কথায় আছে, বিপদ যখন আসে চারপাশ দিয়েই আসে। অনিমা আর আর্জুর ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হতে শুরু হল। আশেপাশে কোন ছাউনি না থাকায় ভিজে গেল ওরা দুজন। কিন্তু এই বৃষ্টি থামার বদলে আরও বেড়ে গেল। চৈত্র মাস ছিল। তাই সেই বৃষ্টি ঝড়ে পরিণত হতে বেশি সময় লাগল না। প্রচন্ড জোড়ে বাতাস বইছে। কিছুক্ষণ পরপরই ভীষণ জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। অনিমা এমনিতেই বজ্রপাতে ভীষণ ভয় পায়। এই প্রথম বজ্রপাতের সময় ও বাইরে আছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে অার্জুকে জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি মেরে বসে আছে ও। আর্জু্ও ওকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ঠান্ডায় দুজনেই কাঁপছে প্রচন্ড। আর্জু কাঁপতে কাঁপতে বলল,
" তুমি কেন বেড়িয়ে এলে? বললাম চলে যেতে গেলেনা। ওরা যদি কেউ চলে আসে তোমারও ক্ষতি করে দেবে।"
অনিমা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,
" আমি তোমাকে একা ছেড়ে দিতে পারব না। মাদার তোমাকে আমার কাছে রেখে গেছে।"
" তুমি এখনো বাচ্চা মেয়ে অনি। তুমি জানোনা ওরা কত ভয়ংকর। যা খুশি করে দিতে পারে। প্লিজ চলে যাও।"
" আমি যাবোনা।"
অনিমার জেদের সাথে পেরে উঠলনা আর্জু। আর্জু যতবার ওকে যেতে বলেছে অনিমা তত শক্ত করে আর্জুকে আকড়ে ধরে বসে ছিল। কিন্তু যেটার ভয় ছিল সেটাই হল। একটু পরেই দুটো গাড়ি এসে থামল ওখানে। হেডলাইটের আলোতে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল ওরা দুজন। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখল গাড়ি থেকে কয়েকজন লোক বেড়িয়ে। আর্জু আর অনিমা প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল এরকম অবস্থা দেখে। আর্জু কম্পিত কন্ঠে বলল,
" অ-অনি পালাও।"
বলে উঠে দাঁড়িয়ে অনিমার হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করল। ঝড়ের জন্যে দৌড়াতেও সমস্যা হচ্ছে ওদের। ওই লোকগুলোও গাড়ি নিয়ে পিছু করল ওদের। তাই বেশিক্ষণ পালাতে পারল না। দু দিক থেকে গাড়ি এসে আটকে দিল ওদের। আর্জু বুঝে গেছে যে এখন আর বাঁচা সম্ভব নয়। তাই বলল,
" অনিমা তুমি পালিয়ে যাও। ওরা আমাকে পেলে তোমার পিছু নেবেনা।"
কিন্তু অনিমা শুনলোনা। আর্জুকে ছেড়ে ও যাবেনা কোথাও। লোকগুলো এসে ওদের দুজনকেই টেনে নিয়ে গাড়িতে তুলল। আর্জু অনেকবার ওদের অনুরোধ করেছিল অনিমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে কিন্তু ওরা অনিমাকে সাথে নিয়ে গেল। দুজনেরই হাত-পা মুখ বেঁধে দিল। বেশ অনেকক্ষণ পর একটা একতলা বড়সর একরুমের শাটার দেওয়া একটা ঘরে ওদের নিয়ে এলো। একটা গাড়ি চলে গেল ওখান থেকে। পাঁচজন রইল ওখানে। একজন অনিমা আর আর্জু দু-জনেরই ছবি তুলে কোথাও একটা পাঠিয়ে ফোন করে বলল,
" স্যার কোন মেয়েটা? নীল গ্রাউন পরাটা নাকি কালো টিশার্ট পরাটা?"
আসলে অনিমা নীল রঙের গ্রাউন আর আর্জু কালো টিশার্ট পরে ছিল। ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল। এরপর ওরা ওখানে অনিমাকে একটা খুঁটির সাথে বেঁধে রাখল। কিন্তু আর্জুকে বাঁধল না। বোঝাই যাচ্ছে ওরা এই ব্যাগটাই চায়। আর্জুকে ওরা প্রথমে মুখে জিজ্ঞেস করে সেই ব্যাগটার কথা। কিন্তু আর্জু বলেনি। এরপর শারীরিকভাবেও অত্যাচার করেছে। অনিমার চোখের সামনে এরকম নৃশংসতা সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিল না কারণ ওর হাত-পা, মুখ বাঁধা ছিল। কিন্তু ও যতবার ছটফট করেছে ওকে থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিয়েছে। তাই ও মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁদছিল শুধু। যখন আর্জু কিছুতেই মুখ খুলছিল না তখন অনিমার গলায় ছুড়ি ধরে ওকে মেরে ফেলার ভয় দেখালো। অনিমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আর্জুকে বলে দিতে হল যে ঐ ডকুমেন্টগুলো ওদের কাছে না ঐ মাদারের কাছে আছে। কিন্তু এরপরই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা। ওই লোকগুলোর একজন আবার কাউকে ফোন করে বলল,
" রঞ্জিত স্যার! মেয়েটার কাছে নেই ঐ আশ্রমের মাদারের কাছে আছে।"
তখন ওপাশ থেকে কী নির্দেশ এলো জানা নেই। কিন্তু ওরা অনিমার চোখের সামনেই আর্জুকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলল। রক্তের কয়েকফোটা ছিটকে অনিমার মুখে এসে পরল। কিন্তু অনিমা কোন প্রতিক্রিয়া করতে পারল না। চোখের এরকম হত্যাকাণ্ড দেখে ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। চোখ একদম পাথরের মত স্হির হয়ে গেছে। সেই দৃষ্টি নিয়েই ও তাকিয়ে আছে আর্জুর লাশটার দিকে। এরপর ওদের একজন এসে অনিমার গলায় ছুড়ি ধরল। কিন্তু অনিমার তবুও কোন প্রতিক্রিয়া নেই। লোকটা ছুড়ি টান দিতে যাবে তখনই আরেকজন বলল,
" থাম। স্যার ওকে মারতে বারণ করেছেন। মাদারের থেকে ফাইল নিতে ওকে কাজে লাগবে।"
এরপর ওরা আর্জুর লাশটা একটা বস্তায় ভরে কোথাও একটা নিয়ে গেল। আর অনিমার নিয়ে আবার গাড়িতে তুলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আর যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখতে ও ঐ গাড়িতে শুয়ে আছে, কিন্তু কোন লোক নেই। ওর হাত-পা ও খোলা। এভাবে ওকে হাত-পা খুলে দিয়ে কোথায় চলে গেল সেটাই ভাবছিল অনিমা। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পরতেই ও কেঁদে ফেলল। ওর চোখের সামনেই ওরা আর্জুকে মেরে ফেলল। কিন্তু ও কিছু করতে পারেনি। কিন্তু ওর মনে হল এখন পালাতে হবে। সেইমুহূর্তেই ঐ গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পালিয়েছিল ওখান থেকে।
__________
অনিমা আর বলতে পারল না। হাসান কোতয়ালের বুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। আদ্রিয়ান লালচে চোখে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। কিছুই বলছে না। হাসান কোতয়াল অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
" তুমি শিওর ফোনের ওপাশে রঞ্জিত চৌধুরী ছিলো?"
" ফোনেতো রঞ্জিত স্যারই বলে ডাকল।"
" আবার বাড়িতে ফিরে আসোনি কেন?"
অনিমা মুহূর্তেই কন্ঠ শক্ত করে বলল,
" আমি আসতে চাইনি। ঘৃণা করি আমি ওদেরকে। আর্জু আপুর মৃত্যুর জন্যে ওনারাও দায়ী।"
বলেই চমকে উঠল। ও তো ওর বাবাকে বলতে চায়নি ওর মামা মামীর আসল চেহারা। কিন্তু রাগের বসে বলে ফেলল। আদ্রিয়ানের সেদিকে খেয়াল নেই। ও গম্ভীরভাবে কিছু একটা ভেবে চলেছে। হাসান কোতয়াল বললেন,
" আমাদের যেটুকু জানার আমরা জেনে গেছি। আর কিছুই বলতে হবেনা। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট কর। আর একদম কান্নাকাটি করবেনা। যেটা হয়েছে সেটাতে তোমার কোন হাত ছিলোনা।"
অনিমা একটু অবাকই হল। এরা দু-জন এমন কেন?.সবকিছুই অর্ধেক বলে, অর্ধেক শোনে। এমন মনে হয় যেন পুরো রিসার্চ করে তবেই শুনতে আসে। আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে বলল,
" চল, রুমে চল।"
অনিমা আর আদ্রিয়ান যেতে নিলেই হাসান কোতয়াল আদ্রিয়ানের নাম ধরে পেছন থেকে ডেকে উঠল। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকাল। এখন আবার অনিমার সাথে যেতে বারণ না করে বসে! কিন্তু হাসান কোতয়াল বললেন,
" রাতে ফোন কর। কথা আছে।"
আদ্রিয়ান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক ওর শশুরের একটু সু-বুদ্ধি হয়েছে তাহলে। এই বুদ্ধিটুকু দিয়েই যদি এখন ওর বউটাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পার্মিশনটা দিয়ে দিতো। কিন্তু ওর কপাল এখনো এতোটাও খোলেনি। এসব ভাবতে ভাবতে অনিমাকে নিয়ে চলে গেল রুমে।
_________
অরুমিতা দুপুরে খেয়ে একটা ভাতঘুম দিচ্ছিল। বাঙালির অতি প্রিয় কাজ এটা। কিন্তু ওর এই আড়াম বেশিক্ষণ টিকল না। ঠিকই ডিসটার্ব করার জন্যে ফোনের রিংটন বেজে উঠল। অরুমিতা ভ্রু কুচকে নাম্বার না দেখেই ফোনটা রিসিভ করে বলল,
" হ্যালো?"
" আশিস বলছি।"
সাথে সাথেই অরুমিতার ঘুম গায়েব হয়ে গেল। এই ছেলেটার সমস্যা কী? রোজ এতো অপমান করে তবুও কেন ফোন দেয় ওকে। হঠাৎ এখন এতো মনে পরছে কেন। ও চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব এনে বলল,
" হ্যাঁ বলুন।"
ওপাশ থেকে আশিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর ইতস্তত করে বলল,
" তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাই। কিছু কথা বলার ছিল।"
অরুমিতা এবার কঠোর গলায় বলল,
" কিন্তু আমি কিছু শুনতে চাইনা। আপনার কথাতো না-ই।"
আশিসের এবার একটু রাগ লাগল। তাই রাগী গলায় বলল,
" তো কার কথা শুনতে চাও। তোমার ঐ অয়ন স্যারের কথা?"
অরুমিতা খানিকটা চমকে উঠল। অয়নের কথা আশিস কীকরে জানে? কিন্তু সেসব চিন্তা সেখানেই বাদ দিয়ে ও রাগী কন্ঠে বলল,
" হ্যাঁ ওনার কথাই শুনতে চাই। তাতে আপনার কী? উনি যথেষ্ট ভালো মানুষ। আপনার মত ঠকবাজ নয়। কারো ফিলিংস, কারো অনুভূতি নিয়ে খেলেনা সে। তাই এসব ফাল্তু কথা বলতে ফোন করবেন না আমাকে। আমি বিরক্ত হই।"
অরুমিতা ফোন রেখে শুয়ে পরল। ভেতরটা কষ্টে ফেটে গেলেও বাইরে দিয়ে তার একবিন্দুও প্রকাশ ঘটালো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। ওদিকে আশিস ফোনটা ছুড়ে মারল মেঝেতে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে একপ্রকার। কিন্তু অরুমিতাকে কী সত্যিই দোষ দেওয়া যায়? ও যা করেছিল তার পরে এই ব্যবহারটাইতো স্বাভাবিক। বরং এরচেয়ে খারাপ ব্যবহার ডিসার্ব করে সে।
__________
আদ্রিয়ান অনিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে যাবে ও। যাওয়ার আগে অনিমাকে ঘুম পারিয়ে রেখে যেতে চায়। তাই আলতো হাতে অনিমার চুলে আঙুল নেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু আদ্রিয়ান খেয়াল করল যে অনিমা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। আদ্রিয়ান বুঝতে পারল যে অনিমা কাঁদছে। আদ্রিয়ান হাত দিয়ে অনিমার মুখ উঁচু করে ধরে ভ্রু কুচকে বলল,
" কাঁদছো কেন? দেখ আর্জুর সাথে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। বাট দ্যাট ওয়াজ নট ইউর ফল্ট। তাই কান্না করোনা প্লিজ। তুমি জানো আমি তোমাকে কাঁদতে দেখতে পারিনা।"
অনিমা কিছু বলছেনা। শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে ফোঁপাচ্ছে। আদ্রিয়ান হাত দিয়ে অনিমার চোখ মুছে দিয়ে ওকে আবার বুকে টেনে নিয়ে বলল,
" কেঁদোনা। ওসব কথা মাথায় এনোনা এখন। ঘুমিয়ে পরো।"
অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে রেখে বলল,
" আমি ওসব ভুলে যেতে চাই। আমি মনে রাখতে চাইনা কিছু। ওসব মনে পরলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় আদ্রিয়ান। আমি সব ভুলতে চাই।"
আদ্রিয়ান কিছু না বলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অনিমাকে। ওর শরীর হালকা কাঁপছে। মনে হচ্ছে যে নিশ্বাসটাও ভীষণ কষ্টে নিচ্ছে। মুহূর্তেই চোখ-কান সব লাল হয়ে উঠল ওর। অনিমার স্বাভাবিক কথাটাও যেন ওর মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
.
.
.
চলবে...............................................