পদ্মপাতা - পর্ব ০২ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!০৪!!

ভালোবাসার মানুষটাকে একটু যত্ন করতে হয়।একটু আদর,একটু মায়াই তো পারে ভালোবাসার টান বাড়াতে।বৃষ্টি হওয়ার পর আকাশটা কেমন থমথমে হয়ে আছে।কালো আর ধূসরের সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক রং।মাগরিবের আজানে চারদিক মুখরিত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের এই আজানের ধ্বনি যেন পাথরের মতো শক্ত ব্যাক্তিরও মন গলিয়ে দিবে।

মতিন চৌধুরী মাত্রই নামাজ পরে ঘরে তার চেয়ারটাতে বসে আছেন।করিম পাশেই বসে আছে।তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক কথাবার্তা চলছে।মতিন চৌধুরীর বয়স হয়েছে চুলে পাক ধরেছে কিনা।কিছুদিন পর মেয়ের বিয়ে দিবেন।করিম কানের পাশে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর তিনি চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে তা শুনছেন।আজ বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া শীতল।মতিন চৌধুরীর ইচ্ছে জাগলো গরম গরম খিচুরি খাবেন।তিনি মোহনাকে ডাক লাগালেন। আর মোহনা মাথায় শাড়ির আঁচলটা টেনে দিয়ে রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

-জ্বি।কিছু বলবেন?
-হুমম।আজ খিচুড়ি করো গরম গরম।আর বেগুন ভাজা করো।
-আচ্ছা। গরুর গোশত খাবেন না খাসির? 
-গরুর গোশত রাঁধো। 
-আচ্ছা। 
-আবির কই?দুপুরে আসার পর বাজারে একবার দেখা হলো।পরে আর কথাই হয়নি।
-আবির তো ঘরে।রুমা, দিমারে নিয়ে পড়াতে বসছে।
-ওহ।চাঁদকে দেখলাম না।
-চাঁদও মনে হয় ঐখানেই। 
-হুমম।যাও।

মতিন আবার চোখ বুজলেন।করিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-চাঁদকে এই বাড়িতে না রাখলে হয়না।ওর জন্য জানেন তো কি হইছে।এই মেয়ে এই বাড়িতে থাকলে আমাদেরও বিপদে পড়তে হবে।আস্ত এক আপদ।আমার ছেলেটা

আর বলতে পারলোনা করিম।কান্নায় ভেঙে পড়লো।

-আহ।করিম।এই ব্যাপারে আগেও কথা হয়েছে। চাঁদ ছোট ওর কোনো দোষ ছিল বলে আমি মনে করিনা। 
-চাঁদই আপনার সব আমি তো আপনার কিছু না।
-তা আমি বলিনি।
-ভাইজান আপনি একদিন বুঝবেন। 

করিম বেরিয়ে গেলো।আর মতিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলেন।এই বাড়ির সকলে তাকে মানে এবং গণ্য করে।তা তিনি জানেন।কিন্তু ভাইয়ের কথা শুনে তিনি একটা নিষ্পাপ মেয়েকে কি করে শাস্তি দিবেন।

তিলোত্তমা রান্নাঘরে বসে গরুর গোশত ফ্রিজ থেকে বের করে পানিতে ভিজিয়ে রাখছেন।আর রহিমা মসলা পিষছে। মোহনা অনেক তাড়াহুড়ো করে খিচুড়ি বসাচ্ছেন।তিলোত্তমা আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
-মহারাণী কই বুবু।একটু সাহায্য করলেও তো পারে।
-চাঁদ পড়ছে তিলো।
-হুম।পড়াশোনা করে তো উনি জগতে নাম কামাবেন।

তাচ্ছিল্যের সাথে বললো তিলোত্তমা। চাঁদকে তার একটুও পছন্দ না। না মানে না।

-এসব বলতে নেই তিলো।মা, বাবা হারা এতিম মেয়েটা।
-আমার কোল যে খালি করলো।
-ওর কোনো দোষ ছিল না।
-আপনি কাজ করেন বুবু।আমার জ্বালা আপনি বুঝবেন না।

মোহনা কথা না বাড়িয়ে কাজে মনোযোগ দিলো।

!!০৫!!

-সে কোথায়? আসেনি কেন?পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি খালি।

প্রমা,রুমা আর দিমা এসেছে আবিরের ঘরে।প্রমা এইবার এইচএসসি দিয়েছে। সামনেই তার বিয়ে।তাই পড়াশোনা থেকে আপাতত মুক্ত সে।নয়তো ভাইয়ের সামনে বই না নিয়ে সে বসতে পারতোনা।দিমা ক্লাস টেনে আর রুমা ফাইভে পড়ে।দিমা আর রুমা খাটে বসে বই নিয়ে পড়ছে।আর পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছে প্রমা।টেবিলের পাশে চেয়ারটায় বসে দিমাকে রাইট ফর্ম অফ ভার্বস বুঝাতে বুঝাতে প্রশ্নটি করেছিল আবির।প্রমা মুখ খুললো,

-কিভাবে আসবে ভাই।তুমি ওকে মেরেছো কেন?
-মারার কাজ করেছে তাই।দিনদিন লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। খালি গাছে উঠা আর ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ানো। 

দিমা আগুনে আরো ঘি ঢালার চেষ্টা চালাবে ভাবছিল।কিন্তু পরক্ষণেই মন পাল্টে ফেললো।এই চাঁদকে সে দুচোখে দেখতে পারেনা।সে শ্যামবতী আর চাঁদ এতো সুন্দর কেন!আবির ভাই সারাদিন খালি চাঁদ চাঁদ করে।মুখটা বাঁকা করে পড়ায় মনোযোগ দিলো সে।

আবিরের যে ভালো লাগছেনা।তার ভীতু হরিণী কি অভিমান করলো।আবির দাঁড়িয়ে ঘরে পায়চারি করছে।অস্থির লাগছে প্রচুর। 

রাতে খাওয়াদাওয়ার সময়ও চাঁদকে দেখা গেল না।আবির ডেকেছিল।কিন্তু চাঁদ ঘরের দরজা আটকে ঘরে বসে আছে।পরে মোহনা তাকে খাবার দিয়ে এসেছিল।রাতে চাঁদ ঘর থেকে বেড়োনোর জন্য পা বাড়ালো।ওর ঘরটা আবিরের ঘরের তিনঘর সামনে।এপাশের কোণায়। সিঁড়ির ঠিক পাশে।আবিরের ঘরের দরজা দিয়ে তাকালে ওর ঘরের অনেকটুকু দেখা যায়।বড় বাড়ি হওয়ায় সবারই আলাদা ঘর আছে। আস্তে আস্তে দরজা খুলে চাঁদ বেরিয়ে গেলো নানুমার ঘরে।নানুমা হয়তো ঘুমিয়ে আছেন।চাঁদ গিয়ে নানুমার পায়ের কাছে নিচে বসলো।পরে নরম হাতে পা টিপে দিতে লাগলো।আনোয়ারা চোখ খুললেন না।ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন কিনা।চাঁদের নানুমাকে অনেক ভালোলাগে। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন যদি কেউ থাকে তা হলো তার নানুমা।চাঁদের মন খারাপ থাকলে সে নানুমার ঘরে এসে তার পা টিপে দেয়।
কিছুক্ষণ পর চাদঁ সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো।মাথাটা বিছানায় রেখে শরীরটা ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে।

!!০৬!!

আবির যা ভেবেছিল তাই।তার ভীতু হরিণী বুড়ির ঘরেই।আবির আস্তে করে চাঁদকে কোলে তুলে নিলো।চাঁদ তখন ঘুমে বিভোর।চাঁদ তার চুলগুলোকে খোঁপা করে রেখেছে। কয়েকটা চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কয়েকটা বের হবার চেষ্টা করছে।আবির একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। তারপর তার কানেকানে ফিসফিসিয়ে মিষ্টি গলায় গাইলো,

কন্যা রে, কন্যা রে-
বাঁকা চুলেতে খোঁপা,
আর বাঁইধো না রে ।
ঐ চুলেতে জাদু আছে রে,
আমার ঘুম আসেনা রাতে
একলা ঘরে রে ।

চাঁদের সেদিকে হুস নেই।ঘুমের ঘোরে সে বললো,

-আপনি অনেক অনেক পচাঁ আবির ভাই।

আবিরও ফিসফিসিয়ে বললো,

-তাই।

চাঁদ ঠোঁট উল্টে বললো,

-হুমম।আমার স্বপ্নে আপনি কত ভালো আবার স্বপ্ন ফুরোলে করলা।

আবির মুচকি হেসে বললো,

-তাই তুমি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখো বুঝি।

চাঁদের আর সাড়া পাওয়া গেলোনা।আবির চাঁদকে নিয়ে চাঁদের খাটে শুইয়ে দিলো।পায়ের পুরানো পায়েলটা খুলে নতুন আরেকটা পায়েল পরিয়ে দিলো।আগেরটা তার সাথে নিয়ে যাবে।নয়তো সে ঢাকাতে দিন পার করতে পারবে নাকি!আবির চাঁদের এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আর চাঁদ যেন আরো গুটিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে ।আবির চাঁদের কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।আর বের হতে হতে বললো,

"তাড়াতাড়ি বড় হও না প্রেয়সী।তোমার প্রেমিক পুরুষ যে তোমার অপেক্ষায়!"

আবির ঘরে এসে বুক সেলফের ভিতর থেকে একটা ডায়রী বের করে তাতে লিখতে বসলো।তার প্রেয়সী,তার ভীতু হরিণীকে না বলা কথাগুলো সে ডায়রীতে লিখে।তার প্রেয়সী যেদিন বড়ো হবে, ভালোবাসার মানে বুঝবে সেদিন আবির তার উদ্দেশ্যে লিখা কবিতাগুলো তাকে শুনাবে।তার হরিণী হয়তো খিলখিলিয়ে হেসে বলবে,

"তুমি এসব আমার জন্য লিখেছো আবির।"

না না আবির না। ভীতুটাতো আবার আবির ভাই ডেকে ডেকে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়।সেদিনও হয়তো বলবে আবির ভাই।না জানি আবিরের বাচ্চাগুলো তাকে মামা বলে ডাকে।নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে উঠে আবির। এসব কি ভাবছে সে!

নিজের সিল্কি চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে আবার লিখাতে মনোনিবেশ করলো আবির।

"তোমার কাজলদিঘীর ন্যায় চোখ
তোমার অবাধ্য চুল
তোমার ভীতু হরিণীর ন্যায় চোখ
তোমার মুখের মিষ্টি ডাক 
আমায় পাগল করে
আমায় আচ্ছন্ন করে।
আমার প্রতি তোমার অভিমান
তোমার অভিযোগ 
আমাকে তোমার আপন করে।
তোমায় যে আমি অনেক বেশি 
ভালোবাসি।
যদি বলি বেশির চেয়েও বেশি।"

শেষে এতটুকু লিখে চোখটা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আবির।তার স্বপ্নে কেবল সে আর তার হরিণী।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন