ভার্সিটির সামনে ছোটখাটো জটলা। রাস্তার অপজিট গাড়িটি যেনো সকল মেয়ের আর্কষন। পূর্ণতা গুটিগুটি পায়ে ভিড় ঠেলে বাইরে এসে রাস্তায় পা দিতেই হাতের সেলফোনটা ভাইব্রেট হলো। পা আর চালালো না পূর্ণতা। ফোনের দিকে নজর রেখে স্ক্রিনের ব্রাইটনেসটা বারিয়ে দিতেই দেখলো একটা নতুন মেসেজ।
' Pick a ricksha & come at Bashundhara hall . '
পূর্ণতা স্পষ্ট বুঝতে পারলো পূর্ব এখানেও পাবলিকের সামনে লুকোচুরি করে দেখা করতে চলে এসেছে। মেসেজটা পড়া শেষ হতেই স্থির থাকা গাড়িটা শো করে চলে গেলো। উপস্থিত জটলার মধ্য দিকে হতাশার শ্বাস ফোস করে বেরিয়ে এলো। মেয়েদের কানাঘুসো চলছে, ওয়াসিফ পূর্ব এখানে কেনো এসেছে? প্রিন্সিপালের সাথে কোনো জরুরী কথা ছিলো? নাকি অন্য কোনো কারন? কানাঘুসোর রেশ আর বাড়তে পারলো না। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আস্তে আস্তে ভিড় কমে গেলে পূর্ণতা একটা রিকশা ডেকে কাঙ্ক্ষিত জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রিকশার হুড তুলেই পূর্ণতা গুটিশুটি হয়ে বসেছিলো কিন্তু বারবার একটা বাইকের শব্দ তার কানে আসছিলো। একবার! দুইবার! তিনবার পযর্ন্ত সে খেয়াল করে একটা বাইক তার পিছু পিছু ফলো করে আসছে। রিকশা যেইদিকে বাক নেয় বাইকটাও সেদিকে মোড় ঘুরায়। প্রচণ্ড অস্বস্তি হলেও হঠাৎ ভয় করতে শুরু হলো ওর। জীবনে এই প্রথম পূর্বের কর্মক্ষেত্রের দ্বারা নিজের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় ভয় পেলো। পূর্ণতা রিকশাওয়ালাকে তটস্থ কন্ঠেই বললো,
- মামা? রিকশা একটু জোরে চালান।
- আইচ্ছা আফা।
কিন্তু রিকশা যেই স্পিডে চলে তাতে ওই বাইকটা যেকোনো সময় ওভারটেক করতে পারবে সে সম্বন্ধে হিতাহিত জ্ঞান আছে পূর্ণতার। শুকনো গলায় ঢোক ফেলে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করলো। রিকশার পেছনে যে খালি অংশটা থাকে সেখান দিয়ে দেখলো বাইকারের মুখটা কালো হ্যালমেটে ঢাকা। ওই দৃশ্য দেখে আর সামলাতে পারলো না পূর্ণতা। যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সে কল করলো আয়মানকে। আয়মান এদিকে ফোন রিসিভ করছেনা। এমনটা কখনোই হয়না। পূর্ণতা এবার বাধ্য হয়ে পূর্বের নাম্বারে ডায়াল বসালো। রিং বাজছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা। পূর্ণতা পাগলের মতো তাগাদা দিতে লাগলো রিকশাওয়ালাকে। রিকশাওয়ালা একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললো,
- এইডা পিলেন না আফা। এইডা রিসকা। আপনে এতো চিল্লাইলে এইডা আর জোরতে চলতো না।
পূর্ণতার মাথায় শুধু সেদিন রাতের ট্রাকটার কথা মনে পরছে। সেসময় তো পূর্ব পাশে ছিলো তাই উদ্ধার হতে পেরেছে। কিন্তু আজ যে কেউ নেই! এইমূহূর্তে কিছু হলে কে বাঁচাবে ? বসুন্ধরা হলের সামনে পৌঁছে ভাড়া চুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো পূর্ণতা। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। হলটাও দীর্ঘসময় যাবৎ ঘাটা পরে আছে। পূর্বের গাড়িও কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। রিকশা থেকে নামার পর হঠাৎই যেনো উধাও হয়ে গেছে বাইকটা। আর দেখা সম্ভব হয়নি। মনেমনে পূর্বকে ভয়াবহ ভাষায় কথা শোনাচ্ছিলো পূর্ণতা। কিন্তু সেই সাথে আকুল হৃদয়ে তীব্র উৎকন্ঠায় পূর্বকেই সে পাশে চাচ্ছিলো। এই মানুষটা যতোক্ষন সামনে থাকে মন, হৃদয়, আত্মা ততোক্ষন যেনো শান্তিতে ডুবে থাকে। কোনো অজানা কারনে আর পারিপার্শ্বিক ব্যাপারে ভয় লাগেনা। দুপুরের উত্তপ্ত সূর্যের দাপটে ঘেমে বেশ ভিজে যাচ্ছিলো পূর্ণতার কপাল। কানের দুইপাশ থেকে অবিরত ধারায় ঘাম চুইয়ে পরছিলো। ছলছল করে উঠছিলো পূর্ণতার চোখ। রাগে হাতের মুঠোয় ওড়নার প্রান্তদেশটা মুচলেকা করছিলো। আজ পূর্বকে কঠিন ভাষায় বলেই দিবে, সে অন্য দশটা সম্পর্কের মতো স্বাভাবিক হয়ে বাঁচতে চায়! মানুষের ভয়ে ও রাজনৈতিক শত্রুতার জেরে সে নিজের খুশিতে মাটি দিতে চায়না। পূর্বের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবেই স্বীকৃতি পেতে চায় জনতার কাছে। এতে যদি একদল ক্ষতি করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে পূর্ণতা সেটাই মাথা পেতে মেনে নিবে। কিন্তু চোখ নিচু করে বাঁচতে পারবেনা সে। ভাবনার চিন্তাপ্রহরে হঠাৎই বিচ্ছেদ ঘটিয়ে পূর্ণতার অজানা ভয়টা আবারও কামড়ে ধরলো বুকে। পূর্ণতা আশ্চর্য দৃষ্টিতে আগমন বাইকটার দিকে তাকিয়ে আছে। দুম করে তার পায়ের কাছে বাইকটা থামতেই পূর্ণতার হাত থেকে ফোনটা অজান্তেই পরে গেলো। বাইক থেকে নামতে নামতে হ্যালমেটে দুইহাত দিলো ছেলেটা। পূর্ণতা সরু দৃষ্টিতে ছেলেটার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। হ্যালমেট খুলে মাথা মৃদ্যূ ঝাঁকানি দিয়ে মিররে হ্যালমেট ঢুকিয়ে রাখতেই পূর্ণতার চোখ ছানাবড়া। না চাইতেও সে কপাল ভীষণ কুঁচকে চেচিয়ে উঠলো,
- তুই!
অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিটা পায়ের কাছ থেকে ফোনটা তুলে পূর্ণতার হাতে ধরিয়ে বললো,
- হ্যাঁ আমি। অবাক হলি?
- তুই এখানে কি করে? কিভাবে সম্ভব! এতোক্ষন তুই আমাকে ফলো করছিস রাজিব?
- হ্যাঁ করছিলাম। কিন্তু অনুমতি নিয়েই ফলোটা করছিলাম। আচ্ছা বল, কেমন আছিস? কি অবস্থা তোর?
ছোট থেকে বড় হওয়া বন্ধুটা যখন নোংরা একটা কাজ করে তখন তার মুখটা দেখতেও প্রচণ্ড ঘেন্না করে। পূর্ণতার এখন সেটাই অনুভব হচ্ছিলো। চোখেমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে রাজিবের উদ্দেশ্যে সে বললো,
- তুই আমার সামনে থেকে চলে যা রাজিব! প্লিজ বিদায় হ সামনে থেকে!
- কুল পূর্ণতা! আমি আর আগের মতো নই। শুধু দুইমিনিট কথা বলতে এসেছি এখানে।
- তোর সাথে কোনোপ্রকার কথা নেই! চলে যা বলছি!
- তুই তো এখন বিবাহিত পূর্ণতা। অন্যের অধিকার। তবুও কেনো আমাকে দেখে এমন ব্যবহার করছিস? প্লিজ একটা সুযোগ দে কিছু বলার?
- তুই কিচ্ছু বলবি না! এক্ষুনি বিদায় হ বলছি! নইলে আমি সত্যি সত্যিই পূর্বকে ডেকে তোর গলা নামিয়ে ফেলব!
- তোর পূর্বই আমাকে পারমিশন দিয়েছে কথা বলার। একটু তো শোন? আমি শুধু দুই মিনিট ভিক্ষে চাচ্ছি।
পূর্ণতা প্রচণ্ডরূপে অবাক হলেও সেটা পুরোপুরি ভেতরে দমিয়ে রাখলো। আপদ্গ্রস্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই রাজিবকে বলতে সুযোগ দিলো পূর্ণতা। রাজিব গলা খাকারি দিয়ে বাইকের সাথে হেলে দাড়ালো। প্রসন্ন গলায় বললো,
- দোস্ত আই এম সরি। আসলে সেদিন তোর সাথে যে আচরণ করেছি তার জন্য অবশ্যই মাফ নেই। কিন্তু তুই প্লিজ আমাকে ক্ষমা কর। আজ আমি সত্যিই তোর সামনে আসতাম না। পূর্ব ভাইয়া আমাকে অনুমতি দিবে সেটাও জানতাম না। আমি তো ভেবেছি ভাইয়া বোধহয় আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেনা। মেরে ফেলবে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে শুধু দুটো পা ভেঙ্গে ছয়মাসের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। আমাকে জানে মারেনি। আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি। কিন্তু আব্বু, আম্মুর সাথে আর যোগাযোগ রাখিনি। কিভাবে রাখতাম বল? লজ্জায় আমি কথা বলার সাহস পেতাম না। তোকে ভালোবাসতে গিয়ে কখন যে হিংস্র হয়ে উঠি সেটা আমি জানতাম না। আজই রংপুর থেকে ফিরলাম দোস্ত। ওখানে একটা এনজিওতে আপাতত জব করছি। ভাইয়ার রেফারেন্সে ভাঙ্গাচুরা আইডিন্টিটি নিয়ে ক্যারিয়ার বিল্ডাপে মনোযোগ দিয়েছি। দোয়া করিস দোস্ত, একটা স্কলারশিপ পেলে এব্রড চলে যাবো। দেশে থাকবোনা।
রাজিব যতো কথার পাল্লা বড় করছিলো ততোই যেনো অবাকের চরমসীমায় পৌছাচ্ছিলো পূর্ণতা। রাজিবের নিখোঁজ অবস্থা সম্বন্ধে পূর্ণতা জানতো ঠিকই কিন্তু পূর্ব যে ওকে সহি-সলামত সবকিছুর বন্দোবস্ত করে বাঁচিয়ে রাখবে তা ধারনার বাইরে ছিলো। অদ্ভুত কারনে পূর্ণতার চোখ বেয়ে পানি ঝরছিলো। সেটা পূর্বের প্রতি উদারমনার জন্য নাকি অন্যকিছুর বাসনায় ঝরছিলো জানা নেই। মাথা নুয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে পূর্বের সুক্ষ্ম ইতিবাচক ভাবনার প্রতি মুগ্ধ হচ্ছিলো এটুকু বুঝতে পারছিলো পূর্ণতা। আচ্ছা মানুষটা ইচ্ছে করে এই প্ল্যান বানিয়েছে কেন? রাজিবের সাথে দীর্ঘদিনের মনোমালিন্য উপড়ে ফেলতেই এই পরিকল্পনা করেছিলো? রাজিব আরো বলতে লাগলো,
- তুই খুব ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিস পূর্ণতা। মানুষটা তোর জন্য কি কি করে সেটা আন্দাজ করতে তোরও বেশ সময় লাগবে। মানুষটার শৃংখলাবদ্ধ জীবন তোকে ঘিরেই চলে দোস্ত। সামলে নিস। কখনো খোলস দেখে ভেতরের সুপ্ত ব্যক্তিত্ব বিচার করিস না।
রাজিব একগাল হেসে পূর্ণতার ধূলো ভরা ফোন মুছে হাতে ধরিয়ে দিলো। নির্লিপ্তে বাইকে উঠে হ্যালমেট পরতে লাগলো রাজিব। পূর্ণতার অশ্রুমাখা দৃষ্টি তখন রাজিবের দিকে। রাজিব বাইকে চাবি ঘুরিয়ে হ্যান্ডেল চাপতেই ডানে মুখ ফিরিয়ে হ্যালমেটের মুখ খুলে বললো,
- আজ আমি সবচেয়ে বেশি খুশি পূর্ণতা। বিশ্বাস কর দোস্ত, বুকের উপর থেকে কয়েক টন পাথর যেনো নেমে গেছে। কি যে শান্তি লাগছে!! অনেকদিন পর আজ শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। আল্লাহ্ আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ যে দিবে তা অভাবনীয় ছিলো। আলহামদুলিল্লাহ দোস্ত, পূর্ব ভাইয়ার জন্য এতোদিনের সব দ্বিধা দূর করে ফেলেছি। শান্তিতে মরতে পারবো। আসি রে... আয়মানের সাথেও দেখা করে আসি।
.
- আয়মান ভাইয়া প্লিজ আপনি হাইপার হবেন না। আমি সত্যি না বুঝে কাজটা করে ফেলেছি। আপনি আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন। আমি মাথা পেতে মেনে নিবো।
আয়মান এ কথা শুনে আরো দুধাপ ক্ষেপে গেলো। চুরির চুরি আবার সেনাচুরি! ঠাটিয়ে দুইগাল বাজিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। আয়মান মুখ গোমরা করেই ফ্লোরে হাঁটু ঠেকিয়ে নোট পেপারগুলো জড়ো করতে লাগলো। মেয়েটা লজ্জায় আর দাড়াতে পারছিল না। সে জানে সিনিয়র ভাইদের সাথে পাঙ্গার পরিণাম সত্যিই ভয়াবহ হয়। যদি র্যাগ-ট্যাগ দেয়? মেয়েটাও চট করে নোটগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলো। আয়মান একনজর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার মনোযোগ দিলো নোট উঠাতে। সবগুলো কাগজ উঠানো শেষ হলে মেয়েটা হাসি মুখে তার হাতের পেপারগুলো বারিয়ে দিলো। আয়মান খপ করে সেগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার মতো টান মারলো। মেয়েটা আরেকবার অপরাধী মুখে বলে উঠলো,
- আয়মান ভাইয়া আপনি কি আমায় ক্ষমা করেছেন? দেখুন, আমি সত্যিই কাজটা দেখে করিনি। আমার ফ্রেন্ডরা একজন পলিটিশানকে দেখে প্রচণ্ড হৈচৈ করছিলো। লোকটা কে দেখার যাচ্ছিলাম তখনই আপনার....
- হয়েছে ব্যস, ব্যস! যেতে পারো।
- সিরিয়াসলি? সত্যি যাবো? আপনি কি র্যাগ দিবেন না?
মেয়েটার কপটভাবে উত্তর দেওয়াটা প্রচণ্ড বিরক্তির উদ্রেক লাগছিলো। আয়মান মুখ গম্ভীর রেখেই বললো,
- আমি র্যাগ দেওয়ার জন্য সিনিয়র হইনি। যেতে পারো। দয়াকরে, চোখ কান খোলা রেখে হাঁটাচলা করবে। আজ আমার জায়গায় শরিফদের দলের কেউ হলে এতোক্ষনে নাকানিচুবানি খাইয়ে দিতো। মেয়ে মানুষ তাই সাবধান করছি। চলে যাও।
মেয়েটা খুশি হলো আয়মানের ব্যবহারে। আগ বারিয়ে বিপদ সম্বন্ধে কোনো ছেলে সর্তক করেনা সহজে। যারা করে তাদের মন যেমন স্বচ্ছ তেমনি কোমল। আয়মানের প্রতি দারুন ইম্প্রেস হলো মেয়েটা। ছোট্ট করে 'থ্যাংকিউ' বলতেই হঠাৎ দরজার মুখ থেকে কেউ ডেকে উঠলো,
- 'সাবিহা ? আর কতো দাড়িয়ে থাকবি? ক্যান্টিনে আসবিনা?'
আয়মান লো বেন্ঞ্চে বসতে বসতে দরজার পাত্তাহীন দৃষ্টিতে তাকালো। চার-পাঁচটা মেয়ের দল নিশ্চয়ই একে সাবিহা বলেই ডাকছে? তাহলে এই মেয়েটির নাম সাবিহা? ডাকাডাকির শোরগোল বেড়ে যেতেই সাবিহা পা চালিয়ে যেতে লাগলো বাইরে। তখনই আয়মান কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
- এই সাবিহা?
ডাকতে গিয়ে নিজের গলার স্বর শুনে বেশ চমক খেলো আয়মান। একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য এতোটা কর্তব্যপরায়ণ হওয়ার কারন ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। সাবিহা ডাক শুনে ততোক্ষনে আয়মানের পানে চেয়ে আছে। আয়মান হাশফাশ করতেই সাবিহার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
- তোমার কলমটা কাইন্ডলি তুলে নাও। ধাক্কার কারনে হাত থেকে কলমটা বেন্ঞ্চে পরেছে। নেক্সট টাইম হাত-পাও সচল রাখবে।
.
আকাশে সূর্যের তেজ বড্ড প্রখর। শো শো করে বাতাস বইলেও তা যেনো আগুনের শিখার মতো উত্তপ্ত। দাপুটে রৌদ্রের কারনে পূর্ণতা হলের সিড়িতে বসে পরেছে। পূর্ব এখনো আসেনি। কেনো আসেনি সেটা ফোন করেও জানা সম্ভব হয়নি। পূর্ব সবসময়ের মতো কল রিসিভ করেনি। বহুদিন পর পূর্ণতার মন বেশ শান্ত হলেও চোখের অবস্থা অবসাদগ্রস্ত। শ্রেয়াকে খুব মনে পরছে ওর। সেই হাসিমাখা সহজাত মুখটা আনমনেই ভেসে বেড়ায়। চোখের কার্নিশে হুট করে অশ্রু জমায়। মনেমনে পূর্ণতা আওড়ায়, ' শ্রেয়া? তোকে খুব মনে পরছে দোস্ত। আজ রাজিবের সাথে সব হিসাব চুকে গেলো। তুই যদি একবার দেখার সুযোগ পেতি? পারলি নারে। সারাজীবনের জন্য আক্ষেপ থাকবে, আমরা চারজন আর কোনোদিনও আগের মতো হতে পারবো না। ছোটবেলার সেই চার বন্ধুগুলো আর একত্র হবো না। আচ্ছা? আমরা না নিজেদের মধ্যে ওয়াদা করেছিলাম? আমরা সবসময় একসাথে থাকবো? আজ সেই ওয়াদা কোথায় গেলো দোস্ত? বন্ধুত্ব যতো পুরোনো হয় বন্ধন ধীরেধীরে ভেঙ্গে যায় কেনো? তুই চলে গেলি পরপারে। রাজিব হারিয়ে যাবে ভিনদেশে। আয়মানকে গম্ভীর বানিয়ে দিলি। আমাকে একা করে সবাই যার যার মতো মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলি। জানিস.. সময়ের চেয়ে ভাগ্য খুব নিষ্ঠুর। সময় একইভাবে চলতে থাকলে ভাগ্য কখনো একরেখায় চলেনা। আমরা চারজন আজ চারসীমানায় চলে গেছি। চাইলেও আর পুরোনো দিন ফিরে পাবো না। আজ খুব করেই মনে পরছে। কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই... আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী বিকেলগুলো সেই... আজ আর নেই। '
হাঁটুতে মুখ গুঁজে শব্দহীন পরিবেশে অস্থির চোখদুটো গাল ভিজিয়ে পানি ফেলছিলো। মন খারাপের কারন না থাকলেও কারন ছাড়াই খারাপ হতে বাধ্য। মানুষের জীবনে ঈষৎ পরিবর্তন মানা যায়, কিছু অবস্থার পরিকল্পনা পূর্বজ্ঞানে বোঝা যায় কিন্তু হুট করে সবকিছু এলোমেলো হয়ে হারিয়ে গেলে সেগুলো মানা বড় দায়। নিস্তব্ধ সময়ে হঠাৎ মাথায় হাতের স্পর্শ অনুভব করলো পূর্ণতা। হাঁটু থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। সবসময়ের মতো মুখটাকে সার্জিক্যাল মাস্কে ঢেকে রেখেছে। পূর্ণতা ঝটপট দাড়িয়ে পরলে পূর্ব ওর দিকে রুমালটা বারিয়ে বলে,
- চোখ মুছো। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে নেই। আসো।
পূর্বের দিকে ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ণতা রুমালটা আনমনে হাতে নিলো। পূর্ব পা ঘুরিয়ে চলে যেতেই হাত দিয়ে ইশারা করলো রাস্তার ওপাশে থাকা গাড়িতে ফটাফট উঠতে। গাড়িটা কখন এসে রাস্তার ওপাশে থেমেছে একটুও জানা নেই পূর্ণতার। পূর্ব গাড়ির পেছনের সিটে বসতেই দরজা খোলা রেখেছে পূর্ণতার জন্য। পূর্ণতাও একপা, দুইপা, কয়েকপা এগিয়ে গাড়িতে বসে দরজা টেনে নিলো। সামনের সিটে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে ড্রাইভার বসা। পূর্ণতা চাইলেও পারছেনা পূর্বকে একটু জড়িয়ে ধরতে। প্রচণ্ড অসহ্য লাগছে। কি করবে? মুখ ফুটে বলবে? নাকি ড্রাইভারকে একটু বাইরে যেতে বলবে? হঠাৎ চিন্তার দোটানায় ছেদ ঘটিয়ে পূর্ব ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
- এখান থেকে চায়ের স্টল কতদূর?
- দশমিনিট।
- এক কাজ করুন। স্টল থেকে কয়েক কাপ চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে আসুন।
ড্রাইভার ফিচেল হাসি দিয়ে সিলবেল্ট খুললো। তার বস কোয়ান্টিটি টাইমের জন্য প্রাইভেসি চাচ্ছে সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারছে সে। তাই চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে উদাস ভঙ্গিতে যাত্রা দিলো স্টলের দিকে। ড্রাইভারটা কিছুদূর চলে গেলে পূর্ণতার দিকে ঘুরে জানালায় পিঠ লাগিয়ে কানের দুপাশে হাত দিলো পূর্ব। মাস্কটা খুলতে খুলতে বললো,
- ওভাবে কাঁদছিলে কেনো? আমি দেরি করেছি বলে কাঁদছিলে? নাকি অন্য কোনো কারন ছিলো?
পূর্ণতা মাথা নিচুকরে কোলের উপর রুমাল নিয়ে গুটি পাকাচ্ছিলো। পূর্বের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলগুলো যদিও ইচ্ছা করে হয়না কিন্তু ছোট্ট মনটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে আসছিলো। পূর্ব মাস্কটা একহাতে পকেটে ঢুকাতেই অন্যহাতে পূর্ণতার হাত টেনে আঙ্গুলের ভাজে মিলিয়ে ধরলো। পূর্ণতা তখনো মাথা নিচু করেই আছে। পূর্ব একটু কাছেঞ এসে পূর্ণতার মুখটা নিজের দিকে জোরপূর্বক ঘুরিয়ে নিলো। কপালের চর্তুপাশে ঘেমে গলার কাছে টপটপ করে পানি পরছে পূর্ণতার। পূর্ব একপলক দেখতেই সামনের সিট থেকে টিস্যুর বক্স টেনে একগাদা টিস্যু নিলো। বামহাতে টিস্যুর কুন্ডলী পাকিয়ে পূর্ণতার মুখ মুছতে থাকলে ডানহাতটা সামনে বারিয়ে এসির সুইচটা টিপে দেয়। পূর্ণতার থুতনি উঁচিয়ে চোখ ছোট ছোট করে কি যেনো পর্যবেক্ষণ করার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলে অনাবশ্যক কারনে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। পূর্ব হাসি দিয়ে বলে,
- আমাকে কপি চলছে? আমার রাগের স্টাইল কপি করলে মারবো কিন্তু।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও পূর্ণতা নিশ্চুপ। কোনো উত্তর নেই, জবাব দেওয়ার ইচ্ছাও যেনো শূন্য। পূর্ব টিস্যুগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে আবার কাচ উঁঠিয়ে দিলো। পূর্ণতার দিকে বাঁ চোখের ভ্রুটা উঁচু তুলে বললো,
- আচ্ছা কি নিয়ে মুখ কালো করে আছো সেটাতো বলবে!
পূর্ণতা নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই মৃদ্যু গলায় বললো,
- আপনার উপর আসক্ত হয়ে পরছি কমরেড সাহেব। দিনদিন মারাত্মক ভাবে আসক্ত হয়ে পরছি। এটা নেশা না ভালোবাসা সেটার বোধগম্য অবস্থা আমার মধ্যে নেই। যখন কাছে থাকেন আমার মনেহয় আর কিচ্ছু প্রয়োজন নেই আমার। কিন্তু দূরে গেলেই অজানা শূন্যতা ভর করে বুকে। আমি না বাজেভাবে ফেসে গেছি। চরম বেহায়া হয়ে গিয়েছি। মেয়ে হিসেবে আমার যতটুকু বিবেকবোধ থাকা প্রয়োজন সেটুকুও নেই। আমি সব সহ্য করতে পারলেও আপনার কাছ থেকে সুক্ষাতিসুক্ষ অবহেলা নিতে পারিনা। আপনি কি আমার ভেতরের অবস্থা বুঝতে পারছেন? সকালটা হলেই আপনি ঘুম থেকে না জাগিয়ে চলে যান। সারাদিন বাইরে থাকেন। কল করলেও আপনাকে পাইনা। আচ্ছা কি নিয়ে থাকা উচিত আমার? একটা সত্য বলে আমায় ধণ্য করবেন? আপনি কি আমায় ভালোবাসেন? আজ আমার কানদুটো পিপাসায় কাতর হয়ে আছে বুঝলেন? সেটা আপনি বুঝবেন না। আপনি জনগণের মনের অবস্থা ঠিকই বুঝেন কিন্তু আমার অবস্থা বুঝেন না। আচ্ছা আমার মনটা যে খা খা করে আছে সেটা কি চোখ দেখেও বুঝেন না? মানুষ তো বলে, মনের ছাপ নাকি চোখের উপর পরে। চোখের দিকে তাকালেই সবকিছু বোঝা যায়। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কি কিছুই বোঝা যায় না? আমি কি...
পূর্ব তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কঠিন বাহুডোরের মাঝে আটকে নিলো পূর্ণতাকে। পূর্ণতার মুখ এসে ঠেকলো পূর্বের ডান কাধ ও গলার সংযোগস্থলে। কানের উপর নরম ওষ্ঠের অনুভব হচ্ছিলো পূর্ণতার। কিছুক্ষণ আটকা পরে রইলো পেশিবহুল বাহুর মাঝে। খানিকটা সময় বাদে ছেড়ে দিয়ে পূর্ণতার গালে, কপালে, পুরো মুখে ওষ্ঠজোড়া স্পর্শ করতে করতে পূর্ব বলতে লাগলো,
- এতো ভারি ভারি কথাগুলো বলো কিভাবে? প্রত্যেকটা কথার ওজন মাপলে এক টন হবে জানো? আর কি যেনো বললে? কানদুটো পিপাসিত হয়ে আছে তাইনা? আমাকে আস্তো পেয়েও তুমি কষ্ট পাও কিভাবে? আমি এতো কাছে টেনে রাখি। তাও এতো অভিযোগ? দেখি চোখ বন্ধ করো। ইশ পূর্ণ, তাকাতে হবেনা, বন্ধ করো বলছি। আমি কেনো সকালে ডাকিনি সেটা তো জানা উচিত ছিলো। তুমি মিষ্টি ঘুম দিলে আমি তো পাষাণের মতো ঘুমটা ভাঙতে পারিনা। তাই চুপচাপ চলে এসেছি। ইলেকশন এগিয়ে আসছে। কতো কাজ যে ফেলে রেখেছি তার হিসাব নেই। তুমি বলো আমার কাজগুলো আমি ছাড়া আর কে করে দিবে? যাদের উপর ভরসা করে রেখে আসবো, তারাই আমাকে সোয়া দশ ফুটের বাঁশ মেরে দিবে। এটা কি ঠিক হবে? মানুষের সেবা করতে চাইলে মানুষের সঙ্গে তো মিশতে হবে। না মিশলে কিভাবে তাদের দূর্বস্থা সম্পর্কে বুঝবো? সরকারের জন্য যারা কাজ করছে একচুয়েলি তারাই ক্ষতি করছে দেশের। আমি সব বুঝেও কোনো এ্যাকশন নিতে পারিনা। আমার মূল কষ্ট এটাই। কিন্তু তুমি কি করে প্রশ্ন তুললে আমি তোমার অবস্থা বুঝিনা? তোমাকে এটুকু এ্যাসোর(assure) দিতে পারবো তোমার মায়ের চেয়েও আমি তোমাকে এনাফ বুঝতে পারি। আম্মাজান অনেক কিছুই তোমার সাথে খারাপ করেছে পূর্ণ। সেসব কথা অতীত ভেবে মাটি চাপা দিলাম। কিন্তু আমি চাইনা তোমার উদাস মস্তিষ্কে ভুলবশত কোনো কলঙ্ক লাগুক। আমি যতোদিন বেঁচে থাকবো ততোদিন তোমার হয়েই আছি। এবং সদা সর্বদা তোমার থাকবো এটুকু গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। আমি পুরুষোচিত মনোভাবের হয়েও একটা কথা বলতে চাই, আমি একনারীতে সন্তুষ্ট। ভালোবাসতে হলে সেই নারীকেই বারবার আর্জি জানিয়ে চাইবো!
.
.
.
চলবে...................................