জল ফড়িঙের খোঁজে - পর্ব ৩৫ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


খুব ভোরবেলা বাইরের হালকা আলো আর পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো রিখিয়ার। আজ শুক্রবার অফিস নেই। চাইলে আরেকটু ঘুমিয়ে নিতেই পারতো তবে ওর ভোরে ওঠারই অভ্যেস। তাই তাড়াতাড়ি উঠে পরল। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখে ওর বাবা-মা দুজনেই উঠে গেছে। রেজাউল ইসলাম চেয়ারে বসে আছেন। আর জাহানারা মানে রিখিয়ার মা নিচে বসে তসবি ঠিক করছেন। রেজাউল ইসলাম রিখিয়াকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

'' কীরে মা? উঠে পরলি যে? আজ তো অফিস নেই আরেকটু ঘুমিয়ে নিতি।"

রিখিয়া রেজাউল ইসলামের পায়ের কাছে বসে ওনার হাটুতে হাত রেখে বললেন,

" আর ঘুম আসছেনা বাবা। অভ্যেস নেই।"

জাহানারা চোখ তুলে বিরক্তি নিয়ে বললেন,

" তা কেন থাকবে। অভ্যেস তো শুধু সারাদিন খেটে বেড়ানোর। নিজের কপালটা নিজেই পুড়ছিস। যা খুশি কর, আমি কিছু বলবনা। আমার কোন দাম আছে না-কি এই বাড়িতে? একদম নেই।"

রিখিয়া নিজের মায়ের কথাতে তেমন পাত্তা দিলোনা। উনি সারাদিন এরকম বলতেই থাকে। মা তো। সন্তানের জন্যে সবচেয়ে বেশি চিন্তা তারই হয়। আর সেইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা থেকেই এসব কথা আসে। এগুলো ধরে বসে থাকার কোন মানে নেই। ও রেজাউল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল,

"চা খাবে বাবা?"

" হ্যাঁ শরীরটা ম্যাচম্যাচ করছে। একটু চা পেলে ভালোই হতো।"

" মা তুমি?"

জাহানারা তজবির দিকে মনোযোগ রেখেই বললেন,

" বাপ-বেটি যখন খাবি তখন আমি আর বাকি থাকব কেন?"

রিখিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। গ্যাস অন করে চায়ের পাত্রে পানি দেওয়ার পরই হঠাৎ তুর্বীর বলা কথাটা কানে বেজে উঠল, ' আমার কফি কে বানাবে ইয়ার? তুই জানিস আমার কফি জঘন্য হয়।' কথাটা মনে রিখিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আচ্ছা তুর্বী এখন নিজে নিজে ভালো কফি বানাতে পারে? সকালে নিজে থেকে ঘুম থেকে উঠতে পারে? কতটা বদলেছে ও? এখন বুঝতে পারছে যে এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি। ও ভেবেছিল সমস্যা কী যোগাযোগ তো থাকবেই। কিন্তু মেয়েটা যে এভাবে হারিয়ে যাবে বুঝে উঠতে পারেনি। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে চা বানানোতে মনোযোগ দিল। চা করে বাবা-মা দুজনকে দিল। নিজেও এক কাপ চা খেয়ে বাইরে হাটতে বেড় হল। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না একদম। হাটতে হাটতে নদীর পারে পৌছে গেল ও। এখানে বেশ ঠান্ডা হাওয়া আছে। এই গরমের মধ্যে এখান দিয়ে হাটতে ভালোই লাগবে। নদীর ওপারের গাছপালা, বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট করে দেখা যাচ্ছে। সকালের আবছা আলোর সাথে হালকা রোদ সব নদীর জলে পরাতে এর নদীর সৌন্দর্য কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে। এপারে বালুর রাস্তা আর অনেকরকমের বড় বড় গাছপালা তো আছেই। রিখিয়া নদীর পার দিয়ে হাটতে হাটতে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছে। হঠাৎ কারো কাশির আওয়াজে পাশে তাকিয়ে দেখে শাফিন ওর পাশ দিয়ে হাটছে। রিখিয়া শাফিনকে দেখে হেসে বলল,

" আপনি কখন এলেন?"

শাফিন মুচকি হেসে বলল,

" যখন তুমি প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত ছিলে।"

" হঠাৎ এদিকে?"

" হাটতে বেড়িয়েছিলাম। তোমাকে দেখে চলে এলাম।"

" ওহ।"

" আঙ্কেল, আন্টির শরীর ঠিক আছে তো?"

" হ্যাঁ, ঠিক আছে!"

দুজনে হাটতে হাটতে এমনি কথা বলছে। কথার মধ্যে শাফিন বলল,

" রিখিয়া, কাউকে ভালোবাসতে?"

রিখিয়া থমকে গেল। কিছুক্ষণ শাফিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

" বাসতাম না। এখনও বাসি।"

শাফিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কী ওর এতো বছরের অপেক্ষা সম্পূর্ণই বৃথা? তবুও ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

" এটাই আমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ? তবে তাকে বিয়ে করে নিচ্ছোনা কেন?"

রিখিয়া মলিন হেসে বলল, 

" সে কখনও আমার হবেনা শাফিন ভাই। আমার ভালোবাসাটা একতরফা। সে হয়তো তার জীবনে এখন খুব সুখেই আছে।"

" যে তোমার কখনও হবেই না তারজন্যে অপেক্ষা করার মানে কী?"

" আপনাকে কে বলল আমি ওনার জন্যে অপেক্ষা করছি? আমি ওনার জন্যে বসে নেই শাফিন ভাই।"

শাফিন একটু অধৈর্য হয়ে বলল,

" তাহলে আমাকে বিয়ে করতে কী সমস্যা? কেন এমন করছো? ছেলে হিসেবে আমি খুব খারাপ?"

" সেরকম কিছু না শাফিন ভাই। আপনি আমার সমস্যাটা বুঝবেন না।"

শাফিন রিখিয়ার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

" বুঝতে তো চাইছি রিখিয়া। কিন্তু তুমি বুঝতে দিচ্ছ না। আমি তোমাকে আমায় বিয়ে করার জন্যে জোর করছিনা। আমি শুধু জানতে চাইছি। আমায় বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা কী? এটুকুও কী জানতে পারিনা আমি?"

রিখিয়া কিছু না বলে শুধু ওর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকাল। শাফিন সাথেসাথে হাত ছেড়ে নিয়ে বলল,

" আ'ম সরি! আমি আসলে.."

রিখিয়া কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। কী করবে ও? শাফিনকে হ্যাংলার মতো করে বলতে পারবেনা যে ও ওর বাবা-মার কথা ভেবে বিয়ে করতে চায়না। শাফিন তাহলে ভেবে নিতেই পারে যে ও শাফিনকে ইনডিরেক্টলি ওর ফ্যামেলির দায়িত্ব নিতে বলছে। ও কারো কাছে ছোট হতে পারবেনা।

____________

ডুপ্লেক্স বাড়ির বিশাল বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে বিহান। হাতে মদের গ্লাস।বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে বান্দরবান নামটা প্রথমদিকেই মাথায় চলে আসে। আর যদি বান্দারবান টাই স্হায়ী ঠিকানা হয় তাহলেতো ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে। এটাই সবাই ভাবে। কিন্তু গত দুবছর যাবত বান্দারবানে থেকে বিহান বুঝতে পেরেছে সুন্দর স্হানগুলো বাসস্হান হওয়া উচিত নয়। তাহলে সেই চমৎকার সুন্দর দৃশ্যগুলোকে একপর্যায়ে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। তখন চমকে যাওয়া বা মুগ্ধ হওয়ার মত কিছু পরে থাকেনা। একটানা বহুদিন দেখলে 'প্যাংগং লেকও' মানুষের কাছে বিশেষ কিছু বলে মনে হবেন। এরচেয়ে ব্যস্ত শহর বা কম উন্নত গ্রামগুলোতে থাকা ভালো। মাঝেমাঝে এরকম জায়গায় ঘুরতে এসে চমকে যাওয়া যায়, মুগ্ধ হওয়া যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলা যায় 'ওয়াও, কী সুন্দর! যদি এখানেই থাকতে পারতাম।' এই যদিটা 'যদি' অবধিই সুন্দর, বাস্তবে রুপান্তরিত করতে গেলেই সবটা পানসে হয়ে যায়। তাইতো বান্দারবানের এই সৌন্দর্য বিহানকে এখন আর সেভাবে টানেনা। তখন পেছন থেকে ফরিদ বলল,

"স্যার আসি?"

ফরিদের ডাকে বিহান ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। সোজা হয়ে বসে বলল,

" হ্যাঁ চলে এসো।"

ফরিদ এসে একটা চেয়ার টেনে বসল। তাকিয়ে দেখে বিহান ড্রিংক করছে। ও শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিহান গ্লাসে আবার মদ ঢালতে ঢালতে বলল,

" খাবে? ঢালবো তোমার জন্যে?"

ফরিদ একটু ইতস্তত করে বলল,

" না। আজ নেব না। আমিতো ঐ মাসে এক দু পেক মারি।"

বিহান একটু হাসল। বিহান হঠাৎই এরকম কারণ ছাড়াই হেসে ওঠে। ওর এই হাসির মানে বুঝে উঠতে পারেনা ফরিদ। হাসি থামিয়ে বিহান বলল,

" আচ্ছা যারা নিয়মিত ড্রিংক করে তারা খুব খারাপ হয়?"

" জি স্যার অব্ না স্যার।"

বিহান আবারও হাসল। ফরিদ পরেছে মহা যন্ত্রণায়। এই লোকটাকে আস্ত একটা ধাঁধা মনে হয় ওর। যেই ধাঁধার সমাধান ও দেড় বছরের করতে পারেনি। বিহান বলল,

" আমাকে ভয় পেয়ে বলতে হবেনা। ওনেস্টলি বল। খারাপ হয়?"

ফরিদ মিনমিনে গলায় বলল,

" জানিনা স্যার। এবিষয়ে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই।"

" এটা বলতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। যাই হোক, নিয়মিত নেশা করার একটা সুবিধা কী জানো?"

ফরিদ কৌতূহল নিয়ে বলল,

" কী স্যার?"

বিহান কিছু বলল না। ফরিদও চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিহান সম্পূর্ণ প্রসঙ্গটাই পাল্টে ফেলে বলল,

" প্রেমের অভিজ্ঞতা আছে?"

ফরিদ একটু লাজুক হেসে বলল,

" জি। গার্লফ্রেন্ড আছে।"

" বউ বানানোর ইচ্ছা আছে?"

'' ইচ্ছেতো আছে স্যার।"

বিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

" সময় থাকতে আগলে রেখো।"

ফরিদ কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। বিহান বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,

" আচ্ছা ফরিদ, তোমার কাছে কী বান্দারবান স্পেশাল কিছু মনে হয়? লাইক এতো দূর থেকে, এতো অর্থ খরচ করে মানুষ দেখতে আসে। সেরকম বিশেষ কিছু?"

ফরিদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

" হয়তো কিছু বিশেষ আছে। তাই সবাই ছুটে আসে। এমনি এমনিতো আর এতো টাকা নষ্ট করে আসবেনা। কিন্তু আমার কাছেতো তেমন বিশেষ কিছুই মনে হয়না।"

" এর কারণ জানো?"

" জি-না। আপনি বলুন!"

" না থাক! আমার দেওয়া লজিক তোমার পছন্দ নাও হতে পারে। এটা বরং তুমি ভাবো। মস্তিষ্কচর্চা হবে। বুঝলে?"

" জি বুঝেছি।"

 বিহান গ্লাসে আরো একটা চুমুক দিয়ে বলল,

" তুমি কেন এসছিলে সেটা বল।"

ফরিদ এবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,

" সিলেট থেকে একটা কম্পানির টিম আসছে বান্দারবানে।"

" ভালো কথাতো। আমি কী করব?"

" ওনারা এই বাংলোর নিচের ফ্লোরটা এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া নিতে চান।"

বিহান গ্লাসটা রেখে ফরিদের দিকে তাকিয়ে বলল,

" কয়টা রুম লাগবে বলেছে?"

" চারটা। মোট আটজন থাকবে।"

" টাকার ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছ?"

" জি। ওনারা রাজি।"

বিহান চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথায় ওপর দিয়ে হাত রেখে বলল,

" তাহলে দিয়ে দাও।"

" আচ্ছা।"

বিহান কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

" হঠাৎ সিলেট থেকে এখানে আসছে যে?"

" প্রতিবছরই কোথাও না কোথাও ট্রেনিং থাকে। এবার বান্দারবান পরেছে।"

" হোটেল ছেড়ে এখানে কেন?"

" তা ঠিক জানিনা।"

বিহান উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বলল,

" বাদ দাও! লংড্রাইভে যাবে?"

ফরিদও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

" লংড্রাইভে? এখন?"

বিহান আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

" বড্ড অসময় তাইনা?"

" জি।"

" সবকিছুই সময় মেনে করতে হবে এটা কোথায় লেখা আছে? চল!"

বলে চাবি নিয়ে বিহান বেড়িয়ে গেল। ফরিদ বিহানের যাওয়ার দিকে বোকার মত তাকিয়ে থেকে নিজেও পেছন পেছন গেল। ফরিদ বুঝতে পারে বিহান এসব কাজের মধ্যে কাউকে একটা খোঁজে। কিন্তু সেটা কে তা জানেনা। কে আছে যে বিহানের এই আড্ডা, লংড্রাইভ, খোলা মাঠে বসে থাকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত?
.
.
.
চলবে.....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন