!!২৫!!
বাড়ির গেটের থেকে একটু দূরে আবির চাঁদকে নামিয়ে দিলো।বাড়িতে বাবা,চাচা আছেন।চাঁদকে কোলে দেখলে খারাপ ভাবতে পারেন।চাঁদ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আবির চাঁদের দিকে ফিরে বললো,
-শোন,আজ কি হয়েছে বাড়িতে কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।বাবা হয়তো এতোক্ষণে খবর পেয়ে গেছেন।সেটা আমি সামলে নিবো।ছোট চাচিকে তো চিনিসই ঘুরে ফিরে তোর ঘাড়ে দোষ চাপাবে।বুঝলি কি বললাম?"
চাঁদ মাথা নাড়লো।অর্থাৎ সে বুঝেছে।আবির আর কথা না বাড়িয়ে চাঁদের উড়নাটা মাথায় ঘুমটার মতো করে দিয়ে দিলো।হলরুমে আপাতত কেউ নেই।যে যার ঘরে।চাঁদ আস্তে করে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো।আবিরও পা বাড়ালো নিজের ঘরে।কি অদ্ভুত এই দুনিয়া তাইনা।যে অপরাধের শিকার হলো তাকে লুকিয়ে থাকতে হয়।আর যে অপরাধ করে সে মাথা উচুঁ করে হাঁটে।আজ যদি চাঁদের মা-বাবা বেচেঁ থাকতো তাহলে কি এতো লুকোচুরির প্রয়োজন ছিল!নিজের সন্তান হলে শত খুন মাফ আর পরের সন্তান হলে এক খুনেই কুপোকাত!
রাত ১২ টা বেজে ২৫ মিনিট। ঘুমোনোর জন্য চোখ বুজেছিল আবির।যদিও আজ ঘুমেরা তার চোখে ধরা দিবেনা।ঐ ছেলেটাকে খুন করে তার রক্ত দিয়ে খেলতে ইচ্ছে করছে তার।কত বড় কলিজা।তার চাঁদের দিকে হাত বাড়ায়।হঠাৎ দরজার ঠকঠক আওয়াজে উঠে বসলো আবির।দরজা খুলে দেখলো মতিন আর মোহনা দাঁড়িয়ে।
-বাবা, আপনারা এতো রাতে। কোনো সমস্যা হয়েছে।
মতিন বললেন,
-আগে ভিতরে তো ঢুকতে দিবে।
-ওহ্।ক্ষমা করবেন।আসেন।ভিতরে আসেন।
মতিন আর মোহনা ভিতরে ঢুকে খাটে বসলেন।আবির ও তার টেবিলের পাশে চেয়ারটায় বসলো।মতিন গলাটা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
-তোমার সাথে আমার এবং মোহনার জরুরি কিছু কথা ছিল।
-জ্বি, বলেন।
-আর কিছুদিন বাদে তো প্রমার বিয়ে দিবো।তুমি আমার একমাত্র ছেলে।বলতে গেলে এই চৌধুরী পরিবারের একমাত্র ওয়ারিশ। আমি চাচ্ছি তোমার আকদটাও করিয়ে রাখতে।আমার আর তোমার মায়ের নিতিকে পছন্দ। আশা করছি তুমিও আমাদের মতের বাইরে যাবেনা।তুমি তোমার সিদ্ধান্ত জানাও।আমি তারপরে নিতির বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো।
আবিরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বাবা এসব কি বলছেন!
-বাবা, আমি এখন বিয়ে করতে পারবোনা।
!!২৬!!
আবির কথাটা বলে মাথা নিচু করলো।আর যাই হোক বাবাকে সে অনেক সম্মান করে।মতিন বুক ফুলিয়ে সবার কাছে আবিরের প্রশংসা করে আর আবিরও কখনো বাবার মান ক্ষুণ্ণ হবে এমন কাজ করেনি আর করবেওনা।একমাত্র ছেলে তারউপর পরিবারের বড় ছেলে।অনেক দায়িত্ব যে তার ঘাড়ে।মোহনা নরম গলায় বললেন,
-তোমার অন্য কোনো পছন্দ আছে আব্বা।
আবির কিছু বললো না।মাথা নিচু করে রাখলো।চাঁদের কথা এখন বলা যাবেনা।মতিন অনেকটা সেকেলে।আত্মীয়দের মাঝে বিয়ে বরাবরই তার অপছন্দ।ভাই-বোনের বিয়ে তিনি কখনো সমর্থন করেন না।তবুও তার কলিজার টুকরা বোনটা তাকে কষ্ট দিয়েছিল।আবির কি করে সে ঘা তাজা করবে!
মতিন শান্ত ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-তুমি এখন বিয়ে করতে চাওনা কেন?
-বাবা,আমি সবে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিলাম।আমার এখন মাস্টার্স করার ইচ্ছা।তারউপর পিএইচডি করার জন্য লন্ডন যাওয়ার স্বপ্ন তো আমার বহুদিনের তা আপনারা জানেন।আর আমি কোনো চাকরিও করিনা।প্রাইভেটের আর কত টাকা পাই?সে টাকা দিয়ে তো আমার খরচ চলে যায়।
-টাকার চিন্তা তুমি করছো কেন?আমার এতো টাকা কি তোমার না?
-বাবা,ব্যাপারটা আমার কিংবা তোমার না।ব্যাপারটা একটা দায়িত্ব নেওয়ার।আমার কাঁধ এখনো দুর্বল বাবা।এই কাঁধ একটা সংসারের ভার বহনের জন্য আপাতত প্রস্তুত নয়।আমার সময়ের প্রয়োজন। আমার লাইফটা এখন একটা চলন্ত গাড়ির মতো।এই গাড়ি স্থির করতে আমার আরো সময় লাগবে।
মোহনা বললেন,
-তাহলে আব্বা আংটি বদল করে রাখো।
-না,মা।আমি এখন এসব পারিবারিক ঝামেলায় যেতে চাইনা।আর নিতির সাথেও তো কথা বলা প্রয়োজন।ওর তো মত নাও থাকতে পারে।কিংবা পরে হয়তো আমার কাউকে পছন্দ হতে পারে।
মোহনা আর মতিন উঠে দাঁড়ালেন।মতিন নিজের চেয়ে লম্বা ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-ছোট থেকেই তোমার অমতে কিছু করিনি।তুমি যেহেতু সময় চাচ্ছো।তাহলে সময় নাও।তবে বাবা আমার অসম্মান হয় এমন কিছু করো না।আমি তোমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করি।
অতঃপর তারা চলে গেলেন।আবির একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।সে কি করবে?একদিকে বাবা-মা, একদিকে অবুঝ প্রেয়সীর প্রতি একবুক ভালোবাসা।অপরদিকে তার পড়াশোনা।এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিতির সাথে কথা বলা।নিতি যদি না করে দেয় তাহলে একটু হলেও স্বস্তি পাবে আবির।
!!২৭!!
আজ সূর্যের মন খারাপ। তাই সে আস্তে আস্তে তার আলো ছড়াচ্ছে।গরমও তেমন পড়েনি।আচ্ছা, আবিরের মনের খবর কি কোনো ভাবে জেনে গিয়েছে সূর্য?তাই তারও মন খারাপ?কে জানে!
আবির প্রমার ঘরে প্রবেশ করলো।প্রমা নিচে।নিতি এখনো ঘুমে।আবির ডেকে তুললো তাকে।ঘুমঘুম কন্ঠে নিতি বললো,
-কিরে আবির।আমার সাথে কি কাজ।গতকাল কি হলো কিছুই তো শুনলাম না।
-তোর সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
-কি কথা?বল।
-বাবা তোর সাথে আমার বিয়ে দিতে চান।
নিতি লজ্জা মুখে বললো,
-হুমম।শুনছি।
-দেখ আমার তোকে কিছু জরুরি কথা বলার আছে।আজ বিকালে চল বড় স্টেশন যাবো।যাবি?
-হুমম।রক্তধারা দেখা হবে।কতোদিন যাইনা।শোন
আমাকে কিন্তু ওয়ান মিনিট মিষ্টির দোকানের আইসক্রিম খাওয়াতে হবে।
-ঠিক আছে। সব হবে।তাহলে তুই যাবি সিউর?
-হুমম।
প্রতিদিনের মতো আজোও আবিরকে চা দিতে এসেছিল চাঁদ।তবে প্রমার ঘরে আবিরের কথা শুনে দরজার আড়ালে দাড়াঁয় চাঁদ।মনে একরাশ অভিমান নিয়ে ভাবে,
"নিতি আপুর সাথেই যখন বিয়ে করবেন,তাহলে আমাকে এই মিথ্যা আশ্বাস কেনো।আমি কি এতোটাই অবুঝ!আমার কপালে ভালোবাসার পরশ দেওয়া।মাঝেমাঝে আমাকে সম্মোহনী কথা বলে ধাঁধায় ফেলে দেওয়া।এসব কেন আবির ভাই?আমি এতিম বলে আমার সুযোগ নিচ্ছেন?"
কিন্তু মুখফুটে কিছুই বলেনা চাঁদ।আবিরের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।আবির চাঁদকে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়।চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দেখে মুখটা ভার করে রেখেছে তার প্রেয়সী।আবির ভাবে হয়তো কাল রাতের জন্য মন খারাপ।তাই সান্ত্বনার সুরে বলে,
-মন খারাপ করিসনা চাঁদ।তোর তো কোনো দোষ নেই।
-না,আবির ভাই আমার মন খারাপ না।আমি ভাবি মানুষ কত বহুরূপী। তাই না আবির ভাই?
বলে একছুটে স্থান ত্যাগ করলো চাঁদ।আর আবির চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেলো।তার অভিমানিনী কি অভিমান করলো?
দুপুর গড়িয়ে গেলো আপন নিয়মে।এখন সময়টা বিকাল।চারিদিকে হাজারো পাখিরা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে আকাশটায়।এই একটা জায়গাতেই তো তারা মুক্ত। নয়তো মানুষেরা তো তাদের পেলেই খাঁচায় ভরে রাখে।
আজ নিতি একটা বেগুনি জামদানী শাড়ি পড়েছে।শাড়িটা অবশ্য তিলোত্তমার।আর আবির পড়েছে একটা কালো টি-শার্ট আর ডেনিম প্যান্ট।চাঁদ দূর থেকে দেখলো খুবই সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে।একেবারে রাজা-রাণী যেন।আবির ভাইয়ের পাশে নিতি আপুর মতো একটা মেয়েই প্রয়োজন।এসব ভেবে মুলি আর দুলিকে কতক্ষণ আদর করলো সে।অতঃপর পা বাড়ালো আমবাগানে।তার মন মাত্রই ভালোবাসার ঘর বাঁধতে চলেছিল।যা দমকা হওয়ায় ভেঙে গিয়েছে। শুরু হওয়ার আগেই আঙুল দিয়ে চাঁদের জায়গাটা দেখিয়ে গিয়েছে।
_____________
বাজার থেকে একটা রিকশা নিলো আবির।চাঁদপুর জেলার পাঁচ রাস্তার মোড় কালী বাড়িতে অবস্থিত।যা শপথ চত্বর নামে পরিচিত।আবিরদের গ্রামের বাজার থেকে শপথ চত্বর চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা। আর শপথ চত্বর থেকে রক্তধারার দূরত্ব ১ থেকে ১.৫ কিলোমিটার।প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো লাগবে যেতে।আবির একটা খোলামেলা জায়গা খুঁজচ্ছিল। যেখানে সে আপনমনে সব কথা নিতিকে বলতে পারবে।অপরদিকে নিতি মনে মনে বেজায় খুশি। আবির যে তার ছোট্টকালের ভালোবাসা।আজ একসাথে রিকশায় ঘুরছে সে আবিরের সাথে।আর কি চাই।কিন্তু নিতি কি আর জানে তার জন্য বড় কোনো ধাক্কা অপেক্ষা করছে।
.
.
.
চলবে.............................