ক্যাম্পাসের সাইডের রাস্তা দিয়ে হেটে অনিমা, অরুমিতা, তীব্র আর স্নেহা। চারজনেই বাদাম খেতে খেতে হাটছে। অনিমা আর অরুমিতা ডানপাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। তীব্র আর স্নেহা অপর পাশ দিয়ে হাটছে। তীব্র আর স্নেহা একটা প্যাকেট থেকেই বাদাম খাচ্ছে। স্নেহা তীব্রর এক হাত জড়িয়ে ধরে আছে। আপাতত কেউ কিছু বলছেনা। আজ অনিমা কলেজে আসার পর থেকেই সবাই কীরকম অদ্ভুতভাবে দেখছে ওকে। আড়ালে ওকে নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। প্রফেসররাও অদ্ভুতভাবে ট্রিট করছে। যেন ও একটু স্পেশাল কেউ। অনেকে তো যেচে যেচে এসে ওর সাথে কথাও বলছে। বিশেষ করে আদ্রিয়ানের ফ্যানেদের মধ্যে অনেকে। আদ্রিয়ান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। এটা ওটা জানতে চাইছে। অনিমা মাঝেমাঝে বেশ বিরক্তও হচ্ছে এসবে। কিন্তু কিছু করার নেই। আপাতত এসবই সহ্য করতে হবে। হঠাৎ অরুমিতার দিকে চোখ পরতেই ও খেয়াল করল যে ও কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে আছে। সকাল থেকেই এরকম অন্যমনষ্ক দেখছে ওকে। তবুও অনিমা কিছু বলল না। গেইটের বাইরে যেতেই ওরা অবাক হল কারণ আশিস গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশিসকে দেখে ওরা সবাই দাঁড়িয়ে গেল। অরুমিতা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অাশিস মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে এসে বলল,
" কেমন আছো তোমরা সবাই?"
অনিমা হেসে বলল,
" ভালো। কিন্তু আপনি এখানে?"
" আদ্রিয়ান ড্রাইভার পাঠাচ্ছিল। ভাবলাম আমি ফ্রি আছি। তাই আজ ড্রাইভারের ডিউটি টা আমিই করে দেই। চলো!"
তীব্র আর স্নেহাকে বিদায় দিয়ে অনিমা আর অরুমিতা আশিসের গাড়িতে উঠে বসল। অনিমা এমনিই পেছনে বসেছে। তাই বাধ্য হয়েই অরুমিতাকে ফ্রন্ট সিটে বসতে হয়েছে। ও আসতেই চায়নি কিন্তু অনিমা জোর করে ওঠালো। অনিমাকে ড্রপ করে দিয়ে অরুমিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘোরালো আশিস। সারা রাস্তা কোন কথা হয়নি দুজনের শুধু স্মৃতিচারণ হয়েছে। আশিস প্রপোজ করার দুদিন পর অরুমিতা রাজি হয়েছিল। সবদিক ভেবেই রাজি হয়েছিল। কারণ টিনএজের ঐ সময়টাতে ওর মনে হয়েছিল আশিসই ওর জন্যে পার্ফেক্ট। বাড়ি পৌছাতেই ওদের ভাবনার ঘোর কাটল।অরুমিতা নেমে সোজা ভেতরে চলে গেল। আশিসের দিকে ফিরেও তাকায় নি। আশিস ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। অরুমিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন এটা ছাড়া কিছু করার নেই।
_____________
রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছেন। দুজনকেই হালকা ভীত মনে হচ্ছে। ওনাদের সাইডের সিঙ্গেল সোফাটায় রিক বসে আছে। ওর চালচলন খুব শান্ত। কফির মগ টি-টেবিলে রেখে ওনাদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে রিক বলল,
" হঠাৎ দুদিনের জন্যে গায়েব হয়ে গেলে দুজন? কী ব্যাপার?"
কবির শেখ একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন,
" গায়েব কেন হব বাবাই! আসলে কাজ পরে গেছিল। রাজনৈতিক কাজের কী ঝামেলা তুমিতো বোঝাই।"
" হুমম। বুঝিতো। তা এতো নরমাল তোমরা? খবর পাওনি? পাওয়ার তো কথা। নিউস তো কখনও মিস করোনা তোমরা।"
রঞ্জিত চৌধুরী নিজের চশমাটা মুছে চোখে পরতে পরতে বললেন,
" অনিমা আর আদ্রিয়ানের বিয়ের কথা বলছ?"
রিক একটু হেসে বলল,
" বাহ! ঠিক ধরেছ? তা এইজন্যই আমাকে কাজে ঢুবিয়ে রেখে ওখানে যেতে দিতে চাওনি। তাইতো?"
রঞ্জিত চৌধুরী ঘাবড়ে গেলেও কবির শেখ বুঝতে পারলেন যে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেকরেই হোক সব সামলাতে হবে। তাই একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন,
" আসলে তোমাকে কীকরে বলব? তুমি কেমন রিঅ্যাক্ট করবে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। তাই.."
রিক একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
" এসব ছাড়ো। এটা বলো যে অনিমা নারী পাচারকারীদের হাতে কীকরে পরল? তোমাদের ভাষ্যমতে ও পালিয়ে গেছিল তাও কারও সাথে। যদি তাই হয়। তাহলে ও ওখানে পৌঁছলো কীকরে?"
রঞ্জিত চৌধুরী এবার একটু রেগে গিয়েই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই কবির শেখ হাত চেপে তাকে থামিয়ে দিলেন। এখন বেফাঁস কিছু বলে ফেললেই বিপদ। রিক আবার বলল,
" কী হল? বল? তোমরা দেখেছিলে ওকে পালাতে? একা বা কারো সাথে? বল?"
কবির শেখ ভাবলেন এখন যদি বলে যে, দেখেছি। তাহলে রিক বলতেই পারে যে, তোমরা আটকালে না কেন? তাই বললেন,
" আমরা তো দেখিনি। ও ভার্সিটি কোন কাজে যাবে বলে বেড়িয়েছিল। আর ফেরেনি। তাই.."
রিক এবার লাথি মেরে টি-টেবিলটা উল্টে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
" এতো বেশি ভাবতে কে বলেছিল তোমাদেরকে? আমিও একটা বর্ন ডাফার। একবার ভেবেও দেখিনি ঠিকভাবে। আর আমি বলেছিলাম আমি আসার আগে ওকে বেড় হতে দেবেনা। বলেছিলাম না? আজ তোমাদের কেয়ারলেসনেসের জন্যে ও এখন অন্যকারো বউ। আর সেই অন্যকেউটা আমার ভাই।"
পরে থাকা টি-টেবিলে আরেকটা লাথি দিয়ে রিক ওপরে চলে গেল। স্নিগ্ধা আড়াল থেকে দেখছিল সব। এই মুহূর্তে চরম অবাক ও কবির শেখের বুদ্ধি দেখে। কীভাবে ব্যাপারটা থেকে নিজেরা গা ঝেড়ে নিল! সত্যি একটা কথা মানতেই হবে এই লোকটার বুদ্ধির জবাব নেই। তবে দুর্ভাগ্য যে এই অসাধারণ বুদ্ধি শুধুই অপকর্মে ব্যবহৃত হয়।
___________
আজ শুক্রবার। আদ্রিয়ান বেড় হবে না, অনিমারও ভার্সিটি নেই। সকালবেলা শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে, কফি বানিয়ে আদ্রিয়ানের রুমে এলো অনিমা। কাল অনেক রাত করে ফিরেছে তাই এখনও ঘুমোচ্ছে আদ্রিয়ান। অনিমা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এলো। একটু এগিয়ে এসে দেখল আদ্রিয়ান এলোমেলোভাবে ঘুমিয়ে আছে। এই ছেলের এলোমেলো রূপটা বরাবরই অনিমার দুর্বলতা। ও কফির মগটা পাশে রেখে দিয়ে আদ্রিয়ানের পাশে বসল। মসৃণ চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপাল ভর্তি হয়ে আছে, গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো যেন চেহারার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, বেবি পিংক ঠোঁটগুলো খানিক বাদে বাদে হালকা নড়ে উঠছে। এই লোকটা ওর বর? ওর গ্রিন কার্ড পাওয়া লিগাল সম্পত্তি। ভাবলেও কেমন করে ওঠে ভেতরটা। অনিমা আলতো হাতে চুলগুলো নেড়ে দিলো। খুব ইচ্ছে করছে কপালে একটা ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিতে। কিন্তু কোথাও একটা সংকোচবোধ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকার পরেও ওকে আর জাগাতে ইচ্ছে করল না অনিমার। পরে আদ্রিয়ান উঠলে আবার কফি করে এনে দেবে ভেবে উঠে চলে যেতে নিলেই হঠাৎ কেউ ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে শুইয়ে দিয়ে ওর ওপর আধশোয়া হয়ে গেল। অবশ্যই সেটা আদ্রিয়ানই। অনিমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমাকে ভালোভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলল,
"এরকম কেন তুমি? এতো লজ্জা পেতে কে বলে? কোথায় ভাবলাম সিনেমার রোমান্টিক হিরোয়িনদের মত তুমি আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কিসি করে দেবে। আমি হাতেনাতে তোমাকে ধরে ফেলব আর তুমি লজ্জায় লাল হয়ে যাবে। এইজন্যই এতক্ষণ ঘুমের এক্টিং করলাম। কিন্তু তুমিতো কিছু না করেই চলে যাচ্ছিলে। আমার সব আশায় এক বালতি জল ঢেলে দিলে। নট ফেয়ার জানপাখি!"
অনিমা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
" ছাড়ুন! দরজা লক করিনি আমি। কেউ এসে পরবে।"
" কেউ আসবেনা সোনা। সবাই জানে এটা নিউ ম্যারিড কাপলদের ঘর। তাই কেউ নক না করে ঢুকবেনা।"
অনিমা মুখ ফুলিয়ে বলল,
" কাপল আর একসাথে থাকে কোথায়?"
আদ্রিয়ান দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে অনিমার কানে কাছে মুখ এনে বলল,
" তোমার কী একসাথে থাকার খুব বেশি ইচ্ছে হচ্ছে?"
" অ- আমি সেটা কখন বললাম?"
আদ্রিয়ান এবার অনিমাকে নিজের সাথে আরো জোরে চেপে ধরে বলল,
" বাই দা ওয়ে। কাল আসার সময় কোন একটা ছেলের খুব প্রশংসা করছিলে। কে সে?"
" আপনি কীকরে জানলেন?"
আদ্রিয়ান অনিমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
" কে ছেলেটা?"
অনিমার একটু দুষ্টুমি করে হেসে বলল,
" আমাদের নতুন প্রফেসর। সদ্য জয়েন করেছে। সেই হ্যান্ডসাম। প্রথম দেখায় ক্রাশ খেয়ে গেছি।"
আদ্রিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
" তাই না?"
" হুম। হাসিটা জাস্ট আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। উফফ!"
আদ্রিয়ান সাথে সাথে অনিমার কানের লতিতে কামড় বসিয়ে দিল। অনিমা 'আহ' করে চেঁচিয়ে উঠল। ঠোঁটে ফুলিয়ে কান ডলতে ডলতে বলল,
" রাক্ষসের মত কামড়াচ্ছেন কেন?"
আদ্রিয়ান অনিমার কপালে কাপাল লাগিয়ে বলল,
" ভবিষ্যতে আমার সামনে অন্যছেলের নামে প্রশংসা করলে আরও বেশি কিছু করব। তুমি সবসময় শুধু আমার কথা বলবে। আমার প্রশংসা করবে। বুঝলে?"
" মামা বাড়ির আবদার?"
আদ্রিয়ান অনিমার নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,
" উমহুম। তোমার জামাইর আবদার। আবদার না আদেশ।"
বলে আবারও অনিমাকে জড়িয়ে ওর কাধে মুখ গুজে শুয়ে রইল। অনিমাও চোখ বন্ধ করে রেখেই আদ্রিয়ানকে সরাতে চাইল কিন্তু পারল না। অনিমা জমে যাচ্ছে আদ্রিয়ানের স্পর্শে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। কিন্তু এই ছেলেকে বলে লাভ নেই, শুনবেনা। কিছুক্ষণ পর অনিমা বলল,
" নিউস চ্যানেল তিনটা ব্যান না করালে হতো না? ছেলেটাকেও রাস্ট্রিকেট করিয়ে দিলেন?"
আদ্রিয়ান অনিমার কাধে মুখ গুজে রেখেই স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
" তুমি বলেছিলে ফিজিক্যালি কোন ক্ষতি না করতে। আমি করিনি। এটাতো বলোনি যে এসব কিছুও করতে পারবোনা।!"
" বলা উচিত ছিল। বুঝে উঠতে পারিনি যে আপনি হেব্বি শেয়ানা মানুষ।"
আদ্রিয়ান হেসে অনিমার কাঁধে একটা চুমু দিলো। অনিমা কাধ খানিক সংকোচিত করে নিল সাথেসাথে। তারপর বলল,
" এবার ছাড়ুন! অনেক বেলা হয়ে গেছে আদ্রিয়ান।"
আদ্রিয়ান বিরক্তি নিয়ে মুখ তুলে বলল,
" সবসময় এমন পালাই পালাই কেন কর বলোতো? তোমাকে একটু কাছে পেতে আমি হাফিয়ে মরি, আর তুমি আছো আমি ধরলেই শুধু ছাড়ুন', 'ছাড়ুন' করো।"
অনিমা আদ্রিয়ানকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কফির মগ হাতে নিয়ে বলল,
" ধৈর্য্য ধরুন নবাবসাহেব। সবুরে মেওয়া ফলে।"
অাদ্রিয়ান হেসে এক হাতের ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে বলল,
" যেদিন মেওয়া ফলবে সেদিন কিন্তু সুদে আসলে আদায় করে নেব বেগমসাহেবা। বি প্রিপার্ড।"
অনিমা কিছু না বলে টি-টেবিলে রাখা বইটা আদ্রিয়ানের দিকে ছুড়ে মেরে লাজুক হেসে চলে গেল কফি গরম করতে। আদ্রিয়ানও বইটা ক্যাচ করে হেসে ফেলল।
.
.
.
চলবে..........................................