জল ফড়িঙের খোঁজে - পর্ব ৩৯ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


গ্রামগঞ্জে বিয়ে ব্যাপারটাই অন্যরকম হয়। নতুন পুরোনো সবরকম নিয়ম মেনেই বিয়ে হয়। প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানেই একটা বাঙালিয়ানা ব্যাপার থাকে। যেটা সত্যি মন ভালো করার মত। করিমের মেয়ের বিয়ে খুব ভালোভাবেই কোনরকম ঝামেলা ছাড়া মিটে গেল। সৌহার্দ্য খুব ব্যস্ত ছিল সারাদিন। যতই হোক আত্মীয়র বাড়ির অনুষ্ঠান। আর ও একটা জোয়ান ছেলে। হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাটা ওকে মানায় না। ব্যাপারটা ভালোও দেখায় না। এখনও খানিকটা ব্যস্ত আছে কিন্তু কিছুটা অন্যমনস্ক। কাল থেকে তিনবার দেখা হয়েছে রিখিয়ার সাথে ওর। গতরাতে হলুদের সময় এসেছিল রিখিয়া। প্রথমে সৌহার্দ্য খেয়াল করেনি। কারণ রিখিয়া এসেই কনের ঘরে চলে গেছিল ওকে সাজাতে। কনেকে স্টেজে আনার সময়ই সৌহার্দ্য খেয়াল করে ওকে। রিখিয়া তখনও দেখেনি সৌহার্দ্যকে। কিন্তু পরে চোখে পরেছে। কিন্তু ব্যস্ততা আর এতো মানুষজনের কারণে কথা বলতে পারেনি কেউই। দুজন দুজনকে মাঝেমাঝে দেখে গেছে শুধু। ভীর কমার আগেই রিখিয়াকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে, তাই আর কথা হয়নি। সকালেও একবার এসছিল। কিন্তু তখনও বাড়ির অবস্থা একইরকম ছিল আর সৌহার্দ্যও অনেক ব্যস্ত ছিল। এরপর দুপুরে খাওয়া দাওয়ার সময় তো কথা বলা অসম্ভব ছিল। তাই তখনও আর কথা হয়নি। কিন্তু সৌহার্দ্যর রিখিয়ার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। ও জানতে চায় যে ও ব্যাংকক যাওয়ার পর কী হয়েছিল। আর ওপরদিকে রিখিয়াও করিমদের বাড়ির উঠোনেই হাটছে। সৌহার্দ্যকে দেখে রিখিয়ার মন অস্হির হয়ে উঠেছিল। ওর চোখ বারবার বিহানকে খুঁজছিল। সৌহার্দ্য এসছে কিন্তু বিহান আসেনি? কেন? হয়তো সাথে ফ্যামলি এসছে বলে। ও যতটুকু জানতো বিহানের সাথে ওর ফ্যামিলির সম্পর্ক ভালো নয়। তাই হয়তো আসেনি। খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওর যে; বিহান কেমন আছে, কীভাবে আছে। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওর মা বারবার ফোন করছে। যেতে হবে ওকে এখন। দূরে থাকা সৌহার্দ্যর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য ডাকে থেমে গেল। রিখিয়া পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল সৌহার্দ্য আসছে। সৌহার্দ্য দ্রুতপদে এসে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

" তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।"

রিখিয়া বলল,

" আমারও।"

" কখন কথা বলা যাবে?"

" কাল সকালে আটটার দিকে সামনে নদীর পারের ঐ বড় মাচাটার সামনে আসতে পারবেন? আমিও চলে আসব।"

" অবশ্যই পারব।"

রিখিয়া একবার ঘড়ি দেখে বলল,

" রাত হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি এখন। কাল কথা হবে।"

সৌহার্দ্য সম্মতি দিল। রিখিয়া চলে গেল ওখান থেকে। সৌহার্দ্য রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দ্রুত নিজের কাজে মন দিল।

সকালে সৌহার্দ্য বড় মাচাটার ওপর বসে বারবার ঘড়ি দেখছে আর রিখিয়ার আসার অপেক্ষা করছে। নদীর পার থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়া, পাখির ডাক, মুগ্ধ করা গ্রামীণ পরিবেশ সবকিছু উপভোগ করার মত হলেও আপাতত সৌহার্দ্যর ইন্টারেস্ট শুধু রিখিয়ার আসা নিয়ে। মনের মধ্যে এতো প্রশ্ন ওকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই রিখিয়া চলে এলো। হালকা হাফানো কন্ঠে বলল,

" সরি, আসলে সব গুছিয়ে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেলো।"

সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল,

" সমস্যা নেই, বসো।"

রিখিয়াও মাচাটার ওপর বসল। সৌহার্দ্য হালকা গলা ঝেড়ে বলল,

" কেমন আছো?"

রিখিয়া মলিন হেসে বলল,

" এইতো আছি। আপনি?"

" চলে যাচ্ছে।''

কথাটা বলে ছোট্ট শ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। এরপর বলল,

" হঠাৎ সব ছেড়ে গ্রামে ফিরে এলে যে?"

রিখিয়ার কষ্ট হলেও মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল,

" বাবা অসুস্থ ছিল। মায়েরও শরীর ঠিক নেই। এখানে দরকার ছিল আমাকে।"

" শুধু কী এটাই কারণ?"

রিখিয়া কোন উত্তর দিলোনা। শুধু মাথা নিচু করে বসে রইল। হঠাৎ করেই কেমন গলাটা ধরে আসতে চাইছে ওর। সৌহার্দ্য আবার বলল,

" তুর আই মিন তুর্বীর সাথে যোগাযোগ হয় তোমার?"

রিখিয়া অসহায় দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল। সৌহার্দ্যর বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। ও উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

" আমি যাওয়ার পর কী হয়েছিল রিখিয়া?"

রিখিয়া নাক টেনে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

" আমি ওখান থেকে চলে আসার দিনই হঠাৎ বাবা ব্রেন স্ট্রোক করে। আমরা দিশেহারা হয়ে গেছিলাম। সব মিলিয়ে তুরের সাথে আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি আমার। কিন্তু পরে ফোন করেও ওকে পাইনি। আমি ফ্রি হয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা ওর খোঁজ করতে। কিন্তু জানতে পারি ও জব ছেড়ে চলে গেছে। এরপর আর কোন খোঁজ পাইনি ওর।"

বলতে বলতে রিখিয়া প্রায় কেঁদে দিয়েছে। সৌহার্দ্যর নিশ্বাস ভারী লাগছে। কোথায় আছে ওর তুর? কীভাবে আছে? যে মেয়েটা কথা বলতে না পারলে অস্হির হয়ে যেত সে এভাবে একা কীকরে আছে? তার রিখিয়াকে ছাড়া? রিখিয়াতো তুরের প্রাণ ছিল। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ছিল। রিখিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

" বিহান কেমন আছে?"

সৌহার্দ্য অতি গম্ভীর কন্ঠে বলল,

" জানিনা।"

সৌহার্দ্যর কথা শুনে চমকে উঠল রিখিয়া। জানিনা? জানিনা মানে কী? কী বলছে এসব সৌহার্দ্য? বিহানের খবর সৌহার্দ্য জানবেনা সেটা কীকরে হয়? ও কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,

" মানে?"

সৌহার্দ্য রিখিয়াকে সবটা বলল। ওর বিহানকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া। বিহানের বাবা-মার ওকে মারা। এরপর বিহানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। সব শুনে রিখিয়া দুহাতে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। সবকিছুর জন্যে ওর এখন নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সবটা ওর জন্যে হয়েছে। সেদিনের ভুল বুঝে মারা ঐ একটা চড় আর ঐ ব্লান্ডারের পরিণতি এমন হবে কে জানতো? সৌহার্দ্য রিখিয়ার মনে অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,

" নিজেকে এভাবে ব্লেম করোনা। তোমার দোষ ছিলোনা বরং তুমি নিজেই একজন ভুক্তভোগী। দোষ আমার ছিল। বিহান অন্যায় করেছিল ঠিকই কিন্তু আমার ওকে এভাবে ছেড়ে যাওয়া ঠিক হয়নি।"

রিখিয়া কিছু ভাবতে পারছেনা এখন আর। বিহানের কথাই মনে পরছে শুধু। ও জানে সৌহার্দ্য বিহানের কাছে কী ছিল। নিজের ভাইকে ছেড়ে কীভাবে আছে ছেলেটা। সৌহার্দ্য বেশ অবাক হচ্ছে। এখনও এতো ভালোবাসা? যদিও ওও তো তুর্বীকে এখনও ততটাই ভালোবাসে। রিখিয়া উঠে চলে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য বলল,

" রিখিয়া, বিয়ে করেছ?"

রিখিয়া ঘুরে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিল। যার অর্থ বুঝতে সৌহার্দ্যর সময় লাগল না। সৌহার্দ্য হেসে বলল,

" আজ ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। ভালো থেকো।"

" আপনিও ভালো থাকবেন।"

বলে রিখিয়া চলে গেল। ওর মন এখন আরও অস্হির। বিহানের চিন্তাই এখন ওর মাথায় ঘুরছে শুধু। সৌহার্দ্য রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, একটা ভুলের জন্যে মেয়েটা এখনও কষ্ট পাচ্ছে। এতোটা কষ্ট ও ডিসার্ব করেনা। যদি একটা সুযোগ পেত বিহানকে রিখিয়ার জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার। এর চেয়ে ভালো কিছুই হতোনা। ও ওর ভালোবাসাকে পায়নি ঠিকই কিন্তু অন্যকেউতো পেত। কিন্তু সেটা কী সম্ভব? বিহান কী এখনও ভালোবাসতে পেরেছে রিখিয়াকে?

___________

 একটা বড় পাথরের ওপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বিহান আর তুর্বী। কেউ কিছুই বলছেনা আপাতত। ওদের দৃষ্টি এখন সামনের কিছুটা দূরের নাফাখুম ঝর্নার দিকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঝর্ণাগুলোর মধ্যে নাফাখুম অন্যতম। সাঙ্গু নদীতে এর অবস্থান। বান্দবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রিতে পাহাড় আর বনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত সাঙ্গু নদী। নৌকা করেই এসছে দুজন এখানে। তুর্বী বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

" দারুণ কিন্তু তাইনা? এরকম ঝর্ণা আগে কখনও দেখিনি আমি। বেশ ইন্টারেস্টিং! কী যেন নাম এটার নাপা.__নাকি নাফা__

বিহান হেসে বলল,

 " নাফাখুম। এটাকে রেমাক্রি জলপ্রপাতও বলে।"

" ও আচ্ছা। বাট বেশ সুন্দর। এসব দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃতি নিজের মধ্যে কত রহস্য আর সৌন্দর্য ধারণ করে রাখে।"

" হুম। তবে আমার কাছে এসব এখন স্বাভাবিক লাগে। দুবছর যাবত প্রায়ই দেখি।"

তুর্বী হেসে বলল,

" থ্যাংকস হ্যাঁ? এভাবে সময় করে ফাঁকে ফাঁকে ঘুরতে আনার জন্যে।"

বিহান মুচকি একটু হেসে বলল,

" কাল সিলেট ব্যাক করছ রাইট?"

" হ্যাঁ। যেতে হবে।"

বিহান আর কিছু বলল না। তুর্বী আড়চোখে তাকাল বিহানের দিকে। ও ইচ্ছে করেই বিহানের সাথে এতো সময় কাটাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করছে যে সত্যিই বিহান কতটা বদলেছে। রিখিয়াকে ভালো রাখতে পারবে কি-না। কিন্তু এখন ও নিশ্চিত যে বিহানই পারবে রিখিয়াকে সবচেয়ে ভালো রাখতে। ও একটু গলা ঝেড়ে বলল,

" যদি তোমার কাছে সুযোগ আসে রিখিয়াকে আবার ফিরে পাওয়ার? ওকে ভালোবাসার? কী করবে?"

বিহান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

" ও আর ফিরবেনা আমার কাছে।"

বলে বিহান হাটা দিল। তুর্বী তাকিয়ে রইল বিহানের দিকে। ও জানে এখন ও কী করবে। একয়েকদিনে ও এটাও বুঝেছে যে বিহান সৌহার্দ্যকেও ভীষণভাবে মিস করে। তাই এবার শুধু রিখিয়া না, পারলে দুই ভাইয়ের সম্পর্কটাও ঠিক করার একটা চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সৌহার্দ্য কী ফিরেছে আদোও? না ফিরলে কী করবে ও? ভাবনা থেকে বেড়িয়ে নিজেও বিহানের পেছন পেছন হাটা শুরু করল।

সিলেটে নিজের ফ্লাটে জামাকাপড় গোছাচ্ছে তুর্বী। মিরাজ রুমে এসে দেখে তুর্বী জামাকাপড় গোছাচ্ছে। মিরাজ ব্যাগটা রেখে আগে ওখানে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেল। তারপর হাফানো কন্ঠে বলল,

" তোর মতলব কী বলত? বান্দরবান থেকে ফিরেই কিছু নিয়ে ভেবে চলেছিস। অফিস থেকে আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি। তারওপর বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এলি। তুই! ছুটি নিয়েছিস! তাও এতোগুলো দিনের? কী হয়েছে বলবি?"

তুর্বী লাগেজ গোছাতে গোছাতেই বলল,

" এবার একটু শ্বাস নে বাপ। বড্ড বেশি কথা বলিস। আর হঠাৎ এখানে এলি কেন?"

" তো কী করব? এরকম উদ্ভট কান্ড করে বেড়ালে টেনশন হয়না? কী চলছে তোর মাথায়?"

তুর্বী হেসে বলল,

" তুই বুঝবিবা। কমপ্লান খেয়ে বড় হ আগে। তারপর বলব।"

মিরাজ বিরক্তি নিয়ে বলল,

" রাখ তোর কমপ্লান, বেশিপ্লান। আগে বল কী করতে চাইছিস তুই? কোথায় যাচ্ছিস? তাও এতোদিনের জন্যে? বস এতোদিনের ছুটি দিল?"

" দুই বছরে এখনও কোন ছুটি নেইনি। তারওপর এখন বিশেষ কোন কাজ নেই। মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে লম্বা ছুটি এপ্রুভ করে নিয়েছে।"

মিরাজ মুখ ফুলিয়ে বলল,

" মিস করব তো ইয়ার।"

তুর্বী মিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

" আমিও।"

" কোথায় যাচ্ছিস সেটাতো বল?"

" আপাতত ঢাকা।"

মিরাজ অবাক হয়ে বলল,

" ঢাকা?"

তুর্বী লাগেজের চেইন আটকাতে আটকাতে বলল,

" হুম। যেখান থেকে গল্পটা শুরু হয়েছিল আবার সেখানেই যেতে হবে। আবার সেখান নতুন করে সবটা শুরু করতে হবে। তাই আমার ঢাকা ফেরাটা এখন খুব প্রয়োজন।"
.
.
.
চলবে...........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন