তোকে ঘিরে - পর্ব ৫৪ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


পূর্বদিকের তপ্তকর সূর্যটা দারুণ দগ্ধ করছে পরিবেশ। খাঁ খাঁ করা গরম। সেই সাথে পথচারীদের গলা শুকিয়ে কাঠ। ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছে পূর্ণতা ও আয়মান। গোল টেবিলের ঠিক দুইপাশে মুখোমুখি হয়ে বসেছে দুজন। পুরো টেবিলে অফসেট পেপারের অগোছালো ভাব। বর্তমানে নোট ও লেকচার নিয়ে তুমুল সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার এক পর্যায়ে অর্ডারকৃত খাবার চলে আসলে বিরতি নেয় দুজন। ঠান্ডা কোকের স্ট্রতে ঠোঁট চেপে ফোনের গ্যালারি ঘাটতে থাকে পূর্ণতা। এরই মধ্যে দুজনের একইসাথে নজরে পরে দূরে দাড়িয়ে থাকা একটি সাদাসিধে মেয়ের দিকে। মেয়েটার সাথে আগেও দেখা হয়েছে আয়মানের। ব্যাপারটা ঠাহর করতে পেরে আয়মান চোখ ঘুরিয়ে নিজের নোটের দিকে দৃষ্টি রাখলো। পূর্ণতা স্ট্র থেকে ঠোঁট উঠিয়ে সেদিকে লক্ষ রেখে চকিত ভঙ্গিতে আয়মানকে বললো, 

  - দোস্ত দেখ? মেয়েটা বোধহয় জায়গা পাচ্ছেনা। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ওকে এখানে বসতে দেই? 

আয়মান একপলক পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে পরক্ষনে মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকালো। পূর্ণতার কথা সঠিক দেখে আয়মান মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, 

  - তোর চোখে কি নোটগুলো পরেনা? ওই মেয়ের খাবারের ঝোল যদি একটা পেপারে পরে কি অবস্থা হবে চিন্তা করছিস? 
  - আহ্! কি বলছিস এগুলো? ক্যান্টিনে তাকিয়ে দেখতো কোনো টেবিল খালি আছে কিনা? একটাও নেই। ওকে আমি ডাক দেই দোস্ত। তুই প্লিজ কিচ্ছু বলিস না। 
  - যেটা মন চায় ওইটা কর। কিন্তু আমার নোটে যদি একফোঁটা ঝোল লাগে ওই মেয়ের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলবো। 

পূর্ণতা সে কথায় পাত্তা দিয়ে মেয়েটাকে ডেকে তার পাশে বসালো। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো মেয়েটার নাম সাবিহা। নিউকামার স্টুডেন্ট। এখানে আসার পর তার যে ক'জন বন্ধু-বান্ধুবী জুটেছে সবাই লাগাম ছাড়া বেপরোয়া, তাই সাবিহা একা একাই থাকে। মেয়েটার চোখদুটো কাজল কালো। ভ্রুগুলো সরু। হাসলে অনেকটা বাচ্চাসুলভ মায়া ভেসে উঠে। চুলগুলো রিবন্ডিংয়ের মতো ঝলমল করে, যেনো পার্লার থেকে এই মাত্র চুল সুন্দর করেছে সে। কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটাও জানতে পারলো সাবিহা গ্রামের মেয়ে। নেত্রকোণার ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছে। এদিকে পূর্ণতার মিশুকে আচরণের জন্য আয়মানের প্রচণ্ড বিরক্তিবোধ হচ্ছে। এমনেই সাবিহা নামের মেয়েটার সাথে প্রথম দেখাটা খুবই বিব্রতকর ছিলো, তার উপর একই টেবিলে বসে মেয়েটা বারবার আড়চোখে ওকে অদ্ভুত নজরে দেখছে। সাবিহা জুসের বোতলে এক চুমুক খেয়ে মিষ্টি হাসিতে বললো, 

  - আপু আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? 

পূর্ণতা সহজ হাসিতে জবাব দিলো, 
  - অবশ্যই করো। 
  - আমি শুনেছি আপনি নাকি বিবাহিত। কথাটা আসলে কতটুকু সত্যি সেটা আমি জানিনা। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম। 

এবার আয়মান ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গরম গলায় কপাল কুঁচকে বললো, 

  - মানুষের পার্সনাল লাইফ নিয়ে এতো ইচিং কেনো তোমার? আমরা যে তোমার সিনিয়র ভুলে গেছো? লিমিটের মধ্যে কোয়েশ্চ্যান করবা। 

আয়মানের ইচ্ছে করছিলো এখুনি টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে। কেউ বিবাহিত না অবিবাহিত এসব নিয়ে প্রশ্ন করার ও কে? কে অধিকার দিয়েছে এসব সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করতে? ফাজিল মেয়ে! এদিকে আয়মানের রাগান্বিত চেহারা দেখে পূর্ণতার আর বুঝতে বাকি রইলো না, আয়মান এ মেয়েটিকে তেমন সহ্য করতে পারছেনা। সাবিহাও অপরাধীর মতো মুখ করে মাথা নিচু করে ফেলেছে। পূর্ণতা সবটা সামাল দিতেই সাবিহার হাতে হাত রেখে বললো, 

  - আমি বিবাহিত। তুমি প্লিজ ওর কথা শুনে মন খারাপ করো না। খাবারটা খেয়ে নেও।

আয়মান এদিকে রাগে ফুসছে। তার বান্ধুবী তারই সামনে অন্য একটা মেয়েকে সাপোর্ট দিবে ভাবতেও পারেনি ও। আয়মান খেকিয়ে উঠলো, 

  - তুই কি ইনডাইরেক্টলি আমাকে অপমান করলি পূর্ণতা? তুই নিজের ব্যাপারে এইসব তথ্য বাইরের মানুষকে বলতে যাস কেন? কার মনে কি মতলব ঘুরে তুই কি জানিস? 
  - তুই একদম চুপ করবি আয়মান। আমি অবশ্যই বোকা না। এটুকু অন্তত বুঝার ক্ষমতা হয়েছে কে ভালো, কে খারাপ। সাবিহাকে সরি বল! 
  - তুই কাকে সরি বলতে বললি? 
  - চোখে দেখিস না কাকে বলতে বলেছি? 
  - না, দেখি না। এই দুদিনের উটকো ঝামেলাকে আমি কিজন্য সরি বলতে যাবো? কি দায় আমার? 

পূর্ণতা চরমসীমায় রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে নেবে হঠাৎ টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়ালো সাবিহা। আকস্মিক উঠার জন্য টেবিলে জোরালো রূপে বিকট শব্দ হলো। এতে আশেপাশের সকলের চক্ষুজোড়া ওদের টেবিলের দিকে তাক হতেই সাবিহা মেজাজটা শান্ত রেখেই আয়মানকে বললো, 

  - আমাকে ক্ষমা করবেন আয়মান ভাইয়া। কিন্তু আপনি একটা নিচু মনের নষ্টালজিক লোক! আমি তো আপনাকে ক্ষতি করে কথাটা বলিনি। আমি সোজাসুজি আপুকে জিজ্ঞেস করেছি। ক্যাম্পাসের চর্তুপাশে পূর্ণতা আপুকে নিয়ে যে যে গুজব রটে সেটা কতটুকু সত্য এটুকু জানার জন্য আমি প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছি। এতে আপনার কোন্ চুলায় আগুন ধরেছে আমি সিরিয়াসলি জানিনা। আমি গ্রামের মেয়ে এই কথাটা শোনার পর থেকেই আপনার চোখে মুখে কেমন ঘেন্না-ঘেন্না ভাব জড়িয়ে গেছে। লজ্জা হওয়া উচিত আপনার! আর শুনুন, আপনার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম এজন্যই, আপনার ঘাড়ের কাছে টিস্যু লেগে আছে। আর যেটা দেখতে খুবই বিশ্রী লাগছে। আমি কিছু বললে আপনি যদি রাগ করেন সেজন্যই ওখানে তাকিয়ে আপনাকে ইশারা দিচ্ছিলাম। আপনি সত্যি খুব জঘন্য মস্তিষ্কের মানুষ! ছিঃ! 

সাবিহা কাধে ব্যাগ তুলে ট্রে নিয়ে হনহন করে ক্যান্টিনের কাউন্টারে চলে গেলো। উপস্থিত সবাই যে আয়মানের দিকে তাকিয়েছিলো, আয়মান সেটা বুঝতে পেরে পূর্ণতাকে উঠতে বলে চলে যায়। সাবিহার জন্য পুরো মেজাজটাই বিগড়ে গেছে আয়মানের। কোনোরকমে ব্যাগের মধ্যে নোট গুছিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে পরে। পূর্ণতা বিল পে করে আয়মানের পাশাপাশি হাঁটতে থাকলে হঠাৎ একটা দৃশ্য ভেবে অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। একবার শ্রেয়ার সাথে এরকম ঝগড়া হয়েছিলো। সেদিন শ্রেয়াও আয়মানকে 'নষ্টালজিক' বলে অপদস্থ করেছিলো। আয়মান এর বিপরীতে কিচ্ছু বলেনি। পূর্ণতার জানামতে আয়মান এমন কোনো গালি শিখতে বাদ রাখেনি যেগুলো এই মূহুর্তে উচ্চারণ করলে সবাই কানে হাত চাপা দিবে। সেই আয়মান শ্রেয়ার বেলায় যেভাবে চুপ ছিলো, আজ সময়ের পরিবর্তনে সাবিহার বেলায়ও চুপ। তবে আয়মানের জীবনে কি পরিবর্তন আসা সম্ভব? আবারও কি সম্ভব সেই হাসিখুশি আয়মানকে ফিরে পাওয়া? আয়মান যে আর অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেনা, সেটা কিভাবে পরিবর্তন করবে? এসব নিয়ে পূর্ণতা নানা চিন্তাভাবনা করতে থাকলে হঠাৎ ওর চিন্তার প্রহরে দাগ বসিয়ে আয়মান বলে উঠে, 

  - ওয়াসিফ ভিলায় যাবি? 

পূর্ণতা চমকে গিয়ে হাঁটা থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। আয়মান পাশে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতা নেই, সে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলো পূর্ণতা আশ্চর্য দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে। আয়মান আবার পূর্ণতার পাশে এসে বললো, 

  - জাওয়াদের মৃত্যুশোকে তোর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা কেমন একবার তো দেখতে যাওয়া উচিত। পূর্ব ভাই নিশ্চয়ই সব একা সামলাচ্ছে। ওখানে একবার গেলে ঠিক হয়না? 

আয়মানের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ পূর্ণতা পেটের উপর হাত রাখলো। চোখের সামনে আজও সেদিনের বীভৎস ঘটনাগুলো স্পষ্ট ভাসে। জাওয়াদের মৃত্যুর পেছনে পূর্বের হাত আছে পূর্ণতা এটুকু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। পূর্ব কি ভালো আছে? এই সুযোগে ওকে যদি একবার দেখার সুযোগ হয় সেটা পূর্ণতা ছাড়বেনা। কিন্তু পূর্ব যেখানে কল দিয়ে ওকে খবরটা দেওয়া প্রয়োজনবোধ করেনি সেখানে বেহায়ার মতো যাওয়ার মানে কি? পেট থেকে ধীরেধীরে হাত সরিয়ে শক্ত গলায় বললো, 

  - আমি ওখানে যাবো না। আর তুই যদি ওখানে যাওয়ার কথা ভুলেও কখনো বলিস, আমি ভুলে যাবো তুই আমার বন্ধু। 

.

দুপুর বারোটায় বাসায় ফিরে আসে পূর্ণতা। সবসময়ের মতো আজও হাসপাতালে ব্যস্ত খোদেজা। একটা বড় ডিলের ঝামেলার জন্য বাধ্য হয়ে পূর্ণতার বাবা সিলেট গিয়েছে। বাসায় নূরানী ছাড়া কেউ নেই। চারদিন হলো পূর্ণতার জন্য আবারও খোদেজা নূরানীর বেতন বাড়িয়ে বাসায় নিয়ে এসেছেন। নূরানী পূর্ণতার সবটা দেখভাল করলেও পূর্ণতাকে খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম থেকে উদ্ধার করে পারেনি। গোসল শেষ করে সালোয়ার-কামিজ পরে আয়নার সামনে যখন চুল ঝারছিলো হঠাৎ পূর্বের কথা বেখেয়ালে মনে পরে যায় ওর। এই মানুষটা কত নিষ্ঠুরভাবে দূরে চলে গেছে! কল দিয়েও খোঁজ নেয়নি ' কেমন আছো? বেঁচে আছো তুমি? '। হাসপাতালে ওই মূমুর্ষ অবস্থায় পূর্ণতা যখন রাতদিন অপেক্ষায় ছিলো তখন সেই মানুষটা আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে দেয়নি। পূর্ণতার শূন্য হাতটা কাতরাতো পূর্বের শক্ত হাতের উষ্ণ অনুভব করার জন্য। ঠোঁটেদ্বয় পিপাসিত হয়ে যেতো তার ওষ্ঠযুগল স্পর্শের জন্য। অথচ দিনেকে-দিন চলে গেলেও মানুষটা কখনো আসতো না। যদি সন্তানটা পৃথিবীতে বেঁচে থাকতো, হয়তো এই অজুহাত হলেও পূর্ব ওকে ছেড়ে দিতো না। আজ পূর্ণতার কাছে কিছুই নেই যার জন্য পূর্ব আর ওর কাছে ভিড়বে। নতুন জিনিসের কদরটা কেটে গেলে পুরোনো জিনিসের তকমা লেগে যায়। আজ পূর্ণতা পূর্বের বিশাল আভিজাতপূর্ণ রুচির কাছে 'পুরোনো'। উদাস দৃষ্টিতে কিছুক্ষন আকাশে তাকিয়ে থাকতেই চোখের কোনা থেকে পানি গড়িয়ে পরলো ওর। হঠাৎ কি যেনো ভেবে পূর্ণতা লেডিস ব্যাগে কিছু টাকা ভরে চটপট রেডি হলো। হাতে ঘড়ি পরতে পরতে মাথায় ঘোমটা টেনে পায়ে জুতা পরতেই নূরানীকে গলা উঁচিয়ে বললো, 

  - এই নূরানী শোন তো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। মা এলে বলবি আমি কিছু কিনতে বের হয়েছি। বাসায় সবকিছু দেখে রাখিস। আমি আসছি। 

নূরানীর পাল্টা উত্তর শোনার জন্য এক সেকেন্ডও নষ্ট করলো না পূর্ণতা, সোজা নিচে নেমে রিকশা ঠিক করলো সে। একটা উবার বুক করার জন্য ব্যাগে হাত দিতেই দেখলো মোবাইল ঢুকায়নি সে। এদিকে রিকশা যতদূর এসে পরেছে আবার ব্যাক করাটা বোকামি হবে ভেবে পূর্ণতা বাসস্ট্যান্ডে গেলো। টিকিট কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে একটা বাসে উঠে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছলো। আরো একবার পূর্ণতা অনুভব করলো আজ তার মন প্রচণ্ড ব্যকুল হয়ে আছে। যার জন্য সে এসেছে তাকে দেখার জন্য প্রচুর অস্থির-অস্থির লাগছে। শুষ্ক হয়ে আসছে গলা, পূর্ণতা বারবার ঢোক গিলছে। বাড়ির লন সাইডে শূন্য, কোনো মানুষ নেই। দরজা খোলা কিন্তু কোনো মানুষ থাকে বলে মনে হয়না। শোকের আবছায়া যেখানে ঘিরে থাকে, সেখানে কান্নার আহাজারি পাওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, পিনপতন চারপাশ এবং শব্দহীন। পূর্ণতা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে কাউকে দেখতে না পেয়ে সোজা শ্বশুরের কক্ষে গেলো। বিছানায় যে ব্যক্তি শুয়ে আছে তার শরীরে হাড্ডির উপর কোনোমতে চামড়া সেঁটে আছে। হাতদুটো সুতোর মতো চিকন, কোনো মাংস নেই সেখানে। চোখের নিচে কালির আস্তরণ, ঠোঁটগুলো রোগার মতো সাদা হয়ে আছে। পূর্ণতা পলাশ ওয়াসিফের এই নাজুক অবস্থা দেখে নিঃশব্দে ফুপিয়ে কেদেঁ দেয়। শ্বশুর নামধারী বাবার মতো আগলে রাখা মানুষটা হাড় জিড়জিড়ে অবস্থায় কখনো শুয়ে থাকবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ। পলাশের বেডের কাছে এসে ফ্লোরে বসে পরে পূর্ণতা। কারোর বসার তীক্ষ্ম আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে তাকায় পলাশ ওয়াসিফ। পূর্ণতাকে দেখেই তিনি কিছু বলার জন্য হাপাতে থাকেন, যুদ্ধ করতে থাকেন নিজের অক্ষম শরীরের সাথে কিছু বলার জন্য। কিন্তু তিনি পারেন না। কষ্টে চোখের পানি ছেড়ে দেন। পূর্ণতা পলাশ ওয়াসিফের ওই অবস্থা দেখে কাঠির মতো আঙ্গুলগুলো মুঠোতে নেয়। নিজের কপালে আঙ্গুলগুলো রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পূর্ণতা। চিৎকার করে কাঁদতে যেয়ে অনবরত কাশতে থাকে ও। এ অবস্থা ঝাপসা চোখে দেখতেই পলাশ ওয়াসিফ ওই প্যারালাইসিস অবস্থায় কিছু বলার জন্য গোঙাতে থাকেন, জীর্ণতার কাছে হার মেনে কিচ্ছু বলতে পারেন না। পূর্ণতার কান্না শুনে পাশের কামড়া থেকে আয়েশা চাকরের সহযোগিতায় ছুটে আসেন। তিনিও দরজার মুখে দাড়িয়ে কান্না জর্জরিত গলায় ডেকে উঠেন, 

  - পূর্ণতা মা, মাগো...  

আয়েশার ওইটুকু ডাকে পূর্ণতা ফ্লোর থেকে উঠে আয়েশার কাছে দৌড়ে যায়। হাতের উল্টোপিঠে অশ্রুপূর্ণ চোখ মুছে আয়েশাকে ধরে ধরে রুমে আনে পূর্ণতা। আয়েশা গা ছেড়ে দেওয়ার মতো করে কান্নাকাটি করছেন। স্বামীর প্যারালাইসিসজনিত অসুস্থতা, জাওয়াদের মৃত্যু, পূর্ণতার সন্তানহারা, পূর্বের একগুঁয়ে গম্ভীর আচরণের জন্য তিনি আজ দিশেহারা হয়ে কাঁদছেন। পূর্ণতা নিজেকে শান্ত করে আয়েশাকে অনেক্ষন সময় নিয়ে সামলায়। ফজরের ওয়াক্তে জাওয়াদকে মাটি দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে শেফালী পাগলের মতো প্রলাপ করতেই অসুস্থ হয়ে পরেছেন। সবাই শেফালীকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। পূর্ব জানাজার পর থেকে আর বাড়ি ফিরেনি। কোথায় আছে, কেমন আছে, কিভাবে আছে... কেউ ওর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখেনি। পূর্ব আগের মতো কথাবার্তাও বলেনা। কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়িয়ে কথা শেষ করে, মুখ ফুটে শব্দ উচ্চারণ করেনা। এদিকে সময়ের পাল্লা কখন দুপুর থেকে কখন সন্ধ্যার দিকে গড়ায় পূর্ণতা সেটা টের পায়না। ঘড়িতে একপলক সময় দেখে নিয়ে সেও নিষ্ঠুরভাবে আয়েশা ও পলাশকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে যায়। সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই মাগরিবের আযান দেয়। পূর্ণতা চিন্তা করলো এই ফাঁকে পূর্বের খালি রুমটা দেখে আসা উচিত। তড়িঘড়ি করে পূর্বের রুমে ঢুকে দেখতেই পূর্ণতা বেশ অবাক! চর্তুদিকে সবকিছু এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেই পূর্ব সামান্যতম অগোছালো অবস্থা সহ্য করতে পারেনা, নিজেই নিজের জিনিস পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে, আজ সেই পূর্বের রুমের অবস্থা এমন বেহাল হয়ে আছে তা ভাবাও দুঃসাধ্য! পূর্ণতা একবার ঠিক করল সবকিছু গুছিয়ে রেখে যাবে। আবার পরক্ষনে চিন্তা করলো জিনিস যেখানে যেমন আছে, সেগুলো সেভাবে থাকাই মঙ্গল। রুমের ভেতর সেই চিরচেনা ঘ্রাণ পেয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন নিরবতা কাটালো পূর্ণতা। সেই মাতাল করা নেশাময় ঘ্রাণটা শুকলে মনেহয় পূর্ব যেনো এখানেই আছে। কিন্তু কি আফসোস! ওয়াসিফ পূর্বের মুখদর্শন আর হলো না...

.

সন্ধ্যা পনে সাতটা। বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে পূর্ণতা। এই সময় বাসায় ফিরতে হলে লোকাল বাসে করে ফিরতে হবে শুনেই ভয়ে ওর বুকটা কুকড়ে আছে। সিএনজিতে যাওয়ার সুযোগ নেই ওর। তারা স্ট্রাইক করছে কিছুদিন যাবৎ। নিরুপায় হয়ে লোকাল বাসের জার্নিটা সহ্য করতে হবে। বাস এলে পূর্ণতা অনেক কষ্টে পেছনের দিকে সিট পায় তাও জানালার কাছে একজন পুরুষ বসেছে।। ভ্যাপসা বিশ্রী গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে পূর্ণতার। নাড়িভুঁড়ি উল্টে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর। পূর্ণতা নাকে ওড়না চেপেও নিজেকে সুস্থবোধ করাতে পারছেনা। পাশে বসা লোকটা ধুমিয়ে সিগারেট টেনে সেটা আবার পূর্ণতার দিকেই ছেড়ে দিচ্ছে। বাস চলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তিল ধারনের জায়গাটুকু নেই, তবুও কন্ডাক্টার অতিরিক্ত ভাড়ার লোভে ঠেসে ঠেসে যাত্রী তুলছে। পূর্ণতা নাকে ওড়না চেপে চোখ খিচে কোনোরকমে দ্রুত পৌঁছনোর জন্য জিকির করছে। আর পারছেনা দমবন্ধকর এই বাসে বসে থাকতে। মাথাও ঘুরাচ্ছে সিগারেটের গন্ধে। হঠাৎ খেয়াল হলো কেউ ওর বাহু ঘেঁষে একটা অপ্রীতিকর কাজ করছে। কিন্তু বাসের ঝাকুনিতে সেখানে প্রথম প্রথম দৃষ্টি না দিলেও এখন মনেহচ্ছে কেউ ওর বাহুতে ইচ্ছে করে পুরুষাঙ্গ ঘষছে। পূর্ণতা ওইটুকু সিটের মধ্যে নিজেকে সর্বোচ্চ সীমায় গুটিয়ে নিলেও লোকটা ততোই ওর দিকে ঘেঁষে সেই জঘন্য কাজটা করছে। পূর্ণতা অসহায় দৃষ্টিতে পাশের লোকটার দিকে তাকালো। লোকটার চোখ কেমন লাল। ভয় ধরে যায় ওই চেহারা দেখলে। আবার জিভ দিয়ে ঠোঁটটা খুবই অশ্লীলভাবে নাড়ছে। পূর্ণতা সাথেসাথে চোখ ফিরিয়ে মাথা নিচে নুয়ে কোলের ব্যাগটা খামচে ধরলো। দেড়ঘন্টার রাস্তা, তার উপর জ্যামে ফাসলে পূর্ণতা এই যাত্রায় বেঁচে থাকবে তো? বামপাশের বাহুতে এখনো মনের শান্তিতে নোংরা কাজটা করছে লোকটা। পূর্ণতা মনেমনে আকুলিবিকুল করলো, 

  - ইয়া আল্লাহ্! আমি যদি জীবনে একটাও ভালো কাজ করে থাকি তাহলে এইমূহূর্তে আমাকে উদ্ধার করো। যদি আমি পাপ কাজ করে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে এই বিপদ থেকে মুক্তি দাও। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা আল্লাহ্!!

চলন্ত বাসটা জ্যামের মধ্যে আবার থামলো। কন্ডাক্টার এই সুযোগে জ্যামের মধ্যে আরো যাত্রী তুললে সামনে থেকে কিছু লোক হৈহৈ করে গালাগাল করলো কন্ডাক্টারকে। ' আপনেগোর বেশি সমস্যা হইলে থাকেন, নাইলে সিট ছাইড়া যান গা' এমন ভঙ্গিতে ভাব দেখাচ্ছে কন্ডাক্টারটা। কেউ আর গায়ে পরে ঝামেলা করলো না। পূর্ণতার বাহু ঘেঁষে যে লোকটা এতোক্ষন দাড়িয়ে ছিলো হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠলো, 

  - ওই মিয়া? ধাক্কায়া পিছে ফালান ক্যা? চোখে কি আর জায়গা দেখেন না? এনেই খাড়ান লাগবো?

পূর্ণতা কি মনে করে যে চোখ খুলে আড়চোখে তাকালো, তাকাতেই দেখলো ওর পাশে এখন সাদা পান্ঞ্জাবী পড়ুয়া কেউ দাড়িয়ে। গায়ে আর কোনো বাজে স্পর্শ লাগছেনা। কে এই মানুষটা সেটা দেখার জন্য অজান্তেই বুকটা ঢিপঢিপ করে লাফাচ্ছে। পূর্ণতা ধীরে ধীরে চোখ তুলে মানুষটার মুখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর সমস্ত জোয়ার যেনো তীব্র জলোচ্ছাসে আছড়ে পরলো! নীলচে রঙের সার্জিক্যাল মাস্কের আড়ালে ওই কাঠিন্য চোখদুটো অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। গরমে ঘেমে গিয়ে কিছু চুল কপালে সেঁটে রয়েছে। সাদা পান্ঞ্জাবীর হাতাগুলো সবসময়ের মতো কনুইয়ের কাছে ভাঁজ করা। পূর্ণতার সিটের মাথায় একহাত ফেলে অনেকটা ঘেরাও সিস্টেমে সামাল দিচ্ছে পূর্ব। এদিকে বিষ্ময়সূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে পূর্ণতা তাকিয়ে থাকলে আচমকা চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের। একজনের চোখে শান্ত ভঙ্গিতে কর্তব্যপালনের নিষ্ঠা, অন্যজনের চোখে প্রকাশ পাচ্ছিলো আকুল হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা। হঠাৎ পূর্ণতার পাশের লোকটা গন্তব্যে নামার জন্য সাইড দিতে বললে পূর্ণতা সরাসরি উঠে দাড়ায়। পূর্ব কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে পূর্ণতাকে দাড়াতে জায়গা দেয়। এরপর লোকটা বেরিয়ে গেলে পূর্ণতা জানালার কাছে বসে পরে। তার পাশেই চুপচাপ সিটে গা ছেড়ে দিয়ে বসে পরে পূর্ব। পকেট থেকে ফোন বের করে 'ডোন্ট কেয়ার' ভঙ্গিতে স্ক্রল করতে থাকে। পূর্ণতা ওর দিকে তাকিয়ে কখন যে ওড়নাটা নাক থেকে সরিয়ে ফেলেছিলো জানা নেই ওর। ব্যাপারটা আড়চোখে লক্ষ করতেই পূর্ব পকেট থেকে হাত ঢুকিয়ে এক্সট্রা মাস্ক ওর দিকে এগিয়ে দিল। আদেশসূচকে বললো, 

  - মুখটা ঢাকো। 

সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো শিউরে উঠে পূর্ণতা। পূর্বের দিকে তাকিয়ে নিবেনা-নিবেনা করেও মাস্কটা নিয়ে নেয়। মাস্কের রাবারদুটো কানে আটকে নিতেই পূর্ণতা বলে উঠে, 

  - আপনার মুখের মাস্কটা যদি পরতে দিতেন আমি খুব খুশী হতাম। 

পূর্ব সাথেসাথে কপাল কুঁচকে চকিতে প্রশ্ন ছুড়ে বললো, 

  - কেনো? 

পূর্ণতা হাসিহাসি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, 
  - আমার চেয়েও আপনার মুখের মাস্কটা প্রচণ্ডরূপে ভাগ্যবান। সে প্রতি ক্ষনে ক্ষনে আপনার ঠোঁট স্পর্শ করার সৌভাগ্য পাচ্ছে। 

চরমসীমায় আশ্চর্য হয় পূর্ব। পূর্ণতার দিকে হতবুদ্ধির মতো কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এই পাগলামীপূর্ণ কথাগুলো বিয়ের আগে বলতো বলে ওকে সামলানো বড় দায় ছিলো। কিন্তু আজ আবার বললো? পূর্বকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। ছাড়তেই শান্ত গলায় বললো, 

  - আল্লাহ্ পাক আপনার সাথে এভাবেও দেখা করিয়ে দিবেন আমি ভাবতে পারিনি। আমার চোখদুটো ধন্য হয়ে গেছে জনাব। আপনাকে এক ঝলক দেখার জন্য যতখানি কষ্ট পেয়েছিলাম, এই সামান্য সাক্ষাতে সব শোধ হয়ে গেছে। 
  - তুমি আমার সামনে এগুলো উচ্চারণ করছো কেনো? 

পূর্ণতা মাথা নিচু করে রইলো। অশ্রু আবার জমতে শুরু করেছে দু'চোখে। সেগুলো আড়ালে অতি সাবধানে জানালার দিকে মুখ করে মুছে ফেললো। মাথা ঘুরিয়ে অপ্রসন্ন হাসিতে বললো, 

  - আপনার সাথে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুখগুলো পেয়েছি।
  - তুমি কি আমার জন্য আশা নিয়ে আছো?
  
পূর্বের কথা শুনে হেসে দিলো পূর্ণতা। এটা দেখে পূর্বের ভ্রুদ্বয়ের মাঝে সুক্ষ্ম ভাঁজটা আরো তীব্র হলো। পূর্ণতা হাসি থামিয়ে উদাস ভঙ্গিতে স্বর নিচু করে বললো, 

  - আমার মধ্যে আপনাকে দেওয়ার জন্য বিশেষ কিছু থাকলে সত্যিই আশা নিয়ে থাকতাম। কিন্তু নেই। 

বাস মন্থর গতিতে চলছে। পূর্ব ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও পূর্ণতা একটু পরপর ওকে দেখছে। হঠাৎ পূর্ণতা নিরবতা চিড়ে প্রশ্ন করলো পূর্বকে, 

   - আপনি লোকাল বাসে কেনো? 

পূর্ব প্রশ্নটা শুনেও পূর্ণতার দিকে নজর করলো না। ওই ভঙ্গিতেই গম্ভীর সুরে বললো, 

  - জীবনে এই প্রথম লোকাল বাসে চড়েছি। সেটা কেনো চড়েছি অন্তত বুঝার কথা। 

পূর্বের দুই বাক্যের উত্তর শুনে প্রচণ্ডরূপে অবাক না হয়েও পারলো না পূর্ণতা। কন্ডাক্টার এরই মধ্যে গন্তব্যের নামটা চেঁচানো সুরে উচ্চারণ করলে পূর্ণতা সেদিকে লক্ষ্য করে পূর্বের দিকে তাকিয়ে বলে, 

  - আপনার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারলাম না। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন মনে এই দুঃখটা নিয়েই নিশ্বাস ফেলবো। 

 হাতে ফোন নিয়ে পূর্ণতার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পূর্ব। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে সেদিকে বিন্দুমাত্র আর ধ্যান না দিয়ে উঠে দাড়ায় পূর্ণতা। অনেকটা অপরিচিত ভঙ্গিতে বলে, 

  - আমার প্লেস এসে পরেছে। একটু যেতে দিন। 

পূর্ব স্তব্ধ ভঙ্গিতে সিট থেকে উঠে দাড়িয়ে জায়গা দিলে পূর্ণতা বের হয়ে বাসের দরজা দিয়ে নেমে যায়। কাধে ব্যাগের ফিতা ঝুলাতেই ওড়নায় চোখ মুছে মুছতে হাত বারিয়ে রিকশা ডাক দেয়। বাসটা চলে গেলো পূর্ণতার সামনে থেকে। রিকশাও উল্টোপথে প্যাডেল ঘুরিয়ে চলতে লাগলো। রিকশার পেছনে যে খালি অংশটা থাকে সেখান দিয়ে বাসটার যাওয়া দেখছিলো পূর্ণতা। মনে মনে আওড়াচ্ছিলো সেই পরিচিত গানের সুর... 

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না? কেন মেঘ হয়ে আসে হৃদয়ে?তোমারে দেখিতে দেয় না। মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না।

.

পূর্ণতা রিকশার ভাড়া চুকাতেই বুঝতে পারলো তার চোখদুটো ভীষণ ফুলে গেছে। ছিপছিপে অবস্থায় চোখের পাতা ভারী লাগছে। নাক বন্ধ হওয়ার কারনে নিশ্বাস নিতেও বেশ ঝামেলা হচ্ছে। পূর্ণতা ঢোক গিলে বিষন্ন ভঙ্গিতে পা চালিয়ে লিফটে ঢুকলো। খালি লিফটে মাথা নিচু করে সুইচ টিপে দিলে দুইপাশ থেকে দরজা চলে আসছিলো। হঠাৎ সেটা বাধাগ্রস্ত হয়ে লিফট খুলে গেলে পূর্ণতা সামনে তাকিয়ে দেখে পূর্ব। ধ্বক করে পূর্ণতার বুকে তীব্র একটা ধাক্কা খেতেই ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পরে পূর্ব। লিফট বন্ধ হয়ে গেলে পূর্ণতার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত বারিয়ে 'পজ' অপশনে টিপে দেয়। মূহুর্তের মধ্যেই তখন লিফটের উঠা-নামা আটকে যায়। পূর্ণতা অবুঝের মতো তাকিয়েছিলো শুধু। কিছুই বুঝতে পারছিলো না পূর্ব কেনো এখানে এসেছে। পূর্ব নির্লিপ্তে কানের দুপাশ থেকে নিজের মাস্ক খুলে ফেললে পূর্ণতা চরম মাত্রায় আশ্চর্য হয়ে যায়! পূর্ব এতেই ক্ষান্ত হয়না। সে পূর্ণতার মুখের মাস্কটাও একপ্রকার টান মেরে খুলে ফেলে। পূর্ণতা কানের পিছনে ব্যথা পেলেও পূর্বের সেই ধারালো দৃষ্টিকোণ থেকে চোখ সরাতে পারলো না। এ যেনো হিংস্র ঘায়েল দৃষ্টিতে ক্ষতবীক্ষত করার মতো বুকে লাগছে! পূর্ব আচমকা ওর গাল চেপে ধরলে গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠে পূর্ণতা। সমস্ত শরীরে শিরশির করে লাগে ওর। পূর্ব অদ্ভুত ভঙ্গিতে তেজালো গলায় বললো, 

  - এখন কাছে আসতে লজ্জা করছে? বাসে যখন ওইসব কথা ঠাস ঠাস উচ্চারণ করেছো তখন এই লজ্জাটা করেনি? এখন লজ্জা করছে কেনো? 

পূর্ণতা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ঠোঁট কাপিয়ে কিছু বলবে পূর্ব সেই সুযোগটুকু দিলো না। একপ্রকার হামলে পরলো পূর্ণতার ওষ্ঠদ্বয়ের উপর। পূর্ণতার গাল থেকে হাত সরিয়ে চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে দিলো হামেশার মতো। হিংস্ররূপে কার্য চালালেও সেটা ধীরে ধীরে শান্তরূপে পরিণত হলো। পূর্ণতার ব্যকুল মনের ইচ্ছা, দীর্ঘদিনের চাওয়া, ছটফট প্রাণের আকাঙ্ক্ষাকে লম্বা সময় ধরে পরিপূর্ণ করলো পূর্ব। পূর্ণতাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ওর পিপাসিত অধরজোড়াকে সিক্ত করে দিচ্ছিলো সে। আজ পূর্বের মন কোনো বাধ মানবেনা। সে প্রিয়তমার কাছ থেকে একটুও দূরত্ব সহ্য করবেনা। অন্তত এই ক্ষনিকের মূহুর্তে শ্বাশুরির শর্ত ভুলতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেনা। পূর্ণতার কাছ থেকে এই অল্পক্ষণের মূহুর্তকে সে সবচেয়ে দামী মূহুর্ত হিসেবে মনের গোপন বাক্সে লুকিয়ে রাখবে। স্মৃতিরূপে প্রতিদিন সে বারবার স্মৃতিচারন করবে। রাতগুলো যে পূর্বের ভালো যায় না, কেউ কি সেটা জানে? পূর্ণতার গায়ের সাথে মিলেমিশে কতদিন সে শান্তির ঘুম দেয়না, সেটা সত্যিই কেউ জানেনা। পূর্ব চাইলেও ক্লান্ত দেহের ভারী মনটা নিয়ে পূর্ণতার কাছে বলতে পারেনা, 'আমার কষ্ট হচ্ছে পূর্ণ, সবকিছু দম বন্ধ লাগছে। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও? কোলে জায়গা দাও তুমি? আমি তোমার কাছ থেকে কিচ্ছু চাইনা...' 
পূর্ণতার নরম হাতদুটো পূর্বের পিঠের পান্ঞ্জাবী মুচড়ে ধরেছিলো তখন। হাসপাতালে সন্তান হারানোর পর আর দেখা দেয়নি এই নিষ্ঠুর মানুষটা। চুটিয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সে। পূর্ণতা পান্ঞ্জাবীটা আরো কঠোরভাবে মুচড়ে ধরলো। কোনোভাবেই পূর্বকে যেতে দিবেনা সে। নিরবতার ব্যাপক সময়ক্ষনের পর পূর্ব হঠাৎ ওকে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিতেই তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে লিফটের 'ওপেন' সুইচ টিপতে লাগলো। লিফটের দরজা খুলে গেলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যায় পূর্ব। অন্ধকার বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি নেমেছিলো। পূর্ব পান্ঞ্জাবীর হাতায় অনবরত চোখ ঘষতে ঘষতে বৃষ্টির মধ্যে চলে যাচ্ছিলো। মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা পূর্ণতা শূন্য দৃষ্টিতে বন্ধ হয়ে আসা লিফটের বাইরে শেষ দৃশ্য দেখছিলো। ধপ করে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে মাথা নুয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো পূর্ণতা। শূন্য হাতদুটো কেমন থরথর করে কাঁপছে। একটু আগে শক্ত করে আকড়ে রাখার জন্য যে উন্মাদনার শিকার হয়েছিলো, মানুষটা তো শেষমেশ চলে গেলো...
.
.
.
চলবে.......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন