জল ফড়িঙের খোঁজে - পর্ব ৪৮ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


বিহান নিজের পেন্টিং করার রুমটায় একা একা বসে পেন্টিং করছে। কী আঁকছে নিজেও জানেনা, বোর্ডের ওপর রং চালিয়ে যাচ্ছে শুধু। আজ বুকের ভেতর ভীষণ ভার হয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। কাঁদতে পারলে হয়তো খুব ভালো হতো কিন্তু আজ কান্নাও বিহানের সঙ্গ দিতে নারাজ। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর নাক টানছে একটু পরপর। চোখ, নাক সব লাল হয়ে গেছে। কিন্তু এই আঘাতগুলো হয়তো ওর পাওয়ানাই ছিল। ওরই দোষ আছে সবক্ষেত্রে। না হলে ওর সাথেই বারবার এমন কেন হবে? ওকেই কেন সবাই ঘৃণা করবে? সকালবেলায় সৌহার্দ্য চলে যাওয়ার পরে বিহানের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসছিল। ফোনটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে রিখিয়ায় গলা শুনে চমকে গেছিল বিহান। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বিহান নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

" কেমন আছো?"

রিখিয়া রাগী গলায় বলল,

" আপনার মত মানুষ যার জীবনে থাকে সে কখনও ভালো থাকতে পারে? কী চান কী আপনি?"

বিহান অবাক হয়ে গেল। এভাবে কথা কেন বলছে ওর সাথে রিখিয়া? ওর জানামতে ওতো এখন তেমন কিছুই করেনি। ও কিছু বলার আগেই রিখিয়া বলল,

" ভালোবাসেন আমাকে তাইনা?"

রিখিয়ার কথা শুনে বিহান চমকে উঠল। রিখিয়া কীকরে জানলো এই কথা? ওতো বলেনি? তাহলে কী সৌহার্দ্য বলে দিয়েছে? ও ইতস্তত করে বলল,

" এসব তোমাকে__"

কথাটা শেষ করার আগেই রিখিয়া একটু আওয়াজ করেই বলল,

" আমি জানতে চেয়েছি ভালোবাসেন কী-না?"

বিহান কিছুক্ষণ নিরব থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্পষ্ট ভাষায় বলল,

" হ্যাঁ ভালোবাসি।"

রিখিয়া একটু হাসল। যাকে বলে তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপর বলল,

" তা এবার কীসের প্রতিশোধ নিতে চান আপনি? সেদিন গিয়ে কিছু করেছিলাম না-কি?"

বিহান চুপ করে আছে। কোনো উত্তর নেই ওর কাছে। তাছাড়াও ও জানে ও এসবই ডিসার্ব করে। রিখিয়া চেঁচিয়ে বলল,

" কী হল বলুন? এবার কোন প্রতিশোধের খেলায় নেমেছেন আপনি? কেন জানালেন এসব আমাকে? নিজেকেতো সামলে নিয়েছিলাম আমি। মেনে নিয়েছিলাম সব। তাহলে কেন এভাবে আবার আমাকে ভেঙ্গে দিলেন? কেন শোনালেন কাল এসব?"

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল রিখিয়া। বিহান অবাক হল খানিকটা। কী বলছে রিখিয়া? কাল কী শুনেছে ও? তাহলে কী ও যখন নেশার ঘোরে কথাগুলো বলছিল তখনই শুনেছে? কিন্তু কীভাবে? সৌহার্দ্য শুনিয়েছে? বিহান বলল,

" রিখিয়া এটা সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি___"

রিখিয়া ওকে থামিয়ে বলল,

" প্লিজ। আপনার সো কলড ভালোবাসার কথা আমি আর শুনতে চাইনা। কয়েকমাস আমার সাথে থাকলেন, তারপর মাঝে দুটো বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজ আপনার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন? যখন আমার বিয়ের মাত্র ন-দিন বাকি। এসবের মানে কী ধরে নেব আমি?"

বিহান অসহায় কন্ঠে বলল,

" রিখিয়া এইজন্যই আমি তোমাকে কিছুই জানাতে চাইনি। কিন্তু হয়তো কাল ব্রো__ জানিনা কী হয়েছে, কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না। ট্রাস্ট মি।"

রিখিয়া আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

" ট্রাস্ট ইউ? কীকরে করি বলুনতো? আসলে আপনার মনের প্রতিশোধের ইচ্ছাটা এখনো শেষ হয়নি। যখন শুনেছেন যে আমার বিয়ে হচ্ছে। আমি নতুন জীবন শুরু করছি। ভালো থাকছি। তখন আপনার সেটা সহ্য হয়নি। তাই আবার নতুন করে এই নাটক শুরু করেছেন তাইনা? যাতে আমাকে আবারও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া যায়, শেষ করে দেওয়া যায়। আপনার মত মানুষ এরচেয়ে ভালো কী ভাবতে পারে। এক থাপ্পড়ের আর কত দাম নেবেন আমার কাছ থেকে? ইউ নো হোয়াট, এইজন্যই আপনার কাছে কিচ্ছু নেই। না পরিবার আছে, আর না ভালোবাসা আছে। আর নিজের ভাইকেও তো কাছে রাখার ক্ষমতা আপনার নেই। ছেড়ে চলে গেছিল। শুধুমাত্র একজন ভালো মানুষ বলেই আজও আপনার সাথে আছেন। না হলে আপনার মত মানুষের সাথে থাকা যায়না। একদম না।"

কথাগুলো বলে রিখিয়া ফোন রেখে দিল। আর এরপরেই শব্দ করে কেঁদে ফেলল। বিহানকে এসব বলতে চায়নি ও। কিন্তু আজ ওর ভেতরে জমানো অভিমানগুলো রাগ হয়ে বেড়িয়ে এলো। কেন করল বিহান এরকম? কেন ওর জীবনটাকে এতো জটিল করে দিল। যদি ভালোবেসেই থাকে তাহলে সেই অনুভূতিগুলো আগে কেন বুঝলোনা? আর যখন বুঝলো, এতো দেরী করে কেন বুঝল? কেন?
বিহান অনুভূতিহীন ভাবে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নিয়ে ওভাবেই বসে ছিল কিছুক্ষণ। ওকে দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা ও অনুভূতি এখন কেমন। শুধু গলাটা কাঁপছিল ভীষনভাবে। এরপর সোজা পেন্টিং করার রুমটাতে চলে আসে আর উল্টোপাল্টা রং করতে শুরু করে। হঠাৎ করেই বিহান রঙের টিউবগুলো একটার পর একটা খুলে খুলে বোর্ডের ওপর ছুড়ে মারতে শুরু করল। সব টিউব খালি হয়ে যাওয়ার পর ও তুলি দিয়ে বোর্ডে লেগে থাকা রংগুলো মিশিয়ে দিতে শুরু করল। কী করছে সেটা ও নিজেও জানেনা। কিন্তু নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে ওর, এখন ভীষণ ব্যস্ত।

_____________

সারাদিনের বৃষ্টি আর বজ্রপাতের পরেও আকাশ এখনও মেঘলা। মনে হচ্ছে বিকেলে আবার বৃষ্টি হবে। তুর্বী জানালা ধরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশের দিকে। ওর অজান্তেই ওর ভাবনায় এখন সৌহার্দ্যর বসবাস চলছে। ও না চাইতেও বারবার সৌহার্দ্যর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে পরছে। ওদের সেই উদ্দেশ্যহীন, কমিটমেন্ট ছাড়া সম্পর্ক। হঠাৎ হঠাৎ একে ওপরের কাছে চলে আসা। খুনশুটিময় কিছু মুহূর্ত। এরপর সৌহার্দ্যর ওকে বিয়ের কথা বলা। বিয়ের কথা মনে পরতেই ওর মনে পরল সৌহার্দ্য আর দোলার বিয়ের কথা চলছে। আচ্ছা সৌহার্দ্য তো ওকে ভালোবাসতো তাহলে অন্যকাউকে কীকরে বিয়ে করছে? তবে কী আজ আর সেই ভালোবাসা নেই? নিজের এরকম চিন্তাতে নিজেই অবাক হল তুর্বী? ও এসব চিন্তা কেন করছে? সৌহার্দ্য বিয়ে করতেই পারে। সারাজীবন একটা মেয়ের স্মৃতি আকড়ে বসে থাকবে না-কি? কিন্তু ব্যাপারটায় হঠাৎ ওর এতো খারাপ কেন লাগছে। কেন মানতে পারছেনা সৌহার্দ্যর বিয়ে হয়ে যাবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে রিখিয়া এসে দাঁড়াল ওর পাশে। তুর্বী না তাকিয়েও বুঝতে পারল যে রিখিয়া এসছে। তাই সামনে তাকিয়ে থেকেই বলল,

" এখনো রেগে আছিস আমার ওপর?"

রিখিয়াও রিক্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থেকে বলল,

" না, রেগে থাকব কেন?"

" কাল রাত থেকে আর কথা বলিস নি আমার সাথে, তাই বললাম।"

রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

" মন ভালো ছিলোনা। আর তাছাড়াও কালকে সবটা প্লানিং করে করেছিলে তাইনা?"

তুর্বী মাথা নিচু করে বলল,

" হুমম।"

রিখিয়া উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে

" কী লাভ হল এসব করে?"

তুর্বী ভ্রু কুচকে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

" রিখু, বিহান ভালোবাসে তোকে। আর তুই নিজের কানে শুনেছিস যে কতটা ভালোবাসে।"

রিখিয়া সামনে তাকিয়ে থেকেই হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

" এসব কথার কোন মানে হয় এখন তুর?"

তুর্বী রিখিয়ার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,

" তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে হয়ে যায়নি ওকে? বিহান লাভস ইউ, রিখু। প্লিজ ভেবে দেখ।''

রিখিয়া হাত ছাড়িয়ে বলল,

" এতো ভাবাভাবির তো কিছু নেই। আমার সাথে এতোগুলো মাস কাটিয়ে ওনার আমার প্রতি কোন অনুভূতি জন্মালো না। ওনার মনে হল উনি আমাকে ভালোবাসেন না। অথচ দূরে গিয়ে দুই বছর পর ওনার মনে হল উনি আমাকে ভালোবাসেন? কাল তো আবার এটাও বলতে পারে যে ওনার ভুল মনে হয়েছিল।"

তুর্বী একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

" রিখু অনেকসময় আমরা যেটা কাছে থেকে বুঝতে পারিনা সেটা দূরে গিয়ে বুঝতে পারি। বিহানের ক্ষেত্রে হয়তো এটাই হয়েছে।"

রিখিয়া আবারও একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তারপর বলল,

" তো? কী দাঁড়াল? ওনার যখন মনে হবে আমাকে ভালোবাসেনা তখন আমাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। আবার পরে যখন মনে হবে ভালোবাসেন তখন আমাকে কাছে টেনে নেবেন। আর আমি? আমি সেটাও এক্সেপ্ট করে নেব? আমি কী পুতুল?"

তুর্বী চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

" ব্যাপারটা সেরকম হলে সবার আগে আমি তোকে আটকাতাম। কারণ আমার কাছে তোর সেল্ফ-রেস্পেক্ট সবার আগে। কিন্তু বিহান কী তোকে একবারও বলেছে যে ফিরে এসো? বা আমি তোমাকে ভালোবাসি? বরং ও নিজে থেকে বলবেনা বলেই আমরা প্লান করে ওকে দিয়ে অন্যভাবে তোকে বলিয়েছি। ও তখন ড্রাংক ছিল রিখু।"

রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকাল তুর্বীর দিকে। বিহান মাতাল অবস্থায় বলেছিল সেসব? তুর্বী বলল,

" আর ও তোর সাথে যা করেছিল তার শাস্তিও কম পায়নি ও। সৌহার্দ্য ওর কাছে কী তুই জানিস না? সেই ভাই ওকে ছেড়ে চলে গেছিল। ওর বাবা এসে মেরেছিল ওকে। সকলের থেকে দূরে গিয়ে বান্দরবান একা কাটিয়েছিল এই দুই বছর। দিন-রাত গুমরে মরেছে ও। রিখিয়া ও নিজে থেকেই তোর কাছে এসে স্বীকার করেছিল সবটা। ও যদি স্বীকার না করত? তাহলে তুই জানতে পারতি ওর প্লান? তুইতো ভাবতি যে তুই-ই নিজে থেকে বেশি এগিয়ে গেছিস, দোষটা তোর। কিন্তু তোকে সেরকম ভাবনায় রাখেনি। বরং সবটা স্বীকার করে নিজে থেকে সরে গেছিল। হ্যাঁ ও যা করেছিল তা অন্যায় ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে ওর অপরাধের যথেষ্ট শাস্তি ও পেয়ে গেছে। ও এখন বদলে গেছে রিখিয়া।"

রিখিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তুর্বীতো ঠিকই বলেছে। অথচ সকালে ফোন করে কত কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে বিহানকে ও। একটা ভুলের শাস্তি কতদিন ভোগা যায়? ও কিছু একটা ভেবে বলল,

" মায়া কে তুর?"

তুর কপাল ভাজ করে ফেলে বলল,

" মায়া? চিনিনা তো! কেন?"

রিখিয়া কালকে বিহানের বলা কথাগুলো সব বলল তুর্বীকে। কথাগুলো শুনে তুর্বী একটু ভাবুক হয়ে বলল,

" এর উত্তর তো সৌহার্দ্য-ই আমাদের দিতে পারবে।"

রিখিয়া কিছু বলল না। ওর এখন বিহানের সাথে করা ব্যবহারের জন্যে মন খারাপ হচ্ছে। এভাবে না বললেও হত। সত্যিই তো বিহান ওকে একবারও বলেনি ওর কাছে ফিরে যেতে। ওকে ভালোবাসতে। বরং নিজের ভালোবাসাটা নিজের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিল। আর ও আজ সকালে কীসব বলে দিয়েছে। কিন্তু ও-ই কী করত ঐ মুহূর্তে ওর মাথা ঠিক ছিলোনা। বিহানের সাথে কথা বলতে হবে ওকে এ ব্যাপারে। ওর কথায় হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা। 

আর তুর্বী এখন রিখিয়ার বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। মায়া কে ছিল? কী এমন করেছিল মায়া যার জন্যে বিহান ওরকম হয়ে গেছিল? হতে পারে এর খোলাশা হলে রিখিয়ার মনে বিহানের প্রতি থাকা অবশিষ্ট ক্ষোভটুকুও আর থাকবে না। তারজন্যে ওকে আগে এই মায়া নামক রহস্যের সমাধান করতে হবে।
.
.
.
চলবে...........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন