পদ্মপাতা - পর্ব ২২ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!৬৪!!

আনোয়ারা বাড়ি ফিরেছেন সন্ধ্যাবেলা। বাড়ি ফিরেই মোহনার মুখে প্রিয় নাতনির এসব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। কিন্তু তিনি কোনো ভাবেই কাজলের মতো একটা খুনীর সাথে চাঁদের বিয়ে মানতে পারছিলেন না। কি করবেন তাও বুঝতে পারছেন না। বাড়িতে কেবল মোহনা, তিলোত্তমা, দিমা আর কাজল। মোহনা এখন প্রচন্ড রেগে রয়েছেন। আনোয়ারা কিছু বললে যে শুনবেন না তা তিনি নিশ্চিত। রাত নয়টায় বিয়ে পড়ানো হবে। হুজুর এশার নামাজ পড়ে আসবেন। মোহনা, দিমা আর তিলোত্তমা নিচতলার ঘরে কথা বলছেন। আনোয়ারা সিদ্ধান্ত নিলেন নিজে বেঁচে থাকতে এই অবিচার তিনি হতে দিবেন না। 

আনোয়ারা চুপচাপ উপরতলায় চলে এলেন। চারদিকে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। দূরে হুতুম পেচাঁ ডাকছে। আনোয়ারা খানিকটা ভয় পেলেন। কারন যখনই এই পেঁচা ডাকে তখনই কেউ না কেউ মারা যায়। তিনি ঘরে এসে চাঁদের মায়ের গহনাগুলো নিলেন। এগুলো তিনি অনেকটা জেদ করে, ঝগড়া করে চাঁদের চাচিদের কাছ থেকে এনেছেন। এগুলো চাঁদের বাবার টাকায় তৈরি। আনোয়ারা ভেবে রেখেছিলেন চাঁদের বিয়েতে দিবেন।এই ব্যাপারে অবশ্য বাড়ির কেউ জানেনা। অতঃপর নিজের বোরকাটা নিলেন। 

এগিয়ে এলেন চাঁদের ঘরের দিকে। দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ। খুলে ভিতরে ঢুকলেন তিনি। চাঁদ তখনও অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। নিজের প্রাণপ্রিয় নাতনির এই রূপ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। পরীর মতো মেয়েটাকে মেরে কি করেছে জানোয়ারের দলেরা। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে গেলেন চাঁদের দিকে। পাশ থেকে পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিলেন চাঁদের মুখে। চাঁদ নিভু নিভু ভাবে চোখ খুললো। আনোয়ারা চাঁদের গালে হালকা চাপড় দিতে দিতে বললেন,
-বইন উঠ। বইন চোখ মেল।

চাঁদ চোখ খুলে উঠে বসলো। চুলের কথা মাথায় আসতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো চাঁদ। 
-বইন কান্দার সময় নাই। এই বোরকা পর জলদি।

চাঁদ হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইলো।
-বড় বৌ কাজলের লগে তোর বিয়া ঠিক করছে আমি এইডা কেমনে হইতে দেই। তাড়াতাড়ি এই বোরকাডা পইরা পালায় যা।
-কোথায় যাবো নানুমা।
-এই নরক থাইকা বের হো। এরা তোরে জানে মাইরা ফেলবো।

চাঁদ তার ব্যথার শরীর নিয়েই বোরকা পরে নিলো। স্কুলের ব্যাগটায় নিজের কিছু কাপড়, একটা ফাইল যাতে সব সার্টিফিকেট, আবিরের ছবি, দরকারী নাম্বার থাকে তা নিয়ে নিলো চাঁদ। তবে মোবাইলটা পেলোনা।পাবে কি করে তিলোত্তমা তো মোবাইল ধুরী দিঘীতে ফেলে দিয়েছে। এদিকে আনোয়ারা তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। 
তিনি চাঁদের হাতে গহনাগুলো দিলেন এবং দুই হাজার টাকা দিলেন।
-এগুলো কার নানুমা।
-তোর বিয়ার জন্য রাখছিলাম।

চাঁদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আনোয়ারাকে। আনোয়ারা নাতনির কপালে চুমু খেলেন। উপরের সব লাইট বন্ধ করে দিলেন তিনি। সবাই মোহনার ঘরে। আস্তে আস্তে চাঁদকে নিয়ে নিচে নামলেন তিনি। হল রুমে আলো জ্বালানো নেই। হয়তো কেউ জ্বালায়নি। হঠাৎ একটা শব্দে চাঁদকে নিয়ে সিঁড়ির পিছনে লুকিয়ে গেলেন আনোয়ারা। দিমা রান্নাঘর থেকে কি যেন নিয়ে মোহনার ঘরে গেলো। চাঁদের শ্বাস আটকে আসছে। হয়তো পালাতে হবে নয়তো বলি হতে হবে। সে একলা হলেও পারতো। তবে তার পেটে যে বেড়ে উঠছে তার জন্য হলেও চাঁদকে পালাতে হবে। কাজলের সাথে বিয়ে আর ভাবতে পারলোনা চাঁদ।

!!৬৫!!

অনেক কষ্টে গেটের বাইরে চলে এলো চাঁদ, আনোয়ারা। 
-নানুমা দোয়া করো।
-যা দোয়া করি বইন। 

চাঁদ কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে ছুটতে লাগলো। আনোয়ারা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
-বইন লাকসাম শিকদার বাড়ি। তোর দাদার বাড়ি। 

চাঁদ কেবল লাকসাম শুনলো। সে জানে তার বাবার বাড়ি লাকসাম। তবে অনেক বছর ধরে যাওয়া হয়না বিধায় কোন জায়গায় কিংবা কি বললে চিনা যাবে তা সে জানেনা। প্রায় নয়বছর হয় দাদাবাড়ি ছেড়েছে সে।

আনোয়ারা বাড়ি ফিরে এলেন। ভেবেছিলেন ঘরে ফিরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবেন। তাই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলেন তিনি। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে কাজল নিচে নামছিলো। মূলত সে গিয়েছিল চাঁদকে দেখতে তবে না পেয়েই সে অস্থির হয়ে গিয়েছে। আনোয়ারা খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন। ঝাপসা আলোয় যা চোখ এড়ালো না কাজলের। 
-চাঁদ কই খালা।

এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেলেন আনোয়ারা। 
-আমি জানিনা। 
-সত্যি কইরা কন।
-কইছি না জানিনা।
-মাথা গরম কইরেন না আমার কন।
-তুমি আমার লগে এমনে কথা কইতাছো কে? আমি কইলাম না জানিনা। 

কাজল রাগে ধাক্কা দিয়ে বসলো আনোয়ারাকে। আনোয়ারা সিঁড়ি গড়িয়ে নিচে পড়ে তৎক্ষনাৎ মারা গেলেন। কাজল ঘাবড়িয়ে গিয়ে মোহনা, তিলোত্তমাকে ডাক দিলো। এতোক্ষণে রক্তে মেঝে ভরে গিয়েছে। মোহনা এক চিৎকার দিলেন। কাজল ছড়ালো চাঁদ তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে কাজল নিজ চোখে তাকে পালাতে দেখেছে। কিন্তু সে ধরতে পারেনি। বাড়িতে এসে এই খবর সর্বপ্রথম আনোয়ারাকে দেয়া মাত্র তিনি মাথা ঘুরিয়ে নিচে পরে গেলেন। চৌধুরী বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলো। করিম, মতিনকে ফোন করা হয়েছে। তারা বাড়ি ফিরছেন। আশেপাশের মানুষ এসে ভরে গেলো চৌধুরী বাড়ি।রহিমা,পচুও খবর পেয়ে এলো। তারা গিয়েছিল পচুর দাদাবাড়ি। সারা গ্রাম ছড়িয়ে গেলো চাঁদ পালিয়েছে। সবাই ছি ছি করছে। কেউ কেউ বলছে এই ছেলের সাথে দেখেছি ঐ ছেলের সাথে দেখেছি। কেউ কেউ রসালো গল্প বানাচ্ছে।

!!৬৬!!

চাঁদ স্টেশনে পৌঁছে আগে একটা পাউরুটি কিনে খেলো। পেটের ভিতর থেকে কে যেনো চিৎকার করে বলছে মা খাবার দাও। খিদা পেয়েছে। কান্নায় গলা দিয়ে খাবার ঢুকছিলো না চাঁদের। চায়ের দোকানের বুড়ো চাচার মোবাইল নিয়ে কল লাগালো আবিরকে। তবে ফোন অফ। 

ট্রেনে উঠে বসলো চাঁদ। ভাগ্য সহায় ছিলো এই ট্রেন সোজা যাবে লাকসাম। তবে আর পাঁচমিনিট দেরি করলেই ট্রেন মিস করতো চাঁদ। 

লাকসাম স্টেশনে নেমে বসে রইলো চাঁদ। কোথায় যাবে কি করবে? সব যে সে ভুলে গিয়েছে। এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেছিলো শিকদার বাড়ি কোথায়। তিনি বললেন সারা লাকসাম স্টেশনের আশেপাশে শিকদার বাড়ি নেই। 

পেটে খিদা, শরীরে ব্যথা আর চোখে অশ্রু নিয়ে স্তব্ধ চাঁদ। কি করবে? কোথায় যাবে সে।

নিজের ফাইলটা বের করলো চাঁদ। আবিরের একটা ছবি বের করে কেঁদে যাচ্ছে চাঁদ। আল্লাহ কেন এতো কষ্ট দিলো তাকে। পাশে একটা লোক এসে দাঁড়ালো। হ্যাংলা, পাতলা চোখ লাল। চাঁদকে দেখে বললো,
-ভাড়া কতো এক রাইতের?

হকচকিয়ে গেলো চাঁদ। আবিরের ছবি দ্রুত রাখতে গিয়ে একটা ছোট কাগজ পেলো সে। তা হাতে নিয়ে ফাইলটা নিয়ে দৌঁড়ে অন্য জায়গায় চলে এলো চাঁদ। লোকটা সেখানেই দাঁড়িয়ে। 

কিছু দূর এসে হাতের কাগজের দিকে তাকালো চাঁদ। একটা মোবাইল নাম্বার লেখা, নাম লেখা রত্না আন্টি, নোয়াখালী বেগমগঞ্জ, রহিম মাস্টারের বাড়ি।

চাঁদ যেনো মূল্যবান ধন খুঁজে পেলো। রত্না আন্টি প্রায় বছর দুয়েক আগে চাঁদের মামাবাড়ি এসেছিলো। উনি নাকি চাঁদের মায়ের বান্ধবী ছিলেন। লাকসামে পরিচয়। চাঁদের জন্য অনেক কিছু এনেছিলেন। নিঃসন্তান এই মহিলা চাঁদকে ছোট থেকে অনেক আদর করতেন। উনার স্বামীর নামই রহিম। চাঁদকে বলেছিলেন লাকসাম থেকে তিনি নোয়াখালী শিফট করেছেন। চাঁদ যদি সময় পায় তাহলে একবার যেনো যায়। পরে পেরিয়ে গেলো দুই বছর। রত্না আর আসেন নি।

চাঁদ দৌঁড়ে টিকিট কাউন্টারে যায়। অতঃপর জানতে পারে এখন যেই ট্রেনটা ছাড়লো তা নোয়াখালী যাবে। চাঁদ দৌঁড় লাগালো ট্রেন ধরতে। একটা মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো চাঁদকে এমন দৌঁড়াতে দেখে হাত বাড়িয়ে টেনে ছিঁচড়ে ট্রেনে তুলে নিলো।
.
.
.
চলবে........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন