!!৫২!!
জানালার পাশে বসে আছে চাঁদ। একমনে তাকিয়ে আছে উঠানের কবুতরের ঘরটার দিকে। চৌধুরী বাড়িতে দুইটা কবুতরের বাসা। একটা ধুরী দিঘীর পাশে। আরেকটা গোয়ালঘরের পাশে। গোয়ালঘরের টা চাঁদের ঘর থেকে দেখা যায়। কবুতরের ডানদিকের ঘরটায় মেয়ে কবুতরটা আজ বাচ্চা ফুটিয়েছে। সবাই উড়ে গেলেও মা কবুতর বাচ্চাদের কাছেই রয়েছেন। মায়েরা বুঝি এমনই হয়। সন্তানের জন্য এতো টান তাদের। চাঁদের মনে পরে গেলো নিজের মায়ের কথা চাঁদের যখন জ্বর হতো তখন সারারাত জেগে পাশে বসে থাকতেন। মাথায় পানি দিতেন, হাত বুলিয়ে দিতেন। বাবা তো অফিস থেকে ফেরার সময় কিছু না কিছু খাবার প্রতিদিনই আনতেন আর এসেই বলতেন আমার তোতাপাখিটা কইরে।
আজ আর কেউ আসেনা। কেউ জ্বর হলে রাত জেগে বসেও থাকেনা। বাবা মায়ের অভাব কেউ পূরণ করতে পারেনা তা সে যতোই আপন হোক। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চাঁদ। সময়টা এখন ডিসেম্বর। চাঁদের নভেম্বরে টেস্ট পরীক্ষা গেলো। এইতো সামনে ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা। সকালবেলা শীত শীত আবহাওয়া চারপাশে।
চাঁদ বসে আছে জানালার পাশে নিজের পড়ার টেবিলে। আবিরের আদেশ এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট চাই। তাই তো দিন রাত খেটে পড়ছে চাঁদ। তবে আজ কেনো জানি পড়তে ইচ্ছে করছেনা। শীতের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে৷ আজ বইয়ের পাতা খুলে রেখে চাঁদ বারেবারে অতীতে ডুব দিচ্ছে।
!!৫৩!!
আবির আর চাঁদের বিয়ে হয়েছে প্রায় দশমাস হতে চললো। এই দশমাসে আবির বাড়ি এসেছে কেবল দুইবার। মাঝে আবিরের মাস্টার্স পরীক্ষা গেলো। আগে আবির প্রতিমাসে চারবার আসতো। তবে এখন ব্যস্ততা আর ক্যারিয়ার গড়ার নেশায় পরেছে সে। প্রথমবার এসেছিলো জুলাইয়ের দিকে। তখন চাঁদকে একটা বাটন ফোন দিয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন নিয়ম করে দুবেলা কথা হয় ফজরের নামাজের পর আর এশার নামাজের পর। চাঁদ সেবার ভিষণ খুশি হয়েছিলো। বিয়েটা হওয়ার পর থেকেই আবিরের জন্য মনের ছটফট টা দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিলো চাঁদের। মোবাইলে কথা বলার কারণে এখন কিছুটা কমেছে।আবির আরেকটা অদ্ভুত কাজ করেছে। চাঁদকে বিকাশ একাউন্ট খুলে দিয়েছে। যেখানে প্রতিমাসে সে টাকা পাঠায়।চাঁদ মানা করলেও পাঠায় । চাঁদ আগে সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরতো এখন সে ঘরে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে।চুপচাপ বাড়ির সব কাজ করে।মেয়েটা যেন থমকে গিয়েছে। তিলোত্তমা তো কথায় কথায় বলেন চাঁদ নাকি নতুন ভং ধরেছে।
এর পরেরবার আবির এলো অক্টোবরের দিকে। কথা গুলো আজোও স্পষ্ট মনে আছে চাঁদের।
_________________
-চাঁদ, এবার পনেরো দিন থাকবো। তোর তো সামনে পরীক্ষা। তাই কোনো সাবজেক্টে সমস্যা থাকলে আমাকে দেখা।
-জ্বি, আচ্ছা।
-চাঁদ, শোন।
-বলেন।
-আমি কিছুদিন পর চলে যাবো।
চাঁদ কিছু বললোনা কেবল মাথা নিচু করে রইলো । চোখের পানিগুলো বাঁধ ভেঙে পড়ছে। আবির চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-কাদঁছিস কেন? বোকা মেয়ে।
-আপনাকে ছাড়া কি করে থাকবো আমি।
-কয়েকটা দিন ধৈর্য ধর। আমি ওখানে গিয়ে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বাবাকে আমাদের ব্যাপারে বলবো।
-আপনি আমাকে ভুলে যাবেন নাতো।
-এই তোর বিশ্বাস চাঁদ।
-না, আমি সেভাবে বলিনি।
-তো কিভাবে বলেছেন আপনি?
-সরি।
-হইছে এবার বুকে আসেন তো।
চাঁদ লজ্জা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো আর আবির চাঁদকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দিলো।
_______________
চাঁদ এবার এসব ভাবনা ছেড়ে পড়ায় মন দেবার চেষ্টা করলো। পড়াশোনা না করলে আবিরের সমান হবে কি করে?
এদিকে আবির মহা ব্যস্ত। মাস্টার্সে তার রেজাল্ট ছিলো ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আইইএলটিএসে স্কোর তুলেছে ৮.৫। এসবের পিছনে ছিলো রাতদিনের মেহনত। বাড়িতে যাইনি, নিজের বাবা- মা, প্রেয়সীকে দেখেনি। প্রজেক্ট, এসাইনমেন্ট,লাইব্রেরিতে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা কিনা করেছে সে। অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল ভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল আবির। তবে লক্ষ্য ছিলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। আর হলো তাই। তার পরিশ্রম সাফল্যে রূপ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেবল তাকেই ইন্টারভিউ দিতে বলা হয়েছিল। অবশেষে স্বপ্ন সফল। নিজের স্বপ্নের ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেলো সে। কিন্তু এরপরেও বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। ভার্সিটিতে পড়া, থাকা, খাওয়ার জন্য একটা মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। যদিও বাবার কাছে চাইলেই পাবে সে। তবুও একটা স্কলারশিপের জন্য প্রচুর খেটেছে আবির। ফুল ফ্রি না হলেও হাফ ফ্রি একটা স্কলারশিপ পেয়েছে। বাকি টাকা বাধ্য হয়েই বাবার থেকে নিতে হবে তার। মার্চে ফ্লাইট। আবির তাই সিদ্ধান্ত নিলো ডিসেম্বর মাসের শেষের এই কয়েকটা দিন আর নতুন বছরের শুরুর কয়েকটা দিন সে বাড়িতে কাটাবে। আপাতত কিছুদিন ফ্রি সে। নিজের প্রেয়সীর সাথেও কিছুদিন সময় কাটানো যাবে সাথে বাবা মার সাথেও। চাঁদকে বলেনি সারপ্রাইজ দিবে।
!!৫৪!!
বেলা বাজে ১২ টা। হঠাৎ ই চৌধুরী বাড়ি গমগমে হয়ে উঠেছে। বাড়ির ছেলে ফিরেছে কিনা। আবির সোফায় বসে আছে। পাশে দাড়াঁনো দিমা, রুমা, মোহনা আর তিলোত্তমা। আনোয়ারা পান চিবুতে চিবুতে বললো,
-এতোদিনে এই বুড়ি বউয়ের কথা মনে পড়লো।
-নাগো আমার প্রাণের বুড়ি তোমার কথা আমি প্রতিরাতে ভাবি।
আনোয়ারা আবিরের কান ধরে বললেন,
-বউয়ের সাথে মশকরা করো।
-দাদিজান ছাড়ো। ব্যথা পাই।
আনোয়ারা ছেড়েঁ দিলেন। পরে নরম কন্ঠে বললেন,
-কিছুদিন পরে তো চলে যাবি খুকু। আমি যদি মরে যাই আমার জানাযায় আসতে পারবি।
আবির আনোয়ারাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-এসব কথা বলেনা দাদিজান।
-আচ্ছা বললাম না। স্বামীর কথা না রাখলে পাপ হইবো তো আমার।
চাঁদ পড়ার টেবিলে বসেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। আবির চারদিকে তাকিয়ে দেখলো চাঁদ নেই। মেয়েটা কি করে ঘরে। আবির খেয়াল করলো তিলোত্তমা চুপসে আছে।
-কি হইছে চাচি।
-কাজলরে পুলিশে নিয়ে গেছে।
-কেনো?
-আরে আর বলিস না মানুষের যা লোভ।
-হুম, থাক মন খারাপ করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আবির উপরে গিয়ে চাঁদের ঘরে ঢুকলো। বউ তার পড়ার টেবিলে পড়েই ঘুম। আবির কাছে গিয়ে বললো,
-বউ। ও বউ।
-হুমম।
-ভালোবাসি গো বউ।
চাঁদও ঘুমের ঘোরে বললো,
-আমিও ভালোবাসি।
-কাকে?
-আবিরকে।
-তাই?
আর জবাব আসেনা। আবির চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অতঃপর টেবিলের উপরে রসমলাইয়ের একটা প্যাকেট, দুইটা শাড়ি ও একটা লাল গোলাপ রেখে বেরিয়ে গেলো। বউটা যে তার একেবারে বাচ্চা। এই মেয়েকে ফেলে বিদেশে সে কি করে থাকবে?
.
.
.
চলবে............................