আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
অভ্রর সকালটা শুরু হলো মকবুল ভাইয়ের ফোন পেয়ে। কল রিসিভ করার সাথে সাথেই তিনি প্রাণবন্ত স্বরে বললেন,
‘কিরে ব্যাটা? কোনো খোঁজ খবর নাই। বাড়িতে গিয়া ভাইরে ভুইলা গেলি?’
মকবুলের প্রশ্ন শুনে অভ্র বেশ লজ্জা অনুভব করলো। নিজেকে তার অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। সত্যিই তো! গ্রামে আসার পর মকবুল ভাইয়ের সাথে একবারো যোগাযোগ করা হয়নি। অবশ্য হবেই বা কিকরে? ফোনের ব্যালেন্স যে তার এখনো শূণ্যের কোটায়! অভ্র নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
‘কি যে বলেন আপনি মকবুল ভাই! বড় ভাইকে কখনো ভোলা যায়?’
মকবুল হেসে জবাব দিলেন,
‘হইছে! না ভুললে একটাবার ফোন অন্তত করতে পারতি।’
অভ্র চুপ করে রইলো। মকবুল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। প্রত্যুত্তরে অভ্র কি বলে তা জানার জন্য। কিন্তু ফোনের অপর পাশের দীর্ঘশ্বাসটুকুই যেনো শোনা গেলো। এটাই উত্তর। মকবুল বললো,
‘তা সপ্তাহখানিক তো কাটিয়ে ফেললি বাড়িতে। হলে ফেরার পরিকল্পনা কি?’
অভ্র নিষ্ক্রিয় কন্ঠে বললো,
‘এখন ফিরেই বা কি হবে বাড়তি খরচ ছাড়া? রোজগারের যেটুকু পথ ছিলো নিজ হাতে বন্ধ করে এসেছি। বর্তমান সময়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে চাকরির খোঁজা আর বীনা পারিশ্রমিকে গাধার খাটুনি খাটাও তো এক।’
মকবুল বললো,
‘চাকরি তোকে খুঁজতে বলেছে কে? হলে ফিরে আয়। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মায়ের কাঁধে চড়েও বা আর কতদিন খাবি? সামনের মাস থেকেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।’
অভ্র চুপ করে রইলো। তার পরিস্থিতি এখন অনেকটা এই প্রবাদের মতো, 'জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। দুদিকেই বিপদ। মহা বিপদ।'
‘আমার কথা শোন।’
‘বলেন ভাই।’
‘একটা টিউশানের খোঁজ পাইছি। মাইনে কম। দেড় হাজার টাকা। কিন্তু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। স্টুডেন্ট আমার এক পুরানো ছাত্রীর ভাই।’
‘দেড় হাজার টাকা!’
মকবুল হতাশ কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘হুঁ।’
‘ছেলে কিসে পড়ে?’
‘ক্লাস এইট এ।’
‘বাসা কোথায়?’
‘সদরে।’
‘দেড় হাজার টাকা তো খুবই কম মকবুল ভাই! আমার পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করতে হবে।বাড়িতে টাকা পাঠানোর পর নিজের কপালে কয় কানাকড়িই বা জুটবে?’
‘সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তোরও তো টিউশান দরকার। একবারে খালি হাতে তো বসে থাকবি না। মাস শেষে কিছু টাকা হলেও পকেটে আসবে।’
অভ্র ক্ষণিককাল চুপ থেকে বললো,
‘মকবুল ভাই, আমি আপনাকে একটু চিন্তা করে জানাই?’
‘ঠিক আছে। চিন্তা ভাবনা কইরাই সিদ্ধান্ত নে। রাখি।’
অভ্র কান থেকে ফোন নামিয়ে ফেললো। টিউশানটা নিয়ে সে খুব একটা আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না। এবিষয়ে ভাবতেও তার ভালো লাগছে না। তাহলে কি নিয়ে চিন্তা করা যায়? অভ্র কপালে ভাঁজ ফেললো। চিন্তার বিষয় মনে হয় পেয়ে গেছে। গতকাল রাতে সে একটা স্বপ্ন দেখেছে। এটা অবশ্যই অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঘুমালে মানুষ স্বপ্ন দেখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বপ্নে সে যে মেয়েটাকে দেখেছে এটা তাকে ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। গতকাল রাতে তার স্বপ্নে ঘটেছে রায়ার আগমন।
মেয়েটা এসেছে লাল কাতানের শাড়ি পরে। গলায় হালকা গয়না। সে প্রচন্ড কাঁদছে। আকাশ তিমিরাচ্ছন্ন। ময়লা মেঘ জমে আছে। অভ্র দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিচিত পোস্ট অফিসের সামনে। কাঁদতে কাঁদতে রায়ার হেঁচকি উঠে গেছে। সে দ্রুত পায়ে সোজা অভ্রর সামনে গিয়ে থামলো। বললো,
‘আজ আমার বিয়ে।’
অভ্র ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
‘হুঁ।’
‘আমি বিয়ে করবো না।’
‘কেনো?’
‘কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিয়ে যদি কখনো করি শুধুমাত্র আপনাকেই করবো।’
‘ও।’
‘ও মানে? এটা কেমন উত্তর? আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন স্যার।’
অভ্র বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় নিয়ে যাবো?’
রায়া ঢোঁক গিলে বললো,
‘জানি না। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন।’
অভ্র দেখলো রায়া ছলছলে চোখে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে।
ব্যাস! এতটুকুই। এরপরে কি হয়েছে অভ্র জানে না। ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে তার। পরের ঘটনাটুকু এখন জানতে ইচ্ছা করছে। সে কি রায়ার হাত ধরেছিলো? নাকি রুদালির মতো তাকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলো?
কোথা থেকে যেনো এক টুকরো মলিনতা ভর করে অভ্রর মুখে। সে চৌকিতে উঠে বসে। তখনি তার কানে ক্ষীণ হট্টোগোলের আওয়াজ আসে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে। তার মায়ের কন্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে। কৌতুহলী পায়ে অভ্র হট্টোগোলের উৎসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখে উঠোনের গেটের কাছে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজনের মুখে পুরু গোফ। সে হাত নেড়ে নেড়ে তার মাকে যেনো কি বলছে। আরেকজন অল্প বয়স্ক। সে কোনো কথায় অংশগ্রহণ করছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের গলায় গামছা ঝুলানো। অভ্র যেনো কোথায় এদের দেখেছে। এখন মনে পড়ছে না। উঠোনে নামতেই তাদের কথা আংশিক শোনা গেলো। স্পষ্টভাবে শোনার জন্য অভ্র আরো সামনে এগিয়ে গেলো। পুরু গোফওয়ালা লোকটি বলছে,
‘আমি এত কিছু শুনবার চাই না। আফনে চাইর দিনের সময় নিছিলেন। আজকে এক সপ্তা হইতে চললো। হয় আফনে ট্যাহা দিবেন নইলে আংটি এইডা বেইচা দিমু।’
সালমা আকুতি করে বলছে,
‘ভাই আর দুইটা দিন সময় দেন? আমি টাকা দিয়ে দিবো।’
‘না আইজকাই দাওন লাগবো। হয় ট্যাহা দিবেন নইলে আংটি বেইচা দিমু।’
সালমা ভেজা চোখে নানাভাবে মিনতি করতে লাগলো। অভ্র চুপ করে থাকতে পারলো না। উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে গেলো।
‘কি হয়েছে এখানে? এত হুল্লোড় কিসের?’
‘এই যে বাপু! আপনি মনে হয় এই আফার পোলা?’
‘জ্বি।’
‘শোনেন আপনারে কই কি হইছে। আপনি বুঝবেন হিসাবডা।’
সালমা লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘ভাই, আমি বললাম তো দুইদিন পরেই দিয়া দিবো। বাজানের সামনে আলাপ করার দরকার নাই।’
‘দাঁড়াও মা। আমি শুনবো। আপনি বলেন চাচা।’
সালমা আঁচলে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইলো। দুচোখ ভেঙ্গে তার অশ্রুকণা ঝরছে। গোঁফওয়ালা লোকটি বললো,
‘আপনি যেদিন আইছেন সেদিন আফায় বাজারে আইছিলো। বাড়িতে কিচ্ছু নাই, মুরগী কিনবো। হের কাছে ট্যাহা আছিলো না। আমি আবার বাকিতে সদাই দেই না। তাই তার আংটি বন্ধক রাইখা দুইডা মুরগী নিবার চাইলো। এহন, হাজার হইলেও আমি মানুষ। আমার পোলাও শহরে পড়ালেখা করে। বাড়িতে আইলে ভালোমন্দ কইরা খাওয়াই। তাই বিষয়ডা বিবেচনা কইরা, আফারে না করি নাই। কথা আছিলো চাইর দিনের মধ্যে ট্যাহা দিয়া দিবো। আইজকা সাত দিন চলে হের ছায়াও বাজারে পড়ে না! আংটিও নিবার আসে না। এইডা কোনো কথা আফনেই কন?’
সবশুনে অভ্র পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। সালমা এখনো মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। অভ্র আড়চোখে সালমার আঙুলের দিকে তাকালো। যা ভেবেছে তাই। বিয়ের আংটিটাই বন্ধক রেখেছে। অভ্র বললো,
‘এখন আপনি কি চাইছেন?’
‘আজকের মধ্যে ট্যাহা দিলে আংটি ফেরোত। নইলে বিক্রি কইরা দিমু।’
সালমা ভাঙ্গা গলায় বললেন,
‘ভাই আমার খদ্দের দুইদিনের মধ্যেই জামার টাকা দিয়া দিবো। দয়া কইরা দুইটা দিন সময় দেন।’
‘আর একদিনও দাওন যাইবো না আফা।’
অভ্র বললো,
‘ঠিক আছে। আপনি আজকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। আমি সন্ধ্যায় গিয়ে টাকা দিয়ে আংটি নিয়ে আসবো।’
‘আইচ্ছা।’
লোকটি তার সাথের অল্প বয়স্ক ছেলেটিকে নিয়ে ফিরে গেলো। সালমা এখনো কেঁদে চলেছে। অভ্র ঢোঁক গিললো। তারও গলা ভেঙ্গে কান্না আসছে। সালমা এখনো কাঁদছে। অভ্র দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা ছেলের বুকে মাথা গুঁজে কাঁদছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। প্রকৃতিও যেনো মায়ের আহাজারিতে থমকে গিয়েছে। কাকগুলোও শান্ত ভাবে বসে আছে গাছের ডালে। অভ্র প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। আজ বুঝি তাদের স্থান নিম্ন মধ্যবিত্তদের চেয়েও এক ধাপ নিম্নে!
অভ্র ব্যাগ খুলে টাকা পয়সা খুঁজতে লাগলো। যদি কয়েক পয়সা পাওয়া যায়! বইয়ের ভাঁজে সত্যিই চকচকে একটি বিশ টাকার নোট পাওয়া গেলো। নোটে রুদালির নাম লিখা। হঠাৎ করে অভ্রর মনে হলো এই নোটটি রুদালি তাকে কোনো এক ইদে দিয়েছিলো। সালামি হিসেবে। সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো এই নোটটি কখনো খরচ করবে না। কিন্তু আজ সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের সময় এসেছে। তাছাড়া যে মানুষটির অস্তিত্ব তার জীবনে এখন আর নেই, সেই মানুষটির নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকার কোনো মানে হয় না। টাকাটা নিয়ে অভ্র বাজারে গেলো। ফোনে ব্যালেন্স ভরতে হবে। মকবুল ভাইকে ফোন করতে হবে। কিছু টাকা ধার চাইতে হবে। টিউশানটা সে করবে। এবিষয়েও তার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
রাতে ঝিলের পাড়ে ঠান্ডা বাতাসের ছড়াছড়ি। অভ্র একা বসে আছে। তার হাতে বিড়ি। দুপুরে সে খায়নি। সবকিছু জানার পর খাবার গলা দিয়ে নামার কথা না। খালি পেটে বিড়ি টানায় পেটের ভেতর দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আরো নানান উপসর্গের দেখা মিলেছে। বমিভাব, মাথাব্যথা, বুক ব্যাথা। তবুও অভ্র অন্যমনস্ক হয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। তার অন্যমনস্ক ভাব কেটে গেলো ফোনের শব্দে। পরিচিত নাম্বার। গত কয়েকদিন ধরে প্রায়ই এই নাম্বার থেকে কল আসে। অভ্র ফোন রিসিভ করলো।
‘বলুন।’
‘আজ এত শান্ত কন্ঠে কথা বলছেন যে! আমি তো আপনার ঝাড়ি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।’
অভ্র উত্তর দিলো,
‘এমনি।’
তনিমা উদ্বিগ্নচিত্তে বললো,
‘আপনার কি মন খারাপ?’
‘হুঁ।’
‘এজন্যই বুঝি আমি ফোন দেওয়ার পরেও ঝাড়ছেন না?’
অভ্র কোনো উত্তর দিলো না।
‘আপনি এখন কোথায়?’
‘ঝিলের পাড়ে।’
‘একা?’
‘হুঁ।’
‘ভয় করে না?’
‘ভয় কেনো করবে?’
তনিমা ঢোঁক গিয়ে বললো,
‘এত রাতে ঝিলের পাড়ে বসে আছেন। যদি অন্যকিছু পা টেনে ধরে?’
অভ্র অবাক হয়ে বললো,
‘কি পা টেনে ধরবে?’
‘ভূত!’
অভ্র একটু শব্দ করে হেসে উঠলো। বললো,
‘ভূত বলে কিছু নেই।’
‘আপনাকে কে বলেছে কিছু নেই? একটা ঘটনা শুনাবো, শুনবেন?’
‘শোনান।’
তনিমা বলতে শুরু করলো,
‘একটা লোক ঝিলে মাছ ধরতে যেতো। সে সবসময় রাতে যেতো…..’
অভ্র মনযোগ দিয়ে তনিমার গল্প শুনছে। তার ভালো লাগছে। এত ঝুট ঝামেলার পর কারো কথা শুনতে যদি ভালো লাগে তবে তার জন্য ফোনে একটুখানি সময় ব্যায় করলে ক্ষতি কি?
← পর্ব ১৩ | পর্ব ১৫ → |