পদ্মপাতা - পর্ব ২৩ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!৬৭!!

ট্রেনে উঠে হাঁপাচ্ছে চাঁদ। মেয়েটা তাকে পানি এগিয়ে দিলো। 
-নেন পানি খান।

চাঁদ মুখ খুলে পানি খেলো। মেয়েটা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। 
-তোমার মুখে দেখি রক্ত শুকায় আছে। বোরকা দেখে ভাবছিলাম আমার বড় এখন দেখি ছোট মেয়ে।

চাঁদ নিশ্চুপ। কোনো কথা বলতে তার ভালো লাগছেনা। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে চাঁদ নোয়াখালী স্টেশন নামলো। মেয়েটা আগের স্টেশনে নেমে গিয়েছে। এখন যেতে হবে বেগমগঞ্জ। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে। ট্রেন চলে যাওয়ার পর সব নিরব হয়ে গিয়েছে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলো চাঁদ। রিকশা, অটো বেশি একটা নেই রাস্তায়। একটা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো চাঁদ,
-চাচা, বেগমগঞ্জ যাবেন?
-আমি এহন যামু না।
-চাচা, চলেন। বিপদে পড়েছি। আপনার মেয়ে ভেবে সাহায্য করেন। 
-ভাড়া লাগবো ১০০ টেহা।
-আচ্ছা, দিবো।

ব্যথা শরীর নিয়ে রিকশায় উঠে বসলো চাঁদ। কে যেন পেটে খাবারের জন্য চিৎকার করছে। চাঁদ পেটে হাত রেখে মনে মনে বললো,
-একটু ধৈর্য ধরো সোনা। মা খাবার দিবো।

সদ্য ১৮ তে পা দেওয়া চাঁদ আজ সকল ঘটনার পরেও খুশি। সে মা হবে। তার পেটে আবিরের সন্তান। তার আর আবিরের ভালোবাসার ফসল। কয়েকটা দিন চাঁদকে দূরে থাকতে হবে। চাঁদ নিশ্চিত তার আবির সব ঠিক করে দিবে সব।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর রিকশাওয়ালা বললেন,
-এই যে এটা বেগমগঞ্জ হাজী সাহেবের মার্কেট। তুমি কই নামবা?
-রহিম মাস্টারের বাড়ি।
-আমি তো চিনিনা।
-চাচা, একটু দয়া করেন। আমাকে পৌঁছে দেন। 
-কি জ্বালা।

রিকশা ওয়ালা পাশের এক দোকানদার থেকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো রহিম মাস্টারের বাড়ি সামনে রাস্তা দিয়ে সোজা গিয়ে ডানদিকে। বড় একটা আমগাছ ওয়ালা বাড়ি। রিকশাওয়ালা নিয়ে চললো সেদিকে। চাঁদের হৃদপিন্ড তড়িৎ গতিতে চলছে। যদি এখানে জায়গা না হয় তাহলে এই রাতে কোথায় যাবে সে।

!!৬৮!!

রিকশাওয়ালাকে ১৫০ টাকা দিলো চাঁদ। রিকশাওয়ালাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বললো,
-বড়ো উপকার করেছেন চাচা। মন থেকে দোয়া রইল। 

রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। টিনের বড়ো গেট। চারদিকে ওয়াল টানা। উপরে ঝুলছে একটা হলদে লাইট। চাঁদ গেটে টোকা দিলো। রাত বোধহয় বারোটার উপরে। এসময় বাড়ির মানুষের ঘুমিয়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। চাঁদ টোকা দিলো একবার, দুইবার। তিনবারের বার ভিতর থেকে আওয়াজ আসলো।
-কে?
-আমি। আমি চাঁদ।
-কে চাঁদ? কারে চাই?
-রত্না আন্টি আসে?
-আফায় তো ঘুমায়।
-ডেকে দেন না একটু।

আর কোনো আওয়াজ আসছে না। রাস্তার সাথে বাড়ি। আশেপাশে আর বাড়ি নেই। দুইপাশে আর সামনে ক্ষেত। দূরে কুকুরের করুন সুর শোনা যাচ্ছে। ভয়ে জমে দাঁড়িয়ে রইলো চাঁদ। এমন সময় গেট খুলে দিলেন মধ্যবয়স্ক এক নারী।পরনে হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। হলদে লাইটে শ্যামবতী নারীটাকে মমতাময়ী লাগছে। চাঁদ গভীরভাবে তাকিয়ে রইলো। মনে পড়লো হ্যাঁ এটাই তো রত্না আন্টি। 
-কে তুমি?
-আন্টি আমি চাঁদ।
-ময়নার মেয়ে চাঁদ?
-হুমম।
-আল্লাহ। মা তুমি এতো রাতে এখানে কি করে? আসো ভিতরে আসো।

চাঁদ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। ছোট উঠান। একপাশে একটা টিন শেড ঘর। অপর পাশে দুইটা টিনের ঘর। টিন শেড ঘরের বারান্দা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো চাঁদ। বারান্দায় লাইট জ্বলছে। একপাশে রান্নাঘর আর অপর পাশে বাথরুম। দুইটা ঘর। মাঝে ওয়াল দেওয়া। যে মহিলা প্রথমে কথা বলেছিলো তিনিও ওদের সাথে ঘরে প্রবেশ করলেন।সম্ভবত উনি এ বাড়িতে কাজ করেন। চাঁদকে খাটে বসালো রত্না। চাঁদ মাথা থেকে হেজাব টা খুলতেই চমকে গেলেন রত্না। এই কি রূপ মেয়েটার। চুলগুলো এবড়োথেবড়ো করে কাটা ঘাড় পর্যন্ত। মাথায় রক্তের দাগ শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। 
-এসব কি চাঁদ? 

রত্না উঠে গিয়ে স্যাবলন আর তোলা এনে সব পরিষ্কার করে দিলেন। চাঁদকে বোরকা খুলতে বলে তিনি খাবার আনতে গেলেন। মেয়েটা ভয় পেয়েছে যা জানার তিনি কাল জানবেন। চাঁদকে খাবার দেওয়ার পর সে গাপুসগুপুস করে খেলো। রত্না কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। চাঁদকে একটা ব্যথার ঔষধ খাইয়ে ঘুমাতে বললেন রত্না। কাজের মহিলার নাম সালমা। তিনি অন্য ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। রত্না চাঁদের পাশে শুয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নিঃসন্তান রত্না ছোট থেকেই চাঁদকে আদর করেন। চাঁদের বাবা-মা মারা যাওয়ার পর দত্তকও নিতে চেয়েছিলেন তবে স্বামীর জন্য পারেন নি।

!!৬৯!!

-আবির চাঁদ পালিয়েছে। 
-এসব কি বলছো মা।
-সত্যিই বলছি। নষ্টা মেয়ে। আজ এই অলক্ষীর জন্য মা মারা গেছেন।
-কি!
-হ্যাঁ।
-মা তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।
-আমার কোনো ভুল হচ্ছে না।
-মা আমি বাংলাদেশ আসছি।

চৌধুরী বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। মতিন পুরোপুরি ভেঙে পরেছেন। করিম তো সেই তখন থেকে বিলাপ করে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছেন। মতিন মাকে নিয়ে হসপিটাল গিয়েছিলো তবে তারা ফিরিয়ে দিয়েছে। আগামীকাল বাদ যোহর কবর দেওয়া হবে আনোয়ারাকে।

আবির হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসে রইলো। বিগত দুইদিন যাবৎ চাঁদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে 
পারেনা সে। আজ প্রিয়তমা স্ত্রীর এমন কান্ড আর প্রাণপ্রিয় দাদির মৃত্যুর সংবাদ শুনে ভেঙে পড়লো আবির। চিৎকার করে উঠলো সে। আজ তার কাঁদার স্বাক্ষী হয়েছে ইংল্যান্ডের আকাশের প্রতিটি মেঘ। 

আবির বিড়বিড় করে বললো,
-আমি তোকে খুব বিশ্বাস করিরে চাঁদ। তুই যদি আমার বিশ্বাস ভেঙেছিস তাহলে আমি বেঁচে থাকতেও মরে যাবো।  

আবিরের দুইটা মোবাইল। একটা মোবাইলে কেবল চাঁদের ছবি আর এই মোবাইল দিয়ে কেবল চাঁদের সাথে কথা বলে সে। তবে আজ সে মোবাইলটা চোর নিয়ে গিয়েছে। সিমও তাই বন্ধ। 

________________

সূর্য আজ উঠেছে দুঃখী হয়ে। চাঁদের দুঃখে বোধহয় সেও দুঃখী। তাইতো নিজেকে মেঘেদের আড়ালে লুকিয়ে আছে। 

দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠলো চাঁদ। শরীরের ব্যথা একটু কমেছে। রত্না ঘরে ঢুকে বললেন,
-তুমি উঠে গেছো। যাও বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসো আমি খাবার দিচ্ছি।
চাঁদ ইতস্তত করে বললো,
-আংকেল কোথায় আন্টি? 
-উনি মারা গিয়েছেন। বছর দুয়েক হলো।
-সরি।
-আরে বোকা মেয়ে সরি বলছো কেন। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।

চাঁদ ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে বসে খাবার খেয়ে নিলো। রত্না চাঁদকে জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে মা। এবার আমায় বলো।
-আন্টি বলবো। তার আগে আপনার মোবাইলটা দেওয়া যাবে?

চাঁদ কল দিলো আবিরকে। আবারও ফোন বন্ধ পেলো। এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো চাঁদ। রত্না মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামাতে বললে চাঁদ বললো,
-এই অভাগীকে আপনার বাড়িতে একটু আশ্রয় দিবেন? 
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন