বর্ষণের সেই রাতে - পর্ব ৪৬ - সিজন ২ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


মানুষের জীবনে হঠাৎ এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায় যার জন্যে মানুষ আগে থেকে প্রস্তুত থাকেনা। নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকেও তখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনা। নিজের ওপরই জন্ম নেয় চরম অবিশ্বাস। সেটা নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষের চলে যাওয়া হোক বা নিজের কোন কাছের মানুষের একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ফিরে আসা হোক। মর্গের ভেতরে ঢুকে ওর চোখ সামনে পরতেই হাসান কোতয়ালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে অনিমা। প্রায় পাঁচ বছর আগেই যার মৃত্যু হয়েছে সেই মানুষটাকে নিজের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যে কেউ চরমভাবে অবাক হবে। আর সেটা যদি হয় নিজের বাবা, তাহলে মনের অবস্থা কীরকম হয় সেটা কল্পনা করাটাও দুঃসাধ্য। অনিমাও তখন এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি। নিজের চোখের সামনে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখার পর আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। চোখ ঝাপসা হওয়ার সাথেসাথেই শরীরটাও ছেড়ে দিল। অনিমা পরে যেতে নিলেই সাথে সাথে একজোড়া হাত ওকে ধরে ফেলল। অনিমা পুরোপুরি নিজের জ্ঞানে নেই। কিন্তু অতি পরিচিত সেই স্মেল পেয়ে অনিমা কেঁপে উঠল। ও চোখ তুলে সামনে তাকালে ওর চোখ স্হির হয়ে গেল। আদ্রিয়ান ওকে পরম যত্নে দুইহাতে আগলে রেখেছে। ওর আদ্রিয়ান বেঁচে আছে? কিচ্ছু হয়নি তাঁর। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান ওর সামনে। অনিমার কাছে এখন সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কেমন যেন সব ঘোরের মত। যা দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ আগে নিজের বাবাকে দেখতে পেল আর এখন ও নিজের স্বামীর বুকে আছে। অথচ দুজনেই পৃথিবীর চোখে মৃত। এটা তাহলে ভ্রম ছাড়া আর কী? ভ্রম হোক আর যাই হোক মানুষটাকে দেখতে তো পারছে। ও এই ভ্রমের মধ্যেই থাকতে চায়। সারাজীবন, অনন্তকাল। অনিমা আদ্রিয়ানকে ছাড়িয়ে নিয়ে আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকাল। ওর মনে হচ্ছে কতযুগ পরে দেখতে পেলো মানুষটাকে। চোখভর্তি জল নিয়ে আস্তে করে আদ্রিয়ানের গালে হাত রাখল। সাথেসাথেই সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেল ওর। এমন মনে হচ্ছে যেন এই মানুষটাকে ছুঁতে পেরে ওর জীবন ধন্য হয়ে গেল। এ স্পর্শ নয় যেন অমৃত। আদ্রিয়ানের দৃষ্টিও অসহায়। ও শুধু নিজের মায়াবিনীর এরকম বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখছে। আদ্রিয়ানে অনিমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

" জানপাখি।"

অনিমা দ্বিতীয়বার কেঁপে উঠল। 'জানপাখি' শব্দটা যেন কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ও ফুপিয়ে কেঁদে উঠল সাথেসাথেই ঝাপিয়ে পরল আদ্রিয়ানের বুকে। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল। এখন আর আদ্রিয়ানকে ছাড়া যাবেনা। একদমই না। যদি আবার হারিয়ে যায়? আদ্রিয়ান অপরাধী দৃষ্টিতে অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে। তারপর বলল,

" এই বোকা মেয়ে! এভাবে কাঁদছো কেন? দেখো, এইতো আমি। একদম ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার। তাকিয়ে দেখ। একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি। নিজের কী অবস্থা করেছ দেখেছ? এরকম করে কেউ? "

কথাগুলো বলতে বলতে অনিমার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিল আদ্রিয়ান। অনিমার সেদিকে কোন খেয়াল নেই ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আদ্রিয়ানকে আর জোরে জোরে কেঁদে চলেছে। উপস্থিত সকলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পরেছে। ভালোবাসাময় এরকম দৃশ্য যেন দেখে চোখ সার্থক করছেন ওনারা। রিক শুধু তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। ওর চোখ টলটল করছে কিন্তু ঠোঁটে মুচকি হাসি। আজ আদ্রিয়ান ফিরে না এলে অনিমা শেষ হয়ে যেত, যেটা রিক সহ্য করতে পারতো না। অন্তত এই তিনদিনে ও ভালোভাবে বুঝে গেছে যে আদ্রিয়ান ছাড়া অনিমা নিঃস্ব, একেবারেই নিঃস্ব। আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

" জানপাখি, ওদিকে দেখ?"

অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখেই আদ্রিয়ানের ইশারা করা দিকে আস্তে আস্তে তাকাল। তাকিয়ে দেখে হাসান কোতয়াল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। উনি এতক্ষণ প্রাণভরে নিজের মেয়েকে দেখছিলেন। ওনারা ছুটে বেড়ানো সেই চৌদ্দ বছরের মেয়েটা আজ কত ম্যাচিউর হয়ে গেছে। একটা ছেলেকে কতটা ভালোবাসতে পেরেছে। কতটা ভালোবাসল কারো জন্যে এরকম আহাজারি করা যায়। অনিমার এতক্ষণ মস্তিষ্কে ধাক্কা লাগল যে হ্যাঁ এখানে এসে প্রথমে ওর বাবাকেই দেখেছিল। কিন্তু সবটাই আবছা মনে হচ্ছিল সবটাই ভ্রম মনে হচ্ছিলো ওর কাছে। কিন্তু এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ও অবাক চোখে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান চোখের ইশারায় বোঝাল ও যা দেখছে সেটা সত্যি। সত্যিই ওর বাবা ওর কাছে ফিরে এসছে। হাসান কোতয়াল অনিমার দিকে এগিয়ে এলেন। অনিমার কাছে এসে ছলছলে নয়নে তাকিয়ে রইলেন নিজের মেয়ের দিকে। অনিমা আদ্রিয়ানকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসান কোতয়ালের দিকে সিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসহায় কন্ঠে ডেকে উঠল,

 ''আব্বু।''

হাসান কোতয়াল এক মুহূর্ত দেরী না করে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলেন নিজের মেয়েকে। অনিমা নিজের বাবাকে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। যখন নিজের বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিল তখন ওর কী অবস্থা হয়েছিল শুধু ও-ই জানে। ভাবতেও পারেনি আবার কোনদিন মানুষটার বুকে মাথা রেখে ও কাঁদতে পারবে। ও এখন কিচ্ছু বলতে চায়না। কিচ্ছূ জিজ্ঞেস করতে চায়না। ও ওর বাবাকে ফিরে পেয়েছে ওর এতেই চলবে। হাসান কোতয়ালও কাঁদছেন। কতদিন পর নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এই দিনটার জন্যে কতদিন যাবত অপেক্ষা করে ছিলেন। আজ ওনার বেঁচে থাকা স্বার্থক হল।

___________

আদ্রিয়ানের বাড়ির ড্রয়িংরুমে ছোটখাটো ভীর হয়েছে। অনিমা গুটিয়ে হাসান কোতয়ালের বুকের সাথে মিশে বসে আছে সোফায়। অনেক বড় একটা বিষাদের মুহূর্ত পার করল এই পরিবার। বাড়ির ছেলেটাতো অলমোস্ট সবার চোখে মরেই গেছিল। তবে আদ্রিয়ানকে কেউ এখনো কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। ও কোথায় ছিল?.এরকম কেন করল? হাসান কোতয়ালই বা এতক্ষণ ওর কাছে কীকরে এলো? এই সব প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেলেও আপাতত আদ্রিয়ান ফিরে এসছে এটাই তাদের কাছে অনেক। এগুলো জানার জন্যে সময় পরে আছে। যেখানে আদ্রিয়ানকে ওনারা মৃতই ভেবে ফেলেছিল সেখানে যে ও ফিরে এসছে এটাই কম কী? সাংবাদিক‍দের কানেও খবর পৌঁছে গেছে আসার পথে ঝেকে ধরেছিল। কিন্তু পুলিশ সরিয়ে দিয়েছে। আদ্রিয়ানের বাড়িতেও এলাও করা হয়নি কাউকে। তবে এসবের মধ্যে নতুন তথ্য পাওয়া গেল। সেটা হচ্ছে মানিক আবরার আর হাসান কোতয়াল ভার্সিটি লাইফের খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু ভার্সিটির শেষে কোনকারণে ওনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে ওনার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন মানিক আবরার। আজ বন্ধুকে জীবিত দেখে উনিও খুশি। দুই বন্ধুর আবেগ মিশ্রিত মিলনও হল এই বাড়িতে আজ। মিসেস রিমা এখনও আদ্রিয়ানকে জাপটে ধরে আছে। ছাড়ার নামই নিচ্ছেনা। আদ্রিয়ান অসহায় কন্ঠে বলল,

'' মা। এবার কান্না থামাও আর আমায় ছাড়ো। পুলিশ স্টেশনে তোমার বর জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে, আমার এই ভাই আর বন্ধুনামক গাধাগুলো একসাথে যেভাবে ধরেছিল। প্লেন ক্রাশে না মরলেও আরেকটু হলে এদের চাপে পরে দম বন্ধ হয়ে শিওর মরতাম। বাড়িতে আসার পর তোমার ছিচকাঁদুনে মেয়ে কেঁদেছে। আর তোমার বউমার কথাতো ছেড়েই দাও। এখন তুমিতো ছাড়ো। বেঁচে আছি আমি।"

মিসেস রিমা ছেড়ে ধমক দিয়ে বলল,

" এবার কিন্তু ঠাটিয়ে একটা মারব বলে দিচ্ছি। এভাবে জ্বালিয়ে কী মজা পাস তুই?"

এবার আদিব, আশিস সবাই মিলে ওকে ঝাড়া শুরু করল। আদ্রিয়ান অসহায় বালকের মত সবার ঝাড়ি শুনে যাচ্ছে। রিক বলল,

" সত্যি বলছি ভাই! এই তিনদিন এখানে কী গেছে তুমি ভাবতেও পারবেনা।"

আদ্রিয়ান ধমকে বলে উঠল,

" চুপ কর গাধা। তোকে ওকে নিয়ে মর্গে আসতে কে বলেছিল? ওখানে ওয়েট করা যেতোনা? আরেকটু হলেই তো আমার বউটা হার্ট ফেইল করত।"

রিক মুখ কাচুমাচু করে বলল,

" তখন অতকিছু মাথায় ছিলোনা।"

মানিক আবরার বললেন,

" তা ঐ হতচ্ছাড়া নাহিদ কই।"

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,

" হতচ্ছাড়া বিকেলে আসবে।"

" অভ্র কোথায়?"

" রাগ করে ফ্লাটে চলে গেছে। চিন্তা করোনা বিকেলের মধ্যেই সুরসুর করে চলে আসবে।"

জাবিন এবার একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
  
" কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী খুলে বলবি আমাদের? কী হয়েছিল যে এমন করলি? আর আঙ্কেল তোর কাছে কীকরে এল? আর এতোদিনই বা কোথায় ছিল।"

আদ্রিয়ান কিছু বলার আগেই মিসেস রিমা বললেন,

" এখন না। পরে সব শুনবো। এখন যা রুম গিয়ে রেস্ট কর। অনিকে নিয়ে যা। তিনদিন যাবত ঠিককরে কিছু খাচ্ছেনা। তাকিয়ে দেখ এখনো ঠিক নেই ও।"

সবাই তাকিয়ে দেখল আসলেই অনিমা এখনো স্বাভাবিক নয়। একদম চুপচাপ লেপ্টে আছে হাসান কোতয়ালের বুকে। বোঝাই যাচ্ছে এখনো ও ঘোরের মধ্যে আছে। হাসান কোতয়াল মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,

" মামণী? চুপ করে আছো কেন এভাবে?"

অনিমা কিছু না বলে আরও গুটিয়ে গেল হাসান কোতয়ালের বুকে। আদ্রিয়ান উঠে এসে অনিমার সামনে বসে বলল,

" মিস্ট... মানে আঙ্কেল এখানেই আছেন। কোথাও যাবেনা। এখন রুমে এসো। ইউ নিড রেস্ট।"

অনিমা না বোধক মাথা নাড়ল। হাসান কোতয়াল অনিমাকে আশ্বস্ত করে বললেন,

" আমি এখানেই আছি মা তুমি যাও।"

" সত্যিই যাবেনা তো? প্রমিস কর?"

হাসান কোতয়াল মেয়ের বাচ্চামো দেখে হেসে দিয়ে বললেন,

" প্রমিস। এতকষ্ট করে এসছি তোমাকে ছেড়ে যেতে না-কি? এখন রুমে যাও।"

বাবার অনুমতি পেয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল ওনাকে। ওনার দিকে স্হির চোখে তাকাতেই উনি আবারও আশ্বস্ত করলেন উনি এখানেই আছেন। মানিক আবরার হাসান কোতয়ালকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

" তুইও চল খেয়ে রেস্ট করবি। পরে সব কথা হবে।"

আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে ওর রুমে চলে গেল। অনিমা আদ্রিয়ানে গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশে রইল। আদ্রিয়ান হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন উপলব্ধি করছে ও। আদ্রিয়ান আরো ভালোভাবে মিশিয়ে নিল অনিমাকে নিজের সাথে। পরম শান্তিতে আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে নিল অনিমা। এর চেয়ে সুখের অনুভূতি হতেই পারেনা। এভাবেই যেন অনন্ত কাল পার করে দিতে পারবে ও। এই বুকে মাথা রাখতে পারলে ওর আর কিচ্ছু চাইনা। কিচ্ছু না।
.
.
.
চলবে.............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন