পদ্মপাতা - পর্ব ১৫ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!৪৩!!

চাঁদ উত্তাল পদ্মায় পরে তলিয়ে যাচ্ছে। ওর কেবল মনে হচ্ছে আচ্ছা ও মরলে কি আবির ভাই কাদঁবে? নানুমা কান্না করবে তা চাঁদ জানে। তবে আবির ভাই?
মৃত্যু কেমন? মৃত্যুর স্বাদই বা কেমন তা চাঁদ জানেনা।তবে এটুকু বুঝতে পারছে পদ্মা আজ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একেবারে তার গহীনে। 

আবির নৌকা থেকে লাফ দিলো।নদীতে প্রচুর বাতাস।পাশেই পদ্মা,মেঘনার আর ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল।যা মৃত্যু কূপ নামে বিখ্যাত। বাতাস যেনো সেদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নৌকা ওয়ালা নৌকা নিয়ে ঘাটের দিকে ছুটলো।আপন জান বাঁচানো ফরজ।

আবির চাঁদকে ধরে ফেলেছে। বাতাস তাদের নিয়ে চলেছে মৃত্যু কূপের দিকে।চাঁদ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। আবির চাঁদকে ধরে চললো তীরের দিকে।তবে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা অনেক কঠিন। ঘাটে দাঁড়িয়ে নিতি,প্রমা,দিমা আর সিফাত চিৎকার করছে।তাদের অবশ্য চিন্তা চাঁদকে নিয়ে হচ্ছেনা।তাদের চিন্তা হচ্ছে আবিরকে নিয়ে।আবির অনেক চেষ্টা করেও স্রোতের বিপরীতে যেতে পারছেনা।অবশেষে চাঁদকে ধরে স্রোতের দিকেই সাঁতার লাগালো আবির।আস্তে আস্তে কিনারার দিকে নিজের শরীরটাকে নেওয়ার চেষ্টা করলো সে।অবশেষে সফল হলো।চাঁদের পেটে হয়তো অনেক পানি চলে গিয়েছে। নিতিরা সবাই ঘাটে।এদিকে দৌড়ে আসছে।চাঁদকে মাটিতে শুইয়ে আবির ডাক দিলো,
-"চাঁদ, এই চাঁদ উঠো।জান আমার।এই ময়নাপাখি চোখ খুলো।"
চাঁদের কোনো হুস নেই।আবির আবার ডাক দিলো।আসলে আবির নিজেও বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত আর সে করছে কি।আবির চাঁদের কপালে কয়েকটা চুমু খেয়ে বললো,
-"এই চাঁদ উঠ নারে। আমার কষ্ট হচ্ছে তো।এই ময়না পাখি চোখ খুলনারে।"

তখনই নিতির ডাক শুনা গেলো।নিতি এগিয়ে এসে চাঁদের মুখে হাত দিয়ে দেখলো শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা।না,শ্বাস-প্রশ্বাস চলছেনা।নিতি এবার চাঁদের মুখটা হা করে মুখে ভিতর থেকে কাঁদা আর শ্যাওলা বের করে নিলো।এবার আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে চাঁদ।
নিতি চাঁদের গলার উঁচু অংশ অর্থাৎ অ্যাডামস অ্যাপেলের একপাশে হাত দিয়ে নাড়ির স্পন্দন আছে কি না দেখলো।অতঃপর বুকের বামপাশে জোরেজোরে চাপ দিলো। এমনভাবে দিলো যেন বুক ডেবে যায়।এখন চাঁদের নাড়ির গতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। পানিও কিছুটা বের হয়েছে। 

-আবির।
আবির যে একধ্যানে তার চাঁদকে দেখছে তার মুখে কোনো কথাই নেই।
-এই আবির,আবির।
-হুম।বল আমার কি করতে হবে?
-চাঁদকে কোলে নে।ওকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে।

আবির চাঁদকে কোলে তুলে নিলো।তার পিছুপিছু নিতি,প্রমা,দিমা আর সিফাত। প্রমা,দিমাকে সিফাতের সাথে করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।নিতি, আবির মিলে চাঁদকে নিয়ে গেলো চাঁদপুর জেনারেল হসপিটাল। চাঁদের তখনও জ্ঞান ফিরেনি।রিকশায় উঠেও চাঁদকে কোলে রেখেছিল আবির।

!!৪৪!!

চাঁদের চিকিৎসা চলছে। সঠিক সময়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বিধায় বেঁচে গিয়েছে। 
চাঁদের জ্ঞান ফিরলো আধাঘন্টা পর।হসপিটালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করলো চাঁদ। চাঁদতো ভেবেছিলো সে বুঝি মরেই গিয়েছে। হাতে স্যালাইন লাগানো।আশেপাশে থেকে প্রচুর আওয়াজ আসছে।নিতি পাশেই ছিলো।আবির ঔষধ আনতে গিয়েছে। নিতি চাঁদকে দেখে বললো,
-এখন কেমন লাগছে তোমার?
-ভালো। 
চাঁদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ওর শরীর প্রচুর দুর্বল হয়ে পরেছে।অজ্ঞান অবস্থাই তিনবার বমি করেছে সে।

চাঁদ এপাশ ওপাশ ফিরে সেই কাঙ্খিত মুখটা খুঁজে যাচ্ছে। 
-কিছু লাগবে তোমার?
-একটু পানি। 

নিতি চাঁদকে ধরে একটু পানি খাইয়ে দিলো।চাঁদ তখনই দেখতে পেলো সেই পরিচিত মুখ।এই মুখটাই তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটাতে যথেষ্ট। তবে আবির মুখ গোমরা করে রেখেছে। আবিরের মেজাজ বড্ড খারাপ। এতো করে মেয়েটাকে কিনারায় বসতে মানা করেছিল তবুও মেয়েটা তার কথা শুনেনি।আজ যদি কিছু হয়ে যেতো!

-নিতি এই মেয়েকে বল এই খাবারগুলো খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিতে।
-তোর আবার কি হলো?
-আমার কি হবে?বেশি কথা না বলে খাওয়াতো।
-আচ্ছা, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।ডাক্তার বলে গেছে কাল সকালে রিলিজ দিবে।ওর শরীর এখনো দুর্বল। 
-যা, আমি বসি।

নিতি চলে গেলো।আবির মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।চাঁদ সুস্থ থাকলে নির্ঘাত গালে একটা ঠাসিয়ে দিতো।

-আবির ভাই।

আবির কোনো কথা বলছেনা।
-ও আবির ভাই।
-কি হইছে?
বিরক্ত কন্ঠে বললো আবির।
-রাগ করেছেন।আমি ইচ্ছে করে করিনি তো।জানেন আমার মনে হচ্ছিল আমি মরে যাচ্ছি। 
-চুপ বেয়াদব। আরেকটা কথা বললে 

কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলোনা আবির।গলাটা ধরে এলো তার।অন্যদিকে ঘুরে চোখের পানিটা অতি সন্তর্পণে মুছে নিলো সে।

টুল থেকে উঠে চাঁদের কাছে গেলো আবির।একটা ভালোবাসার পরশ দিলো কপালে।জড়িয়ে ধরে রাখলো কতক্ষণ। 
চাঁদ ফিসফিসিয়ে বললো,
-আবির ভাই সবাই দেখছে।
-দেখতে দে।
-নিতি আপু এসে পরবে।
-আসতে দে।
চাঁদ একটা চিমটি কাটলো আবিরের হাতে।
-উফ্,চাঁদ।দিনদিন বেশি দুষ্ট হয়ে যাচ্ছিস তুই।

আবির এবার পাশে রাখা টেবিল থেকে খাবার নিয়ে খাওয়াতে শুরু করলো চাঁদকে।

-ভালোই হয়েছে তুই খাওয়ানো শুরু করেছিস।আমার আসতে দেরি হয়ে গেলো।ঐ একটা পরিচিত ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল।

চাঁদের বেডে বসতে বসতে বললো নিতি।চাঁদ ওষুধ খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছে।

-নিতি, একা বাসায় যেতে পারবি।নাকি বাবাকে ফোন দিয়ে বলবো তোকে নিয়ে যেতে?
-আমি কোথাও যাচ্ছিনা।
-তা কি করে হয়।তুই আমাদের অতিথি। সারারাত জেগে থাকতে হবে এখানে থাকলে।
-এই তুই আমাকে বন্ধু ভাবিস।তোর বোন অসুস্থ আর আমি চলে যাবো।

আবির আর কথা বাড়ালো না।

!!৪৫!!

চাঁদকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে সকাল ১০ টায়।এক রিকশায় বসেছে আবির।আরেক রিকশায় চাঁদকে ধরে নিয়ে বসেছে নিতি।

বাড়িতে হলুদের প্যান্ডেল টানানো হচ্ছে। সন্ধ্যায় গায়েঁ হলুদ।চাঁদকে রিকশা থেকে নামিয়ে ধরে ধরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে নিতি।মোহনা এগিয়ে এসেছেন।মতিন বাড়ি নেই।মোহনাও চাঁদকে ধরে ধরে উপরে তুলে নিয়ে গেলো তার ঘরে।তবে যাওয়ার সময় চাঁদ ঠিকই শুনলো তিলোত্তমা বলছে,
-এসেছে অলক্ষী।মরলেও তো ভালো ছিল।বাড়ির শুভ কাজ বাধাঁ হলো।

চাঁদের কথাটা ঠিক বুকে গিয়ে লেগেছে। আবির থাকলে হয়তো জবাব দিতো।তবে আবির বাইরে।চাঁদ ভাবলো তার মা আজ থাকলেও কি এভাবে বলতো।
চাঁদ খাটে শুয়ে আছে।মোহনা একটু আগে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন।নানুমা এসেও কান্নাকাটি করেছিল।
বাইরে কতো হইচই।যে যার মতো মজা করছে।প্রমা এসে আফসোসও করলো চাঁদ তার হলুদে থাকতে পারবেনা, মজা করতে পারবেনা। বাড়ির সবাই হলুদের অনুষ্ঠান নিয়েই পড়ে আছে। কেবল দুইজন ব্যাক্তি চাঁদকে নিয়ে ভাবছে।আনোয়ারা আর আবির।আজ চাঁদের বাবা-মা বেঁচে থাকলে কি এমন হতো।এতিমদের অনেক কষ্ট। অনেক।

সারাদিন ঘুমিয়েই কাটলো চাঁদের। দুপুরে নানুমা এসে খাবার খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন।মতিনও এসেছিল।কথা বলে গিয়েছেন।

সন্ধ্যা হতেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। জোরেজোরে গান বাজানো হচ্ছে।সিফাতদের বাড়ি থেকে তত্ত্ব পাঠানো হয়েছে। দিমা, প্রমার বান্ধবীরা নাচ করছে। এরমাঝে কনেকে হলুদ লাগিয়ে যাচ্ছে সবাই।প্রমা হলুদ শাড়ি পরে বসে আছে স্টেজে।সবাই সবার মতো মজা করে যাচ্ছে। এখানে যে একজন সদস্য অনুপস্থিত তাতে কারোরই যেনো কোনো যায় আসে না।আবির প্রমাকে হলুদ লাগিয়ে দিলো।একটু হলুদ বাটা লুকিয়ে নিয়ে নিলো তার চাঁদের জন্য।

খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে চাঁদ।শরীর প্রচুর দুর্বল তার। নিচে যেতে ইচ্ছে করছেনা তার।কেউ ডাকতেও এলোনা।

দরজা দিয়ে ঢুকে চাঁদের সামনে দাঁড়ালো আবির।চাঁদও তাকালো তার দিকে।আবির চাঁদের চোখে স্পষ্ট অভিযোগ দেখতে পাচ্ছে। সারাদিন কাজের ভিড়ে সে আসতে পারেনি চাঁদের কাছে।

-না এলেই পারতেন আবির ভাই।
-বাহ্বা, আমাদের চাঁদ দেখি অভিমানও জানে।

চাঁদ অন্যদিকে মুখ ঘুরালো।আবির এগিয়ে এসে চাঁদের দুইগালে হলুদ বাটা লাগিয়ে দিলো।

-নে তোকে হলুদ বাটা লাগিয়ে দিলাম।
-এটা কি করলেন আবির ভাই?
-কেনো?
-এবার তো আমার তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে।
-ভালোই তো।চল বিয়ে করে ফেলি।
-যাহ্।আপনি ও না।
-আমি কি?
-কিছুনা।

তখনই আবিরের ডাক পরলো।মোহনা ডাকছেন।

-আমি যাই।আমার চাঁদরাণী যেন দুষ্টুমি না করে।একটুপর আমিই খাবার নিয়ে আসবো আর আমি যদি না পারি তো রুমাকে পাঠাবো।খেয়ে ঘুমিয়ে থাকবি।ওহ্, এইনে এই বইটা পর বোর লাগবেনা।

আবির চলে গেলো।চাঁদের মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে। সত্যিই এই লোকটা তার!এই আবির ভাইটা তার।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন