!!৩৪!!
চারদিন বাদে প্রমার বিয়ে।সিফাতদের বাড়ি চাঁদপুর শহরে।শপথ চত্বরের পাশেই।প্রমাদের বাড়ি থেকে আধাঘন্টার মতো লাগে যেতে।প্রমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে সে।ব্যাংকে জবটা হওয়ার সাথে সাথেই বাবা-মা কে প্রমার কথা জানিয়েছে।বিয়ের প্রস্তাব যখন দেয়া হয়েছিল তখন প্রমার এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল।সবদিক বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়েছিল পরীক্ষার পরই বিয়ে হবে। আর তাই হলো।প্রমা তো লজ্জায় ঘর থেকেই বের হয়না।আসলে প্রমাও মনেমনে সিফাতকে পছন্দ করতো।ছেলেটা প্রতিদিন তাদের বাজারে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো।প্রমা,রুমা,দিমা আর চাঁদ যখন একসাথে স্কুলে যেতো তখন হা করে প্রমার দিকে তাকিয়ে থাকতো।কলেজের বেলায়ও তাই।
এদিকে চাঁদ অনেক খুশি।আজ আবির ভাই আসবে।উফ্,এতো মধুর অনুভূতি হচ্ছে চাঁদের।কাজল এতোদিন পর বাড়িতে আসলো।সে মূলত তিলোত্তমা আর তার সম্পত্তির খবর নিতে বাড়ি গিয়েছিল।সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। চাঁদ অনেক শান্তিতে ছিল কয়েকটা দিন।কাজলকে চাঁদ দুচোখে দেখতে পারেনা।কালো গায়ের রং আর এতো মোটা যে কেউ দেখলে প্রথমে দানব ভেবে ভুল করবে।তিলোত্তমা,চাঁদের ছোট চাচি ভাইকে নিজের কাছে এনে রেখেছে।কি আহ্লাদ! যেনো ছেড়ে দিলে বাঘে খাবে।
কাজল এবাড়িতে আসার আগে আজ থেকে চার বছর আগে তার সাত মাসের অন্তসত্তা স্ত্রী মারা গিয়েছিল পুকুরে ডুবে।গ্রামের সবাই ধারণা করেছিল ঐটা খুন।আর সন্দেহের তালিকায় ছিলো কাজল।তারপরই হঠাৎ করে একদিন নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে হাজির হয় কাজল।তিলোত্তমা তো নিজের ভাইকে পেয়ে অনেক খুশি। এই যে কাজল ঘাঁটি পাতলো।আজ চারবছর সে এখানে।তার লোলুপ দৃষ্টি সবসময়ই ছিল চাঁদের উপর।চাঁদের গায়ের প্রতিটা ভাঁজে নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে সর্বদা প্রস্তুত যেন সে।একরাতের জন্য না এই মেয়েকে তো তার সারা জীবনের জন্য চাই।তিলোত্তমাকে এখনো জানানো হয়নি।জানালে অবশ্য বোন রাজি হবে বলেই তার বিশ্বাস।তবে মেয়ে যেহেতু ছোট তাই আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা দরকার।কাজলের বয়স বেশি নাকি।মাত্র ৩৫ হলো।
চাঁদ দুলি-মুলিকে খাবার খাওয়াচ্ছিলো।আর দূর থেকে কাজল ধুরী দিঘীর পাশে বটগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো চাঁদকে।এটা মেয়ে না।এটা একটা আগুনের গোলা।গায়ে যেনো কারেন্ট খেলে গেলো তার।এভাবে আর কয়দিন নিজেকে ধরে রাখবে কাজল।
!!৩৫!!
বাড়িতে মেহমান আসা শুরু করেছে।উঠানে বাঁশ আর প্যান্ডালের কাপড় রাখা।কাল বাদে পরশু প্রমার হলুদ।যেহেতু বাড়ির একমাত্র মেয়ে তাই বড়সড় করে আয়োজন করবে মতিন।কোনো কিছুতে কমতি রাখা যাবেনা।কয়েকদিন আগে মতিন,প্রমা আর মোহনা মিলে ঢাকা গিয়ে কেনাকাটা করে এসেছে। মোহনার ঠোঁটের হাসি যেন সড়ছেই না।মেয়ের বিয়ে বলে কথা।আবার অপরদিকে দুঃখ লাগে মেয়েটা বিয়ের পর চট্টগ্রাম চলে যাবে।সিফাতের পোস্টিং সেখানে।
চাঁদের ডাক পড়লো।তিলোত্তমা ডাকছেন।এই কয়েকদিনে গাঁধার মতো খাঁটিয়েছে চাঁদকে।সবাই দেখেও যেনো দেখেনা।কেউ কিছু বলেও না।আনোয়ারা মাঝেমাঝে সাহায্য করতেন চাঁদকে।চাঁদ যখন স্কুলে থাকে সে যেন মায়ের পেটে থাকে।বাড়িতে আসলেই কেবল কাজ আর কাজ।
প্রমার বিয়ের জন্য তো এই সপ্তাহে আর স্কুলে যাওয়াও হবেনা।
-ছোট মামি ডাকছিলে।
-এতোক্ষণ লাগলো কেন?সে কখন ডাকছি আমি।খালি কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা।এই যে মুখপুড়ি যা গিয়ে বাজার থেকে দশকেজি তেল নিয়ে আয়।আর এককেজি লবণের প্যাকেট আনবি পাঁচটা।লতিফের দোকানে গিয়া আমার কথা বললেই দিবে।
-দিমারে নিয়ে যাই ছোটমামি।
-কেন?দিমা যাইবো কেন?তুই নিয়া আয়।
-এতোগুলা আমি একা কেমনে আনবো?
-সেসব আমি জানিনা। আনতে বলছি আনবি।
চাঁদ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে মেঠোপথে হাঁটা শুরু করলো।মেইন রোডে অনেক মানুষ তাই এই পথ দিয়েই যাবে।সামনেই বাজার।তবে তার মতো একটা মেয়ে কিভাবে এতো কিছু আনবে।চাঁদের মনে মনে আফসোস হলো তার বন্ধু জুবায়ের, পাটকাঠি পাশের গ্রামে ফুটবল খেলতে গেছে।নয়তো তাদের সাহায্য নিতো।আর তমালকে তো ঢাকায় একটা মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছে তার বাবা।যেদিন চলে যাচ্ছিল সেদিন কি কান্না ছেলেটার।
পচুকে পেলেও তো হতো।ধ্যাত বলে আরো জোরে হাঁটা দিলো চাঁদ। বাজারে লতিফের দোকানে এসে ছোটমামির কথা বলতেই ইয়া বড়ো এক বস্তা ধরিয়ে দিলো দোকানদার লতিফ। চাঁদ পড়লো মহা চিন্তায়।এই বস্তা তো সে তুলতেই পারছেনা।বাড়ি নিবে কি।
-বাজারে কি?
হঠাৎ পরিচিত সে কন্ঠে পিছনে ফিরে তাকালো চাঁদ। আর চোখ দুটো স্থির হয়ে গেলো তার।আবির ভাই দাঁড়িয়ে। সাদা শার্ট আর কালো জিন্স প্যান্টে যেনো হিরো লাগছে।সানগ্লাসটার উপর রাগ হলো চাঁদের। আবির ভাইয়ের চোখগুলো ঢেকে রেখেছে। পঁচা সানগ্লাস।
-কি হলো?ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেনো।বাজারে কি তোর?
-ছোটমামি পাঠিয়েছে।
-চাচির কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। এতো মানুষ থাকতে তোকে পাঠালো।হাতে কি এটা।এই বস্তা তোকে নিতে পাঠিয়েছে?
গলার আওয়াজটা যেনো বেড়ে যাচ্ছিলো আবিরের।চাঁদ এবার খানিকটা ভয় পেলো।আবির নিজের ব্যাকপ্যাকটা আর সানগ্লাসটা চাঁদের হাতে দিয়ে বস্তাটা উঠিয়ে দুইহাতে নিলো।চাঁদ বাঁধা দিতে চেয়েছিল।এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।সারা রাস্তা দুজনে কোনো কথা বললোনা।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে উঠানে যেতেই মোহনা দৌঁড়ে এলো।
-আব্বা,তুমি আনতা গেলা কেনো?কাজল ভাইরে নয়তো জমাল রে বললেই তো এনে দিতো।
-মা, আগে এটা বলেন চাচির কি এইটা আনানোর জন্য চাঁদকে পাঠানো উচিত হয়েছে?
-তিলো চাঁদকে পাঠাইছিলো?
-জ্বি।এই বাড়ির মেয়ে চাঁদ। ও কি এই বাড়ির কাজের বুয়া।চাচি কেন এমন করে?
-আমি জানতাম না আব্বা।জানলে না করতাম।
উঠোনে অনেক লোকজন আবির আর কথা বাড়ালোনা।হনহন করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো।চাঁদও চললো তার পিছুপিছু। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় মাথা চেপে বসলো আবির।এখনই এই অবস্থা। ও বিদেশ গেলে কে দেখবে চাঁদকে।আবির মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলো নিজে যাওয়ার কিছুদিন পর এসেই চাঁদকেও সাথে করে নিয়ে যাবে।
!!৩৬!!
-আবির ভাই।
চাঁদের ডাক শুনে আবিরের কি যেনো হলো।দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো চাঁদকে।চাঁদ হতভম্ব।তার হাত থেকে আবিরের ব্যাগপ্যাকটাও পড়ে গেলো।তার কানে বাজছে আবিরের বুকের আওয়াজ ধুকপুক ধুকপুক।
দরজার শব্দে আবির ছেড়ে দিলো চাঁদকে।হাওয়ায় দরজা নড়ছিলো।আবির এবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চাঁদের মুখের দিকে।এই মুখটা দেখার জন্য ঢাকায় প্রত্যেকটা রাত ছটফট করতো সে।ছবি দেখলে কি আর মন মানে।
-আবির ভাই।
আবির এবার বললো,
"এতো মায়া এতো শান্তি এতো সুখ কেনো পাই তোমায় দেখলে?"
চাঁদ চুপ। কি বলবে সে।মতিনের ডাকে হুঁসে আসলো আবির।নিচ থেকে আবিরকে ডাকছেন।আবির -আসছি বাবা।
বলে আবার নিচে চলে গেলো।চাঁদ তখনো দাঁড়িয়ে। এটাই ভালোবাসা।আবির ভাই তাকে ভালোবাসে।এবার শুধু স্বীকারোক্তি বাকি। সেও যে আবির ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছে। নানুমা যে ছটফটানির কথা বলেছিল। তা এই কয়েকদিনে খুব টের পেয়েছে চাঁদ।চাঁদের গালগুলো লাল হয়ে গেলো।হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো সে।ইস্,কি লজ্জা!
.
.
.
চলবে.................................