাসি।চাঁদ হাত পা নাড়াচাড়া করছে প্রতিনিয়ত। আর মনে মনে চিৎকার করছে,
"আবির ভাই কই আপনি।আপনার চাঁদ যে বিপদে আবির ভাই।কই আপনি।আবির ভাই।"
নাগরদোলা থেকে নামার পর থেকে বুকটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতিতে ভোগাচ্ছে আবিরকে।কেমন কু ডাকছে মনটা। আবির ভাবলো,
"চাঁদের কিছু হলোনা তো?"
নিতিকে রেখেই দৌঁড়ে ফুচকার দোকানে গেল আবির।রুমা একা বসে।বুকটা ছেৎ করে উঠলো আবিরের। চাঁদ কই।সে দ্রুত এগিয়ে গেলো রুমার দিকে,
-চাঁদ কই রুমা?
-আপু নদীর পাড় গেছে।
আবির আরো হকচকিয়ে গেলো।এই সময় নদীর পাড়।এমনিতেই চারদিকে অন্ধকার তার উপর সেদিকটায় লোক সমাগম কম।ততক্ষণে নিতি, প্রমা আর দিমাও এসে হাজির।
-কখন গেছে?
আবির চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো।
-অনেকক্ষণ তো হইলো।
রুমা ভাবলেশহীন। আবির দৌড় লাগালো নদীর পাড়ের দিকে।নিতি এতো করে ডাকলো।সেই ডাক যেনো কানেই তুলেনি আবির।
!!২৩!!
এইদিকে তিনজন ছেলে মিলে ধস্তাধস্তি করেও চাঁদের সাথে পেরে উঠছেনা।নিজের সম্মানহানি রুখতে কি কোনো দৈব শক্তি এসে ভর করলো চাঁদের মাঝে!অতঃপর চাঁদের গালে ঠাস করে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় লাল গেঞ্জি পরিহিত ছেলেটা।চিৎকার করে বলে,
-"তোর তেজ যদি না কমাইছি তাইলে আমিও রবিন না।"
চাঁদ সর্বস্ব দিয়ে একটা ধাক্কা লাগায় তাকে।ছেলেটা উল্টে পড়ে যায়।বাকি ছেলে দুটো পাশেই সিগারেট ফুঁকছিলো।উঠে দৌড় লাগায় চাঁদ।এদিকে আবির পাগলের মতো ছুটছে আর ডাকছে চাঁদকে।নদীর পাড়ে লাল ভাঙা কাচের চুড়ি দেখে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তার।ছেলেগুলো ছুটছে চাঁদের পিছনে।চাঁদ প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ আবিরের কণ্ঠ ঝাপসা কানে এলো চাঁদের। সে দৌড়ে সেদিকে গিয়ে দেখলো আবির দাঁড়িয়ে। চাঁদ ঝাপটে ধরলো আবিরকে।আবির হঠাৎ এমন ধাক্কায় কিছুটা পিছিয়ে গেলো।চাঁদের ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো সে।ছেলে তিনটা এসে দাঁড়িয়ে আছে।খুব সম্ভবত তারা এই এলাকার না।নয়তো চৌধুরী বাড়ির বড়ছেলেকে সবাই চিনে।একসময় আবির এই এলাকা দাপিয়ে বেড়াতো।পড়াশোনার জন্য যা অনেকটাই থেমে গিয়েছে। চাঁদের মুখের দিকে চেয়ে রইল আবির।এলোমেলো চুল,জামার হাতার দিকে কিছু অংশ ছিঁড়া,বিধ্বস্ত চেহারা,গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট। মাথা নষ্ট হয়ে গেলো আবিরের। লাল গেঞ্জি পড়া ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো,
-ভাই এই পাখি আমাগো।আপনে অন্যটা নেন তো।চাইলে আমাদের সাথেও মজা করতে পারেন।
কন্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে হুসে নেই।আবিরের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছে। হ্যাংলা পাতলা ছেলেটাকে ঠাটিয়ে চড় লাগালো সে।চাঁদকে নিজের পিছনে নিয়ে আবার মারতে আরম্ভ করলো সে।বাকি ছেলে দুটো ভয়ে পালিয়েছে। এতোক্ষণে ভিড় জমে গিয়েছে সেখানে।ছেলেটার হাত এমনভাবে জখম করেছে জীবনেও আর কোনো মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর সুযোগ হয়তো পাবেনা ছেলেটা।দুই তিনজন এগিয়ে এসে ঐ ছেলেটাকে ধরলো।পুলিশে ফোন করা হয়েছে। আবির খেয়াল করলো চাঁদের গায়ে উড়না নেই।মেয়েটা এখনো তার পিছনে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে। আবির চাঁদকে নিয়ে হাটাঁ ধরলো বাড়ির দিকে।কিছুদূর এগিয়ে দেখলো চাঁদেের উড়নাটা নিচে পড়ে আছে।উড়নাটা হাতে নিয়ে সারা শরীর ঢেকে দিলো চাঁদের।প্রমাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে তারা যেন একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যায়।প্রমাদের আর ব্যাপারটা জানালো না আবির।আবির চাইল ব্যাপারটা যেন না ছড়িয়ে পরে।তাহলে চাঁদের বদনাম হবে।যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে ফিরা প্রয়োজন। ছেলেটাকে উপযুক্ত শাস্তি সে দিয়েছে। বাকিটা এখানকার মানুষ বুঝে নিবে।চৌধুরী বাড়ির ছেলে বলে সবাই তাকে চিনে।তাছাড়া এখানে আবিরের এক বন্ধু পারভেজও আছে।ব্যাপারটা সে বুঝে নিবে বলে আশ্বস্ত করলো আবিরকে।
!!২৪!!
অনেক খুঁজেও কোনো রিকশা পেলোনা আবির।বাজার থেকে মেইন রোড ধরে বাড়ি গেলে ১০ মিনিট লাগে।তবে সেখানে অনেক মানুষ থাকবে নিশ্চয়ই। তাই মেঠোপথে রওনা দিলো আবির।চাঁদ আস্তে ধীরে হাঁটছে।মেয়েটা ভিষণ ভয় পেয়েছে। আবির যখন দেখলো চারিদিকে অন্ধকার আর কোনো মানুষজন নেই তখন মোবাইলের ফ্লেশটা জ্বালিয়ে মুখে নিয়ে হুট করে কোলে তুলে নিলো চাঁদকে।চাঁদও কোনো দুরুক্তি করলোনা।তার শরীর অনেক দুর্বল লাগছে।কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটা নারিকেল গাছের নিচে বসলো আবির।মুখ থেকে মোবাইলটা রেখে চাঁদের মুখের দিকে তাকালো।তার প্রেয়সী একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে ভালোবাসার পরশে সারামুখ ভরিয়ে দিলো আবির।চাঁদ অবাক হয়ে তাকালো তাঁর আবির ভাইয়ের মুখের পানে।আবির কি কাঁদছে।নিজের কপালে উষ্ণ তরল অনুভব করলো চাঁদ।আবির ভেজা ভেজা কন্ঠে বললো,
-আমি আজ কতটা ভয় পেয়েছিলাম তুমি জানো।এই যে ঠিক বুকের বা পাশটায় কতটা ব্যথা অনুভব করেছিলাম আমি তুমি জানো।এই প্রেয়সী এভাবে আর ভয় দেখিও না আমায়।আমি মরে যাবো।একদম মরে যাবো।
চাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
-আবির ভাই।
আবির নিজেকে সামলিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর কড়া গলায় বললো,
-একা একা নদীর পাড়ে কেনো গিয়েছিলি তুই।বেশি ঘুরাঘুরির শখ না।একদম পা কেটে হাতে ধরিয়ে দিবো বেয়াদব।
চাঁদ একটা ভেঙচি কাটলো আবিরকে।আবির অবশ্য সামনের দিকে তাকিয়ে। চাঁদ বিরবির করে বললো,
-"এতোক্ষণ তো ভালোই ছিলো।আবার নিজের রূপে ফিরে এসেছে।এই লোক ভালো হওয়ার নয়।করলা কোথাকার।"
আবির এই বিরবির করা শুনেও কিছু বললোনা।আজ সে প্রচুর ভয় পেয়েছে। প্রচুর।এখন সে ঢাকা যাবে কিভাবে?মন কি টিকবে তার। তারপর কিছুদিন পর দেশের বাইরে।তার এই ছোট প্রেয়সীর কি হবে?ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো আবিরের।চাঁদ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।
চারদিকে হালকা হালকা দমকা হাওয়া বইছে। মেঠোপথ ধরে হেঁটে চলেছে দুইজন কপোত-কপোতী। পাশের ধানক্ষেতগুলোতে বাতাস লেগে শো শো শব্দ হচ্ছে। দূরে এককোণে দেখা মিললো কিছু জোনাকির দলের।যারা একমনে নিজের আলো ছড়াচ্ছে। অন্ধকারের মাঝে আলোর এই খেলা যে কারো মন কাড়তে বাধ্য। দুইপাশে গাছের সারিগুলো লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকছে নিজের।আর বলছে,"প্রেমের বাতাস বইছে গো প্রেমের বাতাস।"
একজনের মনে চলছে প্রেয়সীকে হারানোর ভয়, ভালোলাগার অনুভূতির সুখ আবার ভবিষ্যত ভেবে দুঃখ। আরেকজনের মনে চলছে অজানা কিছু অনুভূতির যন্ত্রণা,কিছু নতুন ভালোলাগার সুখ আর চেনা মানুষের অচেনা রূপের সাক্ষাতের অনুভূতি। দুজনের ভাবনা ভিন্ন।কিন্তু একসূত্রে গাঁথা নয়কি!
.
.
.
চলবে............................