আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ২১ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ২১তম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

এত প্রতিযোগীর ভীড়ে অভ্রর চাকরিটা হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট অভিশঙ্কা রয়েছে। অনিশ্চয়তা তো বটেই! তবুও নিম্ন মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন দেখায় ভেটো দেওয়ার অধিকার কারো নেই। অভ্র কল্পনায় দেখছে। মায়ের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। যে চোরাবালির ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে, ধীরে ধীরে সেই চোরাবালি শক্ত মাটিতে পরিণত হচ্ছে। বাবার হার্টের ওষুধ ফুরোবার আগেই প্লাস্টিকের সেই বাক্সে নতুন ওষুধের প্যাকেট বিদ্যমান। হোক অভ্রের কল্পনা আকাশ কুসুম। এই সুখ স্বপ্নের আনন্দ সবার জন্য নয়। এই সুখ স্বপ্নের আনন্দ শুধুমাত্র অভ্রদের জন্য।
সাদা ফর্মাল শার্ট পড়া একজন ছেলে থাইগ্লাস ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো। চতুর্দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললো, সিফাতুল হক কে? অভ্র জড়তা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

‘আমি।’

‘ভেতরে আসুন।’

অভ্র বড় করে শ্বাস নিলো। তারপর ধীর পায়ে লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
ইন্টারভিউ বোর্ডে মাত্র দুজন মানুষ বসে আছে। পরনে দামী স্যুট, প্যান্টস। গলায় গাঢ় রঙের টাই বাঁধা। অভ্র ভেবেছিলো প্রশ্নকর্তা অন্তত চার পাঁচজন তো থাকবেনই। একথা ভেবেই সে ক্ষান্ত হয় নি, খানিকটা বিচলিত হয়েও পরে। কিন্তু বোর্ডে মাত্র দুজনকে বসে থাকতে দেখে অভ্র বেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। সালাম আদান প্রদানের পর অভ্রকে বসতে বলা হয়। সিভি নাড়াচাড়া করে মধ্যবয়স্ক প্রশ্নকর্তা বললেন,

‘আপনি অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন।’

‘জ্বি।’

‘চাকরি কেনো করতে চাইছেন?’

‘প্রয়োজন বলে।’

‘কেমন প্রয়োজন?’

‘আর্থিক প্রয়োজন।’

প্রশ্নকর্তা মাথা নাড়লেন। এবার অপরজন বলে উঠলেন,

‘আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। সাথে চাকরি করতে চাচ্ছেন। সময় ব্যবস্থাপনায় আপনার দক্ষতা কতটুকু? ধরুন, আপনাকে দশ এর মধ্যে গুণমান নির্দেশ করতে বলা হলো। আপনি নিজেকে কত দিবেন?’

‘আট দিবো।’

‘দশে দশ নয় কেনো?’

অভ্র হেসে উত্তর দিলো,

‘মানুষ একেবারে নির্ভুলভাবে কোনো কাজ সম্পাদন করতে পারে না। তার জন্য এক কেটে নিয়েছি। আর বাকি এক কেটেছি অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যত কোনো ঘটনার জন্য। যা আমার দক্ষতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।’

প্রশ্নকর্তা দুজন দুজনের দিকে চোখাচোখি করলেন। এবার প্রথম প্রশ্নকর্তা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘প্রতিটা মানুষের মাঝে বিশেষ কোনো না কোনো গুণ থাকে। আপনার মাঝে কি বিশেষ গুণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?’

অভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার মাঝে বিশেষ কোনো গুণ নেই। একটি মাত্র গুণই রয়েছে সেটি হলো মিথ্যা বলার গুণ। এটাকে বিশেষ গুণের উপাধি দেওয়া কতখানি যুক্তিসংগত তা অভ্র জানে না। তবুও উত্তর তো দেয়া চাই! অভ্র প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,

‘আমি অনেক গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারি।’

স্যুট প্যান্টস পরা মধ্যবয়স্ক লোক দুজনের কপালে ভাঁজ পড়লো। একজন গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘মিথ্যা বলা গুণ?’

‘সময় বিশেষে অনেক বড় গুণ স্যার।’

‘এক্সপ্লেইন করুন।’

‘স্যার, উত্তরটি আমি একটি গল্পের মাধ্যমে দিচ্ছি। গল্পটি একজন সংগ্রামী নারীর। একজন আদর্শ স্ত্রীর। একজন দুর্ভাগা মায়ের। যার সারাটাদিন কাটে ভাঙ্গা একখানা সেলাই মেশিনের সামনে বসে। জামা সেলাই করে যে কানাকড়ি জোটে তা দিয়েই তাদের সংসার চলে। স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাদের একটি মাত্র ছেলে মফস্বল শহরে পড়াশোনা করছে। গল্পের মা কখনো জীবন যুদ্ধে হারেনি। তবে প্রতিনিয়ত অভাবের কাছে হেরে গিয়েছে। স্বামীর হার্টের ওষুধ ফুরিয়ে গেলে আঁচলে মুখ লুকিয়ে ছেলের কাছে কয়েক পয়সা চান। ওই কয়েক পয়সা চাইতেও সেকি কমজোরি! হবে নাই বা কেনো? ছেলের যে দিন কাটে একবেলা পেট পুরে খেয়ে! তবুও ছেলে খুশি মনে কয়েক পয়সা কাছে রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেয়। মায়ের সাথে কথা বলার সময় মিথ্যার ফুলঝুরি ছড়িয়ে দেয়! যেনো মা ঘুণাক্ষরেও টের না পায় মাসের বাকি দশ দিন তার উপবাসেই কাটবে।
এবার আপনারাই বিবেচনা করে বলুন। মিথ্যা বলাও কি সময় বিশেষ গুণ নয়?’

প্রশ্নকর্তা দুজন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ক্ষণিককাল বাদে একজন বললো,

‘আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আপনি কি মনে করেন?’

‘সত্যি কথা বলা।’

‘সত্যি কথা বলা দুর্বলতা?’

‘সময় বিশেষে অবশ্যই। যেমন গল্পের ওই ছেলেটি যদি তখন সত্যিটা তার মাকে বলে দিতো পরস্থিতিটা কি দাঁড়াতো একবার ভেবে দেখেছেন স্যার?’

আবারো কিছুক্ষণ ঘরে নিরবতা বিরাজমান। শুধুমাত্র এসির অদ্ভুত বিজবিজ শব্দটাই শ্রবণগোচর হচ্ছে। বোর্ডের যে লোকটি চশমা পরে ছিলেন তিনি খুব সাবধানে চোখ থেকে চশমা সরিয়ে ফেললেন। শান্ত গলায় বললেন,

‘দেখুন মিস্টার সিফাতুল হক, আমরা বুঝতে পারছি চাকরিটা আপনার প্রয়োজন। আপনার মতো আরো অনেকেরই হয়তো প্রয়োজন। তবে আমাদের প্রয়োজনটাও তো দেখতে হবে। দেখুন, এই চাকরিটার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার গুণ কোনো কাজে আসবে না। কাজেই এমন অনুপযোগী উত্তর না দেয়াটাই উত্তম বলে মনে করি। আপনার বিশেষ কোনো গুণ যেমন কম্পিউটারে আপনার দক্ষতা, পাবলিক স্পিকিং, ভালো ইমেইল লিখতে পারেন বা এই টেকনোলজির যুগে যে কাজটায় আপনি পারদর্শী সে সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।’

অভ্র চুপ করে মাথা নাড়ালো।

‘আমার এমন কোনো গুণ নেই, স্যার।’

এসব বিষয়ে সত্যিই অভ্রর কোনো দক্ষতা নেই। তার হাতের ফোনটাও বাটন ফোন। স্মার্ট ফোন নয়। ভার্সিটির প্রয়োজনে অন্যের ল্যাপটপ ধার করে কাজ করে সে। এসকল বিষয়ে অজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া তার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়। ইন্টারভিউ বোর্ডের দুজন হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

‘ঠিক আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাকে জানাবো। আপনি এখন যেতে পারেন।’

অভ্র ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস থেকে সোজা রাস্তায় নেমে এলো। ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। সে জানে চাকরিটা তার হবে না। আজকাল মানুষের মনেই আবেগের ঠাঁই নেই। কর্মক্ষেত্র তো বহুত দূরের বিষয়!

রুদালি পাঠ্য বইয়ের মাঝে ধ্যানমগ্ন ছিলো। ফোনের শব্দে সেই ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে মুচকি হেসে ফোন কানে ধরলো। অপর পাশ থেকে অর্ণবের ভরাট কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেলো।

‘ভাবছি ঢাকায় একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলবো।’

‘কেনো টাংগাইলের বাড়িতে কি সমস্যা?’

‘অনেক সমস্যা। এই ধরো চাইলেই বউয়ের সাথে একান্তে, নিভৃতে বৈঠকে বসা যায় না।’

‘কেমন বৈঠক?’

‘মধ্যরাতের বৈঠক।’

‘আপনি বুঝি ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে বসেন?’

অর্ণব রুদালির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হতাশ কন্ঠে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

‘তুমি কি আমাকে ‘আপনি’ বলা ছাড়বে না?

‘না।’

‘কেনো?’

‘আপনি বলতে ভালো লাগে। আমি কি জিজ্ঞেস করলাম? উত্তর দিলেন না।’

‘ও হ্যাঁ। অবশ্যই প্রতিটি বৈঠকের নির্ধারিত সময় আছে। তাছাড়া মধ্যরাতের বৈঠকে নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির সাথেই বসতে হয়।’

‘সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তি কে?’

‘সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তি হলো বিয়ে করা বউ।’

রুদালি অর্ণবের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

‘হেসো না। হাসির কোনো কথা বলিনি। ট্রাম্প পুতিনের বৈঠক নিয়ে কেউ হাসাহাসি করেছে?’

‘না।’

‘তাহলে আমাদের বৈঠক নিয়ে মজা লুটছো, এটা কেমন হলো?’

‘উনাদের সাথে আমাদের তুলোনা করলে চলবে?’

‘কেনো উনারা কি হাত পা ছাড়া মানুষ? গড়ন, গঠন সব এক।’

‘আপনি ঝগড়াটে হয়ে যাচ্ছেন দিন দিন!’

‘তাই? ঠিক আছে। এই বিষয়টাও তোলা রইলো। মধ্যরাতের বৈঠকের দিন মনে করিয়ে দিবে।’

রুদালি হেসে বললো,

‘ঠিক আছে।’

‘ভার্সিটি যাওয়া আসার পথে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’

‘না।’

‘সমস্যা হলে কিন্তু বলবে!’

‘হুম বলবো।’

‘তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে, রুদালি।’

‘ফিরবেন কবে?’

‘মাসখানিক আরো।’

‘দ্রুত ফেরা যায় না?’

‘এত তাড়া কিসের?’

‘আপনার সাথে আমার এখনো হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা বাকি।’

‘এই কনকনে ঠান্ডায়?’

‘সমস্যা আছে?’

‘জ্বর ঠান্ডায় আক্রান্ত হলে রাত জেগে জলপট্টি লাগিয়ে দিতে তোমার সমস্যা আছে?’

রুদালি হেসে ফেললো,

‘না নেই।’

অর্ণবও হেসে বললো,

‘তাহলে আমারও নেই।’

‘সাবধানে থাকবেন।’

‘তুমিও। রাখছি তাহলে?’

‘হুঁ।’

টুট টুট টুট। অর্ণব ফোন কেটে দিয়েছে। রুদালি কানের থেকে ফোন নামিয়ে বুকে চেপে ধরলো। মানুষটার অনুপস্থিতি তাকে অস্থির করে তুলছে। তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। পবিত্র বন্ধনের শক্তির প্রখরতা ব্যাপক। অতীত ভুলিয়ে দিতে হয়তো পারে না। তবে অতীতের ক্ষত শুকিয়ে আরোগ্যপ্রাপ্ত হতে খুব স্বল্প সময়ই নেয়।

← পর্ব ২০পর্ব ২২ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন