আকাশে ঘনকালো মেঘ করেছে। আজ সারাদিনই থেকে থেকে বৃষ্টি পরছে। মেঘের জন্যে চারপাশটাও অন্ধকারে ছেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর মেঘ ডাকছে। বৃষ্টিমুখর পরিবেশটা যেন বান্দরবানের সৌন্দর্যকে একটা নতুন রূপ দেয়। এখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে। বিহান ওর রুমের বিশাল থাই গ্লাসটা খুলে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে বৃষ্টি দেখছে। হালকা বৃষ্টির ছিটা খানিকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওকে। তাতে ওর বিশেষ কিছু যায় আসছেনা। ও ওর ভাবনায় মগ্ন। বিহানের ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোনের রিংটনে। এসময় ডিসটার্ব করাতে বেশ বিরক্ত হলো বিহান। ফরিদের নামটা স্ক্রিনে দেখে বিরক্তি মোটেও কমলো না। রিসিভ করে বিরক্তিমাখা কন্ঠেই বলল,
" হ্যাঁ বল?"
ওপাশ থেকে ফরিদ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
" স্যার, নিচের ফ্লোরে যেই কম্পানির আটজনকে ভাড়া দিয়েছি তাদের এমডি দেখা করতে চাইছে আপনার সাথে।"
" আমার সাথে কেন?"
" জানিনা, বললেন কথা বলবে।"
বিহান ভ্রু কুচকে ফেলে বলল,
" উনি আসবেন না আমাকে যেতে হবে?"
ফরিদ ইতস্তত করে বলল,
" আপনি এলে ভালো হয়।"
" আচ্ছা রাখছি।"
বিহান ফোনটা রেখে আবার বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিল। সিগারেটটা শেষ করে তারপর যাবে দেখা করতে। নতুন কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া পরিচিত হতে ভালো লাগেনা ওর। কিন্তু আপাতত যেতে হবে। কেউ কথা বলতে চাইছে আর ও যদি না যায় তাহলে লোকটাকে অসম্মান করা হবে। সেটা ঠিক হবেনা। সিগারেট শেষ করে লম্বা শ্বাস ফেলে ও নিচে চলে গেল । নিচে করিডরে রেখে দেওয়া লম্বা চেয়ারে সেই কম্পানির এমডি বসে আজিজুল বসে আছেন। বিহানকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বিহানও ওনার সাথে হ্যান্ডশেক করে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করে নিল। আজিজুল বললেন,
" আসলে এবার আমি চাইছিলাম একটু প্রাকৃতিক পরিবেশে নরমালি থেকে এবারের ট্রেনিং সাড়তে। তাই এই বাংলোতে আসা।"
বিহানও হেসে বলল,
" ভালো করেছেন। মাঝেমাঝে প্রকৃতির স্বাদ নেওয়া ভালো।"
" হ্যাঁ একদম। আমার সাথে আমার সাতজন এম্প্লয়ী এসছে। দেখা হয়ে যাবে তোমার ওদের সাথে। বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট তাই তুমি বললাম। কিছু মনে করো না।"
বিহান হেসে বলল,
" না কিছু মনে করব কেন? অবশ্যই ডাকতে পারেন!"
দুজনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করল। বিহানের প্রথমদিকে বিরক্ত লাগলেও পরে বেশ ভালো লাগলো লোকটাকে। বেশ মিশুক টাইপ মনে হল। কত তাড়াতাড়ি মিশে গেল ওর সাথে। আজিজুলের সাথে কথা বলে বিহান ফরিদকে নিয়ে চলে আসার সময় সিড়ির কাছ দিয়ে কারো সাথে ধাক্কা লাগল। বিহান না দেখেই 'সরি' বলে চলে যেতে নিলে কেউ অবাক কন্ঠে 'বিহান' বলে ডেকে উঠল। বিহান বেশ অবাক হল এখানে ওর নাম ধরে কেউ ডাকাতে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টিতেও অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। মিরাজও ছিল তুর্বীর সাথে। তুর্বীকে দাঁড়াতে দেকে ওও দাঁড়িয়ে গেছে। বিহান একটু এগিয়ে এসে বলল,
" তুমি? এখানে?"
তুর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেই বলল,
" আমি এখানে ট্রেনিং এ এসছি। কিন্তু তুমি এখানে কীকরে?"
" এটা আমারই বাংলো। কিন্তু তুমি ট্রেনিং এ এসছো মানে তুমি এখন সিলেটে থাকছ?"
" হুম। কিন্তু তুমি বান্দরবান শিফট কবে করলে?"
" দু-বছর আগেই। তুমি সিলেট থাকো। আর রিখিয়া? ও কেমন আছে?".
তুর্বী এবার হাত ভাজ করে চোখ ছোট করে বলল,
" ও কেমন আছে সেটা জেনে তুমি কী করবে? ওর প্রতি তোমার এই ইন্টারেস্টের কোন কারণ আছে কী? তোমার তো ভালো থাকার কথা। তা বিয়ে করে ফেলেছো? না-কি এখনও জামাকাপড়ের মত গার্লফ্রেন্ডস্ বদল করা, বেডরুমে নিয়ে আসা। এসব চালিয়ে যাচ্ছো?"
ফরিদ বড়সর ঝটকা খেল শেষের কথাটা শুনে। বিহানের গার্লফ্রেন্ড? তাও বেডরুমে? কীভাবে সম্ভব? এই দেড়বছরে কোন মেয়ের ধারেকাছে ঠিকভাবে যেতে দেখেনি বিহানকে। বেডরুম তো অনেক দূরের কথা। এই মেয়ে কী বলছে? তুর্বীর এটিটিউটের এরকম পরিবর্তন থেকে বিহান অনেকটা শকড। তুর্বী মানেই ওর চোখে একটা হাসিখুশি প্রাণচ্ছল মেয়ের ছবি ভাসত। কিন্তু এটা কোন তুর্বী? দুই বছরে এতোটা বদলে গেছে মেয়েটা? বিহান শান্ত গলায় বলল,
" সবকিছুর কারণ থাকতে হয়?"
তুর্বী কোন উত্তর দিলো না। বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকাল। বিহানের আচরণে অনেক পরিবর্তন চোখে পরছে ওর। এটা দুবছর আগের সেই বিহান নয়। কথায় কথায় ফ্লার্ট করা, মজা করা, দুষ্টুমি করা সেই বিহান কোথাও একটা মিসিং আছে। বিহান বলল,
"ও কোথায় আছে এখন?"
" ওর গ্রামের বাড়িতে হয়তো।"
" যোগাযোগ নেই তোমার সাথে?"
" যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম চলে যাওয়ার পর কিছুদিন। পারিনি। হয়তো আমার মত খারাপ একটা মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়নি।"
বিহানের কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলেই তুর্বী বলে উঠল,
" সৌহার্দ্য ফেরেনি?"
বিহান থেমে গেল তুর্বীর প্রশ্ন শুনে। পেছন ফিরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
" ওর কথা মনে আছে তোমার?
তুর্বী মাথা নিচু করে ফেলল। বিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
" ও ওর কথা রেখেছে। যোগাযোগ করেনি আমার সাথে আর। হয়তো ফেরেনি এখনও দেশে। আবার ফিরতেও পারে। জানিনা।"
তুর্বী কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই বিহান বলল,
" বদলে গেছ অনেক।"
" তুমিও।"
কথাটা বলে তুর্বী একটা মলিন হাসি দিল।
বিহান আর কথা না বাড়িয়ে ওপরে চলে গেল। ফরিদও পেছন পেছন গেল। তুর্বী নিজের কাজে যেতে নিলে মিরাজ বলল,
" কে ইনি? তোর পরিচিত কেউ?"
কিন্তু তুর্বী কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল। এখন মন মেজাজ একদম ভালো নেই ওর। কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়না।
____________
সৌহার্দ্য দু-দিন আগে ফিরেছে দেশে। সৌহার্দ্যর ফিরে আসাতে বাড়ির সবাই খুব খুশি হয়েছে।শফিক রায়হানকে বাড়ি আনা হয়েছে মোটামুটি সুস্থ উনি এখন। কিন্তু অফিসে যেতে পারবেন না। তাই আজ সৌহার্দ্যকেই অফিস যেতে হবে। কিন্তু ওর ভেতরটা কেমন করছে। দু-বছর পর আবার তুর্বীর সম্মুখীন কীকরে হবে? দূরে থেকে নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এখন সামনে গেলে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তো? এসব ভেবে ভেবেই সকাল থেকে অস্হির হয়ে যাচ্ছিল ও। কিন্তু অফিসে গিয়ে এতবড় ধাক্কা খাবে ভাবতে পারেনি। অফিস গিয়ে তুর্বীকে পায়নি ও আর। খুব অবাক হয়েছে ব্যাপারটাতে। আরো অবাক হয়েছে এম্প্লয়ীদের লিস্ট চেক করে কোথায় তুর্বীর নাম না পাওয়াতে। ও দ্রুত ম্যানেজারকে ডাকল। ম্যানেজার আসতেই সৌহার্দ্য জিজ্ঞেস করল,
" তুর্বী ইসলামের কথা মনে আছে আপনার?"
" জি স্যার।"
" উনি নেই কেন?"
" স্যার উনিতো জব ছেড়ে দিয়েছেন।"
সৌহার্দ্য হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
" কবে?"
" স্যার প্রায় দুবছর হবে।"
সৌহার্দ্য কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,
" উনি বর্তমানে কোথায় আছে জানেন?"
" না স্যার।"
ম্যানেজারকে বিদায় দিয়ে সৌহার্দ্য মাথা চেপে ধরে বসল। তুর্বী আর এখানে নেই? ঐ ঘটনার পরেই চলে গেছে মেয়েটা। কিন্তু কোথায়? সৌহার্দ্য দ্রুত রিখিয়া যেই ব্যাংকে চাকরি করতো সেখানে ফোন করল। আর ওনাদের থেকে ইনফরমেশন নিয়ে জানতে পারল যে রিখিয়াও জব ছেড়ে দিয়েছে। কী হচ্ছেটা কী? কী হয়েছিল সৌহার্দ্য বিদেশ চলে যাওয়ার পর? এদিকে বিহাটারও খোঁজ নেই। ওর অবর্তমানে এখানে সবকিছু এভাবে বদলে গেছে? তাও এভাবে?
সন্ধ্যার অনেক পর বাড়ি ফিরল সৌহার্দ্য। ফ্রেশ হয়ে অনেকটা মনমরা হয়ে এসে ড্রয়িরুমে সোফায় বসল। নুসরাতের ছেলে 'মীর' অস্পষ্ট স্বরে 'মামা' বলে নুসরাতের কোল থেকে হাত বাড়িয়ে দিল। সৌহার্দ্য মুচকি হেসে ভাগ্নেকে কোলে তুলে নিলো। শফিক রায়হান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
" বিহানের কোন খোঁজ পেয়েছ?"
সৌহার্দ্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
" তুমি আবার ওকে নিয়ে কবে থেকে ভাবছ?"
" ও তোমার ভাই হওয়ার আগে আমার ভাগ্নে। ওকে শাসন করতাম ঠিকই কিন্তু ভালোও কম বাসিনি একসময়। তোমার সন্তান হওয়ার পর সে যদি এরকম জঘন্য একটা কাজ করে তুমি মেনে নেবে? খুন করলেও বিবেচনা করতাম। কিন্তু একটা ধর্ষককে কীকরে ক্ষমা করি?"
সৌহার্দ্য বলল,
" বাবা প্লিজ! অসুস্থ তুমি। আমি এসব নিয়ে তর্ক করতে চাইনা।"
শফিক রায়হান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
" বয়স তো অনেক হল। এবার বিয়েটা করে ফেলো। তোমার বিয়ে দেখে অন্তত মরতে দাও।"
সৌহার্দ্য মীরের সাথে খেলতে খেলতেই বলল;
" পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা বিয়ে করেনি। তারা কী বেঁচে নেই? আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। নতুন কিছু বল।"
এবার মিসেস নাহার বললেন,
" আচ্ছা বিয়ে না করলি। মেয়েটার সাথে কথা বল। কয়েকটা দিন বন্ধুর মতো মেশ। এরপর যদি তোর ইচ্ছে না হয় বিয়ে করতে আমরা জোর করব না। বাবা-মায়ের এটুকু আবদার রাখ?"
সৌহার্দ্য একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
" আচ্ছা।"
নুসরাত হেসে বলল,
" যাক একটু হলেও সুমতি হয়েছে।"
শফিক রায়হান গম্ভীর স্বরে বললেন,
" তোমার করিম কাকার মেয়ের বিয়ে সামনের শুক্রবার। আমাদের যেতে হবে। অনেক দূরে গ্রামে বাড়ি। তাই দুদিন আগেই চলে যেতে হবে। এতোদিন পর দেশে এসছো। তোমাকেও যেতে হবে কিন্তু।"
সৌহার্দ্যর কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই এখন। কিন্তু এখন না ও করতে পারবেনা। তাই মাথা নেড়ে মীরকে কোলে নিয়েই ওপরে চলে গেল। এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না।
.
.
.
চলবে...................................