বর্ষণের সেই রাতে - পর্ব ৪৭ - সিজন ২ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


কপালে কারো ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে অনিমা পিটপিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করল। নাকে আসছে অতি পরিচিত সেই মিষ্টি গন্ধ। চোখ না খুলেই অনিমা অনায়াসে বুঝতে পারল ও আদ্রিয়ানের বুকে আছে। দুই বাহু দিয়ে নিজের বুকে আবদ্ধ করে রেখেছে আদ্রিয়ান ওকে। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে ওকে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। অনিমার জন্যে এর চেয়ে আরাম আর তৃপ্তির জায়গা আর কিছু হতেই পারেনা। তাই চোখ না খুলে আদ্রিয়ানকে আরেকটু জোরে জড়িয়ে ধরে। আদ্রিয়ান অনিমাকে নড়তে দেখে চোখ খুলে তাকায়। ওর চোখ লেগে এসছিল। ও বুঝতে পারল অনিমা জেগে গেছে। আর জাগার পর অনিমার এমন কান্ড দেখে হেসে ফেলল। তারপর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

" জানপাখি?"

অনিমা কিছু বলল না চোখ বন্ধ করে আদ্রিয়ানের টিশার্ট খামচে ধরল। আদ্রিয়ান অনিমার গালের ওপর থেকে চুল সরাতে সরাতে বলল,

" তাকাও!'

অনিমা না বোধক মাথা নাড়ল। ওর এখনও মনে হচ্ছে যদি সব স্বপ্ন হয়? চোখ খুললেই যদি দেখে সবটাই স্বপ্ন ছিল, আদ্রিয়ান বা ওর আব্বু কেউ-ই ফিরে আসেনি, তাহলে? না, তারচেয়ে ও এইরকম স্বপ্নেই ভালো আছে। এভাবেই থাকতে চায় ও সারাজীবন। অনিমার মনের কথাটা যেন আদ্রিয়ান বুঝে ফেলল। ও কোমল স্বরে বলল,

" এসব কিছুই স্বপ্ন নয় অনি। তোমার বাবাও ফিরে এসছে, আর আমিও। আমরা দুজনেই আছি। চোখ খুলে দেখ।"

অনিমা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাল এবার। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর চোখ দিয়ে পানি পরতেই আদ্রিয়ান সাথেসাথেই ওর চোখদুটো মুছে দিয়ে বলল,

" কেঁদোনা প্লিজ। তুমি জানো আমার এই একটা জিনিস সহ্য হয়না। কাঁদছো কেন এভাবে? আমি চলে এসছিতো। আর দেখ তোমার বাবাও ফিরে এসছেন। আজকেও যদি এভাবে কাঁদতে থাকো তাহলে হয়?"

অনিমা নাক টেনে টেনে বলল,

" আপনি খুব খারাপ একটা মানুষ। এভাবে না বলে কেউ উধাও হয়ে যায়? জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছিল? আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, হাত-পা আবস হয়ে যাচ্ছিল, আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, আমি মরে যাচ্ছিলাম আদ্রি.."

কথাটা শেষ করার আগেই আদ্রিয়ান অনিমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বল,

" হুশ! একদম মরার কথা বলবেনা জানপাখি। তোমার কিছু হলে আমি কী-করে থাকব বলো? আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে তো শুধু তোমারই বসবাস। তুমি চলে গেলে আমার মধ্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আর আমাকে এভাবে অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার অধিকার তোমার নেই, একদম নেই।"

এরপর আলতো করে অনিমার কপালে চুমু দিল। অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে। আদ্রিয়ান বলল,

" তোমাকে কোলে করে ওপরে নিয়ে আসতে আসতে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পরলে। এটা কোন কথা হল? কিছু খাওয়াও হয়নি তোমার এখনো। দেখ তোমার খাবার এনে রেখে দিয়েছি। উঠুন ম্যাডাম, খেতে হবে।"

অনিমা ভাঙা গলায় বলল,

" আব্বু কোথায়?"

" খাওয়া-দাওয়া করে নিজের রুমে রেস্ট করছে। সন্ধ্যায় সবাই মিলে একসাথে গল্প করব। চল ওঠ, খাবে।"

অনিমা উঠে বসল। আদ্রিয়ান গিয়ে ওয়াসরুম থেকে নিজের হাত ধুয়ে এলো। বেড়িয়ে এসে দেখে অনিমা খাটে আসাম করে বসে আছে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে খাবারের প্লেট নিয়ে এসে অনিমার সামনে বসল। এরপর ওর দিকে এক লোকমা এগিয়ে দিতে অনিমা জিজ্ঞেস করল,

" আপনি খেয়েছেন?"

" তোমাকে প্রথম লোকমা দিয়ে এরপর আমি খাবো। দ্রুত হা কর।"

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হা করল। আদ্রিয়ান ওকে খাইয়ে এরপর নিজেও খাবার মুখে দিল। কয়েকমাস আগেও অনিমার মনে হতো ওর মতো খারাপ ভাগ্য পৃথিবীতে কম মেয়েরই আছে। না হলে এতো বড় পৃথিবীতে ও এতো অসহায় কেন? কিন্তু এখন বুঝতে পারে যে ও কতটা ভালো ভাগ্য নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে। এমন স্বামীভাগ্য কজনের হয়। অনিমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিয়ান ভ্রু নাচিয়ে অতি প্রেমময় ভঙ্গিতে বলল,

" এম আই লুকিং টু মাচ হ্যান্ডসাম, জানপাখি?"

অনিমা সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিল। আদ্রিয়ানের বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠল ওর। ঠোঁটে কোণে ফুটে উঠল হালকা হাসি। আদ্রিয়ানও আর কিছুই না বলে অনিমাকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিল। তখনই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিক বলল,

" আসতে পারি?"

আদ্রিয়ান তাকিয়ে রিককে দেখে মুচকি হাসল। তারপর বলল,

" জিজ্ঞেস করার কী আছে? চলে আয়?"

রিক ভেতরে এসে সোজা আদ্রিয়ানের মাথায় একটা চাটা মারল। আদ্রিয়ান মাথা হাত দিয়ে ঘষে বলল,

" মারছিস কেন?"

" নাহ, মারবো কেন? আপনাকে তো ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা উচিত ছিল আমার। অতি মহৎ কাজ করে ফিরেছেন কি-না।"

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে আবার অনিমাকে খাওয়াতে শুরু করল। অনিমা একপলক রিকের দিকে তাকিয়ে আর তাকায় নি। রিক টুল টেনে বসে বলল,

" ইডিয়ট একটা। এই মেয়েটার অবস্থা দেখেছিস একয়েকদিনে কী হয়েছে? কাঁদতে কাঁদতে চোখের সব পানি এই তিনদিনেই শেষ করে ফেলেছে। এবার ভবিষ্যতে যখন তোদের ধুমধাম করে আঙ্কেল বিয়ে দেবে। তখন বিদায়ের সময় কাঁদবে কীকরে?''

আদ্রিয়ান ফিক করে হেসে দিল। অনিমা মুখ ফুলিয়ে তাকাল রিকের দিকে। রিক ওর হয়ে কথা বলছে না-কি ওকেসহ পঁচাচ্ছে বুঝতে পারছেনা। রিক ধমকের সুরে বলল,

" ঐ একদম হাসবি না। নিজের বউকে কাঁদিয়ে এখন হাসছে। ইরেস্পন্সিবল একটা।"

আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

" আরে ভাই, তুই ছিলিতো। আমি জানি তুই আর যাই হোক বন্ধু হিসেবে বেস্ট। আর এরকম মুহূর্তে একজন বন্ধুই সবচেয়ে বেশি সামলাতে পারে।"

অনিমা আর রিক দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ানেল কোন ভাবান্তর নেই। ওর মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ও অতি স্বাভাবিক একটা কথা বলেছে। রিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,

" মানে?"

আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

" তোর নীলপরী কেমন আছে?"

অনিমা হালকা কেঁপে উঠল। আদ্রিয়ান নীলপরী সম্পর্কে জানে? এটাও কী জানে যে নীলপরী কে? না-কি শুধু নামটাই জানে? রিক অবাক হলেও একটু হাসার চেষ্টা করে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

" ভালো আছে। ইনফ্যাক্ট খুব ভালো আছে।"

তারপর সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিল। এরপর ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

" অ-আমি রুমে যাচ্ছি। তোরা রেস্ট করে সন্ধ্যায় নিচে চলে আসিস। সবাই আসছে।"

আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

" তুইও গিয়ে রেস্ট করে নে, তোর ওপর দিয়েও অনেক ধকল গেছে।"

রিক দ্রুতপদে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। যেন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই কিছু একটা ধরা পরে যাবে। অাদ্রিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবার অনিমাকে খাওয়ানো শুরু করল। অনিমাও মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছে। কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। তবে আদ্রিয়ানের শেষের কথাগুলো ভাবাচ্ছে ওকে।

___________

আবরার মেনশনে ড্রয়িংরুমে কোলাহলপৃর্ণ খুশির আমেজ। যেন তিনদিনের ঘনকালো মেঘ পেরিয়ে উজ্জ্বল রোদের আলো দেখা দিয়েছে। সকলেই চা পাকোড়া খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছেন। আদিব, আশিস, অভ্র, নাহিদ। এদিকে অরুমিতা, তীব্র আর স্নেহা সবাই এসছে। নাহিদকে মানিক আবরার আচ্ছামত কানমোলা দিয়েছে কারণ ও সবটাই জানতো যে আদ্রিয়ান কোথায় আছে। কিন্তু বলেনি। সোফাতে হাসান কোতয়ালের এক হাত জড়িয়ে ধরে বসে আছে অনিমা। এতোবছর পর বাবাকে ফিরে পেয়ে ছাড়তেই চায়না ও আজ আর। আদ্রিয়ান ওপর সাইডে সোফার হ্যান্ডেলে বসে আছে, রিক ঠিক ওর বিপরীত হ্যান্ডেলে বসেছে, বসার জায়গাটায় স্নিগ্ধা বসে আছে। অনেকক্ষণ আড্ডার পর মানিক আবরার বললেন,

" তো এবার খুলে বলতো কী হয়েছিল?"

মিসেস রিমাও বললেন,

" হ্যাঁ এভাবে হুট করে উধাও হয়ে গেলি। হাসান ভাইকেও নিয়ে এলি। কী হয়েছিল?"

অনিমা সহ সবাই কৌতহলী চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। হাসান কোতয়াল মৃদু হাসছেন। আদ্রিয়ান কয়েকসেকেন্ড চুপ থেকে তারপর বলল,

" আমি আর নাহিদ ভার্সিটি লাইফে একবার রাজশাহী গিয়েছিলাম মনে আছে? তো ওখানে রাতে আমি আর নাহিদ বাইকে করে ঘুরছিলাম। কিন্তু আনফরচুনেটলি__ এক্চুয়ালি ফরচুনেটলি বলা যায়, ব্যালেন্স হারিয়ে আমাদের বাইকটা পাশের সরু এবং প্রায় পানিশূণ্য খাদে পরে যায়। আমাদের তেমন বিশেষ ইঞ্জুরি হয়নি ঠিকই। কিন্তু একটা মানুষকে ওখানে অজ্ঞান অবস্থায় পাই আমরা। লোকটার বেশ ভয়ংকররকম ইঞ্জুরি ছিল। আর উনি আঙ্কেলই ছিলেন।"

সবাই বেশ অবাক হয়। অনিমা ওর বাবাকে আরেকটু শক্ত করে আকড়ে ধরে। আদ্রিয়ান বলল,

" আমরা ওনাকে নাহিদের বাবার হসপিটালে নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে পরেরদিন নিউস পেপারে ওনারাই মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। পেপারের ছবি দেখেই সেটা বুঝেছি। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল ওনার জীবিত থাকার খবরটা ঐ মুহুর্তে বাইরে যাওয়া ঠিক হবেনা। তাই আমরা ওনাকে লুকিয়ে ফেলেছিলাম, সবার আড়াল করে রেখেছি। আর উনি এতোদিন ইউ এস এ তে নাহিদর বাড়িতে ছিলেন। অনিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে আমি ওনাকে নিয়ে আসতেই ইউএস যাচ্ছিলাম কিন্তু এয়ারপোর্ট যাওয়ার পর জানতে পারি এই নাহিদ গাধা ওনাকে নিয়ে ওলরেডি চলে এসছে। এখন চট্টগ্রাম আছে। তাই আমি সেখানেই গেছিলাম ওদের আনতে।"

সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। সবার সবকিছুই এলোমেলো লাগছে, কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। আদিব ভ্রু কুচকে বলল,

" এতোকিছু হয়ে গেল আর আমরাই জানিনা? কিন্তু তাহলে এই পাঁচবছরে আঙ্কেল ফিরে আসলেন না কেন? আর তুই কীকরে জানলি যে ইনিই অনির বাবা? আর চট্টগ্রাম গিয়ে কাউকে কিছুই না বলে তিনদিন পরে ছিলি কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা সব গুলিয়ে যাচ্ছে।"

আদ্রিয়ান আর হাসান কোতয়াল একে ওপরের দিকে তাকাল। ওনাদের ঠোঁটে এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। আর কিছু বলার আগেই রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ এসে প্রবেশ করলেন ভেতরে। ওনাদের পেছনে মিসেস লিমাও এসছেন। কবির শেখ দ্রুত পদে এসে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরলেন। আদ্রিয়ানও হেসে দিয়ে নিজের মামার পিঠে হাত রাখল। কবির শেখ ওকে ছেড়ে বলল,

" এটা ঠিক আদ্রি? এভাবে হুট করে গায়েব হয়ে যায় কেউ? এদিকে কী অবস্থা হতে পারে বোঝনা তুমি?"

আদ্রিয়ান ঘাড় বাঁকা করে কাপ ধরে বলল,

'' সরি মামা। আসলে আমি প্লেনে উঠিনি সেই দুঃখে যে প্লেনটা ক্রাশ করে বসবে সেটা বুঝিনি।"

মিসেস লিমা রাগী কন্ঠে বললেন,

"সেই কিউট করে সরি বললেই সব গলে যায়।এইছেলে কোনদিনও শোধরালো না।"

আদ্রিয়ান হাসল। রঞ্জিত চৌধুরী বললেন,

" তবুও তোমার জানানো উচিত ছিল।"

'' হ্যাঁ আই এগ্রি। তাইতো সরি বলছি। বাই দা ওয়ে মামা। আমার বউকে তো চেনই এতোদিনে। এখন আমার শশুরমশাইয়ের সাথে আলাপ করে নেও।"

এরপর আদ্রিয়ান হাসান কোতয়ালকে দেখিয়ে করে বলল,

" অনিমার বাবা, হাসান কোতয়াল। পেশায় জার্নালিস্ট।"

হাসান কোতয়ালকে দেখে কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী দুজনেই জমে গেলেন। যেন চোখের সামনে ভুত দেখছেন। ঘাম বেড়িয়ে গেছে ওনাদের। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। মন একটাই প্রশ্ন করছে, এটা কী করে সম্ভব?
.
.
.
চলবে..........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন