আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
নুরুল আলমের বাড়িতে আজ সকাল থেকেই হুলুস্থুল কান্ড। বাবুর্চি ভাড়া করে আনা হয়েছে। নানারকম মুখরোচক খাবারের আয়োজন চলছে। আজ একটি বিশেষ দিন। তার একমাত্র মেয়ে রায়ার জন্মদিন। সেই সুবাদে ছোট খাটো পার্টি রেখেছেন নুরুল আলম। ছোট খাটো পার্টি হলেও গুণে গুণে চল্লিশ জনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই পার্টিতে অংশগ্রহণ করার মতো রায়ার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই আবার নুরুল আলমের বন্ধুদের অভাবও নেই। সম্প্রতি তার খুব কাছের এক বন্ধুর ছেলের বিয়ে হয়েছে। মেয়ে দেখতে গিয়েই চটজলদি শুভকাজ সম্পন্ন করে ফেলা হয়েছে। এখনো অনুষ্ঠান করা হয়নি। সেই বন্ধুও সপরিবারে আসছেন।
রায়া নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে। জন্মদিন উপলক্ষে এই আয়োজন তার পচ্ছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু বাবার অপ্রকৃতস্থ ভাব দেখতেও তার ভালো লাগছে। মানুষটা কত উৎসাহ নিয়ে সকল আয়োজন করছেন। অবশ্য প্রতিবছরই করেন। পুরো বাড়ি ম ম করছে বৈদেশিক খাবারের ঘ্রাণে।
নুরুল আলম রায়ার ঘরে ঢুকলেন। রায়া একমনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শে তার অন্যমনস্কভাব কেটে গেলো।
‘বাবা, তুমি এখানে! কিছু বলবে?’
নুরুল আলম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘একা একা কি করছিস, মা?’
রায়া মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘কিছু না। বসে আছি।’
‘বেলা গড়িয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে আসবে। গোসল করবি না? নতুন জামাকাপড় পরবি না?’
রায়া আবারো মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘পরবো।’
‘যা তাহলে। গোসল করে তৈরি হয়ে নে।’
‘তোমার বন্ধুরা কখন আসবে?’
‘এইতো সন্ধ্যার পর।’
রায়া কিছু বললো না।
আচমকা নুরুল আলমের বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। চোখ দুটো নিমিষেই এলো ঝাপসা হয়ে। অস্ফুটবাক্যে বলে উঠলেন,
‘কত বড় হয়ে গেছিস। আজ তোর মা বেঁচে থাকলে একসাথে কত আনন্দ করা যেতো। হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতো পুরো বাসা।’
‘হুঁ।’
‘মায়ের জন্য তোর মন খারাপ করছে তাই না রে?’
রায়া সহজ কন্ঠে বললো,
‘না তো। মনে খারাপ করছে না।’
নুরুল বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
‘মায়ের কথা তোর মনে পড়ছে না?’
‘না। যে মানুষটার অস্তিত্ব নেই সেই মানুষের কথা মনে করে লাভ আছে?’
নুরুল আলম বড় বড় চোখ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। রায়ার সেদিকে মনোনিয়োগের প্রয়োজন বোধ করলো না। বাবার সামনে থেকে উঠে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বড় করে শ্বাস নিয়ে আলমারি খুললো। নতুন জামা বের করলো। এরপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি তাহলে গোসলে যাচ্ছি।’
নুরুল মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
‘ঠিক আছে।’
রায়া বাথরুমে ঢুকে গেলো। কাপড় গুলো ঝুলিয়ে রেখে ঝরনা ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। হাঁটু দুটো ভাঁজ করে দুই হাত তার ওপর রেখে মাথা গুঁজে দিলো। রায়া কাঁদছে। ঝরনার ঠান্ডা পানির মাঝেও তার উষ্ণ চোখের পানি বিছিন্ন করা সম্ভব।
রুদালি উইন্ড চাইম হাতে বসে আছে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। উইন্ড চাইমটা কোথায় লাগাবে সে বুঝতে পারছে না। দরজার সামনে নাকি জানালার সামনে। উইন্ড চাইমটা ঝিনুকের তৈরি। সাগরপাড়ে একটি বাচ্চা ফেরি করে বেড়াচ্ছিল। শেষ বিকেলের আলোয় ঝিনুকগুলো কেমন চিকচিক করছিলো। রুদালি বিমোহিত হয়ে যায়। তার অনুরোধেই অর্ণব উইন্ড চাইমটা কিনে ফেলে। কিন্তু এখন এটা রুদালির পচ্ছন্দ হচ্ছে না। একবার ভাবলো ঘরে ঢোকার দরজার কাছে লাগাবে। পরক্ষণেই মনে হলো, জানালার কাছে লাগালে বেশ হবে! সূর্যের আলোয় সেই আগের চাকচিক্য ভাব ফিরে আসতে পারে। রুদালি যখন দ্বন্দ্বের টানা হেঁচড়ায় ক্লান্ত তখন ঘরে প্রবেশ করলো অর্ণব। মাত্র বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরলো। কাঁধের একপাশে টাওয়েল ঝুলছে।
‘কি ব্যাপার এভাবে বসে আছো কেনো?’
রুদালি করুণ কন্ঠে বললো,
‘উইন্ড চাইমটা দরজার সামনে লাগাবো নাকি জানালার সামনে লাগাবো বুঝতে পারছি না।’
অর্ণব বললো,
‘উইন্ড চাইম ছাড়ো। দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। আধা ঘন্টার মধ্যে আমরা বের হচ্ছি।’
‘বের হচ্ছি মানে? কোথায় যাচ্ছি?’
‘বললাম না? বাবার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু নুরুল আংকেলের মেয়ের জন্মদিন।’
রুদালি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘আমার হট্টোগোল পচ্ছন্দ না।’
‘বাহ। তুমি তো একদম রায়ার মতো!’
রুদালি অবাক হয়ে বললো,
‘রায়া টা কে?’
অর্ণব হেসে বললো,
‘কে আবার? নুরুল আংকেলের মেয়ে। তোমার চেয়ে বছর দুয়েক ছোট হবে হয়তো। কিন্তু মেয়েটা অনেক ভালো।’
‘ও।’
‘আমার অনেক আদরের ছোট বোনও বলতে পারো।’
রুদালি হাসলো। অর্ণব বললো,
‘হট্টোগোল ভালো না লাগলে রায়ার সাথে গিয়ে বসে থাকবে। প্রতিবছর ও তাই করে। জন্মদিন ওর, অথচ ওকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। যাইহোক, তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও।’
রুদালি বিরস মুখে উইন্ড চাইমটা অর্ণবের দিকে এগিয়ে বললো,
‘দয়া করে এটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলুন।’
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘যথা আজ্ঞা, মহারাণী। এবার তৈরি হতে যান?’
রুদালি হেসে বললো,
‘ঠিক আছে।’
রুদালি ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই অর্ণব মাথা চুলকাতে লাগলো। সেও দেখা যায় রুদালির মতো দোটানায় পড়ে গেলো। উইন্ড চাইমটা কোথায় লাগালে বেশি সুন্দর লাগবে? দরজার সামনে নাকি জানালার এপারে?
সিঁড়ি দিয়ে রমজান খান তিন তলায় উঠছেন। নুরুল আলম তাকে দেখা মাত্র হই হই করে উঠলেন। কোলাকোলি করে বললেন,
‘কিরে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলি। কয়েকদিন পর দাদা হয়ে যাবি। হা হা হা।’
রমজান খান হাসিমুখে বললেন,
‘ওরে দাদা কি আমি একা হবো রে? তুই হবি না?’
‘তা তো অবশ্যই। অর্ণব কি তোর একার ছেলে নাকি? আমারও ছেলে। তা কই সে কই?’
এপর্যায়ে রুদালি এবং অর্ণবের পাশাপাশি দেখা মিললো। অর্ণব সালাম দিলো। হাসিমুখে বললো,
‘কেমন আছেন আংকেল?’
‘আলহামদুলিল্লাহ বাবা। ভালো আছি।’
অর্ণব রুদালিকে ইশারা করলো। রুদালি উবু হয়ে দোয়া নিলো। নুরুল প্রাণভরে দোয়া করে দিলেন।
‘কি যেনো নাম তোমার মা?’
‘রুদালি।’
‘বাহ খুব মিষ্টি নাম।’
অর্ণব বললো,
‘আংকেল রায়া কই?’
নুরুল পানসে কন্ঠে বললেন,
‘কই আবার? গিয়ে দেখো, ঘরবন্দী হয়ে আছে।’
‘আচ্ছা আমি তাহলে রুদালিকে নিয়ে যাই। রায়ার সাথে তো ওর পরিচয় নেই।’
‘হ্যাঁ বাবা অবশ্যই। ওকে নিয়ে যাও।’
অর্ণব রুদালিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
রমজান খান জিজ্ঞেস করলো,
‘ছেলের বউ পচ্ছন্দ হয়েছে?’
‘মাশা আল্লাহ। ভারী মিষ্টি চেহারা।’
‘মেয়েটা অনেক লক্ষ্মী।’
‘পড়াশোনা কোন পর্যন্ত করেছে?’
‘অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।’
‘বাহ। খুব ভালো। অনুষ্ঠান করবি না? যেভাবে ছেলের বিয়ে দিলি।’
‘আসলে দেখতে গিয়ে পচ্ছন্দ হয়ে গেলো। মেয়ের বাবার জোরাজুরিতে আর না করতে পারিনি। ইচ্ছা আছে এই বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠান করার। বাকিটা উনার ইচ্ছা।’
রমজান খান আকাশে এক আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো। মানে সবই আল্লাহর ইচ্ছা। নুরুল আলম হাসলেন। পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন মুখে বললেন,
‘ভাবি কই?’
‘পার্টির নাম শুনেই বাতের ব্যাথার বাহানা জুটিয়েছে!’
‘ভাবি এজীবনে আর শুধরাবে না।’
রমজান খান হেসে বললেন,
‘চল ভেতোরে যাই।’
‘চল।’
রায়া ডায়রিতে কিছু একটা লিখছিলো। অর্ণবের গলার স্বর শুনে চমকে উঠে।
‘কি খবর ভেটকি?’
রায়া পেছনে ঘুরে হেসে ফেলে।
‘আরে অর্ণব ভাইয়া!’
‘শুভ জন্মদিন।’
‘ধন্যবাদ।’
রায়া দেখলো অর্ণবের পাশে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা কিছুটা অপ্রস্তুত। রায়া মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অর্ণবের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই অর্ণব হেসে ফেললো।
‘তোর ভাবী। তোর মতোই। হুল্লোড় পচ্ছন্দ না। তাই ভাবলাম তোর কাছে রেখে যাই। দুজনে মিলে গল্প গুজব কর।’
রায়া হাসিমুখে বললো,
‘কোনো সমস্যা নেই। ভাবী এখানে থাকুক। তুমি যাও পার্টি ইনজয় করো।’
অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে রুদালির দিকে তাকালো। ইশারায় আশ্বস্ত করে বললো,
‘থাকো তাহলে?’
‘আচ্ছা।’
অর্ণব রুম থেকে বের হয়ে গেলে রায়া এগিয়ে আসলো। রুদালির হাত ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে আসলো। বললো,
‘আমার নাম জানেন?’
‘জানি। তোমার নাম রায়া।’
রায়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘আমার নাম বলে দিয়েছে?’
রুদালি হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘হ্যাঁ।’
‘কেমনটা লাগে!’
‘কি হয়েছে?’
‘আমার নাম বলেছে অথচ আমাকে আপনার নাম বলে গেলো না।’
রুদালি হেসে ফেললো,
‘এই কথা? আমি বলছি। আমার নাম রুদালি।’
‘অর্ণব রুদালি। বাহ! আপনার নামটা কিন্তু ভাইয়ার নামের পাশে মানিয়েছে।’
রুদালি হাসলো। মুখে কিছু বললো না।
‘আপনি কিসে পড়াশোনা করছেন?’
‘অনার্সে।’
‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়?’
‘ভাসানীতে।’
রায়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। হঠাৎ করে তার অভ্রর কথা মনে হলো। অভ্র আর রুদালি একই ভার্সিটিতে পড়ছে। রায়া কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। হঠাৎ করে রুদালি কাশতে শুরু করলো। রায়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। রুদালিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দ্রুত পানি আনতে গেলো। রায়া যাওয়ার পর পরই রুদালি নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো। গলার খুশখুশ কমে এসেছে। হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে সাই সাই করে দক্ষিণা বাতাস এসে ঘরময় ছোটাছুটি করতে লাগলো। বাতাসের তোড়ে রায়ার ডায়রির পাতা একাই উল্টাতে লাগলো। ডায়রিতে চোখ পড়তেই রুদালি চমকে উঠলো। একটি পৃষ্ঠায় রঙিন মার্কার দিয়ে বড় করে লিখা, ‘ভালোবাসি অভ্র স্যার।’
← পর্ব ১৪ | পর্ব ১৬ → |