পূর্ব ঠোঁট টিপে আলতো হেসে প্রশ্নের আশায় ভ্রু নাচালে পূর্ণতা লজ্জায় অন্যদিকে তাকায়। এই মূহুর্তে কিচ্ছু বলতে চাচ্ছেনা পূর্ণতা। পূর্বের হাসি দেখলে নির্ঘাত ঘন ঘন ফিট খেতে হবে। যখন পাশে থাকবে না তখন কেমন কষ্ট হবে এই হাসির কল্পনা করলে?
- আশ্চর্য তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেন? নিজেই তো বললে আমি তোমার রোগ বাধিয়ে ফেলেছি। কি রোগ বাধালাম তাই তো বললে না। বলো? কি হলো? তুমি প্রেগনেন্ট?
পূর্ণতা ভ্রু কুচকে ঠোঁট উল্টে রাগত ভঙ্গিতে বলে উঠে,
- তুমি আমার কাছে পনের মিনিটের বেশি থেকেছো? আউল ফাউল কথা না বললে চলে না?
পূর্ব তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসিতে পূর্ণতার হাত টেনে বুকে রেখে বলে উঠে,
- তুমি কি চাচ্ছো আমি পনের মিনিটের বেশি থাকি?
পূর্ব এখন কোন ইঙ্গিতে কথাটা বোঝাচ্ছে তা বুঝতে পেরেছে পূর্ণতা। কপালে জোরালো রেখায় ভাজ ফেলে ভ্রু দুটো তীব্র কুচকে টান দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো পূর্বের বুক থেকে। কোল থেকে পূর্বের মাথা নামিয়ে বালিশে শুয়িয়ে বিছানা থেকে নামতেই পূর্ব কৌতুহল কন্ঠে বলে উঠলো,
- কোথায় যাচ্ছো? আমি কিচ্ছু খাবো না। ফজরের আযানটা দিলেই চলে যাবো।
- কতদিন ধরে না খাওয়া? পিটিয়ে কি করেছে তোমার শরীর। আয়নায় একবার দেখবে?
- আমি এসবে অভ্যস্ত পূর্ণ। তুমি প্লিজ ঝামেলা করো না আমার পাশে কিছুক্ষণ বসো।
- পাশে বসলে কি হবে? শরীর কি আগের মতো সুস্থ হবে? আমি কি মেডিসিন?
- মোটেও না। তুমি মেডিসিন কেন হবে আজব? পাশে থাকতে বলেছি চুপ করে পাশে বসো। আমার রাগ তুলো না।
শেষের কথাটা রাগী স্বরের মতো দৃঢ় কন্ঠে বললো পূর্ব। পূর্ণতা শুকনো গলায় ঢোক গিলে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আবার পা উঠিয়ে পূর্বের কাছে বসলো। পূর্বের কথার খেলাফ পূর্ণতা কখনোই করতে পারেনা বা করতে চায়না। পূর্ব চোখ বন্ধ করে আছে এখন। একটু আগে হাসির ঝিলিকে মেতে উঠা স্নিগ্ধ মায়াময় মুখটা আচানক রাগের আক্রোশে গম্ভীর রূপ ধারন করেছে। পূর্ণতা চুপচাপ শান্তিশিষ্ট ভঙ্গিতে পূর্বের মাথায় হাত বুলিয়ে নিস্তব্ধ রুমের খোলা জানালার বাইরে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। বাতাসের সাথে ঝুম বৃষ্টি মিলেমিশে প্রকৃতিতে কি কঠিন তান্ডব করছে। কি ভয়ংকর লাগছে! মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী বিধ্বস্ত করার চেষ্টায় ক্ষেপণাস্ত্রের মতো মহড়া ছুড়ছে এই ঝড়োবৃষ্টি। বৃষ্টির দিনে অজানা কারনে মন উদাস হয়ে যায়। ভীষন একা লাগে। কাউকে কিচ্ছু বলা যায় না কেন একা লাগছে। পূর্ণতা শুধু ভাবছে যদি এই মানুষটার কিছু হতো তাহলে কি হতো পূর্ণতার? মরে যেতো? মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ধুকে ধুকে বাচঁতো? ঠিক কি হয়েছে পূর্ণতার? কেন এই পূর্ব নামক মানুষটার জন্যে মন কাঁদে? এই মানুষটা কেমন অসুখের মতো পূর্ণতার ঘুম, শান্তি, সুখ সব কেড়ে নিয়েছে! প্যানড্রাইভে ভাইরাস ঢুকলে পুরো কম্পিউটার যেমন অচল হয়ে যায় তেমনি প্রিয় মানুষটা মনের ভেতর একবার ঢুকলে সচল মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
- আমার দিকে একটু ঝুকো তো পূর্ণ, কাজ আছে।
পূর্ণতার চিন্তার চাদঁরে ছিদ্র করে আদেশসূচকে বলে উঠলো পূর্ব। পূর্ণতা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে পূর্বের দিকে ঝুঁকতেই হঠাৎ মাথায় একগুচ্ছ চুল খাবলে পূর্ণতার নাকে কামড় দিলে ব্যথায় শিউরে উঠে নিচু গলায় বলে উঠলো পূর্ণ, 'আমি ব্যথা পাচ্ছি!! ছাড়ো!!' চুলের মুঠো আলগা করে করে ছেড়ে দিলে পূর্ণতা হাতে নাক ডলে চোখ কুচকায়। চোখে পানি এসে গেছে ওর। মনে হচ্ছে নাকের নিচটা নেই ছিড়ে আলাদা হয়ে গেছে! ভীষণ ব্যাথা করছে!পূর্ব ভাবলেশহীন গলায় গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে উঠে,
- এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যথা তুমি দিয়েছো। আমি তো চেঁচানোর সুযোগটা পযর্ন্ত পাইনি ঠোঁট কেটে দিয়েছো। যাইহোক, তোমার ফোন কোথায়?
পূর্ণতা এখনো ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে আছে। পূর্বের কথায় কোনো হেলদোল নেই ওর। পূর্ব বালিশের কাছে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে ফোন বের করে কাকে যেনো কল করে। পূর্ণতা মাথা নুয়িয়ে কামিজের শেষপ্রান্তটা দিয়ে চোখের কার্নিশ মুছে ফেলে। পূর্ব কি তাহলে শোধবোধ করলো? অসভ্য লোক! নাকে কেউ কামড় দেয়? কি করে কাল সকালে হলুদের আয়োজনে বসবে? কি উত্তর দিবে ও?
- হ্যালো আপি? এই শোন, এই। কি আশ্চর্য ঢঙ দেখাচ্ছিস কেন? থাপড়ানো উচিত তোকে! ছোট ভাইয়ের সাথে ফাজলামো করিস? ফোন কাটবি না! গাড়ি পাঠা আমি পূর্ণতার বাড়িতে। আবার প্রশ্ন করছিস! তোর প্রশ্নের...তুই কি এখন গাড়ি পাঠাবি নাকি বকবক করতেই থাকবি? বললাম না বাড়ি এসে বলছি এতো অধৈর্য হচ্ছিস কেন? আচ্ছা ওয়েট করছি।
পূর্ব কলটা কেটে দিতেই পূর্ণতা প্রচণ্ড উদ্বিগ্নে বলে উঠে,
- তুমি চলে যাচ্ছো? কেন যাচ্ছো? থাকো না।
পূর্ব ফোনটা বালিশের তলায় রেখে দুর্হতে ভর দিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই বলে উঠলো,
- আমি ঘুমাবো।
- ঘুমাও। এখানে ঘুমালে সমস্যা কি?
পূর্ব এমন করে তাকালো যেন পূর্ণতা একটা বিশ্ব গাধা। পরক্ষনে চোখ সরিয়ে ফ্লোরে পা ফেলে এদিক ওদিক চোখ বুলাতেই পান্জাবীর অস্তিত্ব আলনায় দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। গায়ে পান্জাবী জড়াতেই বলে উঠলো,
- তোমার সাথে থাকলে আমি পাগল হয়ে পাবনার আসামীতে রেকর্ড করবো বুঝছো?
- কেন? পূর্ণতার ভ্রু কুন্ঞ্চিত প্রশ্ন।
- তুমি যে আমার বউ সেটা তোমার মা নিশ্চয়ই জানেনা? এখন যদি ভুল করে তোমার রুমে আমাকে দেখে চড়টা কে খাবে? তুমি! আসো বিদায় দাও। কি হলো বসে আছো কেন?
পূর্ণতা বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের মতিগতি দেখতে লাগল। বাইরের আবহাওয়া ভালো না এখন কি চলে যাওয়াটা ঠিক হবে? পূর্ব এককথার মানুষ। যা বলবে করেই ছাড়বে কারোর কথা কানে নিবেনা। মৃদ্যু শ্বাস ছেড়ে পেছনে ঘুরতেই পূর্ণতা দেখে পূর্ব পান্জাবীর পকেটে হাত গুজে আকাশে চোখ রেখে দাড়িয়ে আছে। পূর্ণতা মাথা নিচু করে ফ্লোরে তাকিয়ে রইলো। মনেমনে বলছে, পূর্ব? এই বৈরি আবহাওয়ায় তোমার যাওয়া লাগবে? মা চড় মেরে আমার গাল শেষ করে দিক সমস্যা নেইতো। তুমি রিস্ক নিয়ে যেও না। কিচ্ছু বলতে পারলো না ফ্লোরের ঠান্ডা পাঠাতনে শব্দযোগে নিশ্বাস ছাড়লো পূর্ণতা। হঠাৎ পূর্ব কয়েক পা এগিয়ে পূর্ণতার নিচু করে রাখা মাথাটার পেছনে চাপ দিয়ে বুকে ঠেকালো। পূর্ণতা জড়িয়ে ওকে ধরলো না। পূর্বের অন্যহাত পকেটে গুজা। ওর মাথায় থুতনি বসিয়ে আকাশ ফেটে শব্দহীন বজ্রপাতের ভয় দেখানো খেলা দেখতেই বলে উঠলো,
- থাকো তাহলে। কাল এসে নিয়ে যাচ্ছি।
পূর্ণতা ঠোঁট ভেদ করে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
- মিটিংয়ের দিন কি হয়েছিলো?
পূর্ব চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার মাথায় চুমু দিয়ে বলে উঠলো,
- কিচ্ছু হয়নি।
মাথা থেকে হাত সরিয়ে পূর্ণতাকে ছেড়ে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পরলো। পূর্ণতা দরজা আটকানোর মনোবল পেলো না ফ্লোরে বসে টিনের দেয়ালে মাথা ডানে হেলিয়ে দিলো। বৃষ্টির ছাটঁ ঘরে ঢুকছে পূর্ণতাকে তিলতিল করে ভিজিয়ে দিচ্ছে মেঘের গর্জনে আকাশ চিড়ে প্রকৃতি ফর্সা হয়ে আবার আধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। পূর্ণতা বৃষ্টির পানি ছোঁয়ার জন্য বাইরে হাত এগিয়ে দিলে পাচঁ আঙ্গুলের মুঠোবন্দিতে বৃষ্টির পানি জমা হয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে লম্বা হয়ে পানি পরছিলো। ঠান্ডা হিম শীতল পানি স্পর্শ করে মনে মনে বলে উঠলো, 'তার জীবনের দুঃখগুলো আমার হয়ে উঠুক। আমার জীবনের শান্তিগুলো তার হাসিতে ফুটুক।'
.
সকাল সাতটা হলেও বাড়ির মধ্যে বেলা বারোটার মতো হরদমে কাজ চলছে। পূর্ণতার বাবা লুঙ্গি উঠিয়ে হাটুতে বেধে কর্মচারীর মতো বাবূর্চির পাশে হাত লাগাচ্ছে। পূর্ণতার মা খোদেজা, মামী, আয়মানে মা মাচা ঘর থেকে মসলার ব্যাগ এনে পূর্ণতার বাবাকে দিচ্ছে। পূর্ণতার খালারা, শ্রেয়ার মা মিলে কোমর বেকিয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে উঠোন। ওয়াকিল, আয়মানরা দেখছে টেবিল চেয়ারের ডেকোরেশন। এতোসব আয়োজনের মধ্যে এলাকার বেশি কাউকে দাওয়াত দেয়নি ওরা। খুবই ঘরোয়াভাবে অতি অল্প মানুষের উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হবে। যতো কম মানুষ তত ভালো কিন্তু কেন পূর্ব এই প্রস্তাব জারি করলো কেউ জানেনা এখনো। শহরে হলুদ লাগানো হয় বিয়ের একদিন পূর্বে সন্ধ্যার দিকে কিন্তু গ্রামের লোকজ ঐতিহ্য হিসেবে হলুদ ছোঁয়ানো হয় বিয়ের দিন সকালে। হলুদের জন্য ঠিক দশটার সময় ধার্য করেছে মহিলারা। পূর্ণতার জন্য হলুদ বাটাঁয় বসেছে ওর ফুপিরা। পিড়িতে বসে মাটির উপর চটের বস্তা বিছিয়ে তার উপর পাটা রেখে হাত দিয়ে হলুদ পিষছে। আনিশা, তানিয়া, শ্রেয়া পূর্ণতার রুমে সাজগোজের সরন্জামাদি আয়নার কাছে সাজাচ্ছে। বিছানার উপর গহনা, শাড়ি রেখে নিজেদের পোশাক নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
- পূর্ণতা তুই কিন্তু এখনো বললি না তোর নাকে ওটা কিসের দাগ! সত্যটা বলতো কিসের দাগ?
পূর্ণতা ঢোক গিলে বলে উঠলো,
- আনিশা আপু এক কথা কতবার বলবো? খাট থেকে পরে গিয়েছি।
- উহু, মিথ্যা!খাট থেকে পরলে নাক ফেটে যেতো তোর তো নাক ফাটেনি। উল্টো দাগ বসেছে।
শ্রেয়া চুড়ির বাক্স থেকে চুড়ি বের করতেই পূর্ণতার বিব্রত চেহারাটা দেখলো। এরপর আনিশার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
- আচ্ছা খাট থেকে পরলে নাক ফাটে এমন তথ্য কোথায় দেওয়া আছে আপু? তুমি কি কখনো একজেম্প্যাল পেয়েছো?
- শ্রেয়া মাঝখানে কথা বলো না। আমি পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করছি সে বলুক।
- আমিও তো সেটাই বলছি। ও তো বলেই দিয়েছে খাট থেকে পরে ব্যাথা পেয়েছে তুমি এতো ব্যাপারটা টানছো কেন? আজ ওর বিয়ে প্লিজ ওকে ওর মতো ছাড়ো।
- তোমার সমস্যা কি শ্রেয়া? ওর পক্ষে কথা বলার জন্য এক্সট্রা ট্যাক্স পাও?
- আশ্চর্য! আমার বান্ধুবীর ব্যাপারে কথা বললে ট্যাক্স লাগবে এইসব আজগুবি পেচাল কোথায় পাও?
- তো? বিয়ের টপিক যে লাস্টে ঢুকালে সেটা কি দরকার ছিলো? বিয়ে কি আমি করিনি? আমি কি বিবাহিত না?
- আপু পূর্ণতার ব্যাপার নিয়ে নিজের সাথে তুলনা করবেনা। তোমার বিয়েটা কিভাবে হয়েছিলো সবাই জানে তাই দয়াকরে আজকের দিনে কিছু বলো না যাতে ও কষ্ট পাক।
- তুমি বেশি কথা বলছো শ্রেয়া!
- বয়সে ছোট বলে কিছু বলিনা তার মানে এটা না পূর্ণতাকে ইচ্ছা মতো শোনাবে। সকাল থেকেই দেখছি তুমি ওর পিছনে লেগে আছো! কি চাচ্ছো তুমি?
পূর্ণতা ওদের দুজনের তর্কাতর্কি দেখে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। আনিশা সকাল থেকেই পূর্ণতার পেছনে পরে আছে, পূর্বের কথা উঠিয়ে একটু পরপর খোচা মারছে। শ্রেয়া শেষবাক্যটা খুব জোর দিয়ে বললো আনিশাকে,
- অন্যের স্বামীর দিকে নজর দিয়ে নিজের বিয়েটার ক্ষতি করো না। পূর্ণতা? চল দশটা বাজে হলুদ লাগাতে হবে।
আনিশা খাম্বার মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। কত বড় স্পর্ধা শ্রেয়ার! রাগে শরীরের রক্ত ফুটলেও চেয়ার ধরে দাড়িয়ে থাকে ও। এদিকে শ্রেয়া পূর্ণতার হাত ধরে রুমের বাইরে চলে যায়। পূর্ণতার মাথায় হলুদ শাড়ির ঘোমটা টেনে দিয়ে বলে উঠে,
- হেতির জ্বলে বুঝিস না? মন টন খারাপ করিস না।
- আপু কি বুঝেছে পূর্ব যে কাল রাতে এসেছিলো?
- যাহ্ কি বলিস। আমি একটা ইদুরও তোর রুমের কাছে আসতে দেরি হেতি কিভাবে ঢুকবে?
পূর্ণতাকে উঠোনের এককোণায় বসিয়েছে শ্রেয়া। সবাই হলুদ শাড়ি পরলেও শ্রেয়ার শাড়িতে এলার্জী মানে এই বস্তুটা ওর সহ্য না তাই পরেনি। মাটিতে বিশাল পাটি বিছিয়ে পূর্ণতাকে একটা কাঠের পিড়িতে বসানো হয়েছে। মামী, খালা, ফুপিরা সবাই গোল করে বসেছে। পূর্ণতার পাশেই বসেছে হলুদ স্কার্টে বসেছে শ্রেয়া। আনিশা নানা পসরা সাজাতে সাহায্য করছে। খোদেজা বলে উঠলো,
- সুহাশ কোথায় গেলো? সুহাশ, এই সুহাশ?
সুহাশ এক ডাকেই কোত্থেকে হুড়মুড় করে উপস্থিত হলো হাপাতে হাপাতে বললো,
- খালা ডেকেছো?
- হলুদ নিয়ে ও বাড়ি থেকে কেউ এসেছে?
হঠাৎ কিছুটা দূর থেকে আয়মান চেচিয়ে বলে,
- আন্টি আন্টি!! পূর্বিকা আপু এসেছে। হলুদের বাটি নিয়ে যান। নানা ডাকে আপনাকে।
খোদেজা বসা থেকে উঠে দাড়াবে হঠাৎ আনিশা তৎপর কন্ঠে বলে উঠে,
- খালা আমি যাই? আমি নিয়ে আসি হলুদের বাটি?
- তুই যাবি? পারবি? আচ্ছা যা নিয়ে আয়।
শ্রেয়ার মনে সুক্ষ্ম ভয় জন্মালো আনিশা কি হলুদের বাটি ফালাবে নাকি? মন তো তাই বলছে। পূর্ণতা শ্রেয়ার তীক্ষ্মদৃষ্টিতে অবলোকন দেখে ওর হাত চেনে বললো,
- কি দেখছিস ওখানে?
- পূর্ণতা তুই বস তো। আমি আসছি।
- প্লিজ যাস না। আমার নার্ভাস ফিল হচ্ছে সঙ্গে থাক।
শ্রেয়া পূর্ণতার দিকে মুখ তুলে আর উঠার চিন্তা করলো না। একপলক চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার হাতে হাত রেখে ইঙ্গিতে আশ্বাস দিলো 'আমি আছি, টেনশন করিস না'। একটু পর পূর্বিকা হাসি মুখে পূর্ণতাকে একবার দেখতে এলো। পূর্বিকাকে দেখে মামী বলে উঠলো,
- নুহাশ? বাবা নুহাশ একটা চেয়ার এনে দে।
- না আন্টি আমি চলে যাবো। ওখানে কাজ আছে প্রচুর। যাওয়ার আগে পূর্ণতাকে একটু দেখতে এলাম।
পূর্বিকা ভিড় ভিঙিয়ে কাছে আসলে একটু নুয়ে পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে। পূর্ণতার কানে ফিসফিস করে বলে উঠে,
- তোমার বর তো উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে বুঝলে। আমি মুখে এক মগ পানিও ঢেলেছি উঠেনি। কান টেনে যেই বলেছি তোমাকে দেখতে আসছি ওমনেই চটান করে উঠে কি বলে জানো? বলে কি, তোমাকে এক্ষুনি এনে এনে দিতে। এই শোনো, খবরদার আজকে ওকে শান্তি দিবেনা। তুমি আজ আমার সাথে ঘুমাবে ওকে আমার পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ বলে এসেছি।
পূর্বিকার কথা শুনে লজ্জা করলেও প্রচুর হাসি পাচ্ছে পূর্ণতার। পূর্বিকা ওকে ছেড়ে দিয়ে থুতনি তুলে দেখে পুরো মুখে হাসির আভাস ফুটেছে বলে কি চমৎকার লাগছে! পূর্ণতার থুতনি ধরা আঙ্গুলগুলোতে ঠোঁট ছুয়িয়ে মিষ্টি ভঙ্গি প্রকাশ করে চলে যায় পূর্বিকা। পাশ থেকে শ্রেয়ার নিচু কন্ঠ,
- পূর্বিকা আপু কত মিষ্টি না পূর্ণতা? আমার না আপুকে সেই কিউট লাগে। কন্ঠটাও কি কিউট।
- হ্যাঁ ঠিক বলছিস।
.
- আপি? গিয়েছিস?
- শুয়ে আছিস শুয়ে থাক। এতো কথা কিসের?
পূর্ব ভোররাতে গোসল সেরে সেই যে শুয়েছে আর উঠেনি। এখনো বিছানায় উপুড় হয়ে পিঠে সাদা কাথা রেখে ঘুমে চোখ বন্ধ করে আছে। পূর্বিকা পূর্বের তছনছ করা অগোছালো রুম গোছাচ্ছে আর প্রলাপ বকছে, ঘুমা ব্যাটা ঘুমা! তোর বউ কিভাবে রাতে এই রুমে আসে আমিও দেখে ছাড়বো! মেয়েটাকে কষ্ট দিছিস না? তোকেও আমি কড়ায় দন্ডায় বোঝাবো। পূর্বিকা রুমের সব ধূলো ময়লা ঝাট দিয়ে আসবাবপত্র চকাচক পরিস্কার করে এখন শেরওয়ানি ইস্ত্রি করছে। পূর্বের রুমে ঢুকতেই সবার আগে চোখে পরবে বামদিকের বড় জানালা যেখান থেকে নীল আকাশের শুভ্র মেঘের ভেলা দেখা যায়। রুমের ঠিক মাঝখানে সাজানো বিছানা, বিছানার ডান পাশে আয়না, বামপাশে খালি। বারান্দা দিয়ে পুরো গ্রামের দৃশ্য দেখা যায়। পূর্ব গ্রামে এলে কখনো জোৎস্নারাত মিস করেনা! সোজা বারান্দায় গিয়ে বিছানা পেতে ঘুমায়। গ্রামের নির্মল সতেজ ধূলোহীন পরিস্কার বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। মাটির একটা মিষ্টি গন্ধের সাথে বিভিন্ন পোকার ডাকহাক শোনা যায় তখন। দূর থেকে ব্যঙ ডাকার আওয়াজও পাওয়া যায়। নিশিরাতের জোৎস্না আলোতে স্বচ্ছ গ্রামের সূদুর নদের কলকল কলোধ্বনি শোনা যায়। কি অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি! আহ্...রাতেরবেলা গ্রামের প্রকৃতি কি শান্তি না দেয়!!
.
- পূর্ব ভাই এখনো উঠেনাই দেখছোস? মিথুন জাওয়াদ পেদানি খাওয়ার পরও মরলো না কেন?
- ফুয়েল শালারপুত! আস্তে বল! পূর্ব ভাই শুনলে কঠিন মাইর দিবো!
- ধুর বা*! শালা ওইটা মরে না কেন? মরলে একটু শান্তি পাইতাম। এইটা আর এইটার বাপের জন্য নিস্তার নাই উফ!
মিথুন চাপা স্বরে বলে উঠে,
- তোরা আজকের জন্য খারাপ কিছু করিস না কিন্তু। আগে ভালোয় ভালোয় ভাবী আসুক।
মিথুন যে পূর্বকে অতিরিক্ত ভয় পায় এজন্য গা জ্বলে ফুয়াদের! ফুয়াদ সরাসরি একটা চড় মেরে ক্ষেপে গিয়ে বলে,
- আলভোলা হইয়া থাকলে পূর্ব ভাই তোকে নমস্কার করবো না। আজকে আমি নিজেই উনার খাটের স্ক্রু লুজ করতে যাবো।
ফুয়াদের চড় খেয়ে গালে হাত দিতে মিইয়ে যায় মিথুন। হঠাৎ জাওয়াদ কি যেন চিন্তা করে সাবধানী গলায় কাছে এসে বলে,
- মিথুন ঠিকই বলছে ব্যাটা! আজকে কিছু করিস না। পরে দোষ পরবো।
- কি বলিস? হাত চুলকাচ্ছে ওর শান্তি দেখে! আর কতো শান্তি পাইবো বল? এদিকে ওইদিন কুত্তার মতো যে মার মারলো ভাবলে মনে চায় আমি নিজে গিয়ে খুন করে আসি উফ!
ফুয়াদ কিছুক্ষণ সাপের মতো ফোস ফোস করে নিজের রাগ থামালো। পূর্ণতার জন্য ওদের যে পিটুনি খেতে হয়েছিলো এখনো সে কথা ভুলতে পারেনি। কে জানে সামনের পরিনাম কি হতে যাচ্ছে?
.
আয়নার সামনে ভেজা চুলে তোয়ালে ডলছে পূর্ণতা। রুমে এখন একা। বাকি সবাই গোসলের জন্য লাইনে লেগেছে। চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি ঝরছে ওর। হঠাৎ রুমের দরজা আটকানোর শব্দ এলে পূর্ণতা চুল মোছা বাদ দিয়ে পেছনে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যায়! চোখের কোটর মুখছেড়া ভূত দেখার মতো বিশাল হয়ে যায় ওর! হাত থেকে ভেজা তোয়ালেটা ফ্লোরে পরে যায়। পূর্ণতা ঢোক গিলতে থাকতে শুধু...
.
.
.
চলবে.................................