পদ্মপাতা - পর্ব ১০ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!২৮!!

রিকশা এসে থামলো বড় স্টেশনের সামনে।এখানেই রক্তধারা ভাস্কর্যটি অবস্থিত।রিকশা ভাড়া মিটিয়ে আবির কতক্ষণ রক্তধারা ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে রইল। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর ২০১১ সালে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ প্রজন্মের দাবিতে প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত হয় 'রক্তধারা'। একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালিকে এখানে এনে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হতো এ বধ্যভূমিতে। তাদের স্মরণে স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়, যার নাম রাখা হয় রক্তধারা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবির নিতিকে বললো,
-চল নদীর পাড়ে গিয়ে বসি।

নিতির মনটা আজ বেজায় ভালো।নিতি হাসি মুখে জবাব দিলো, 
-চল।

অতঃপর তারা মোলহেডের দিকে এগিয়ে গেলো।
পদ্মা,মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল অবস্থিত রক্তধারার পাশেই।এই মিলন স্থলকে মোলহেড নামে ডাকা হয়।নদীর তীরে হরেক রকম গাছ।কয়েকপ্রকার কাঠগাছ,ফলের গাছগুলো যেন নদীর তীরটাকে আপনমনে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।আর কেউ যদি জিজ্ঞেসা করে "এইখানেই কি ঘাঁটি গেড়েছ বাপু?"
গাছগুলো বিরক্তির স্বরে বলে,"নিজের ঘর সংসার ফেলে আর কোথায় যাবো বাছা"।

এক সারিতে পাশাপাশি অনেকগুলো সিমেন্টের বসার জায়গা তৈরি করে রাখা হয়েছে। তারই একটাতে বসলো আবির আর নিতি।নদীর ঢেউয়ের আওয়াজ আসছে ছলাৎ ছলাৎ। ছোট ছোট নৌকাগুলো আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে নদীতে।আকাশে মেঘেদের আনাগোনা। সূর্যটা আস্তে আস্তে বিলীন হচ্ছে।সেই কখন থেকে আবির আর নিতি বসে আছে।এইবার নিতি বলেই বসলো,
-কিরে আবির তুই না জরুরি কথা বলবি।তো বল।
-হুমম।বলছি।মনোযোগ দিয়ে শুনবি।

আবিরের মনে চাঁদের প্রতি যে মনোভাব আছে তা সে কখনো বাইরের কারো কাছে প্রকাশ করেনি।তাই কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে তার।আর আবির কিছুটা হলেও নিতির মন পড়তে পারছে।মেয়েটা হয়তো তাকে ভালোবাসে।তবে আবির নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেতে স্বার্থপর হতেও রাজি।এতে নিতি হয়তো কষ্ট পাবে।

!!২৯!!

-আমি বাবা মাকে বলেছি এখন বিয়ে করতে পারবোনা। 
-হুমম,শুনেছি তোর সময় প্রয়োজন তো। আচ্ছা নে।আমার কোনো সমস্যা নেই।আমিও আমার পড়াটা শেষ করি।
-না,আরো কারণ আছে?
-কি কারণ?

আবির উঠে দাঁড়াল।নদীর দিকে এক মনে তাকিয়ে রইল কতোক্ষণব্যাপী।ঢেউগুলো যেন আছড়ে পড়ছে।সূর্যটা ডুবে গিয়েছে তবে নিজের অস্তিত্বের জানান রেখে গিয়েছে। সূর্যের রংয়ের মতো লাল রঙে মেতে উঠে আকাশ।পাখিগুলো একঝাঁক হয়ে নিড়ে ফিরছে।দৃশ্যটা সত্যিই মনোরম।নিতি আবিরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।আবির বলতে শুরু করলো,
"আমি চাই তারে বারে বারে
তার দীঘল কালো চুলে আমি হারাই
তার নয়নজোড়া আমার প্রাণ কাঁপায়
তার কন্ঠে আমি বিলীন হই।

আমার প্রেয়সী,আমার হরিণী
আমার অস্তিত্বের অংশ
আমার এই মরুভূমি বুকটার এক ফোটা জল
তারে ছাড়া আমি নিঃস্ব,শূন্য,বিরান।"

নিতি একটা ঘোরের ভিতর চলে গিয়েছিল।নিজের অজান্তেই তার কন্ঠস্বর আর ঠোঁট মিলে প্রশ্ন করে,
-কে সে?
-আছে একজন।আমাদের ভালোবাসাটা স্বাভাবিক নয়।হয়তো তাকে পেতে আমাকে সাতসমুদ্র পাড়ি দিতে হবে।

নিতির বুকটা হা হা করে উঠলো।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।বুকে কেউ তীর মারলো কি?হঠাৎ করে প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়ার সুখ পেয়েছিল।আবার একমুহূর্তে তা বিলীন!তবুও নিজের ভাবনাগুলোকে চেপে গেলো নিতি।আজ সব পেয়েও কিছু নেই নিতির।নিতি বললো,
-আমায় কি করতে হবে?
-তুই শুধু না করে দিস তাহলেই হবে।আমার যতটুকু বলার বাবাকে বলেছি।প্লিজ নিতি এইটুকু সাহায্য কর।ছোটবেলা থেকে প্রত্যেকটা কাজে সাহায্য করেছিস।এটাও কর।

নিতি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
-ঠিক আছে। তাহলে তাই হবে।আমার জবাব না ই হবে।
-ধন্যবাদ,নিতি।তোর এই ঋণ কখনো ভুলবোনা।

চারিদিকে আস্তে আস্তে অন্ধকার হতে শুরু করেছে।ঠিক যেমনটা নিতির মনে জমেছে।আবির বললো,
-চল,তাহলে বাড়িতে ফিরা যাক।
-হুমম,চল।

!!৩০!!

একটা রিকশা ঠিক করে তাতে উঠে পড়লো নিতি আর আবির।রিকশা চলছে আপনমনে।নিতির মন আর মস্তিষ্ক স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট এতো তীব্র!সেই ছোট থেকে একমনে নিতি কেবল আবিরকেই চাইতো।যদিও মুখ ফোটে কখনো বলেনি।সবসময় বন্ধুর মতো পাশে ছিলো। আজোও না হয় থাকলো।পাশে ঘুরে অতি সন্তর্পণে নিজের চোখের জলটা মুছে নিলো সে।আবিরের নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে।ভালোবাসা পেতে একটু স্বার্থপর হলে কি খুব বেশি দোষের?নিতির কষ্টটা যেন দেখেও অদেখা তার।

শপথ চত্বরে এসে ওয়ান মিনিট মিষ্টির দোকানের সামনে রিকশা থামলো।নিতি চমকে তাকালো।

-এখানে থামিয়েছিস কেন?
-তুই না বলেছিলি আইসক্রিম খাবি?
-না,মন চাচ্ছে না।তুই খেলে নে।আমি খাবোনা।
-একটা খা।
-না,দোস্ত। খাবো না।
-আচ্ছা,তাহলে তুই বস।আমি বাড়ির জন্য মিষ্টি নিয়ে নেই।

আবির মূলত নেমেছে রসমলাই নিতে।তাঁর চাঁদ পাগলী খেতে ভালোবাসে কিনা!দুইকেজি মিষ্টি নিলো বাড়ির সবার জন্য।এককেজি রসমলাই আলাদা নিলো।অভিমানিনীর অভিমান ভাঙাতে।আর একটা আইসক্রিম নিলো নিতির জন্য।সবকিছু নিয়ে রিকশায় বসলো আবির।জোর করে নিতির হাতে আইসক্রিমটা ধরিয়ে দিলো।অন্ধকার পুরোপুরি নেমে এসেছে। মাগরিবের আজান অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছে।এই অন্ধকারে ছুটে চলেছে একটি রিকশা। সেই রিকশা বসে আছে দুইজন যুবক-যুবতী। একজনের মনে চলছে হাহাকার আর দহন যন্ত্রণা আর অপরজনের মনে চলছে প্রেয়সীর অভিমান ভাঙানোর কৌশল রপ্ত করণ। 

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে আবির আর নিতি প্রবেশ করলো বাড়িতে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে নিতি উপরে চলে গেলো।হয়তো এখন সে বাথরুমে ঢুকে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিবে।নিজের খা খা বুকটা শান্ত করবে।পুড়ে যাওয়া দহনে পানি ঢালার ব্যর্থ চেষ্টা করবে।

আবির ডাইনিং টেবিলে মিষ্টির প্যাকেটগুলো রাখলো।রহিমা খালাকে ডেকে বললো মিষ্টিটা যেন তিনি ফ্রিজে রেখে দেয়।মতিন আর করিম এখনো বাড়ি ফিরেনি।তিলোত্তমাকে নিয়ে মোহনা পাশের বাড়ি গিয়েছেন।বাকিরা নিজেদের ঘরে।আবিরও উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।হাতে তার প্রেয়সীর প্রিয় রসমলাইয়ের একটা প্যাকেট।সিঁড়ির ঠিক ডানপাশে চাঁদের ঘর।একেবারে এক কোণে।বাকি ঘরগুলো সিঁড়ির অপর পাশে।টানা তিনটে ঘর।প্রথম ঘরটা আবিরের দাদির,রুমা আর দিমার মাঝেরটা,তার পাশেরটা প্রমার।তারপরে একেবারে দিঘীর পাশে কোণের ঘরটা আবিরের।ঘরগুলোর সামনে খোলামেলা বিস্তৃত বারান্দা।যেখানে আপাতত টানানো রশিতে বাড়ির সবার কাপড় ঝুলছে।চাঁদের দরজাটা হালকা চাপিয়ে রাখা।আবির ঠকঠক আওয়াজ তুললো দরজায়।

চাঁদ বিকালে একমনে কতোক্ষণ আমবাগানে বসে কেঁদেছে।তবে যখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল তখন বেচারি ভয়ে বাড়িতে চলে এসেছে। ওর যে লম্বা চুল নির্ঘাত জ্বীনে ধরতো।বাড়িতে এসেও যখন আবিরের দেখা মিলেনি তখন মুখটা মলিন করে নিজের ঘরে চলে আসে।খাটের উপর বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে ঠিকই তবে তাতে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। 
ইতিহাস বইটা সামনেই পড়ে রইল।বেচারা চিল্লিয়ে বলছে,"পড়বিনা যখন আমায় খুলে রেখেছিস কেন।বেয়াদব মেয়ে।তোর দ্বারা পড়াশোনা হবেনা।"
তবে যার জন্য চিৎকার করা সে তো অন্য ধ্যানে মগ্ন। একসময় ইতিহাস বইটাও চিল্লাতে চিল্লাতে হার মানে।

তখনই দরজার ঠকঠক আওয়াজে ধ্যান ভাঙে চাঁদের।দরজাটা গিয়ে খুলে দেয় সে।আবির ঘরে ঢুকে খাটে গিয়ে বসে।সে যা ভেবেছিল তাই।তার প্রিয়তমা চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে কেদেঁ।তখন সে চাঁদকে হয়তো বলে যেত তবে কাছেই পায়নি।আবির চাঁদকে ইশারা করলো তারপাশে বসতে।তবুও চাঁদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।তার দৃষ্টি নিচের দিকে।যেনো উপরে তাকালেই আবির কিছু পড়ে ফেলবে।আবির এবার মুখেই বললো,
-চাঁদের কণা পাশে এসে বসো।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন