মুষ্টিবদ্ধ হাতের উচুঁ হাড়গুলোতে চামড়া উঠে রক্ত লেগে আছে। পূর্ণতা ধপ করে উঠে বসে ছটফট করে হাতটা চোখের সামনে এনে ফু দিতেই এমন ভঙ্গিতে অস্থির হয়ে উঠলো যেনো ব্যথাটা ওর করছে। ভীষন উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
- তুমি ওকে মেরেছো না? ওকে মারলে কেনো? এ কি করলে হাত? তোমাকে নিয়ে আমি কি করবো!!
বলতে বলতেই তিনগুণ বেশি চান্ঞ্চল্যে কামিজের শেষ কোণাটা টেনে পূর্বের হাতের উপর চেপে ধরে। পূর্ব ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে মাথার নিচে হাতের তালু রেখে নিরুদ্যম কন্ঠে বললো,
- মাথা ঠান্ডা! কিচ্ছু হয়নি। হাত ছাড়ো।
পূর্ণতা চোয়াল কঠোর করে চোখ রাঙিয়ে এমন দৃষ্টিতে তাকালো পূর্ব বাধ্য হয়ে নতজানু স্বীকার করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। পূর্ণতা মলম, এন্টিসেপটিক লিকুইড ও তুলা এনে জায়গাটা খুব সাবধানে জীবাণুমুক্ত করে ভায়োডিন(Viodin-মলম) লাগিয়ে দিলো। দোলনায় পূর্ব শোফার মতো করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলে পূর্ণতা সব সামগ্রী রেখে এসে, দেখে পূর্ব ঘুমিয়ে পরেছে। একটা নরম পশমী কম্বল এনে পূর্বের পেট পযর্ন্ত ঢেকে দিলো পূর্ণতা। শহরে দুপুর টাইমে তীব্র তাপদাহ থাকলেও রাতের দিকে অদ্ভুতকাণ্ডের মতো এমন হিমভাব দেখা দেয় তখন গায়ে কিছু না জড়ালে নির্ঘাত ঠান্ডা লাগতে বাধ্য। পূর্ব এমনভাবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে যেনো গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। কিন্তু তাই বলে কি বারান্দায় শুতে দেওয়া যায়? ন'তলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় কেউ শুলে দূর-দূরান্ত থেকে সহজে না দেখা গেলেও নিজের কাছেই তো কেমন অদ্ভুত লাগে। তাছাড়া এতো তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমায়? পূর্ব সারাদিন বাইরে কেমন ধকল সহ্য করতে থাকে তা যদিও অনুমানের বাইরে তবুও আন্দাজ করা যায় দৌড়ঝাঁপের চেয়ে সেটা কম না। দোলনাটা বেশ চওড়া ও দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা ছিলো বলে পূর্বের মতো বিশাল লম্বাটে মানুষ সাচ্ছন্দ্যে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে।
আচ্ছা? হাতে যেহেতু ক্ষত ছিলো শরীরের অন্যত্র কোথাও আঘাত লেগেছে? লাগলেও তো পূর্ব সেটা বলবেই না। পূর্ণতা ঘুমের মধ্যেই ওর শার্টের কলার টেনে গলা, কাধ দেখলো। হাতের কনুই পযর্ন্ত এপিঠ ওপিঠ দুইপিঠেই চেক করলো। যাক শান্তি আর কোনো ক্ষত নেই। পূর্ণতা একবার ভাবলো পূর্বকে ডেকে বিছানায় শুতে বলবে পরক্ষনে চিন্তা করলো কি দরকার স্বার্থপরের মতো এতো সুন্দর ঘুমটা ভাঙানোর? একদিন কষ্ট করে ঘুমালে কিচ্ছু হবেনা ওর। পূর্ণতা রিস্ক নিয়ে দোলনার যতটুকু অংশ পূর্বের শোয়ার পর বাকি ছিলো সেটুকু অংশতে এক কাত হয়ে পূর্বের দিকে ফিরে কম্বলে ঢুকে পরলো। যদি ভুলবশত সে ওকাত ফিরতে যায় তাহলে কোমর থেকে পিঠের হাড্ডি চুরচুর! কিন্তু এই মূহুর্তে পূর্বকে ছাড়া শোওয়ার লোভ সে কোনোভাবেই সামলাতে পারবেনা, কাজেই ঝুঁকিটা নিতেই হয়। ছোট্ট কুশনে মাথা হেলিয়ে পূর্ব সোজা হয়ে শুয়ে ছিলো , পূর্ণতা ওর ডানপাশে এককাত হয়ে পূর্বের বুকের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করলো। সময় কতক্ষণ অতিবাহিত হয় পূর্ণতার খেয়াল নেই হঠাৎ পূর্ব ওর দিকে ঘুরে দুহাতে এমনভাবে চেপে ধরলো পূর্ণতার দম কঠিন ভাবে বন্ধ হয়ে আসলো। এরপর ওকে কিছু বলতে না দিয়েই ওকে সম্পূর্ণ ডানপাশ থেকে বামপাশে শুইয়ে দিলো পূর্ব। পূর্ণতা চমকানো দৃষ্টিতে বৃহৎ আকারে চোখ বড় করে ছিলো, মুখ হা করে অনবরত শ্বাস ছাড়তেই বললো,
- একাজ করলে কেন? যদি তোমার বাহুর পিষ্টনে মরে যেতাম!! আল্লাহ্, এখনো ধড়ফড় ধড়ফড় করছে...
পূর্ব প্রশ্নটার ছিটেফোঁটা গুরুত্ব না দিয়ে কম্বলটা টেনে পূর্ণতাকে আলতো করে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো। পূর্ণতাকে সেইফটি দেয়ার জন্যই মূলত পাশ পরিবর্তন করে দোলনার দেয়াল ঘেঁষে শুয়িয়েছে পূর্ব। দোলনা যতই চওড়া হোক, ঘুমের ঘোরে পূর্ণতা যদি বায় চান্স তাল বিগড়ে উল্টে পরে এতে অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রবল ছিলো। পূর্ব যদিও জানে সে ঘুমের মধ্যে পূর্ণতার নড়াচড়া অনুভব করতে পারে তবুও সে তিলফোঁটা রিস্ক নিতে চাইলো না। পূর্ণতা এখনো বিষ্ময় কাটাতে পারেনি। একের পর এক বিরাট চমক খেয়ে যাচ্ছে যার কোনো উত্তর সে পায়নি। পূর্ণতা বললো,
- তুমি আমাকে এপাশে আনলে কেনো?
- তুমি ওপাশে থাকলে পরে যাবে।
- এটা কেমন হিসাব! আমি শুলে পরবো! আর তুমি শুলে পরবেনা?
- একটা মারবো! ঘ্যানঘ্যান করা বন্ধ করবে? চুপচাপ ঘুমাও।
পূর্ব আড়ম্বরপূর্ণ ভঙ্গিতে পূর্ণতাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু নিরর্থক ভাবে প্রশ্নটার উত্তর দিলোনা সে। পূর্ণতা দুইহাতে নিজের দিকে এমন আকড়ে ধরেছিলো যেনো পূর্ব কোনোভাবে পিছিয়ে না যায়। গেলেই ব্যথা পাবে।
- কুত্তার বাচ্চাটা কতদিন ধরে জ্বালাচ্ছিলো? আমাকে এ ব্যাপারে কেনো বললে না!
পূর্বের মুখে আচমকা এমন কথা শুনে প্রচণ্ডরূপে শিউরে উঠে পূর্ণতা। গলার ঝাঁজটাই যেনো আগুনের লাভায় চুবানি খেয়ে তপ্ত স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছিলো। পূর্ণতা খপ করে পূর্বের পিঠের শার্ট খামচে ভয়ে ধরে। পরপর গলায় ক'টা ঢোক গিলে ধাতস্থ সুরে বললো,
- আস্তে পূর্ব! রাতেরবেলা মাথা গরম করো না। কি করেছো ওকে?
- আদর করে চুমু খেয়েছি। কোলে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি, ঠিক করেছিনা বলো?
পূর্ব যত হাস্যকর ভাবে কথাটা উচ্চারণ করছে ঠিক ততটাই ভয়ানক কিছু ঘটিয়ে এসেছে ওখানে। কি কান্ড করেছে সেটা আজ নয়তো কাল এমনেই জানা যাবে কিন্তু সাংঘাতিক কিছু যে করে এসেছে এটুকু আঁচ করে প্রচুর চিন্তান্বিত পূর্ণতা। খুব কষ্ট করে চোখের পাতা বুজে ঘুমাতে চেষ্টা করলো ও। ঠিক কখন যে তন্দ্রাঘোরে ডুবে যায় খেয়াল থাকেনা পূর্ণতার।
.
বাড়ির ফটক পেরিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঠিক ড্রয়িংরুমেই শ্বাশুড়ি ও দুই চাচীকে জড়ো দেখে পূর্ণতা। সবার মুখ থমথমে বিষন্ন ও করুণ চেহারা। পূর্ব চুলের ব্যাকব্রাশ করতে করতে সিড়ি ধরে উপরে চলে যায়। এদিকে পূর্ণতার আগমনে আয়েশা কিছুটা অভিমান গলিয়ে পূর্ণতাকে খাবার টেবিলের দিকে নিয়ে যায়। পূর্ণতা একটা ব্যাপার লক্ষ করে পূর্বের বড় চাচী খুব চটে আছেন, রাগে উনার চোখদুটো দপদপ করে উঠছে। তার পাশে বসা ছোট চাচী চোখ এমনভাবে রাঙিয়ে আছেন যেনো একপলকের জন্যও চোখের পাতা ফেলেনা। পূর্ণতা আশেপাশে কোথাও ফুয়াদ, জাওয়াদ ও সায়মাকে দেখতে পেলো না। আয়েশা পাউরুটিতে ওরেন্জ জেলি মাখিয়ে পূর্ণতাকে খেতে দিয়ে বলে,
- কাল রাতে কিছু খেয়ে ঘুমিয়েছো?
পূর্ণতা আয়েশার দিকে তাকিয়ে মিইয়ে যায়। রাতে ও কিছুই খেয়ে ঘুমায়নি এমনকি সকাল সাতটা না বাজতেই পূর্ব এমন জোর খাটালো যে পূর্ণতার মা খোদেজা রাগে পূর্বকে কটু কথা শোনালেন। এমনেই সে পূর্বকে দেখতে পারেনা তার উপর নাস্তা না খাইয়ে পূর্ণতাকে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলতেই ভীষন রেগেমেগে কথা শোনায় পূর্বকে। পুরো রাস্তায় পূর্ব টু শব্দ না করলেও খোদেজার আচরণ বেশ রূঢ়-ই ছিলো, অন্যকেউ হলে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করার কথা বলতো পূর্ব সেটা করেনি। পূর্ণতা নাস্তা খেয়ে পূর্বের জন্য রুমে ট্রে নিয়ে গেলে পূর্বিকাকে পূর্বের পাশে বসে থাকতে দেখে। পূর্ব সোফায় বসে নিচের দিকে ঝুকে দুহাতে মাথা টেনে ধরে আছে আর পূর্বিকা অনবরত ওকে শান্ত হতে বলছে।
কালরাতে পূর্ব যখন রুমের দরজা খুলে দেখে পূর্ণতা নেই, বুকটা খা খা করে উঠে ওর। তীব্র অপরাধবোধে দরজা চাপিয়ে আলমারি খুলতেই হঠাৎ অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পেয়ে স্থির হয়ে যায়। শব্দটা রুমের ভেতর হচ্ছে কিন্তু কোথা থেকে হচ্ছে সেটা বুঝতেই পূর্ব কয়েক মিনিট চারিদিকে চোখ ঘুরালো। আবিষ্কার করলো ওয়াশরুমের দরজায় কেউ ঠকঠক করে নক করছে। পূর্ব সর্তক হয়ে দরজায় পাশে এসে কান পেতে শুনতে পায় পুরুষালী গলা। অশ্রাব্য, অকথ্য বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করছে পূর্ণতার নাম ধরে। যার কথাগুলো ছিলো এমন,
- একবার দরজা খোল পূর্ণতা! আজ যদি তোকে বেডে না আনি! তোর ভাব যদি চুরমার নি করি দেখিস! কিরে মা* দরজা খোল!
নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনা পূর্ব! ছিটকিনি টেনে দরজা খুলতেই দেখে ফুয়াদ। ফুয়াদ ভেবেছিলো পূর্ণতা হবে তাই মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছিলো কিন্তু হরিণের জায়গায় বাঘকে দেখে ফুয়াদ তৎক্ষণাৎ ফ্লোরে লুটিয়ে হাতজোর করে মাফ চাইতে লাগলো। পূর্ব ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতায় নেই, না আছে নিজেকে সামলানোর মতো ক্ষমতা! এই মূহুর্তে দুনিয়া কাঁপিয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়ার পৈশাচিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে পূর্ব। কোমর থেকে চামড়ার মোটা বেল্টটা খুলে হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে ব্যায়ামের মতো ঘাড় একাত ওকাত করছে। ফুয়াদ তাই দেখে জীর্ণশীর্ণ ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি পূর্বের পা ধরে ক্ষমা চায়। ও জানে পূর্বের রাগ আর যাই হোক কোনো বীভৎস তান্ডবলীলার চেয়ে কম না! একফোঁটা দয়াও ওর কাছ থেকে পাওয়া বৃথা। ফুয়াদ নিরুপায় হয়ে কেদেঁ দেয়, ওর বাবা মাকে ব্যর্থ চেষ্টায় ডাকতে থাকে কিন্তু কেউ শুনতে পায়না। পূর্ব রুমে ঢুকতেই দরজার নবে লক চেপে ঢুকেছে, অতপর ফলাফল শূন্য! শত চিল্লিয়েও লাভ নেই! এরপর যে দৃশ্য শুরু হয় তা যে কেউ দেখলে ভয়ে, আর্তনাদে মুখের উপর হাত চেপে পালিয়ে যেতো। পূর্ব প্রতিটি গালির, প্রতিটি অকথ্য ভাষার, প্রতিটি কটুক্তির জন্য পাই পাই হিসাব চুকিয়ে ক্লান্ত দেহ নিয়ে পোশাক হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে। মাথার রগরগে দারুণ উত্তপ্ত অনুভব করছে পূর্ব। শাওয়ার ছেড়ে দেয়ালে একহাত রাখতেই হঠাৎ চাপা উত্তেজনা ঠেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে! শান্তি নেই! মনে আজ শান্তি নেই পূর্বের!
পূর্বের কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ড ক্ষেপে পলাশের উপর রাগ ঝেড়েছে পরশ। ছেলেকে এমনভাবে পিটিয়েছে এখন হাসপাতালের সিসিইউ-তে ভর্তি করতে হয়েছে ফুয়াদকে। ওর অবস্থা নাজুক। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে, ডাক্তার রক্ত বন্ধ করতে পারছেনা। নাক থেকে রক্ত আসছে বিধায় ওর শ্বাসকার্য চালানো কঠিন হয়ে পরেছে। ডাক্তার টেস্ট করার সময় পাচ্ছেন না, প্রচুর টেনশনে ফুয়াদকে হ্যান্ডেল করছে। ফুয়াদের মা একটু পর পর সেন্সলেস হয়ে আজেবাজে বকছে, কাউকে চিনতে পারছেনা। মিথুন রুমালে মুখ ঢেকে কাঁদছে। সায়মা হঠাৎ হঠাৎ পাগলের মতো চেঁচামেচি করে উঠছে। মোটকথা বাড়ির অবস্থা এতো নাজেহাল হয়তো আগে কখনো হয়নি। আয়েশা ছেলের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শোনার পর কাউকে দোষারোপ করতে পারছেন না। ওদিকে ফুয়াদের দোষ থাকলেও পূর্ণতা কেনো কথাটা সবাইকে জানালো না এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছে সবাই। পলক চুপ থাকলেও মাঝেমাঝে যেটুকু কথা বলে সবটাই পূর্ণতার বিপক্ষে এবং পূর্বের দোষের কথা এহলান করে।
পূর্বিকা পূর্ণতাকে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে আসতে বলে। পূর্ণতা গুটিগুটি পায়ে চুপচাপ ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ব ভ্রুক্ষেপ না করে মাথা নিচু করেই থাকে। পূর্বিকা শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
- কাল আমাকে ডাকলে এখন এমন পরিস্থিতি হতো না পূর্ণতা। হাসপাতালে ফুয়াদের অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে। এখনো ব্যাগে ব্যাগে ব্লাড সাপ্লাই দিতে হচ্ছে।
বলতে বলতেই ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ফুস করে নিশ্বাস ছাড়ে পূর্বিকা। পূর্বের পাশ উঠে পূর্ণতার কাধে হতাশ ভঙ্গিতে হাত রেখে চলে যায় রুম থেকে। পূর্ণতা পূর্বের পাশে সোফায় বসলো। পূর্বের পিঠে নির্লিপ্তে হাত রাখতেই পূর্ণতা বলে উঠলো ,
- আমি কি ভুল করেছি বলো? চাচী আমার সাথে এমন করছে কেনো?
পূর্ব চোখ বন্ধ করে মাথার চুল টেনে ধরে। পূর্ণতা বিকেলে কল করেছিলো কিন্তু পূর্ব একটা জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিলো বলে ধরতে পারেনি। পূর্ণতার সেই অসহায় সময়টাতে যদি ফুয়াদ সত্যিই ক্ষতি করে বসতো তখন? তখন পরিবার ফুয়াদকে কিসের শাস্তি দিতো? আইনের শাস্তি? যেখানে মার্ডার কেসেরই শাস্তি হয়না আর সেখানে রেপের কেসে সাজা হবে তা তো কল্পনার কথা। পূর্ব মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। পূর্ণতার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই ঝাঁপিয়ে পরলো ওর উপর। পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে গালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে পূর্ব বলে উঠলো,
- তুমি যেখানে ভুল করোনি সেখানে তোমাকে দোষারোপ করার মানে হয়না। ওই কুত্তার বাচ্চাকে বাঁচার জন্য ওভাবে মারিনি! মরার জন্যই পিটিয়েছি! ও বাঁচুক তা আমি চাইবো না!
পূর্ণতা জোরে নিশ্বাস ছেড়ে চোখের পাতা বুজে ফেললো। সামনে খুব বড় ঝড় আসতে চলেছে। হয়তো এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই পূর্বের আপন মানুষগুলো ওর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে। পূর্ণতা আজ নিরুপায়, নিরুদ্দিষ্ট, নিরুত্তেজ! ঠিক কি কি সহ্য করতে হবে ওর...জানা নেই।
সকালটা না হতেই তুলকালাম ঘটনা বাধিয়ে ফেললো পরশ ওয়াসিফ। বড় ভাইয়ের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা উঠলো। পূর্ব তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করছিলো নিচ থেকে চাচা ও বাবার গলা শুনে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো। পূর্ণতা অনেক আগেই নাস্তার টেবিলে সবার জন্য সকালের নাস্তা সাজাচ্ছিলো ড্রয়িংরুম থেকে চিল্লাচিল্লি শুনে সে-ও কাজ ফেলে সেখানে দৌড়ে গেলো। পূর্ব ততক্ষণে চাচাকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলো চাচা উল্টো ওর দিকে তর্জনী উঁচিয়ে উঁচু গলায় বললো,
- তুমি কথা বলতে আসবেনা পূর্ব! যেই ছেলে বিয়ের পরপরই বউয়ের কথায় উঠবস করে তাকে আমি দুচোক্ষে সহ্য করতে পারিনা!
- সেক্ষেত্রে তো দাদার উচিত ছিলো তোমাকে বিয়ের পরদিনই বের করে দেওয়া। দিয়েছে?
- খবরদার পূর্ব! এতো স্পর্ধা দেখাবেনা ! তোমার বউ কতখানি খাটি সেটা আগ বারিয়ে বিচার করা উচিত ছিলো!
- ওহ্! আমার বউ খাটি না বাসি তা আমি জানিনা? না জেনেই রেন্ডম মেয়েকে বিয়ে করেছি বলে ভাবো?
- অবশ্যই! নাহলে যেই ছেলেকে বিয়ের জন্য হাজার হাজার ছবি দেখানো হলো, শেষে কিনা ঘোষনাও দিলো সে জীবনেও বিয়ের মতো পাপ কাজ করবেনা হঠাৎ এতো উতলা হলো কি করে?
- সেটা তো তোমার দেখার বিষয় না চাচ্চু। আমি বিয়ে করেছি সেটা কমপ্লিটলি আমার ডিসিশান! এখানে ইনিয়ে বিনিয়ে তোমার জাওড়া ছেলের জন্য আমার বউকে তো দোষারোপ করতে পারো না।
- আমার ছেলেকে নিয়ে একটাও বিশ্রী কথা বলবেনা তুমি!
- কেনো? গায়ে লাগছে? তাহলে আমার বউকে যখন প্রস্টিটিউটের মতো গালিগালাজ করছিলো আমার তখন কেমন লাগছিলো সেটা একটু বুঝো!
- বারবার 'আমার আমার' করা বন্ধ করো। দুদিনের মেয়ে এসে কেমন রঙ খাইয়ে দিয়েছে তা তো চোখে দেখতেই পাচ্ছি! আমিতো আর কানা না!
- আমিও অন্ধ নই চাচ্চু! তোমার বেশশরম ছেলে 'বন্ধু' বলে কোন মেয়েদের বাড়িতে আনতো সে সম্পর্কেও আমার কাছে লম্বা ইনফরমেশন আছে! আমাকে তুমি জ্ঞান দিতে এসো না।
ভাই ও ছেলের অহেতুক ঝগড়ার রেশে পলাশ ওয়াসিফ চিন্তান্বিত হয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরে। পূর্বিকা বাবার পাশে দৌড়ে এসে দেখে পলাশ গোসলের মতো ঘামছে, ঘাড় ঘুরাচ্ছে। পূর্বিকা চটজলদি পালস রেট চেক করতে যেয়ে অসাড়শূন্য মুখে পূর্বের দিকে তাকিয়ে বলে,
- ভাই? আব্বুর পালস রেট হাই হচ্ছে। কিছু কর!
পূর্ব চলমান তর্কযুদ্ধটা হঠাৎ থামিয়ে পূর্বিকার করুন চাহনি ও বাবার অসুস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে যায়। পলাশ চোখ বন্ধ করে হাপানির মতো নিশ্বাস টানছে। পূর্ব গালে আলতো ধাক্কা মেরে বলতে থাকে,
- আব্বু? আব্বু চোখ খুলো? খুব খারাপ লাগছে? হসপিটালে নিবো?
পলাশ ওভাবেই নিশব্দে মাথা ডানেবামে নেড়ে বুকের বাঁ পাশে ঘুষাতে থাকে।। লক্ষন শুভ নয়! পূর্ব একহাত কাধে তুলে তাড়াতাড়ি বাবাকে রুমের দিকে নিয়ে যায়। বাড়ির যত চাকর ছিলো সবাইকে মাথায় তুলে পূর্ব প্রচণ্ড অপ্রকৃতিস্থ হয়ে বাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। ডাক্তারকে বাসায় ডেকে চেকআপ করাতেই জানতে পারে ০.৯ মাত্রায় হার্ট এ্যাটাক করেছে পলাশ ওয়াসিফ। পূর্ব এতোটা বিহ্বল হয়ে ভেঙ্গে পরেনি যতোটা বাবার অসুস্থতার এমন খারাপ খবর শুনে সে হয়েছে। পূর্ণতা বোবার মতো চুপচাপ হয়ে যায়। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সবকিছু অরুচির তালিকায় চলে যেতে থাকে। একদিকে ফুয়াদের ক্রিটিক্যাল অবস্থার জন্য হাসপাতালে সবাই কাঁদছে অন্যদিকে পলাশ ওয়াসিফের ছোট্ট মাত্রায় হার্ট এ্যাটাকের খবর পরিবেশটা আরো গুমোট করে দিয়েছে। দেখতে দেখতে ক্যালেন্ডারে দুটো দিন কাটা পরে যায়। কিন্তু সকাল হয়ে রাত হলেও পরিস্থিতি আগের মতোই শ্বাসরুদ্ধকর থাকে। আয়েশা হাইপ্রেশারের পেশেন্ট সেই সাথে শরীরে কিডনি জনিত সমস্যার জন্য বহুদিন যাবৎ অসুস্থ। পূর্ণতা শ্বাশুড়ির প্রতি মনোযোগী হলে অপরদিকে পূর্ব বাবার দিকে মগ্ন থাকে। কিছু সম্পর্ক ধীরে ধীরে খোলস ছাড়িয়ে আসল রূপ দেখিয়ে দেয়। পরশ ওয়াসিফের প্ররোচনায় পলক ওয়াসিফও পূর্বকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর যুদ্ধে নেমে পরে। পূর্ব যতদিন এ বাড়িতে থাকবে সম্পত্তি বিষয়ক কাজে কন্টক হয়ে বাধা দিবে।।
ফুয়াদের অবস্থা আগের থেকে উন্নতিলাভ করে। ডাক্তার ওকে সিসিইউ থেকে আইসিইউতে শিফট করে। তবুও নাকে নল ঢুকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর সিস্টেমে উন্নতিলাভ হয়নি ওর। কোমার মধ্যেই চিকিৎসা চলছে ফুয়াদের। বাড়ির প্রকৃতি নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরীর মতো লাগে পূর্ণতার। সকালে বিকালে দফায় দফায় খোটা খায় পূর্ণতা। বড় চাচী একদফা বলে গেলে ছোট চাচী এসে সেটা রসালো করে আরেকদফা খোচা মেরে যায়। এদিকে পূর্বের উপর পারিবারিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক চাপগুলো একসঙ্গে ধেয়ে আসে। পলাশ ওয়াসিফের অসুস্থতার খবর পেয়ে অনেক ইনভেষ্টমেন্টরা তাদের মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, পূর্বের শূন্যতায় দলের মধ্যে নানা দন্ড-বিরোধ হচ্ছে, পূর্ণতাকে নিয়ে কথা বলতে সুযোগ ছাড়েনা কেউই। পূর্ব বিধ্বস্ত হয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে আরো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলো দিন দিন। সব সম্পর্কের জন্য অবনতির জন্য পূর্ণতার সাথেও স্বাভাবিক সম্পর্কটা ঠিকঠাক ভাবে চালাতে পারছেনা পূর্ব। পূর্ণতাকে দেখলে এখন মনেহয় মূল দোষটা ওরই! যদি পাকনামো না করে সে ফুয়াদের ঘটনাটা আগেই কাউকে বলে দিতো তাহলে এ পর্যায়ে ঘটনাটা এগুতো না। পলাশের হার্ট এ্যাটাকেও পূর্বের ব্রেন কোনো না কোনো ভাবে পূর্ণতাকে দায়ী করে। আবার এক মূহুর্তের জন্য ভাবে এতে পূর্ণতার দোষ নেই। দোষটা ওর নিজের। ফুয়াদকে ওভাবে না মারলে ঠিক হতো কিন্তু পূর্ণতার বিরুদ্ধে একটা অক্ষর শুনলে ওর আত্মা যেভাবে পৈশাচিক রূপ ধারন করে এতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই পূর্বের। ফুয়াদের সাথে যা হয়েছে তা একদম যোগ্য কাজ হয়েছে! ওর মরে যাওয়া উচিত। পূর্ব সামনের পথটা খুব ঘোলাটে, ধোয়াশা, ধুম্রাবস্থা দেখছে। পূর্ণতার জন্য সবার সাথে সম্পর্কটা যেভাবে নিচুস্তরে তলিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ করে 'বিচ্ছেদ' শব্দটা 'উড়ে এসে জুড়ে' বসে কিনা কে জানে?
.
.
.
চলবে.......................................