আকাশটা বেশ পরিষ্কার। কয়েকদিন টানা বর্ষণের পর আজ রৌদ্রজ্জ্বল সকালের দেখা মিলেছে। চারপাশের ভেজা সবুজ প্রকৃতিতে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। এই বিশুদ্ধ বাতাসে চোখ বন্ধ করে প্রাণখুলে নিশ্বাস নেওয়া যেতে পারে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। অনিমা গোসল করে ছাদে এসে ওর আর আদ্রিয়ানের ভেজা পোশাকগুলো শুকানোর জন্যে মেলে দিল। ওর আগে আদ্রিয়ান গোসল করেছে। পোশাক মেলে দিয়ে অনিমা চুল মুছতে মুছতে রেলিং এর পাশে এসে দাঁড়ালো। টাওয়েল টা রেলিং এ মেলে দিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকাল। নিজেকে বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন ওর। এই কটা দিন আদ্রিয়ানকে ছাড়া খুবই বাজে কেটেছে। কিন্তু কাল রাতে এতোদিন পর আদ্রিয়ানের বুকে ঘুমোতে পেরে এখন শান্তি অনুভব করছে। তখনই পেছন থেকে কেউ ওকে জড়িয়ে ধরে ভেজা চুলে মুখ গুজে দিল। অনিমা শিউরে উঠল। আদ্রিয়ানের স্পর্শ চিনতে ওর একটুও দেরী হয়নি। ও চোখ বন্ধ করে বলল,
" রকস্টার সাহেব, এটা আপনার বাড়ি না। কেউ চলে আসবে, ছাড়ুন।"
আদ্রিয়ান অনিমার চুলে মুখ গুজে রেখেই বলল,
" আসুক! কেন ছাড়বো? আমার মোটেও ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা।"
অনিমা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে নিজেই ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু আদ্রিয়ান আরও শক্ত করে ধরে বলল,
" জানপাখি! এতো ছটফট করোনা। আ'ম ইনজয়িং দিস। তোমার চুলের স্মেলটা দারুণ!"
" ওটা চুলের না শ্যাম্পুর স্মেল।"
" উমহুম। এটা তোমার চুলের স্পেশালিটি। তোমার চুলের স্পর্শ পেয়েই শ্যাম্পুটা এতো সুন্দর স্মেল দিতে পারে। আমার বউ বলে কথা।"
অনিমা হেসে কুনুই দিয়ে আদ্রিয়ানের পেটে একটা গুতো মারল। আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে অনিমাকে ছেড়ে দিল। অনিমা ঘুরে তাকাকেই আদ্রিয়ান একহাতে ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিল। অনিমা মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাল। একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে, ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, যার অনেকটাই কপালে ভর্তি। অনিমা হাত দিয়ে আদ্রিয়ানের ভেজা চুলগুলো নেড়ে দিল। আদ্রিয়ান হাসল। অনিমা আদ্রিয়ানের দু-কাধে হাত রেখে বলল,
" সবসময় এমন চিল মুডে কীকরে থাকেন?"
আদ্রিয়ান এবার মুখ হালকা গম্ভীর করে বলল,
" আর চিল! আমার সব চিল করা বিকেলেই শেষ হয়ে যাবে। বিকেলবেলা চলে যেতে হবে।"
এবার অনিমার মুখেও হালকা আঁধার নেমে এলো। ও সামান্য অসহায় কন্ঠে বলল,
" বিকেলেই চলে যাবেন?"
" হ্যাঁ ! কীকরে থাকবো? তোমার আব্বুতো পারলে আমাকে এক্ষুনি পাঠিয়ে দেয়। আরে আমি এ বাড়ির জামাই। কোথায় বলবে এসছো আরও দুটো দিন থেকে যাও। তা-না, বলে কি-না কখন যাচ্ছো? এসবের মানে হয়?"
অনিমা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
" আপনি আবার কবে থেকে কারো কথা শুনতে শুরু করলেন?"
আদ্রিয়ান অনিমার কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,
" তোমার বাবা আর বাকি সবাই আমার কাছে এক নয়। ওনাকে আমি এমনি এমনি মিস্টার সিনিয়র বলে ডাকিনা। মন থেকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। এমনিতে দুষ্টুমি করলেও, তার প্রতিটা শব্দই আমার কাছে আদেশ।"
অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসল হালকা। আদ্রিয়ান অনিমার চোখে হাত দিয়ে বলল,
" চোখ বন্ধ রাখো। আমি বললে খুলবে।"
অনিমা কোনরকম কোন প্রশ্ন না করেই চোখ বন্ধ করে রাখল। আদ্রিয়ান ওর পকেট থেকে একটা ঝিনুকের মালা বেড় করল। তারপর সেটা অনিমার গলায় পরিয়ে দিল। অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলল। আদ্রিয়ান বলল,
" এবার খোলো!"
অনিমা চোখ খুলে দেখল ওর গলায় বেশ সুন্দর একটা ঝিনুকের মালা। এরকম মালা ওর খুব পছন্দের। ও হেসে দিয়ে বলল,
" এটা কোথায় পেলেন?"
আদ্রিয়ান অনিমার দুইকাধে হাত রেখে বললেন,
" কক্সবাজার থেকে এনেছি। আরও অনেক কিছুই এনেছি। তোমার রুমে পেয়ে যাবে। কিন্তু এইটা স্পেশাল। কারণ এটা দেখার পর তোমার কথাই মনে পরেছিল সবার আগে! পছন্দ হয়েছে?"
অনিমা উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
" ভীষণ!"
এরপর কিছু একটা ভেবে বলল,
" আন্টি আর জাবিনের জন্যে কিনেছেন তো?"
আদ্রিয়ান অনিমার নাক টিপে দিয়ে বলল,
" জি ম্যাডাম, কিনেছি।"
অনিমা কোন উত্তর দিলোনা। ও খুশি মনে মালাটা হাত দিয়ে নেড়ে নেড়ে দেখছে। আদ্রিয়ান মুগ্ধ চাহনীতে তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে। কত অল্পতেই খুশি হয়ে যায় এই মেয়ে। ভালোবাসায় মোড়ানো ছোট্ট উপহারও ওকে কতটা আনন্দ দেয়। আদ্রিয়ানের তো টাকা কম নেই। অনিমা যখন তখন ডায়মন্ড, গোল্ডের জিনিস চেয়ে বসতে পারে। কিন্তু কিছু তো চায়ই না উল্টে আদ্রিয়ানের দেওয়া এই সামান্য ঝিনুকের মালাই ওর কাছে কতটা প্রিয় হয়ে গেল। অনিমার এই ব্যাপারগুলোই আদ্রিয়ানকে বারবার মুগ্ধ করে। কারণ অনিমার কাছে উপহার নয়, তাতে মিশে থাকা ভালোবাসাটাই ইম্পর্টেন্ট।
___________
রিক নিজের রুমে শুয়ে আছে। এখনো বাড়ি থেকে কোথায় বেড় হয়নি ও। পারেনি বেড় হতে। স্নিগ্ধার সাপোর্টে আগের চেয়ে অনেকটা নরমাল হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি এখনো। বুকে পাথর চেপে দেয়ালে টানানো অনিমার ছবিটা সরিয়ে ফেলেছে। ওটা দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা ও। ওর ফোন বা ল্যাপটপেও অনিমার কোন সিঙ্গেল ছবি রাখেনি। এখনো না চাইতেও অনিমার কথাই ভাবছে।
" এভাবে ঘরে বসে কতদিন চলবে?"
রিক নিজের বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ বন্ধ করে একটা বিরক্তির শ্বাস ফেলল। এরপর উঠে বসে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
" যতদিন আমার ইচ্ছে হয়, ততদিন।'
রঞ্জিত চৌধুরীর গা জ্বলে উঠল রাগে। ছেলেটা ইদানীং বেশি কথা বলছে। আগে তো এতো তর্ক করত না! উনি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
" এসব কী হচ্ছে কী? পার্টি অফিসে যাচ্ছোনা, কোন কাজে পার্টিসিপেট করছ না। ঐ একটা মেয়ের জন্যে কী সারাজীবন ঘরে বসে পার করবে না-কি? এগুলো কেমন ছেলেমানুষী?"
রিক কিছুই বলল না। যেন ও কথাগুলো শুনতেই পায়নি। কবির শেখ বললেন,
" বাবাই, আমরা তো বলেছিলাম তোমার যদি ওকে এতোই প্রয়োজন কিছু করো। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? অনেক কিছুই করা যেত। আর যদি তুমি না পারো তো আমাদের বলো! আমরা__"
রিক ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
" একদম না! কোনভাবে যদি তোমরা অনি-আদ্রিয়ানের সংসার বা শান্তি নষ্ট করার কথা ভাবো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা। শুধুমাত্র আমার বাবা বা মামা বলে আমি কিন্তু তখন আর চুপ থাকব না। আমি চুপচাপ শান্ত আছি, সেরকমই থাকতে দাও। তোমাদের জন্যে ভালো হবে।"
" আমরা তো তোমার ভালোর জন্যেই__"
" অনেক ভালো করেছ তোমরা আমার। আর করতে হবেনা। যাও এখন।"
ওনারা বুঝে গেছেন যে রিককে কিছু বলে কোন লাভ হবেনা। তাই বেড়িয়ে এলেন রুম থেকে। রঞ্জিত চৌধুরী ভ্রু কুচকে কবির শেখকে বললেন,
" কী ব্যাপার বলোতো? রিক কখনও আমাদের সাথে এভাবে কথা বলেনা। কোনভাবে কী কিছু জেনেছে?"
কবির শেখও গম্ভীরভাবে কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,
" ঐ মেয়েটাই হয়তো সব বলে দিয়েছে।"
" তারমানে তো__"
" আরে চিন্তা করবেন না। ও ততটাই বলতে পেরেছে যতোটা ওর জানা আছে। এখনো অনেক কিছুই ওর অজানা। আর ও যেটুকু জানে সেটুকু দিয়ে আমাদের কিচ্ছু করতে পারবেনা।"
রঞ্জিত চৌধুরী থুতনি চুলকে বললেন,
" আর হাসান? ওর কী করবো?"
কবির শেখ বাঁকা হেসে বললেন,
" ওর আপাতত কিছুই করতে হবে না। মরতে গিয়েও মরল না। বেঁচে যখন গেছে। থাকুক। যেহুতু ও আমাদের কিছুই করছেনা। শুধুশুধু ওকে কিছু করে আমাদের রিস্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। অনিমা, হাসান সবকিছুই এখন সাইডে রেখে আমাদের তাঁর খোঁজ করতে হবে ঠিক করে। আদ্রিয়ানকে সন্দেহ আমার হয় মাঝেমাঝে। কিন্তু কেউ তো আছে যে এখোনো আড়ালে বসে খেলছে। কালকেও একটা গোডাউনে পুলিশ চলে এলো। এগুলো কে করাচ্ছে সেটা জানতে হবে। এখন চুনোপুঁটি ধরছে তাই অল্পে বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু রাঘব বোয়াল ধরে ফেললে সমস্যা। আর তারওপর মাদারও গুম হয়ে আছে।"
রঞ্জিত চৌধুরী রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
" সব ঐ মেয়েটার থেকেই শুরু হয়েছে। ঐ আর্জুকে..."
সাথেসাথেই কবির শেখ ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
" চুপ করুন। এগুলো মুখ দিয়েও উচ্চারণ করবেন না। ছোট্ট একটা ভুল সব বরবাদ করে দিতে পারে।"
রঞ্জিত চৌধুরী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলেন। আসলেই এখন যা অবস্থা ওনাদের! ছোট ছোট ভুলগুলোও সর্বনাশ করে ছাড়তে পারে।
___________
অনিমা হাসান কোতয়ালের রুমের দরজার কাছে এসে একটু উঁকি দিলো। কারণ রুমের ভেতরে টানা একঘন্টা যাবত জামাই-শশুরের মিটিং চলছে। যেখানে কারো আসা বারণ ছিলো। দুপুরের খাওয়া শেষ করেই এই মিটিং বসেছে দুজনের। কিন্তু হঠাৎ করেই অনিমার ডাক পরায় ওকে আসতে হল। অনিমা গলা ঝেড়ে বলল,
" আব্বু আসবো?"
অনিমার আওয়াজ পেয়ে ওনারা ওনাদের কথা থামিয়ে দিলো। তারপর হাসান কোতোয়াল মুচকি হেসে বলল,
" হ্যাঁ ভেতরে এসো।"
অনিমা ভেতরে গেল। এরপর বিছানার ওপরে উঠে বসল আসাম করে। ওর একপাশে হাসান কোতয়াল আরেকপাশে আদ্রিয়ান বসেছে। হাসান কোতয়াল বলল,
" আদ্রিয়ান বিকেলে চলে যাচ্ছে জানো তো?"
অনিমা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান অভিযোগের কন্ঠে বলল,
" যাচ্ছিনা, বলো তাড়িয়ে দিচ্ছো।"
হাসান কোতয়াল হাসলেন। অনিমাও ঠোঁট চেপে হাসছে। আদ্রিয়ান মুখ ফুলিয়ে বলল,
" হ্যাঁ তুমিতো হাসবেই। আমার কী ইচ্ছে করছে জানো? তোমাকে এখন আরেকটা বিয়ে করাই। পরে একবছর পর সেই বউকে কিডন্যাপ করে গুম করে দেই। তখন বুঝতে আমার কষ্টটা!"
হাসান কোতয়াল একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
" সেটাতো অনেক আগেই বুঝেছি জুনিয়র।"
অনিমার মুখটাও মলিন হয়ে গেছে। আদ্রিয়ান বুঝতে পারল দুষ্টুমি করতে গিয়ে দুজনকেই একটু কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। তাই পরিস্হিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
" তাছাড়াও তোমাকে কেউ বিয়ে করবেনা। বুড়ো হয়ে গেছো।"
অনিমা তৎক্ষণাৎ আদ্রিয়ানের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠল,
" মোটেও না। কোন এঙ্গেল দিয়ে বুড়ো মনে হয়? দেখো এখনো কত ফিট আছে। পেটে একটুও মেদ নেই। আর চুল মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা সাদা হয়েছে। গুনে ফেলা যায়। কোথাও তেমন বলিরেখাও নেই।"
হাসান কোতয়ালও মেয়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বললেন,
" তাইতো! কোন দিন দিয়ে বুড়ো আমি?"
আদ্রিয়ান মুখের সামনে এনে হাত জোড় করে বলল,
" মাফ চাই! ভুল হয়ে গেছে আমার। কান ধরে উঠবস করব?"
অনিমা আর হাসান কোতয়াল দুজনেই হেসে দিলেন। এটা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসিমজার পর হাসান কোতয়াল অনিমার উদ্দেশ্যে বললেন,
" মামনী। এখন আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করব। সোজাসুজি সেগুলোর উত্তর দেবে। যেটুকু জানতে চাইব সেটুকুই বলবে বেশি কিছু না।"
অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলল ওনার এরকম সিরিয়াস কথায়। এমন কী জিজ্ঞেস করবে যে এতো গম্ভীরভাবে বলছে? আদ্রিয়ান বলল,
" বাট মাথায় কোনরকম প্রেশার নেবেনা। সিম্পলি উত্তর দেবে।''
অনিমা বলল,
" কী জিজ্ঞেস করবে?"
হাসান কোতয়াল কয়েকসেকেন্ড নিরব থেকে বলল,
" আর্জু শারমা কে ছিল? ওর সাথে তোমার কীভাবে আলাপ? আর ও এখন কোথায়?"
অনিমা হালকা চমকে উঠল হাসান কোতয়ালের কথায়। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল ওও উত্তর শোনার জন্য তাকিয়ে আছে। কিন্তু উত্তর দেওয়ার আগে ওর মাথায় চলছে আর্জুর কথা ওর বাবা আর আদ্রিয়ান কীকরে জানে? ওদের সাথে এই ঘটনার কী সম্পর্ক?
.
.
.
চলবে...........................................