আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
রমজান খান বারান্দায় পায়চারি করছেন। টানা যে পায়চারি করছেন ঠিক তা নয়। থেকে থেকে থামছেন আবার নতুন উদ্দ্যমে হাঁটা শুরু করছেন। থামছেন তিনি তার সাধের ফুলগাছগুলোর কাছে। বারান্দায় তার নতুন অতিথি এসেছে। তাদের নিয়েই অন্যরকম উষ্মা ছেয়ে আছে রমজানের চোখে মুখে। ফুলগুলো তিনি আনিয়েছেন বিসিকে যাওয়ার পথে মেইন রোডে যে সরকারি নার্সারিটা পড়ে সেখান থেকে। গোলাপ ফুল, নয়নতারা, দুই রঙের বাগান বিলাস আরো বেশ কয়েকটি ফুলগাছ তিনি কিনেছেন। হাঁটার মাঝপথে তিনি মনের আনন্দে ফুলগুলো স্পর্শ করে যাচ্ছেন। সেই হাত আবার নাকে নিয়ে শুঁকছেন। কি মিষ্টি গন্ধ! আচ্ছা সবগুলো ফুলের গন্ধ মিশিয়ে কি পারফিউম তৈরি করা যায় না? রমজান খানের যদি পারফিউমের ফ্যাক্টরি থাকতো তাহলে তিনি অবশ্যই চেষ্টা করে দেখতেন। আরো বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি চললো। ক্লান্তিরা অবশ্য বেশিক্ষণ রমজান খানকে ছুটি উপভোগ করতে দিলো না। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিলেন। এমন সময় সাহেলা হাতে চা নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলো। একটু শব্দ করেই চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রাখলো। রমজান খান ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
‘কি ব্যাপার? মুখ এরকম কয়লার মতো কালো বানিয়ে রেখেছো কেনো?’
সাহেলা কোনো উত্তর দিলো না।
‘কি আজব ব্যাপার! কথা বলো না কেনো? হয়েছে কি?’
সাহেলা খেঁকিয়ে উঠলো,
‘কি হয়েছে সেটা বলেই বা কি হবে? বাড়ির কেউ কি আর আমার কথা শুনে? আমার কথা ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়? যার যা খুশি তাই করছে। তা করুক গে! আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম বান্দী হয়ে, মরবোও বান্দী হয়ে। আমার আবার কিসের এতো আপত্তি?’
রমজান খান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘আহা! কি হয়েছে সোজা সাপ্টা বলো না। এত পেঁচিয়ে বলার কি প্রয়োজন?’
সাহেলা এবার কঠিন গলায় বললো,
‘বাড়ির বউ ব্যাগ কাঁধে এখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে ভার্সিটি পড়তে যাবে। এসবও আমার দেখা লাগবে!’
রমজান খান খুব সাবধানে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর গলা কেশে পরিষ্কার করে বললেন,
‘রুদালির কথা বলছো? ও কি ভার্সিটি গিয়েছে নাকি আজকে?’
‘হুঁ।’
‘তা বেশ তো! এতে ক্ষতি কি! মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো। তাছাড়া বিয়ের সময় ওর বাবাকে আমি কথা দিয়েছি। মেয়েকে পড়ালেখা করাবো।’
‘এরকম একটু আধটু কথা নেওয়া দেওয়া হরহামেশাই হয়। তার মানে এই না যে সেসব ধরে বসে থাকতে হবে।’
কথোপকথনের এই পর্যায়ে রমজান খানের কপালে ভাঁজ পরিলক্ষিত হলো। তিনি গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘কি চাইছো তুমি? খুলে বলো তো?’
‘বাড়ির বৌ এরকম রঙ ঢং করে বাইরে পড়তে যেতে পারবে না।’
‘কেনো? কি সমস্যা? অর্ণব সারাদিন বাড়িতে থাকে না। তুমি রান্নাঘরে অন্য কারো উপস্থিতি সহ্য করতে পারো না। মেয়েটা সারাদিন বাড়ি বসে করবে কি?’
‘এত কিছু জানি না। আমার মন চান দিচ্ছে। খানিকটা সন্দেহও হচ্ছে!’
‘সন্দেহ? কি নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তোমার?’
‘যেভাবে মেয়েটাকে হুট করে আমাদের ছেলের ঘাড়ে তুলে দিলো, আমার তো মনে হয় মেয়ের সমস্যা আছে। তুমিও যাচাই বাছাই না করে মত দিয়ে দিলে।’
‘তুমি খামোখা এত ভাবছো।’
‘যাই বলো, আমি মেয়ের পড়াশোনার পক্ষে না।’
রমজান খান চুপ হয়ে গেলেন। মনস্থির করলেন আর কথা বাড়াবেন না। অবশ্য কথা বাড়িয়েও লাভ নেই। সাহেলা কথার পিঠে কথা বলতেই থাকবে। যুক্তি তর্কও চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে। অনন্তকাল। আনস্টপেবল আর্গুমেন্ট। সাহেলা সহজ গলায় বললো,
‘একটু পরে কমলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কাপ নিয়ে যাবে।’
সাহেলা বের হয়ে গেলো। রমজান খান কানের পাশে চশমা গুঁজে নিলেন। আজকের পত্রিকা এখনো পড়া হয়নি।
রুদালি মাওলানা ভাসানি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশাদ্বার দিয়ে ঢুকলো। অভ্রর সাথে দেখা হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সম্ভাবনা বাদ দিয়ে আশঙ্কা বলা হচ্ছে কারণ রুদালি চায় না অভ্রর সাথে তার দেখা হোক। কিন্তু প্রকৃতি বড় অদ্ভূত। মানুষের ইচ্ছের বিপরীতে চলতে তার সীমাহীন আনন্দ! ভার্সিটির পুকুর পার হওয়ার সাথে সাথে অভ্রর দেখা পাওয়া গেলো। গাছের গোড়ায় বসে আছে। একা। হাতে বই। অভ্রর গল্পের বই পড়ার অভ্যাস নেই। তাই একাডেমিক বই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। একবার রুদালি অভ্রকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই পড়তে দিয়েছিলো। চোখের বালি। লেগে থেকে প্রথম কয়েক পাতা পড়ানো গেলো। বাকি পাতাগুলো সে ছুঁয়েও দেখলো না। আবার কে জানে! হয়তো নতুন করে গল্পের বই পড়া শিখেছে। বা কেউ শিখিয়ে নিয়েছে। রুদালির মানসিকতা বদলাতে শুরু করলো। তার অভ্রর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। ছেলেটা কেমন আছে জানতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পর তার খবরা-খবর নেওয়াটা কি অন্যায়ের মাঝে পড়ে?
‘কেমন আছো?’
অভ্র চমকে উঠলো। মুখ তুলে চাইলো। বুকটা ধক করে উঠলো। মরীয়া বাতাসে যেনো অভ্যন্তরীন হাহাকার গুলো জেগে উঠেছে। সে নিজেকে সামলে নিলো। হাসিমুখে উত্তর দিলো,
‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো আছি।’
প্রত্যুত্তরে অভ্র শুধু হাসলো মাত্র। আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে নাকি তার বোধগম্য হচ্ছে না। রুদালি আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো অপেক্ষা করছে। অভ্র কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা! অভ্র জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে?’
‘আমার এখন দুটো পরিবার। কোন পরিবারের কথা জানতে চাইছো?’
‘নতুন পরিবার।’
রুদালি হাসলো। হেসে উত্তর দিলো,
‘ভালো আছে। সবাই অনেক ভালো আছে।’
অভ্রও হাসলো। আবার কিছুসময়ের জন্য পরিবেশ থমকে গেলো। এ যেনো ক্ষণিকে ক্ষণিকে মন খারাপের বার্তা। পুরোনো দিনের একসাথে কাটানো মুহূর্তের ঐকতান। এ যেনো কোনো উপন্যাসের কলমের ছোঁয়ানো ইতিকাল। পুরোটা উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেনো তারাই ছিলো। তাদের ভালোবাসার চিত্রকলা ফুটে উঠছিলো। শুধু শেষটা হলো তাদের অনিচ্ছায়। বাস্তবতার মোহে হলো উপন্যাসের বিচ্ছিন্ন এক শেষ। রুদালি বললো,
‘আমি তাহলে ক্লাসে যাই?’
‘যাও।’
‘ভালো থেকো।’
‘তুমিও।’
রুদালি সামনে পা ফেলতে শুরু করলো। আজ থেকে অভ্রর সাথে তার মাঝে মাঝে দেখা হবে। তাদের আকাশে মেঘগুলো জমাট বেঁধেছে। এ মেঘগুলো স্থির। এ যেনো চোখের পলক না ফেলতেই হারিয়ে ফেলা সময়। মনের ক্ষুধা না মিটতেই বিযুক্তির খবর। চাইলেও এখন আর জেলা রোডের ফুচকা আর চটপটির প্লেটে কেউ ভাগ বসাতে আসবে না। আজ অভ্রর কাছে যেতেই সেই সস্তা পারফিউমের গন্ধ রুদালির নাকে লেগেছে। আজ সেই গন্ধটা তার কাছে অচেনা বলে মনে হয়েছে। চিরচেনা লাগেনি! রুদালি সবে বুঝতে পেরেছে গন্ধটা ভীষণ ঝাঁঝালো। আগে তো কখনো মনে হয়নি! রুদালির বিছানার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটা মিষ্টি গন্ধযুক্ত পারফিউম গায়ে মাখে। সেই গন্ধে এখন রুদালি বিমোহিত। সময় বদলে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে পুরোনো অনুভূতি। দিয়ে যাচ্ছে নতুন আবেগ। এইতো জীবনের সংজ্ঞা।
রাতে অর্ণব অফিস থেকে ফিরলো। ঘরে ঢুকে দেখলো রুদালি জানালার কাছে বসে আছে। উদাস দৃষ্টি মেলে দিয়েছে আকাশে।
‘সারাদিন কেমন গেলো আজ? ভার্সিটি কেমন ছিলো?’
রুদালি আগের অবস্থায় থেকেই জবাব দিলো,
‘ভালো।’
‘পুরোনো বন্ধুদের সাথে মন খুলে কথা বলেছো?’
রুদালি হেসে বললো,
‘আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই যার সাথে মন খুলে কথা যায়।’
‘ও।’
এমন সময় শব্দ করে কোথাও বাজ পড়লো। রুদালি ছিটকে উঠলো কিন্তু জানালার কাছ থেকে সরলো না। অর্ণব অবাক হয়ে বললো,
‘বাজ পড়লে তুমি ভয় পাও না?’
‘না। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে কি?’
‘কি আজব মেয়েরে বাবা! বাংলা সিনেমাতে দেখো না বাজ পড়লে নায়িকারা ভয় পায়। নায়ককে জড়িয়ে ধরে। তোমার আমার মাঝে এ জাতীয় ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই দেখা যায়।’
রুদালি প্রত্যুত্তরে হাসলো।
‘ রুদালি বাইরে যাবে?’
‘এখন!’
‘হ্যাঁ। চুপ করে বেরিয়ে যাবো।’
‘কোথায় যাবো?’
‘ক্যাপসুলের সামনে। আইসক্রিম খেতে।’
‘আকাশের যে অবস্থা! যখন তখন বৃষ্টি শুরু হবে।’
‘শুরু হলে হবে। ভিজতে ভিজতে আইস্ক্রিম খাবো।’
রুদালি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজে আইস্ক্রিম খাওয়ার পরিকল্পনা রুদালির কাছে নতুন নয়। বহু আগে তার ডায়রির পাতায় এই ইচ্ছের কথা লিখা হয়ে গেছে। অর্ণবের প্রতিটি পদক্ষেপ সেই ডায়রির লিখাগুলোর সাথে মিলে যায়। কেনো যায় এও এক রহস্য!
← পর্ব ১৬ | পর্ব ১৮ → |