আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
মাস কয়েক পর...। অভ্র এখন দুজনকে পড়ায়। বাম্পু আর ট্যাম্পুকে। বাম্পু ক্লাস এইট এ পড়ে। ট্যাম্পু পড়ে ক্লাস নাইনে। ট্যাম্পু বাম্পুর চাচাতো ভাই। তাদের নাম মিলিয়ে রাখা হয়েছে। এ বংশের সব ভাই বোনদের নাম কি মিলিয়ে রাখা হবে? মকবুল ভাই বাম্পুর বড় বোনকে পড়াতেন। সেই মেয়ের নাম হলো শ্যাম্পু। অর্থাৎ বাম্পুর বড় বোনের নাম শ্যাম্পু। ট্যাম্পুর কোনো বোন আছে কিনা অভ্র এখনো জানে না। কিন্তু সে ধারণা করতে পারছে। ট্যাম্পুর কোনো বোন থাকলে তার নাম হবে ল্যাম্পু। এই বংশের নাম একসময় ‘এম্পু’ হয়ে যাবে। বাচ্চাগুলো বড় হয়ে পরিচয় দিবে আমরা ‘এম্পু’ বংশের সন্তান। ব্যাপারটা বেশ মজাদার!
দুজনকে পড়ানোর ফলে হাতে আরো কিছু টাকা আসছে অভ্রর। হেসে খেলে না হলেও মাস কেটে যাচ্ছে তার। আজ বাম্পু আর ট্যাম্পু দুজনই ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে পড়তে এসেছে। ট্যাম্পুর চোখ চিকচিক করছে। যেনো দুচোখে জ্বলজ্বল করে তারা জ্বলছে। আর বাম্পুর চোখে ভয়। তারও কারণ রয়েছে। বোর্ড পরীক্ষাকে সকলেই ভয় পায়। বাম্পুর জে এস সি পরীক্ষার তারিখ ঠিক করে ফেলা হয়েছে। এদিকে এস এস সি ক্যান্ডিডেট দের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হলো বলে! ট্যাম্পুদের স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে। অবশ্য টেস্ট পরীক্ষার ঝামেলা মিটলে তাদের বার্ষিক পরীক্ষার ঝামেলা শুরু হবে। কিন্তু এ নিয়ে ট্যাম্পুকে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। বাম্পুর মাথায় অভ্র হাত বুলিয়ে দিলো। নরম কন্ঠে বললো,
‘মন খারাপ কেনো?’
‘ভয় লাগছে, স্যার।’
‘ভয় লাগছে! কেনো?’
বাম্পু চুপ করে রইলো। পাশ থেকে ট্যাম্পু বলে উঠলো,
‘স্যার, বাম্পু পরীক্ষা নিয়ে টেনশন করছে।’
অভ্র বাম্পুকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
‘ভয় কিসের? তুমি অনেক ভালো রেজাল্ট করবে।’
বাম্পু কিছুক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে বসে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ট্যাম্পু ভাইয়ার থেকেও ভালো করবো?’
ছেলেটার প্রশ্ন শুনে অভ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। সে চোখে এক ঝাঁক বিস্ময় নিয়ে দেখলো বাম্পুর চোখের কোণায় পানি।
‘একি বাম্পু! কান্না করছো কেনো?’
‘আমি যদি ট্যাম্পু ভাইয়ার চেয়ে বেশি না পাই মা আমাকে খুব মারবে। বলেন না স্যার, আমি কি ট্যাম্পু ভাইয়ার চেয়ে বেশি পাবো?’
অভ্র বুঝতে পারলো তার ধারনা ভুল ছিলো না। প্রথম যেদিন সে বাম্পুকে পড়াতে আসে ছেলের হাতে লম্বা লম্বা কালো দাগ আবিষ্কার করেছিলো। কিন্তু তাকে এবিষয়ে কিছু শুধায়নি। অবশ্য, শুধানোর প্রয়োজন মনে হয়নি। পারিবারিক ব্যাপারে নাক ঘষা উচিত নয়। সে বাইরের লোক। তবে বাম্পুর মা ছেলের পড়াশোনার বিষয়ে যে কতটা সিরিয়াস সেটা তার কথা বার্তা আর অভিযোগের ফুলঝুরি ছড়ানো দেখেই অভ্র আঁচ করতে পেরেছিলো। এই বয়সের ছেলেরা অনেক চঞ্চল প্রকৃতির হয়। কিন্তু বাম্পু একদম আলাদা। খুব চুপচাপ। অভ্র পুনরায় বাম্পুর মনে শক্তি জোগালো।
‘নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই তুমি ভালো করবে।’
এ পর্যায়ে ট্যাম্পুও বলে উঠলো,
‘হ্যাঁ, ভাই। তুই আমার থেকেও ভালো করবি। মিলিয়ে নিস।’
অভ্র আর ট্যাম্পুর কথায় বাম্পু ভরসা করতে চাইলো। কিন্তু ঠিক কতখানি ভরসা করতে পেরেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। অভ্র তাদের বই খাতা খুলতে বললো। পড়ানোর এক ফাঁকে, অভ্রর মনের মখমলের পর্দার আড়াল হতে রায়া বেশ কয়েকবার উঁকি দিলো। বড় জানতে ইচ্ছা করছে তার, মেয়েটার প্রস্তুতি কেমন? টেস্ট পরীক্ষায় এবার উত্তীর্ণ হবে তো?
বিশাল বড় একটি গ্লাস রায়ার পড়ার টেবিলের ওপর রাখা হলো। কাঁচের গ্লাসে ধবধবে সাদা দুধ। দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। কিন্তু খেতে ঠিক ততটাই বিশ্রি লাগবে। তবুও রায়ার খেতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দুধের গ্লাস খালি হবে না নুরুল আলম এক ইঞ্চিও এদিক সেদিক নড়বেন না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। দুধ খাওয়া নিয়ে রায়ার ওপর এই অত্যাচার শুরু হয়েছে বিমল স্যারের নির্দেশে। তিনি নুরুল আলমকে বলেছেন,
‘আপনার মেয়ে এবারো ফেল করবো। তার মাথায় তো দুধের অভাব।’
‘মাথায় দুধের অভাব?’
তিনি পান চিবোতে চিবোতে উত্তর দিয়েছেন,
‘জ্বে। তাকে বেশি কইরা দুধ খাওয়ান। মাথায় দুধ গেলে, ব্রেন পুষ্টি পাবো। মেয়ের বুদ্ধি বাড়বো।’
‘নিয়মিত দুধ খেতে না দিলে মেয়ে পাশ করবে না?’
‘জ্বে না। পাশ করাতে চাইলে তারে দুধ খাওয়ান। পাশের সাথে বুদ্ধি ফ্রি। মাইয়া মানুষের মাথায় বুদ্ধির অভাব।’
বিমল বাবুর কথা নুরুল আলমের মনে ধরেছে। তিনি নিষ্ঠার সাথে স্যারের নির্দেশ পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন রায়াকে জোর করে এক গ্লাস দুধ খেতে হচ্ছে। বুদ্ধি বাড়লো কিনা তা নিয়ে নুরুল আলমের মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু মেয়ের এবার পাশ করতে হবে। রায়া শান্ত গলায় বললো,
‘বাবা, আমি দুধ খাবো না।’
‘খাওয়া লাগবে। মাথায় দুধ নাই তোর।’
রায়া বিরক্তি ভরা কন্ঠে বললো,
‘বাবা মূর্খদের মতো কথা বলবে না। দুধের জন্য কি মস্তিষ্কে আলাদা পাকস্থলি রাখা আছে যে দুধ মাথায় যাবে?’
‘না।’
‘তাহলে এজাতীয় কথা বলবে না।’
‘আচ্ছা বলবো না। কিন্তু তুই দুধটুকু খেয়ে নে।’
‘যেহেতু মাথায় আলাদা পাকস্থলি নেই সেহেতু আমার মাথায় দুধ যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কাজেই, আমি দুধ খাবো না।’
‘পরীক্ষায় ফেল করবি এবারও।’
‘দুধ খাওয়ার সাথে পাশ ফেলের সম্পর্ক কি? দুধে কি অংকের সূত্র মেশানো?’
‘জানি না। বিমল বাবু বলে গেছেন।’
‘উনি সবসময়ই ভিত্তিহীন কথা বলেন। উনার কথা ধরে বসে আছো তুমি!’
নুরুল আলম হতাশ কন্ঠে বললেন,
‘দুধ খেলে কি তোর কোনো ক্ষতি হবে?’
‘না। কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’
নুরুল আলম এক চুলও নড়লেন না। রায়ার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। যত যাই হোক, বাবাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা যায় না। রায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুধটুকু খেয়ে নিলো।
অভ্র হলের বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে আছে। পাশে মুড়ির টিন রাখা। খরচ বাঁচাতে আজকাল রাতে সে একমুঠো করে মুড়ি খায়। প্রথম দিকে সমস্যা হলেও এখন আর সমস্যা হয় না। সয়ে গেছে। কথায় আছে 'শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবেন তাই সয়।' সবই অভ্যাসের বিষয়। আচমকা তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীনে নাম দেখে অভ্র ফোন রিসিভ করলো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেয়েটা বলে উঠলো,
‘আপনার মাথায় দুধ আছে?’
এমন প্রশ্ন শুনে অভ্র হেসে ফেললো।
‘আপনি এমন উদ্ভট উদ্ভট প্রশ্ন কই খুঁজে পান?’
‘কেউ একজন আমার বাবাকে বলেছে আমার মাথায় দুধের অভাব। তাই তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে এক গ্লাস দুধ আমাকে খাওয়াচ্ছেন!’
‘বেশ তো। ক্ষতি কি?’
‘ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনি আমাকে এটা বলেন, যে মানুষ এ কথাটা বলেছে তিনি মূর্খ না?’
‘না। মূর্খ কেনো হবে?’
‘মূর্খ হবে না কেনো? মানুষের মাথায় দুধের প্রয়োজন এটা কেমন তর কথা?’
‘হয়তো উনার কথার অভিগমন ভিন্ন। উনি বোঝাতে চেয়েছেন আপনার বুদ্ধি কম, তাই দুধ খাওয়া প্রয়োজন।’
‘আপনারও কি আমাকে নিয়ে একই মতামত?’
‘কোন বিষয়ে?’
‘বুদ্ধির বিষয়ে?’
‘না। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।’
মেয়েটা হাসলো। তার হাসি আচমকা অভ্রর কাছে বেশ পরিচিত বলে মনে হলো। কোথায় যেনো শুনেছে! কিন্তু মনে করতে পারলো না।
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
অভ্র বললো,
‘করুন।’
‘আপনি যখন কোনো কিছু নিয়ে অনেক চিন্তায় থাকেন তখন কি করেন?’
‘চিন্তাদের ছুটি দিয়ে দেই।’
‘সেটা কিভাবে?’
‘অনেক অনুশীলনের বিষয়। এর জন্য আপনাকে সবসময় চিন্তার মধ্যেই থাকতে হবে। চিন্তা দিয়ে বাড়িঘর বানাতে হবে। চিন্তার বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে হবে। চিন্তার গ্লাসে প্লেটে খেতে হবে। নিজের পৃথিবীটা হয়ে যাবে চিন্তাময়। একসময় আপনি চিন্তাদের সাথে সমঝোতায় আসতে পারবেন। বলবেন, চিন্তা ভাই, অনেক খাটুনি তো হলো। আপনি আপনার পরিবার এবং আত্মীয় সজনদের নিয়ে দূরে কোথাও ছুটি কাটাতে যান।’
‘তখন চিন্তা ভাই কি করবে?’
‘চিন্তা ভাই প্রস্তুতি নিবে। ব্যাগ পত্র গোছাবে। আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হবে। গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সবাইকে নিয়ে ফিরে আসবে।’
‘বাহ!’
‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার কারণ?’
‘এমনি। জানতে ইচ্ছে করলো। আচ্ছা আমি রাখছি।’
‘ঠিক আছে।’
রায়া কান থেকে ফোন নামিয়ে পাশে রেখে দিলো। ‘তনিমা’ চরিত্রটি থেকে বের হয়ে আসলো। পরীক্ষা নিয়ে সে বেশ চিন্তায় আছে। তাদের ক্ষণিককালের জন্য ছুটি দেয়া প্রয়োজন।
← পর্ব ১৭ | পর্ব ১৯ → |