আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ২০ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ২০তম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

রায়া ঘড়ির দিকে তাকালো। অংক পরীক্ষা শুরু হতে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। স্কুল বেশি দূরে নয়। রায়াদের বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা পথ মিনিট পাঁচেক হবে। রায়া ডায়রি হাতে নিয়ে বসলো। মায়ের দোয়া নিতে হবে না? এই ডায়রিটাই তো তার মায়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম! সে ডায়রির বাদামী পাতায় খসখস করে লিখতে শুরু করলো।
বান্ধবীদের মুখে শুনেছিলাম, পরীক্ষার আগে তারা মা বাবাকে কদমবুসি করে দোয়া নেয়। মায়েরা তার সন্তানের কপালে চুমু এঁকে দেন। বাবারা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বাবা আমার মাথায় হাত তো রাখবেন কিন্তু আমার কপালে চুমু এঁকে দেওয়ার জন্য তুমি নেই কেনো মা? আজ আমার অংক পরীক্ষা। আমি গত দুবছর ধরে এই পরীক্ষায় ফেল করে আসছি। এর জন্য শুধুমাত্র তুমি দায়ী। এপর্যন্ত অংকে টেনেটুনে পাশ করা এই মেয়েটার জন্য আজকের অংক পরীক্ষাটা পাহাড় সমান। কারণ তার জীবনের সবচে প্রিয় অংকের শিক্ষক আজ ওই দূর আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র।
ছোটবেলায় তোমার কোলে বসেই প্রথম গুণতে শিখেছিলাম। বিকাল বেলা সুনীল আকাশে শঙ্খচিল গুলো যখন উড়ে বেড়াতো, তুমি তোমার আঙুল দিয়ে সেদিকে ইঙ্গিত করতে। কিন্নর কন্ঠে বলতে,

‘বল তো মা? কয়টা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে?’

আমি তোমার গাল ধরে বলতাম,

‘ঠিক ঠিক উত্তর দিলে আমায় কি দিবে মা?’

তুমি বলতে,

‘অনেক অনেক আদর দিবো তোকে।’

আমি গুণতাম। আনন্দ নিয়ে গুণতাম। একটা, দুইটা, তিনটা। তুমি খুশি হয়ে যেতে। চুমুতে ভরিয়ে দিতে আমার মুখমন্ডল। আজ আমার অংকের উত্তর মিলে গেলেও চুমুতে ভরিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। যে উত্তর মিলে গেলেও প্রতিদানে কিছু পাবো না সেই উত্তর না মিললেও ক্ষতি তো নেই!
প্রতিটি সন্তানের জীবনে মায়ের উপস্থিতি কতটা প্রয়োজন আমি বেশ বুঝতে পারি। আমিও তো একদিন মা হবো। সেদিন তুমি দেখবে। আমি আমার সন্তানকে ছেড়ে কখনো চলে যাবো না। সবসময় বুকে আগলে রাখবো। প্রতিদিন কপালে চুমু খাবো। শ্রেষ্ঠ মা হয়ে দেখাবো। তুমি মিলিয়ে নিও!
রায়া ডায়রি রেখে দিলো। তার দুচোখ বেয়ে নোনা বৃষ্টি ঝরঝর করে ঝরছে। বালিশে মুখ লুকিয়ে রায়া কাঁদছে। হঠাৎ তার মনে হলো কেউ তার মাথায় আলগোছে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। স্পর্শটা রায়ার খুব পরিচিত। যেনো এই স্পর্শের সাথে তার আত্মিক কোনো সম্পর্ক রয়েছে। বছরের পর বছর কেটে গেছে। এই স্পর্শ সে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছে। রায়া কপাল কুঁচকে মাথা তুললো। ফোলা ফোলা চোখে দেখলো চিত্রা তার সামনে বসে আছে। পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি। কি পবিত্র দেখাচ্ছে তাকে! অস্ফূট স্বরে রায়া বলে উঠলো,

‘মা!’

চিত্রা মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন আছিস?’

মায়ের কথা গুলো কেমন গমগমে শোনাচ্ছে রায়ার কাছে। সে কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে রইলো।

‘হ্যাঁ রে! আমার ওপর তোর ভীষণ রাগ। তাই না?’

‘মানুষ তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর সাথে রাগ করে। তুমি কি আমার কাছের মানুষ? তোমার ওপর রাগ কেনো থাকবে?’

‘আমি তোর কাছের মানুষ নই?’

‘মোটেও না। কাছের মানুষ কখনো তার আপনজনদের ছেড়ে হারিয়ে যায়?’

চিত্রার মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। সে পুনরায় হেসে বললো,

‘সবাইকেই তো একসময় না একসময় এই দুনিয়া ছেড়ে, প্রিয়জনদের বাঁধন ছিন্ন করে চলে যেতে হয়। সৃষ্টির শুরুতে ফিরে যেতে হয়। এই তো জীবন, মা! এইতো জীবন!’

‘সবাই তো এত দ্রুত চলে যায় না, মা। কই দাদী তো বাবাকে ছেড়ে এখনো দূরে চলে যায় নি! তুমি কেনো চলে গেলে? আমি কি খুব বেশি দুষ্টুমি করতাম? তোমায় খুব বেশি কষ্ট দিতাম?’

চিত্রার চোখ ভিজে উঠলো। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে মেয়েকে দু বাহু প্রসার করে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু মৃত মানুষকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয় নি। তারা চাইলেই জড়িয়ে ধরে শূণ্য বুকের হাহাকার দমিয়ে নিতে পারে না। ভালোবাসায় ভরিয়ে নিতে পারে না।

‘চুপ করে আছো কেনো, মা? বলো? আমি কি অনেক দুষ্টুমি করতাম?’

চিত্রা ভেজা চোখে হেসে বললেন,

‘স্কুলে একবার ছুটির ঘন্টা বেজে গেলে তোদের স্কুলে থাকতে দেয়?’

‘না। দেয় না। দারোয়ান মামা বের করে দেয়।’

‘তাহলে আমি কিভাবে থাকতাম রে? আমারও যে মৃত্যু ঘন্টা বেজে গিয়েছিলো! তাই এই দুনিয়াতে থাকার অনুমতি ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। কে চায় সম্পর্কের বাঁধন ছিন্ন করে হারিয়ে যেতে? কেউ চায় না। তবুও এটাই বাস্তবতা। এটাই সবচেয়ে বড় সত্যি! এই মৃত্যু ঘন্টা উপেক্ষা করার সাধ্য কারো নেই।’

রায়া মাথা নিচু করে কেঁদে ফেললো। চিত্রা ভেজা চোখে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। নরম কন্ঠে বললেন,

‘একটু বাদেই তোর অংক পরীক্ষা। এখন কাঁদলে চলবে?’

‘আমার অংক করতে ভালো লাগে না মা। তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ে!’

‘রায়া, মানুষের জীবন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি উপহার। কারো কারো ক্ষেত্রে এই উপহার উপভোগের সময়কাল দীর্ঘ। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত। আমরা কেউই জানি না এক মুহূর্ত পর কি হতে চলেছে। জীবন থেকে যেটুকু হারিয়ে গিয়েছে সেটুকু হারিয়ে যেতে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যেটুকু আদায় করে নেওয়া সম্ভব সেটুকুর পেছোনে শ্রম দিয়ে যেতে হবে। হার মানলে চলবে না।’

একটু থেমে চিত্রা আবার শুরু করলো,

‘আমি খুব স্বল্প সময় হাতে নিয়ে তোর কাছে এসেছি, মা। আমার ফিরে যেতে হবে। আর কখনো তোর সামনে আসতে পারবো না। তবে একটা কথা মনে রাখিস, যতদিন বেঁচে আছিস তোর অভিমানের পাল্লা কখনো ভারী হতে দিবি না। মুক্ত করে দিবি। মুক্ত পাখির মতন ছেড়ে দিবি খোলা আকাশে। দেখবি তাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ তোকে কতটা স্বস্তি এনে দেয়। উঁচু নিচু চলার পথ কেমন সমতল ভূমি বলে মনে হয়।’

এমন সময় নিচ থেকে নুরুল আলমের গলার স্বর পাওয়া গেলো।

‘রায়া মা? তৈরি হয়েছিস?’

চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘তৈরি হয়ে নে। আমিও চলি। ঘন্টা বেজে গেলো যে!’

‘মা। তুমি সত্যি আর কখনো আসবে না? এভাবে আমার সাথে এসে গল্প করে যাবে না? আমার ভীষণ একা লাগে, মা।’

চিত্রা ছলছলে চোখে বললো,

‘আমাকে যে আর আসতে দিবে না রে, মা! তুই ভালো থাকিস।’

চিত্রা উঠে দাঁড়ালো । রায়া এগিয়ে গিয়ে মায়ের পা দুটো ছুঁয়ে দোয়া নিলো। চিত্রা আলগোছে মেয়ের কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন। রায়া চোখের পাতা জোড়া এক করে ফেললো। টপ করে একফোঁটা পানি গাল গড়িয়ে মেঝেতে পড়লো। ঘটঘট শব্দে ফ্যান ঘুরছে। নুরুল আলমের কন্ঠস্বর আরো একবার শোনা গেলো। রায়া চোখ মেললো। পুরো ঘরে সে একা। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো।

‘মা তুই তৈরি হয়েছিস?’

‘এখন হবো। আমি রেডি হয়ে নিচে নেমে আসছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো বাবা।’

‘ঠিক আছে, মা। তুই নিচে নেমে আয়।’

রায়া বড় করে শ্বাস নিলো। নিজেকে তার ভীষণ হালকা মনে হচ্ছে। এতক্ষণ তার সাথে যা ঘটেছে তা সত্যি ছিলো নাকি নিছক কল্পনা তা নিয়ে রায়া ভাবতে চায় না। তবে মায়ের প্রতি জমিয়ে রাখা অভিমান গুলোকে সে আজ মুক্ত করে দিতে চায়। তারাই না হয় শঙ্খচিল হয়ে উড়ে বেড়াক ওই খোলা আকাশে! রায়া জানালার পাশে বসে আবারো গুণবে। একটা, দুইটা, তিনটা।

দোতলা অফিসটার সোফায় অভ্র বসে আছে। সে এসেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। মকবুল ভাই সেদিন পত্রিকা পড়তে পড়তে উল্লাসিত কন্ঠে বলে ওঠেন,

‘অভ্র রে! একটা চাকরির বিজ্ঞপ্তি ছাপাইছে। চেষ্টা করে দেখবি নাকি? সদরের মধ্যেই।’

অভ্র হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।

‘এই পোড়া কপালে সামান্য টিউশনিই জোটে না। চাকরি – সে তো সোনার হরিণ! বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন।’

‘নারে! কম্পানিটা নতুন। ইন্টার মিডিয়েট পাশ করেই এপ্লাই করা যাবে। তবে অনার্স পড়ুয়াদের দাম একটুখানি বেশি। বেতনও তো অনেক।’

‘কত?’

‘পনেরো হাজার টাকা।’

পনেরো হাজার টাকা!- অভ্রর চোখ চিকচিক করে ওঠে। চাকরিটা পেলে মাকে একটা ভালো সেলাই মেশিন তো কিনে দেওয়া যাবে তাই না? অসুস্থ্য বাবার ওষুধ কেনার জন্য অন্যের দুয়ারে হাত পাততে হবে না। বহুদিন পর অভ্র যখন গ্রামে ফিরবে, সোনার আংটি বন্ধক রেখে তার মায়ের ভালো মন্দ বাজার করতে হবে না। অভ্র নিজেই মাছ, মাংস, শাক সবজি ভর্তি চটের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে গ্রামে ফিরবে। এসব ভাবতে ভাবতে অভ্রর চোখের কোণায় জল জমে যায়। সে হাতের উলটো পিঠ চোখে চেপে ধরে মকবুলকে বলে,

‘ভাই চেষ্টা তাহলে করে দেখি। মেঘ না চাইতে বৃষ্টি যদি ভুল করেও পেয়ে যাই?’

মকবুল অভ্রর পিঠ চাপড়ে বলে,

‘পারবি। তুই ঠিক পারবি।’

অভ্র ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে ডাক পেয়েছে। শ’ খানিক সিভি জমা পড়েছিলো বোধ হয়। তার বয়সী অনেক ছেলে আছে। তার চেয়ে বয়সে ছোট এমন ছেলেও আছে। পুরো অফিসে সেন্ট্রাল এসি। এই শীতের মাঝেও এসি চালিয়ে রাখার হেতু অভ্র বুঝতে পারছে না। যেখানে রাস্তায় ক্ষণিক দূরের ব্যবধানে কাঠ খড় পুড়িয়ে সবাই আগুন পোহাচ্ছে! সেখানে এই কনকনে ঠান্ডায় বিজবিজ শব্দে এসি চলছে।

← পর্ব ১৯পর্ব ২১ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন