রিক আর স্নিগ্ধা সকালের নাস্তা করেই চলে গেছে। আদ্রিয়ান বলেছিল আর কয়েকটা দিন থাকতে কিন্তু রিক আর থাকতে চাইল না। আদ্রিয়ানও আর তেমনভাবে জোরাজুরি করেনি। তবে যাওয়ার আগে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলেছিল, ভাবিকে ভালো রাখিস। উত্তরে আদ্রিয়ান শুধু মুচকি একটা হাসি দিয়েছিল। স্নিগ্ধা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রিকের দিকে। সবটা জেনে আর দেখেও রিকের এতো শান্ত থাকাটা যে ওর চেনা রিকদার সাথে বড্ড বেমানান। অনিমার রিকের সামনে আসতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। তাই দূরেই ছিল। ও রিককে কথা দিয়েছে যে আগের মতই ওকে নিজের বন্ধু ভাববে। রিকের নিতান্তই একতরফা সেই অনুভূতিটা ওদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু অনিমারও একটু সময় চাই স্বাভাবিক হতে।
আবরার মেনশনে সবাই বিকেলে একত্রে বসেছেন। আদিব, আশিস, আদ্রিয়ান সবাই থাকলেও অভ্র অনুপস্থিত। মানিক আবরার আশেপাশে তাকিয়ে বললেন,
" অভ্র কোথায় আদ্রিয়ান? ডাকো ওকে।"
কথাটা শুনে জাবিনও আদ্রিয়ানের দিকে তাকাল। সকাল থেকে দেখেনি অভ্রকে। ওরও জানার ইচ্ছে হচ্ছে কোথায় গেল। আদ্রিয়ান জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল,
" অভ্রকে একটু কাছে পাঠিয়েছি, বাবা। দু-দিন পর ফিরবে।"
জাবিনের মুখ নিমেষেই অন্ধকার হয়ে গেল। কেন নিজেও জানেনা। শুধু জানে দুর্বল হয়ে পরেছে অনেক লোকটার ওপর। আদ্রিয়ান মৃত্যুর খবর শোনার পর ও যখন প্রচন্ড কান্নাকাটি করছিল তখন অভ্র ওকে সামলেছে। ঐ প্রথম অভ্র নিজে থেকেই ওর কাছে এসছে, ওর সাথে কথা বলেছে। এরপর থেকে ওর দুর্বলতা আরও বেড়ে গেছে। কী ভাবছে সেটা খেয়াল হতেই জাবিন সাথে সাথেই নিজেই নিজেকে বকা দিয়ে ফোন স্ক্রোল করায় মনযোগ দিল। হাসান কোতোয়াল বলল,
" মানিক তোরা এখন এখানেই থাকবি তো?"
মানিক আবরার বললেন,
" হ্যাঁ এতোদিন ঐ বাড়িতে থাকতাম কারণ জাবিনের কলেজ ওখানে ছিল। আমারও অফিসে কাজ ছিল। এখনতো ওকে এখানকার ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি করে দিয়েছি। এইচ এস সি রেসাল্ট তো দিয়ে দিয়েছে।"
রিমা আবরার বললেন,
" আর তাছাড়াও আদ্রিকে আমি আর একা ছাড়বোনা। ঐ তিনদিনে কলিজা নিয়ে টান মেরেছিল আমার।"
আদ্রিয়ান হাসল। অনিমা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। সত্যিই কত ভয়ংকর ছিল ঐ তিনটা দিন। হাসান কোতয়াল অনিমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
" মামনী ব্যাগ গুছিয়ে নাও। কালকেই আমরা বেড় হবো।"
অনিমা একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকাল নিজের বাবার দিকে। আদ্রিয়ান একটুর জন্যে বিষম খায়নি। অনিমা কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান বলল,
" যাবে মানে? ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাবে?"
হাসাত কোতয়াল হেসে বললেন,
" আমার তো নিজের বাড়ি আছে, জুনিয়র। সেখানে তো যেতে হবে। আর মামনীকে এতোদিন পর কাছে পেলাম রেখে যেতে তো পারবনা।"
" হ্যাঁ তো গিয়ে দুদিন থেকে চলে আসবে তো। ব্যাগ গোছানোর কী আছে?"
" দুদিন না। ও এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে।"
অনিমা এবার একটু অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল ওর বাবার দিকে এরপর আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান কিছু না ভেবেই বলে ফেলল,
" মানে কী? আমার বউ আমি দেবোনা।"
সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। অনিমা চোখ বড় বড় করে দেখছে আদ্রিয়ানকে। সবাই কিছুক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থাকার পর মিটমিটিয়ে হাসতে শুরু করল। অাদ্রিয়ান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গলা ঝেড়ে বলল,
" না মানে, এখনতো ও আমার বউ তাইনা? এমনিতে বেড়াতে গেলে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু শশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে এটা কেমন কথা?"
হাসান কোতয়াল বললেন,
" আমি শুনেছি তোমাদের বিয়েটা হঠাৎই হয়েছে। পরিস্হিতির চাপে পরে। তাই আমি আপাতত ঠিক করেছি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। ওর পরীক্ষাও তো এগিয়ে আসছে। এখন ও আমার কাছেই থাক।"
আদ্রিয়ান এবার অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল ওর বাবা মায়ের দিকে। ওনাদের দেখে বুঝতে পারল যে ওনাদের সাথে কথা বলেই এই সিদ্ধান্তের নেওয়া হয়েছে। অনিমাও মুখ কাচুমাচু করে রেখেছে। হাসান কোতয়াল বললেন,
" মামনী রাতের মধ্যেই সব গুছিয়ে রেখো কিন্তু। কাল সকাল সকালই বেড় হব আমরা।"
অনিমা নিচু কন্ঠে বলল,
" জি আব্বু।"
আসলে অনিমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। নিজের বাবার কাছে থাকতে পারবে বলে ভালোও লাগছে। আর ওপরদিকে আদ্রিয়ানকে ছেড়ে যেতে হবে বলে কষ্টও হচ্ছে। আদ্রিয়ান পলেছে মহা জ্বালায়। এটাও ঠিক যে ওনার মেয়েকে উনি ওনার কাছে নিয়ে রাখতেই পারেন। হাসান কোতয়ালকে যে বলবে এ বাড়িতে থেকে যেতে ও সেটাও পারবে না। কারণ ও ভালোকরেই জানে যে উনি যথেষ্ট আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। নিজের মেয়ের শশুর বাড়িতে থাকবেন না। তাই শুধু মলিন মুখ করে সবার দিকে একপলক করে তাকাল। অনিমাও প্রচন্ড অসহায় মুখ করে বসে আছে।
____________
কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী তাদের পার্টি অফিসে নিজেদের ক্যাবিনে বসে আছেন। দুজনের মুখেই চিন্তার ছাপ। যেন দুজনেই যাতাকলে পরে গেছেন। নিরবতা ভেঙ্গে রঞ্জিত চৌধুরী বলল,
" হাসান বেঁচে গেল কীকরে? আমরাতো লাশ দেখে ভেবেই নিয়েছিলাম আপদ বিদায় হয়েছে। কিন্তু লোকটাতো আবার কোন গর্ত থেকে উঠে এলো। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের কথা ভুলে গেছে। জার্নালিস্ট ছিল। তাই রোজ কত মানুষকেই তো এক্সপোস করত। সবার কথা মনে থাকে না-কি। তাও পাঁচ বছর।"
কবির শেখ ভাবনায় মগ্ন থেকে বললেন,
" তবুও! ডাউট তো থেকেই যায়। তারওপর আপনার ছেলে আমার ভয়টাই সত্যি করল। কিছুই করল না। বরং এখন আমাদের এভোয়েট করে চলছে। আমার তো এখানেও ঘাপলা আছে মনে হচ্ছে। কিছু বুঝে যায়নিতো?"
রঞ্জিত চৌধুরী মাথা চেপে ধরে বললেন,
" এতো প্রেশার এবার সত্যিই আর নেওয়া যাচ্ছেনা। এখনো এটাও জানতে পারলাম না আড়ালে বসে এভাবে একে একে কে ডোবাচ্ছে আমাদের।"
কবির শেখ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন,
" আগে আদ্রিয়ানকে সন্দেহ হলেও এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অন্যকিছু। যদি আদ্রিয়ান এর পেছনে থেকেও থাকে তাহলেও ও একা নেই। ওর সাথে এমন কেউ আছে যে ওর মতই চতুর। কিন্তু কথা হল সেটা কে?"
___________
বাইরে ধীরগতিতে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ কোন বজ্রপাত বা ঝড় নেই। প্রকৃতি বেশ শান্ত। অনিমা অনেকটা মন খারাপ নিয়েই ব্যাগ গোছাচ্ছে। ভালো লাগছেনা কিছুই আজ। যদি ওর আব্বু আর আদ্রিয়ান দুজনের সাথেই থাকতে পারত। কিন্তু ওকে যেকোন একজনের সাথেই থাকতে হবে। এখন ওর বাবার সাথে। পরে হয়তো আদ্রিয়ানের সাথে। কিন্তু দুটো মানুষের সাথে একসঙ্গে থাকা হবেনা। তবে ওর বাবাকে ও ফিরে পেয়েছে। আবার নিজের বাবার প্রিন্সেস হয়ে ওর নিজের বাড়িতে থাকতে পারবে। এতেও বেশ খুশি ও। কিন্তু ঐ বাড়িতে কী ওর মামুরা এখনো আছে? কোথায়ই বা যাবেন। ওর আব্বুর সাথেও তো এই বিষয়ে কোন কথাই হয়নি অনিমার। কিছুই বলেনি কী কী হয়ছিল উনি যাওয়ার পর। হাসান কোতয়ালও অনিমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি এ বিষয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে লাগেজের চেইন আটকে দিয়ে অনিমা ব্যালকনিতে চলে গেল। রেলিং ধরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছে। ওর চারপাশে সবকিছু কেমন রহস্যময় আর অদ্ভুত। আদ্রিয়ান ওর অতীত নিয়ে ভাবেনা জানতেও চায়না। ওর বাবা হঠাৎই পাঁচ বছর পর ফিরে এলো যাকে ও মৃত বলে জানতো। উনি এই পাঁচবছর উনি কেন ফেরেন নি,আদ্রিয়ানই বা কোথায় ছিল ঐ তিনদিন? ওর বাবাই বা কেন একবারও জিজ্ঞেস করল না যে নিজের বাড়ি ছেড়ে ও এখানে কেন? অনিমা এসব জিজ্ঞেস করায় শুধু একটাই উত্তর দিয়েছে ওকে, সময় হলে বলব। সবকিছুই কেমন জটপাকিয়ে যাচ্ছে কেন? এতো রহস্যময় সব? হঠাৎই ও পেটে কারো আলতো হাতের স্পর্শ পেল, তার সাথে কাঁধে কারো গরম নিশ্বাস অনুভব করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কারণ ও জানে এটা আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান অনিমার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
" মন খারাপ?"
অনিমা কিছু না বলে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। আদ্রিয়ান ওকে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোমরে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
" কী হয়েছে, আমার মায়াবিনীর মায়ামাখা মুখটা আধারে ঢাকা কেন?"
অনিমা চোখ তুলে আদ্রিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
" আমি কাল আব্বুর সাথে চলে যাচ্ছি, খারাপ লাগছেনা আপনার?"
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,
" খারাপ লাগার কী আছে? তুমি তোমার বাবার সাথে তোমার বাড়ি যাচ্ছো। এতে খারাপ কী? ভালো তো।"
অনিমা মুখ গোমড়া করে আদ্রিয়ানকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আদ্রিয়ান তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে। ওর নিজেরও ইচ্ছে করছেনা অনিমাকে ছাড়তে। ভীষণ মন খারাপ করছে। কিন্তু একপাক্ষিক চিন্তাভাবনা করলে তো আর হয়না। অনেকসময় পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘোরাতেই চমকে উঠল। দ্রুত অনিমার দু-গালে হাত রেখে বলল,
" এই বোকা মেয়ে এভাবে কাঁদার কী আছে। তোমার পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই একেবারে ঝাকঝমক করে ব্যান্ড বাজিয়ে বিয়ে করে আমার বাড়ি নিয়ে আসব। যাতে আমার ভিলেন শশুরটা আর তোমাকে নিতে না পারে।"
'ভিলেন শশুর' কথাটা শুনে অনিমা ভ্রু কুচকে তাকাল। আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,
" আমার এখন তোমার বাবাকে বাংলা সিনেমার সেই ভিলেন টাইপ শশুর-ই মনে হচ্ছে। তবে একটু পার্থক্য আছে। সেটা কী জানো?"
অনিমা না বোধক মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান বলল,
" বাংলা সিনেমার শশুররা বলে, এ বিয়ে আমি মানিনা। আমার মেয়েকে তোরমত ছোটলোকের হাতে আমি তুলে দেবনা। কখনও না। কিন্তু আমার শশুরের ক্ষেত্র কেসটা হল, এতোদিন পর আমার মেয়েকে পেয়েছি। আমার মেয়ে আমি নিয়ে গেলাম। পরের টা পরে দেখা যাবে। মানে হল, ইনি হাতে মারবেন না ভাতে মারবেন। কী ভয়ংকর ব্যাপার-স্যাপার।"
অনিমা হেসে দিল আদ্রিয়ানের কথায়। সেই হাসি দেখে আদ্রিয়ানের হৃদয় ঠান্ডা হল। এই হাসির জন্যেই তো এতোকিছু বলা। ও আলতো হাতে অনিমার চোখ মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। অনিমাও আদ্রিয়ানের বুকের সাথে মিশে রইল। ওর ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলে আছে। যাকে বলে তৃপ্তির হাসি।
.
.
.
চলবে.......................................