পদ্মপাতা - পর্ব ২১ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!৬১!!

ফজরের আজান দিচ্ছে চারপাশে। ভোরের আলো এখনো ফুটেনি। চাঁদ ঘুম থেকে উঠে আবিরের ঘুমন্ত মুখপানে চেয়ে রইলো। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল। অতঃপর দৌড়ে চলে গেলো নিজ ঘরে। আবির ভাইটা না ভিষণ পঁচা। কিসব করলো তার সাথে। ইস্, কি লজ্জা! 

বেলা দশটা বেজে পনেরো মিনিট। আবির কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। আসলে কিছু ঘটনা মানুষের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটে। গতকালকের রাতটাও তাই। তবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে বিপজ্জনক কিছু ঘটতে পারে। চাঁদ ছোটো বুজবে না। কিন্তু সে তো বড়। নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত আবির। দুপুরে রওনা দিবে সে। তবে এখন তার একটু বাজারে যাওয়া প্রয়োজন। 

চাঁদ লজ্জায় আবিরের সামনে যায়নি। সকালে গোসল করে খেয়ে আমবাগানে বসে আছে। বাজার থেকে ফিরে আবির খুঁজলো চাঁদকে। মেয়েটা যে কই গেলো। এদিকে সময়ও হয়ে যাচ্ছে। তাকে রওনা দিতে হবে। মোহনা দুপুরে বিভিন্ন রকমের রান্না করলেন, পিঠা বানালেন। ডাইনিং টেবিলে সবাই থাকলেও চাঁদ নেই। আবিরের খাবার গলা দিয়ে নামছেনা। চাঁদকে যে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেওয়া প্রয়োজন। নয়তো সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। চাঁদ সেই যে আমবাগানে বসেছে আর বাড়ি ফিরেনি। এতোক্ষণ লজ্জা লাগলেও এবার তার বিষাদ লাগছে। আবির তাকে ছেড়ে চলে যাবে। এমন সময় পচুর গলা পেলো চাঁদ।
-চাঁপু। এই চাঁপু।
-কি হইছে পচু।
-আবির ভাই ডাকে। ঢাকা চইলা যাইতাছেন।
-উনি না আরো পরে যাবেন।
-কি জরুরি কাজ নাকি পরছে। তুমি চলো।
-আচ্ছা, যা আমি আসছি।

কষ্টে কালো হয়ে গেলো চাঁদের মুখ। ভালোবাসার মুহূর্তগুলো এতো অল্প কেনো!

গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আবির। সবাই এখানে আছে। দিমা,রুমা,মোহনা,তিলোত্তমা, করিম,মতিন,আনোয়ারা, রহিমা,পচু। তবে আবিরের কাঙ্খিত মুখটা যে নেই। বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসছে চাঁদ। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। আবির আসছি বলে সেদিকে এগিয়ে গেলো। মোহনা কাঁদছেন তিলোত্তমা আর আনোয়ারা তাকে সামলাচ্ছে। 
-কোথায় যাচ্ছো?
মতিনের ভিজে গলা। একমাত্র ছেলে বিদেশ যাচ্ছে। মতিনের মতো শক্ত ব্যাক্তিও আজ নরম হয়ে গিয়েছেন
-ঘরে একটা জিনিস ফেলে এসেছি।
-আচ্ছা, যাও।

গেটের বাইরে সবাইকে রেখে ভিতরে ঢুকে গেলো আবির। চাঁদকে টেনে নিয়ে গেলো গাব গাছটার পিছনে। অতঃপর জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার পরশ দিলো কপালে। 
-কাদঁছিস কেনো বোকা মেয়ে। মোবাইলে কথা বলবো তো।

চাঁদের কান্না তবুও থামেনা।
-জান কাঁদে না। এভাবে তোকে রেখে গেলে যে আমি যন্ত্রণায় মরে 

চাঁদ আবিরের মুখে হাত রাখলো। বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারলোনা সে। চাঁদের চোখে ঘোর বর্ষা।

-চাঁদ। এই প্যাকেটে একটা ঔষধ আছে খেয়ে নিবি কেমন। আর একটা চেন আছে। পরে নিস তুই। এখন সময় নেই নয়তো আমি পরিয়ে দিতাম। বিবাহিত মেয়েদের গলা খালি রাখলে মানায় না বুঝলি পাখি।

চাঁদ মাথা নাড়লো। তার প্রচুর পেট ব্যথা করছিলো। এটা বোধহয় ব্যথার ঔষধ। আবির ভাই তাকে নিয়ে কতো ভাবে। কথাটা ভাবতেই আরো কেঁদে দিলো চাঁদ। আবির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। তারও যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আবির গেটের বাইরে বেরিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বাবাকে। সবার সাথে কথা শেষে রিকশায় চড়ে চলে গেলো আবির। চাঁদ এতোক্ষণ না আসলে পরে দৌড়েঁ এলো। তবে ততক্ষণে আবিরের রিকশা অনেক দূর চলে গিয়েছে। দিমা আবিরের হাতে একটা প্যাকেট দেখেছিলো। এখন সেইটা চাঁদের হাতে।

!!৬২!!

-তোর হাতে কিরে চাঁদ?

দিমার প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলো চাঁদ।

-ঔষধ। 
-কিসের? দেখিতো।
-দেখার দরকার নেই। 

দিমার এবার জেদ চাপলো। নির্ঘাত এর ভিতরে আবির কিছু দিয়েছে চাঁদকে। দিমা টানাটানি শুরু করে দিলো চাঁদের সাথে। পাশেই ছিলো শতবছরের পুরানো চৌধুরী বাড়ির কূয়া। সেই কূয়ায় পরে গেলো প্যাকেটটি। চাঁদ ছলছল চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। 
-সরি রে চাঁদ। দেখিনি আমি।
চাঁদ কথা না বলে দৌঁড়ে ঘরে চলে গেলো। তার মেজাজ বড্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে। রাতে আবির কল করলো। কথা বলার এক পর্যায়ে বললো,

-ঔষধ খেয়েছিলি তুই?

চাঁদ খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছে। এখন সত্যিটা বললে নির্ঘাত আবির তাকে বকবে।

-কি হলো বল?
-খেয়েছি। 

আবির যেনো শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। পিল না খেলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করতো চাঁদ। বুক থেকে একটা পাথর নামলো আবিরের। 
__________________
আবির লন্ডন গিয়েছে আজ প্রায় দুমাস হলো। ফোনে কেবল রাতে কথা হয় চাঁদের। চাঁদের যে মোবাইল আছে বাড়ির কেউ জানেনা। কারন চৌধুরী বাড়িতে এইচএসসি পরীক্ষার আগে মোবাইল চালানো নিষেধ। 

চাঁদের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। চাঁদ জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। বেজায় খুশি চাঁদ। তবে শরীরটা আজকাল ভালো যায়না চাঁদের। খালি ক্লান্তি আর অবসাদ। মোহনার ডাকে উঠানে যায় চাঁদ।
-বলো বড়মামি।
-এই আচারের বৈয়াম খালি করলো কে কিছু জানিস? কতগুলো আচার ছিলো। কোনো চোর টোর ঢুকলো নাকি বাড়িতে। 

চাঁদ ঢোক গিলে বললো,
-কি জানি আমি তো জানিনা।

কিন্তু চাঁদ যে এই আচারগুলো শেষ করেছে বড়মামি জানলে নির্ঘাত বকবে। তার শখের আচার। ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করতে পারে।  

!!৬৩!!

পরশুদিন কলেজে ভর্তি হবে চাঁদ। মতিন ঢাকা গিয়েছেন। নয়তো কালই ভর্তি হতো চাঁদ। রুমা বাসায় নেই। বাড়িতে তিলোত্তমা, মোহনা আর দিমা। আনোয়ারা পাশের বাসায় গিয়েছেন। কাজলের বেল হয়েছে। তিনদিন হলো বাড়িতে। চাঁদের বড্ড অস্বস্তি লাগে। কিভাবে যেনো তাকিয়ে থাকে কাজল। কি হিংস্র চাহনি। গাঁ ঘিনঘিন করে উঠে চাঁদের। 

সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠে চাঁদের। লুটিয়ে পরে নিচে।

চোখ খোলার পর নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে চাঁদ। তাদের গ্রামের হাতিম ডাক্তার এসেছিলেন। তিনি যা বললেন তাতে মোহনা আর তিলোত্তমা অবাক।

উঠে বসার সাথে সাথে গালে একটা চড় পড়লো চাঁদের। মোহনা মেরেছেন। এই মেয়েটাকে প্রথমে পছন্দ না করলেও এতোগুলা বছরে কখনো অনাদর করেন নি। চাঁদ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তিলোত্তমা চাঁদের মোবাইলটা খুঁজে পেয়ে ধুরী দিঘীতে ফেলে দিয়েছেন।

-আমি প্রথমেই বলছিলাম বুবু। এই মাইয়া অলক্ষী। এবার হইলো তো।

দিমাও তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। মোহনা শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, 
-বাচ্চা কার? 

চাঁদ অবাক হয়ে বললো, 
-কোন বাচ্চা? 
সাথে সাথে আরেকটা চড় পড়লো চাঁদের গালে। এবারেরটা তিলোত্তমা দিয়েছেন। 
-এই মা* এমনে কইতো না। দিমা যাতো কেঁচি নিয়ায়। এর দেমাগ কমামু।

চাঁদ হকচকিয়ে যায়। 
-তিলো চুপ কর। ওকে জবাব দিতে দে। কি হলো বল বাচ্চা কার?

চাঁদ হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে থাকে। সে কি বলবে এই বাচ্চা আবিরের। 

-কি হলো বল?

তিলোত্তমা এবার রাগে লাঠি নিয়ে পিটানো শুরু করেন চাঁদকে। চাঁদ ব্যথায় মাগো বলে চিৎকার করছে তবে কেউ তাকে ধরার জন্য এগিয়ে এলোনা। ব্যথায় অসহ্য হয়ে চাঁদ বললো,
-আবির ভাইয়ের।

চাঁদের মুখ ফুটে কথাটা বলতে দেরি আর মোহনার চড় দিতে দেরি হলোনা। 
-ছি ছি শেষ পর্যন্ত আমার ছেলের ঘাড়ে চাপালি।

তিলোত্তমা এই সুযোগে কেঁচি নিয়ে এলেন। চাঁদের চুলের মুঠি ধরে বললেন,
-কার না কার কুকর্মের ফল আমাদের ছেলের উপর চাপাচ্ছিস। মা*, পতিতা।

দিমার যেনো খুব আনন্দ হচ্ছে। চাঁদের গৌরবর্ণ মুখ মারের আর রক্তের দাগে কালো হয়ে গিয়েছে। সে পৈশাচিক তৃপ্তি পাচ্ছে। চাঁদ তার চেয়ে কালো হয়ে গেলে সে মসজিদে বিশ টাকা দিবে বলে নিয়ত করে। যা বুঝা যাচ্ছে চাঁদের চুলগুলোও আজ যাবে। আবিরকে দিমা না পাক তবে চাঁদের রূপের ধ্বংসে সে পায় প্রশান্তি। 

তিলোত্তমা কেঁচি দিয়ে চাঁদের গোড়ালি পর্যন্ত বিস্তৃত চুলগুলো কেটে দেন। নিমিষেই কাঁধ বরাবর হয়ে যায় চুলগুলো। চাঁদ এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায়। এই চুলগুলো যে আবিরের বড্ড পছন্দের ছিলো। ঘরে অজ্ঞান অবস্থায় আটকে রাখা হয় চাঁদকে।

কাজল যেনো এমন একটা মুহূর্তেরই অপেক্ষা করছিলো। মোহনাকে চিন্তিত দেখে কাজল বলে,
-ভাবি একখান কথা কইতাম।
-কি বলবে কাজল।
-আপনার কি মনে অয় আবির এই কামডা করছে।
-জীবনেও না। আমি এই ব্যাপারে আবির আব্বারে কিছু বলবোনা। তোমরাও বলোনা। ছেলেটা পড়তে গেছে। আর এরমাঝে এইসব আব্বার মাথায় দিয়া লাভ নাই। ঐ অলক্ষী ভুলে গেছে আমার আব্বায় তারে বোন হিসেবে কতো আদর করতো।
-সবই স্বার্থপর ভাবি।মতিন ভাইরে কিছু জানাবেন।
-আপাতত না।
-আমার একটা প্রস্তাব আছিলো।
-কি?
-আমি চাঁদেরে বিয়া করমু।
-এসব তুমি কি বলো!
-আপনি ঠান্ডা মাথায় ভাবেন ভাবি। আপনেরে যে কইতে পারে বাচ্চা আবিরের সে অন্য মাইনসেরে কইতোনা তার কোনো গ্যারান্টি আছে। সম্মান কইলাম আপনের আর ভাইয়ের যাইবো। আমরা তো জানি আবির পোলা ভালা। তবে গেরামের মাইনষে তো তা বুঝতো না। আমার সাথে বিয়া দেন আজকা রাইতে। কালকা গিয়া চাঁদপুর হসপিটালতে বাচ্চা ফালায় দিয়া আমু।
-তাহলে তাই হোক।

ঈষৎ হাসলো কাজল। হিংস্র বাঘেরা যেমন ঝোঁপের আড়ালে ঘুপটি মেরে থাকে। কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষা করে। আর সময় আসলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ হরিণীর উপর কাজলেরও তাই। সে এতোদিন কেবল সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো। যা আজ এসে গিয়েছে। কাজল হেসে হেসে বিড়বিড় করে,
-এবার তোমার দেমাগ কমামু সুন্দরী। 
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন