আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
রায়া হাতে পানির গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কাঁচের গ্লাসে টলমলে পানি। রুদালির দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিলো সে। রুদালি সম্পূর্ণ গ্লাস খালি করে রায়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘ধন্যবাদ, তোমাকে।’
রায়া তাকে স্বাগত জানালো। গ্লাস নিয়ে পড়ার টেবিলের ওপর রেখে আড়চোখে ডায়রির দিকে একবার তাকালো। সাথে সাথে বুক ধক করে উঠলো রায়ার। তাড়াহুড়ো করে ডায়রি বন্ধ করে ফেললো। রুদালির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রুদালি জিজ্ঞেস করলো,
‘তারপর তুমি কিসে পড়ছো?’
‘টেন এ। এবার এস এস সি দিবো।’
রুদালির কিছুটা খটকা লাগলো। ডায়রির পাতায় পরিচিত সেই নাম দেখে সন্দেহের যে জালটা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো, তা যেনো আরো ঘটা করে জেঁকে বসলো।
‘বেশ ভালো। প্রস্তুতি কেমন?’
‘ভালো।’
ঘরজুড়ে ক্ষণিককাল নীরবতা বইলো। পুনরায় প্রশ্নপর্ব শুরু হলো রায়ার কন্ঠে।
‘আপনাদের ক্লাস কবে শুরু হবে?’
‘এইতো। কয়দিন পর থেকেই।’
‘আংকেল, ভাইয়া সবাই মিলে সহযোগিতা করছে তো?’
‘আসলে আমি এই বিষয়ে এখনো তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলিনি। বলবো।’
‘না বললেও সমস্যা নেই। অর্ণব ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ। রমজান আংকেলও মাটির মানুষ। বলতে গেলে ভাইয়া একদম উনার বাবার মতো হয়েছে। দেখবেন পড়াশোনার বিষয়ে সবার সহযোগিতা পাবেন।’
রায়ার কথা শুনে রুদালি হাসলো। সে জানে পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়ার জন্য তার স্বামী অথবা শ্বশুর না থাকলেও, অন্য একজন ঠিকই আছেন। তবে সেই প্রসঙ্গে রায়ার সাথে সে অবশ্যই কোনো কথা বলবে না।
ডিনার, কেক কাটা সব মিলিয়ে পার্টি শেষ হলো রাত দশটায়। রমজান খান সপরিবারে বাড়ি ফিরে এলেন। রুদালি তার ঘরে ঢুকতেই টুং টাং জাতীয় শব্দ শুনতে পেলো। উইন্ড চাইমটা জানালার কাছে লাগানো হয়েছে। থাই গ্লাস একটু ফাঁকা হয়ে আছে। সেখান থেকেই ঝড়ো বাতাসের আগমন। উইন্ড চাইমটা থেকেও নানাবিধ শব্দ আসছে। মনের অজান্তেই রুদালি হেসে ফেললো। সঠিক জায়গায় উইন্ড চাইমটি লাগানোর জন্য অর্ণবকে সাধুবাদ জানানো উচিত। কিন্তু সে ঘরে নেই। রায়াকে নিয়ে আরো একটি প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই প্রশ্নটিও অর্ণবকে শুধাতে চায় রুদালি।
রমজান খান ছেলেকে নিয়ে ছাদে চলে এসেছেন। বহুদিন পর একটুখানি মদ ছুঁয়েছেন তিনি। যদিও নিজের ইচ্ছায় নয়। বন্ধুর অনুরোধ রক্ষার্থে। তবুও ছুঁয়েছেন যখন এই অনুভূতি তিনি বৃথা যেতে দিবেন না। কোথায় যেনো তিনি শুনেছেন, বাতাস গায়ে মাখলে নেশা ধরে। সত্যতা যাচাই করার জন্যই তিনি ছাদে এসেছেন। সঙ্গী হিসেবে এনেছেন নিজের ছেলেকে। ছেলের সাথে তিনি যথেষ্ট খোলামেলা আলাপ করেন। সাবলীল আচরণ করেন। তবে, এই আচরণের বিরূপ প্রভাব কখনো পড়েনি। ছেলে বাবাকে সম্মান করে।
ছাদে ঝলকে ঝলকে দমকা হাওয়ার তোড়। এই তোড়ে সত্যি বুঝি রমজান খানকে নেশায় পেয়ে বসেছে! তিনি সিগারেট জ্বালিয়ে অর্ণবের দিকে এগিয়ে দিলো। অর্ণব অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। অন্ধকারে বাবার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে ইতস্তত করে বললো,
‘বাবা, আমি সিগারেট খাই না।’
রমজান খান জিভ কেটে বললেন,
‘ওহ হো! তুই তো সিগারেট খাস না। যদি খেতিস তাহলে নিতি?’
অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘না।’
রমজান খান তৃপ্তির হাসি হাসলেন। নিশ্চিন্তে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। বললেন,
‘ছোটবেলা থেকেই আমি তোর সাথে খুব খোলামেলা আলোচনা করি। ওপেন মাইন্ডেড ফাদার বলতে যা বোঝানো হয় সেটাই আমি। লোকে কত কিছু বলতো। ছেলে বড় হয়ে বেয়াদব হয়ে যাবে। মা বাবাকে মান্য করবে না। আরো কত কি!’
এটুকু বলে রমজান ছেলের পিঠে হাত থাবড়ে বললেন,
‘আমি জানতাম সবাই একদিন ভুল প্রমাণিত হবে। তবুও নিজের মাঝে খুঁতযুক্ত ভাবনা তো থাকেই। সেই ভাবনা থেকেও তুই আজকে আমায় মুক্তি দিলি।’
অর্ণব হাসলো।
‘থ্যাংক ইউ বাবা।’
‘তুই ভালো আছিস তো অর্ণব?’
‘হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছো কেনো বাবা?’
‘ঘরে নতুন বউ তোলার পর তোর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগ হলো কই? সবকিছু ঠিক আছে তো?’
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘হুঁ। আছে। তবে কি জানো বাবা? বিয়ে মানে অনেক বড় একটা দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়া। এই দায়িত্বটা অনেক কঠিন। তার চেয়েও কঠিন নিজের স্ত্রীর সাইকোলজি বুঝতে পারা। তাকে প্রতিটি পদক্ষেপে সাহায্য করা। আশ্বাস দেওয়া।’
রমজান খান দুদিকে মাথা নাড়লেন। এর মানে হলো, না। তিনি বললেন,
‘স্ত্রীকে যদি মন থেকে সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে মানিস তাহলে বিষয়টা ঠিক ততটাই সহজ যতটা কঠিন তুই ভাবছিস। একটা কথা মনে রাখবি। নারী দেহ জোর খাটিয়ে পাওয়া যায়, তবে এর মাঝে পুরুষত্ব নেই। কিন্তু এই দেহ যখন তোকে ভালোবেসে নিজের থেকে আত্মসমর্পণ করবে তখনই তুই স্বার্থক। আর এই স্বার্থকতা পেতে হলে স্বার্থহীন ভালোবাসা প্রয়োজন। ভালোবেসে আদায় করে নিতে হবে। প্রথমে বন্ধুত্ব, পরবর্তীতে বাকিসব!’
অর্ণব সব বুঝে ফেলেছে এমন ভাবে মাথা নাড়লো। রমজান খান হেসে বললেন,
‘দ্যাটস লাইক মাই সন।’
সিগারেটের বাকি অংশে তিনি মনোনিবেশ করলেন। অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বললো,
‘বাবা তোমার সাথে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
‘কি কথা?’
‘রুদালির পড়ার বিষয়ে।’
‘ও হ্যাঁ। কবে ক্লাস শুরু হবে এসব কিছু বলেছে?’
‘না আমাকে এখনো কিছু বলেনি। তবে বলবে। আমি অবশ্য ওর বলার প্রতীক্ষায় বসে নেই। খোঁজ নিয়ে ফেলেছি। কয়েকদিনের মধ্যেই ওদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। ওর পড়াশোনার প্রতি অনেক আগ্রহ।’
‘হুঁ। যাবে। পড়াশোনা করবে। সমস্যা নেই তো।’
অর্ণব ইতস্তত করে বললো,
‘মাকে তো চিনোই।’
‘আরে বেটা ওই বুড়ি কে নিয়ে ভাবিস না। ওই বুড়িকে সামলানোর জন্য এই বুড়া আছে।’
অর্ণব নিচু স্বরে বললো,
‘মা যদি কখনো জানতে পারে, তার অনুপস্থিতিতে তাকে বুড়ি বলে সম্বোধন করছো তখন ঠেলা বুঝবে!’
‘কথা মন্দ বলিসনি। নেশাটা ভালোই ধরেছে। নিচে যে যাবো, সাহসে কুলাচ্ছে না!’
‘কিছুই হবে না। চুপটি করে মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বে। কিচ্ছু টের পাবে না।’
‘তুই যখন বলছিস তাই হবে হয়তো। রাত তো অনেক হলো। চল যাই।’
অর্ণব হেসে বললো,
‘চলো।’
রুদালি বিছানা গুছিয়ে বসে আছে। অর্ণব হাসিমুখে ঘরে ঢুকলো। উইন্ড চাইমে এখনো শব্দ হচ্ছে। বাতাস থামার নাম গন্ধ নেই।
‘বস্তুটা কি ভুল জায়গায় লাগিয়েছি, রুদালি?’
‘না তো! ঠিক জায়গায় লাগিয়েছেন। আর এইজন্য আপনার ধন্যবাদ প্রাপ্য।’
‘তাই? কার কাছ থেকে?’
‘আমার কাছ থেকে।’
‘দিয়ে ফেলো। অপেক্ষা কিসের?’
‘ধন্যবাদ।’
‘স্বাগত। তবে রাতেও মনে হচ্ছে এই বস্তুটির আওয়াজ থামবে না। ঘুমাতে পারবে?’
‘পারবো।’
‘তাহলে তো চিন্তার কারণ নেই।’
রুদালি হাসলো। অর্ণব জামা কাপড় পালটে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বসলো। রুদালি অবাক হয়ে বললো,
‘আপনি ঘুমাবেন না?’
‘কাজ আছে একটু। না করে ঘুমাতে পারছি না। তুমি ঘুমিয়ে যাও।’
‘কফি বানিয়ে দিবো?’
অর্ণব বললো,
‘দিতে পারো।’
রুদালি কফি বানাতে গেলো। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো কথাটা কিভাবে শুরু করবে। মাথায় বুদ্ধিও খেলে গেলো। এক মগ স্ট্রং কফি বানিয়ে ফিরে এলো। অর্ণবের দিকে মগ এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘আচ্ছা আপনার বাবার বন্ধুর মেয়ে রায়া। ওকে দেখে বেশ বড় মনে হয়। বুঝিই নি এখনো স্কুলের গন্ডি পেরোয় নি।’
অর্ণব হেসে বললো,
‘হিসেব মতো ভেটকির এবার ইন্টার দেওয়ার কথা। পর পর দুবছর ম্যাট্রিকে ফেল করে আটকা পড়ে গেছে।’
রুদালির সন্দেহ এবার সত্যিতে রূপান্তরিত হলো। সে ভুল ভাবেনি। রায়ার ডায়রির খাতায় সে তার প্রাক্তন প্রেমিক অভ্রর নামই দেখেছে। রুদালি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘কি ব্যাপার? দাঁড়িয়ে আছো যে?’
‘কফি কেমন হয়েছে?’
‘ভালো হয়েছে।’
‘আমি ঘুমিয়ে যাই তাহলে।’
‘আচ্ছা। শুভ রাত্রী।’
‘শুভ রাত্রী।’
রুদালি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। তার দৃষ্টি উইন্ড চাইমটির দিকে। কি সুন্দর আলগোছে দুলছে! ধীরে ধীরে রুদালির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো। কর্ণিয়া গড়িয়ে একফোঁটা অশ্রু নিঃশব্দে বালিশের কভারের ওপর পড়লো। গহীন রাতে নীরব কান্না মেশানো মুখ লুকাতে বালিশের জুড়ি নেই!
← পর্ব ১৫ | পর্ব ১৭ → |