আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ১৯ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ১৯তম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

ইদানিং পল্টনদার সাথে রমজান খানের বেশ ভাব জমেছে। পল্টনদার বাড়ি এইতো বেশি দূরে নয়, দশতলা বিল্ডিংটার ওপারে। সে মাঝে মাঝেই বাসায় আসেন। রমজানের সাথে বসে গম্ভীর মুখে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। দুঃখ করেন। তার পচ্ছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে এলাকার মেয়র নির্বাচন করলেন অথচ এলাকার কোনো উন্নতি নাই। আজও বিষাদগ্রস্ত স্বরে বললেন,

‘বুঝলেন রমজান সাহেব? সবই মিথ্যা। সবই ছল ছাতুরি। ইলেকশন স্পিচ দিয়ে তারা সাধারণ জনগনের মন গলাবে। ইলেকশন শেষে পাছায় লাত্থি মারবে। উন্নতির নাম গন্ধ নাই!’

‘ঠিকই বলেছেন দাদা। এরা কি আসলেই মুখ দিয়ে কথা বলে কিনা কে জানে?’

‘ভাবলাম আজিজ সাব রে উঠাইলে এবার শহরের উন্নতি হবে নি। কিসের কি? ঘুরে ফিরে তালগাছ আমার। রাত নামতে না নামতেই সামনের টং এ গাঁজার আসর বসাচ্ছে। এইতো সেদিন একখানা খুনও হয়ে গেলো। আর রাস্তাঘাটের তো যাচ্ছেতাই অবস্থা!’

‘হক কথা, দাদা। হক কথা।’

‘বউ বাচ্চা যে বাসা থেকে বের হবে তা নিয়েও হয়রানি হতে হয়।’

‘এই ভয় তো আমিও পাই। বৌমা ভার্সিটি যায়। এতদিন না হয় অর্ণব ছিলো। কোনো ঝঞ্ঝাট হলে সমস্যা ছিলো না। আজ ছেলেটা ঢাকা যাচ্ছে। এখন বেশ চিন্তা হচ্ছে।’

‘ও।’

পল্টনদা নাক কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,

‘তা বাড়ির বৌ এর আবার এত পড়াশোনা কিসের?’

এমন সময় সাহেলা চা আর বেলা বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। রমজানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি বলে উঠলেন,

‘এ কথা উনাকে বলে লাভ নাই দাদা। আমি কম বলেছি? বাপ বেটা কেউই দু পয়সা পাত্তা দিলো না। বলি যে, এখন মেয়ে পড়াশোনা করেই বা করবে টা কি? জজ ব্যারিস্টার হবে?’

পল্টন অভিযোগের সুরে বললেন,

‘এটা ঠিক না ভাই। আপা কিন্তু ঠিকই বলেছে। তাছাড়া মেয়ের বয়স কম। দেখতেও সুন্দর।’

রমজান খান বুঝলেন পল্টন তাকে কি বুঝাতে চাইছে। এই কথাগুলো সাহেলার ওপর বাজে প্রভাব ফেলবে। ইতিমধ্যে তার চেহারার রঙ পাল্টাতে শুরু করেছে! তিনি দ্রুত অন্য প্রসংঙ্গে কথা তুললেন,

‘দাদা, আপনার মেয়ে ইন্ডিয়া থেকে ফিরবে কবে?’

‘এ বছরের শেষে আসার কথা। গত বছরই আসতো কিন্তু তখনই আমার নাতনিটা হলো। তাই আর আসে নি।’

‘ও আচ্ছা!’

রমজান খান কথার ফাঁকে একবার আড়চোখে সাহেলার দিকে তাকালেন। সাহেলার মুখ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। রমজান খান খুব সাবধানে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সাহেলা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলো না। কমলা এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল। পল্টন তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন,

‘নাতনি আমার বড় ভক্ত। ভিডিও কলে কথা বলে। ট্যান ট্যানা কন্ঠ। হা হা হা। অর্ণবের বিয়ে হলো ক মাস যেনো হলো ভাই?’

‘এইতো আট মাস।’

‘ও’ পল্টন পিরিচ থেকে বানানো পান নিয়ে মুখে পুরলো। রমজান খানও পান মুখে দিলেন। এমনিতে তার অথবা সাহেলার কারোরই পান খাওয়ার অভ্যেস নেই। কিন্তু সামনে কেউ পান খেলে সঙ্গী হওয়াটা তার স্বভাব। এছাড়া পান না খেলেও সাহেলা নিয়মিত পান, সুপারি কিনে রাখে। সুন্দর একখানা পানদানীও আছে তার। চমৎকার কারুকাজ করা। এক প্রকার খানদানী ভাব আছে। রমজান খান একদিন স্ত্রীকে আদুরে গলায় বলেছিলেন,

‘ওগো, আমার সহধর্মিনী। খাও বা না খাও। এক দুখানা পান বানিয়ে আঁচলে বেঁধে রাখলেই পারো।’

সাহেলা খেঁকিয়ে উঠে বলেছে,

‘হ্যাঁ, চাবির গোছা ফেলে এখন পান বেঁধে রাখি। বাপ বেটা মিলে যা মন চায় করছো তাতেও শখ মিটছে না। এখন আমার সংসার হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা।’

রমজান প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলেননি। শাশুড়ি আর বৌ এর সম্পর্ক নিয়ে তিনি প্রায়ই ভাবেন। সাহেলা যে রুদালিকে পচ্ছন্দ করে না ব্যাপারটা এমনও নয়। এইতো সেদিন, গা পুড়িয়ে জ্বর এলো রুদালির। সাহেলা গম্ভীর মুখে ঘরে প্রবেশ করলেন। বললেন,

‘তুমি আজ তোমার বেটার সাথে গিয়ে শোবে।’

রমজান চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেন,

‘সেকি বৌ ফেলে বেটার ঘরে গিয়ে ঘুমাবো কেনো?’

‘রুদালির জ্বর। ওকে আমার কাছে শোয়াবো।’

নাহ! রুদালির প্রতি সাহেলার ভালোবাসা মিথ্যে নয়। আবার জেনারেশন গ্যাপের বিষয়টাকেও উড়িয়ে দিলে চলবে না। চিন্তা ভাবনা প্রজন্মের সাথে বদলায়। তবে জগতে মনুষ্যত্বের বিবর্তন বলে কিছু নেই। বৌ টা তার শাশুড়ি হিসেবে মন্দ, একথা বলা চলবে না।
রুদালি টাওয়েল হাতে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব আজকেও টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে ভুলে গেছে। এ যেনো তার রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কাজটা অর্ণব অনিচ্ছাকৃত ভাবে করে রুদালির তা মনে হয় না। আবার টাওয়েল হাতে নিয়ে দরজার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খারাপও লাগে না। তাই কোনো অভিযোগ করেনি। তবে আজ তার মন খারাপ। অর্ণব ঢাকা যাচ্ছে। বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য। এখনি বুকের ভেতোরটা শূন্যতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার। এই সম্পর্কটার প্রতি রুদালির মায়া জন্মে গেছে যে! এই আট মাসে তারা একসাথে কম স্মৃতি কুড়িয়েছে?
মধুচন্দ্রিমার নামে শীতাকুন্ডে এডভেঞ্চার। রাতে ট্রেন জার্নি। বৃষ্টির রাতে ভিজে ভিজে আইসক্রীম খাওয়া আরো কত কি! অনুভূতি জন্মেছে। এতো অস্বীকার করার মতন নয়। অর্ণব গোসল করতে করতেই জিজ্ঞেস করলো,

‘রুদালি?’

রুদালি উত্তর দিলো,

‘হুঁ।’

‘বাবা কি করছেন?’

‘পল্টন কাকা এসেছেন। উনার সাথে গল্প করছে।’

‘আচ্ছা।’

আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে অর্ণব ডাক দিলো,

‘রুদালি?’

‘হুঁ।’

‘আচ্ছা। তুমি হালি হালি ডিম খাও না কেনো? তোমার নাম রুদালি। হালি হালি ডিম খাওয়ার কথা না?’

অর্ণবের প্রশ্নে রুদালির বিয়ের পরের দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। মনের অজান্তেই সে অল্প পরিসরে হেসে নিলো। কিন্তু অর্ণবকে গম্ভীর কন্ঠেই উত্তর দিলো,

‘আমার পা ব্যাথা করছে। আপনার আর কতক্ষণ লাগবে?’

‘হয়ে গেছে। জাস্ট গিভ মি টু মিনিটস।’

অর্ণব রুদালির হাত থেকে টাওয়েল নিয়ে গা মুছতে মুছতে বের হয়ে এলো। আলনা থেকে নতুন হালকা সবুজ রঙের শার্ট পরতে পরতে বললো,

‘ব্যাগ গরম কাপড় ভরেছো?’

‘হুঁ।’

‘তোমার কি মন খারাপ?’

‘হুঁ।’

‘কেনো কি হয়েছে?’

‘রুদালি কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনি ফিরবেন কবে?’

‘কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবো।’

রুদালি আর কিছু বললো না। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো। জানালার বাইরে হালকা কুয়াশার চাদর। ফেব্রুয়ারি মাস চলছে। সে নিজেও গায়ে শাল জড়িয়ে আছে। অর্ণব ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুল ঠিক করছিলো। রুদালির মনমরা চেহারা আয়নায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রুদালি এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে দেখছে। তার ধ্যান ভাঙ্গলো অর্ণবের কন্ঠে। অর্ণব জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে?’

রুদালি কিছুক্ষণ বোকার মতো অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরলো। বিবাহিত জীবনের এই প্রথম আবেগঘন মুহূর্ত। অর্ণবও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে আশা করেনি। অর্ণব আরো অবাক হলো যখন লক্ষ্য করলো তার বুকের কাপড় ভিজতে শুরু করেছে। হায়! রুদালি কাঁদছে!

‘বোকা মেয়ে। কাঁদছো কেনো?’

‘আমি জানি না কেনো কাঁদছি।’

‘কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো তো?কেউ কিছু বলেছে? মার সাথে কিছু হয়েছে?’

‘না।’

‘তাহলে?’

‘আপনি এত বলদ কেনো?’

অর্ণব অবাক হয়ে বললো,

‘আমি বলদ সেজন্য তুমি কাঁদছো কেনো। কাঁদার কথা আমার!’

‘ধুর।’

রুদালি অর্ণবের দুই হাতের বাঁধন খুলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। অর্ণব তাকে আটকালো। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘আমি খুব দ্রুত চলে আসবো।’

রুদালি নাক টানলো। মুখে কিছু বললো না। অর্ণব রুদালির কপালে ছোট্ট একটি ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিতে ঠোঁট জোড়া এগিয়ে দিলো। কিন্তু সংকোচ পিছু ছাড়লো না। অর্ণব নিজেকে সামলে নিতেই রুদালি ভ্রু কুঁচকালো। কপাল এগিয়ে দিলো অর্ণবের ঠোঁটের দিকে। অর্ণব মুচকি হেসে উষ্ণ ঠোঁট জোড়া রুদালির কপালে ছোঁয়াল। মেয়েরা বরাবরই ভালোবাসার কাঙ্গাল। ভালোবেসে এদের মনে জায়গা করে নেওয়াটা খুব সহজ।

← পর্ব ১৮পর্ব ২০ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন