আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
অভ্র যে লোকটির সামনে বসে আছে এই লোকটি সেদিন ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন। তবে আজ তার পরনে স্যুট প্যান্টস নেই। গলায় টাইও বাঁধা নেই। ভদ্রলোক পাঞ্জাবীর ওপর মোটা শাল গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। মুখভর্তি আধ পাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যেনো তাকে আরো সুদর্শন করে তুলেছে। অভ্র এখনো বুঝতে পারছে না ভদ্রলোক তাকে কেনো ডেকে পাঠিয়েছেন। চাকরিটা তার হয়নি। সেই পোস্টে অন্য একজন জয়েন করে ফেলেছে। অভ্র খোঁজ নিয়ে শুনেছে। তারপরেও তাকে ডেকে পাঠানোর কারনটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। তারা যে রুমটায় বসে আছে এই রুমটা বেশ বড়। আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। ডান পাশে বিশাল বড় এক সেলফ। সেলফ ভর্তি নানাবিধ বই। দেয়াল থেকে ল্যাম্প ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। টিমটিম করে জ্বলছে। কেমন অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ। ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে শামসুর চৌধুরী ঝিমুচ্ছেন। এক ফাঁকে কাজের লোক এসে দুকাপ চা দিয়ে গেলো। সাথে সিগারেটের প্যাকেট। শামসুর চোখ বন্ধ রেখেই প্যাকেট হাতড়িয়ে একটি সিগারেট হাতে নিলেন। মুখে পুরে লাইটার জ্বালানোর চেষ্টা করতে করতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
‘সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস আছে?’
অভ্র হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। ভদ্রলোক এবার চোখ মেললেন। সিগারেটের প্যাকেট অভ্রর দিকে এগিয়ে দিলেন। অভ্র অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘না স্যার, আমি খাবো না।’
‘আরে নাও নাও। এটা ইন্টারভিউ বোর্ড না। এখানে স্মোকিং এলাউড।’
অভ্র বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলো। শামসুর তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,
‘আরে নাও। একা একা স্মোক করে মজা নেই। একটা নিয়ে নাও।’
অভ্র সিগারেট নিলো। শামসুর লাইটার অভ্রর দিকে এগিয়ে দিলেন।
‘আমার আচমকা এই তলবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছো?’
‘না।’
‘কোনো অনুভূতি হয়নি?’
‘অবাক হয়েছি।’
‘কেনো?’
‘চাকরিটা আমার হবে না সেটা আমি জানতাম। সেই পোস্টে নতুন একজন জয়েন করে ফেলেছে। এরপরেও আমাকে ডাকার পেছোনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাইনি। তাই অবাক হয়েছি।’
‘হুম।’
ভদ্রলোক ফড়ফড় করে ধোঁয়া ছাড়লেন। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
অভ্র চায়ের কাপ হাতে নিলো। ভদ্রলোক নাক টেনে বললেন,
‘তোমার সম্পর্কে কিছু বলো শুনি।’
‘আমার সম্পর্কে বলার মতো তেমন কিছু নেই। থাকলেও তার মাঝে আকর্ষণীয় কিছু নেই।’
‘ভুল বললে। প্রতিটা মানুষের জীবনের আলাদা আলাদা গল্প থাকে। প্রতিটি গল্পই কৌতূহলপূর্ণ। আকর্ষণীয়।’
‘আমি অভ্র। মা বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা আগে স্কুল টিচার ছিলেন। ব্রেন স্ট্রোকের কারণে এখন প্যারালাইজড। মার একটা ভাঙ্গা সেলাই মেশিন আছে। দরজিগিরি করে সংসার টিকিয়ে রেখেছেন। আমি ফিজিক্স নিয়ে অনার্স করছি। টিউশনি করে নিজের পেট চালাই।’
‘আচ্ছা।’
‘এই জীবন ধারণের গল্প আপনার কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে? অবশ্যই নয়।’
‘মনে হয়েছে।’
অভ্র বিস্মিত চোখে ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে রইলো। শামসুর চৌধুরী এক গাল হাসলেন।
‘আমার এই কম্পানিটা নতুন। আরো দুটো কম্পানির মালিক আমি। সবকিছুর উৎসস্থল ওই শূণ্যের কোটা। আমরা সবাই শূণ্য হতে শীর্ষে পৌঁছাই। মিথ্যা বললাম?’
‘না স্যার। সত্যি বলেছেন।’
‘ইন্টারভিউ বোর্ডে তুমি একটা গল্প শুনিয়েছিলে। আজ আমার একটা গল্প তোমাকে শোনাতে চাই। শুনবে?’
‘শুনবো, স্যার।’
‘এই গল্পের প্রধান চরিত্র যে মানুষ, তার বাল্যকালে অভাবের ঘাটতি ছিলো না। ছেলের বাবার আর্থিক অবস্থা ছিলো শোচনীয়। অনেকটা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়-ধরনের। তবে ছেলের প্লেটে কখনো ভাতের অভাব হয়নি। মা-বাবা তো সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন উপবাসেই কাটাতেন! মাঝে মাঝে বড় বোনও তাদের সাথে যোগ দিতো। ছেলে জিজ্ঞেস করলে বলতো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য রোজা রাখছেন। রমজান মাস ছাড়াও মা বাবাকে রোজা রাখতে দেখে ছেলে ভাবতো উনারা অলি আউলিয়া পর্যায়ে চলে গেছেন।’
এটুকু বলে শামসুর চৌধুরী হাসলেন।
‘কি বুঝলা? অভাব মানুষকে হয় চোর বানায় নইলে বানায় অলি আউলিয়া। হা হা হা!’
ভদ্রলোক আরেকটা সিগারেট ধরালেন। অভ্রকে পুনরায় সাধলেন। অভ্র দুদিকে মাথা নাড়ালো। শামসুর তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘একটার বেশি খাও না বুঝি?’
‘না।’
তিনি ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,
‘ভালো স্বভাব। আমার এক বসায় দুই তিনটে না টানলে চলে না। যাক গে। তারপর কি হলো শুনো।
তোমার মতো ছেলেটাও চাকরি খুঁজছিলো। আরেকটু আরলি এইজে। সবে মাত্র এইচ এস সি দিয়েছে। এর মাঝেই ছেলের বাবা হৃদরোগে মারা গেলেন। মাও তখন শয্যাশায়িনী। যে কোনো দিন পটল তুলবেন। বোনের বিয়ে হয়েছে এক ছোটলোকের ঘরে। মোটামোটি টাকাপয়সা দেখেই বিয়েটা দেয়া হয়। বোনজামাই স্ত্রীকে বেধড়ক মারতো। বোন চিঠিতে প্রায়ই ভাইকে লিখতো সেকথা। বাদামী পৃষ্ঠায় লিখা প্রতিটি চিঠিতে চোখের পানির দাগ বসে যেতো। কলমের লিখাও ছড়ে ছড়ে যেতো। ভাইয়ের করার কিচ্ছু ছিলো না। চিঠি পড়তো। মাঝে মাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে যেতো। এই যা। সেদিন এক চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে মাত্রই ছেলে বাড়িতে পা ফেলেছে। শশুড়বাড়ি থেকে খবর এলো বোন দড়িতে ঝুলেছে। মরে গিয়েও মেয়েটার শেষ রক্ষে হলো না। গ্রামের মানুষজন তার চরিত্র নিয়ে কত নিন্দা করলো! পর পুরুষের সাথে মেলামেশা ছিলো। ধরা পড়েছে তাই গলায় দড়ি দিয়েছে। ইত্যাদি।’
এতটুকু বলে শামসুর চোখ দুটো আংগুল দিয়ে দলে পরিষ্কার করলেন। খস খস করে দাঁড়ি চুলকে বললেন,
‘মেয়ের মৃত্যুশোক শয্যাশায়িনী মায়ের সহ্যতা ছাড়িয়ে গেলো। তিনিও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। এবার ছেলে একা। তবে এক পেট তো কুকুরও চালায়। এভাবেই দিন চলছিলো। একদিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাচ্ছে সেই ছেলে। হঠাৎ দামী একটি গাড়ি রাস্তার পাশে এসে থামলো। গাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক নেমে এলেন। চোখে কালো চশমা। গায়ে দামী সুগন্ধি মাখা। ছেলেটিকে তিনি তার সাথে নিয়ে গেলেন। পড়াশোনা করালেন। একসময় ব্যবসার দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দিলেন। হঠাৎ করেই ছেলেটার জীবন বদলে গেলো। অভাব ঘুঁচে অঢেল সম্পত্তির মালিকানাভুক্ত হলো।’
একটু থেমে তিনি আবার বললেন,
‘এ গল্প থেকে কি বুঝলে?’
অভ্র বললো,
‘বুঝলাম। সময় বদলায়।’
শামসুর চৌধুরী মাথা নাড়লেন।
‘সময় প্রতি মুহূর্তেই বদলায়। এক্ষেত্রে ছেলের ভাগ্য বদলেছে।’
অভ্র হাসলো। মুখে কিছু বললো না।
‘আমি সবাইকে হারিয়ে যখন শূণ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন এক আগন্তুক এসে আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তবে সময় যা কেড়ে নিয়েছে তা ফিরিয়ে দিতে পারেনি। মৃত বাবা, মা অথবা বোন কেউ আমার পরিবর্তন দেখে যেতে পারেনি। তোমায় নিয়ে আমি কিঞ্চিৎ রিসার্চ করেছি বলতে পারো।’
‘আমায় নিয়ে?’
‘হুম। জানতে পারলাম নিজের প্রেমিকাকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলে। সে এখন অন্যের সংসার সাজাতে ব্যস্ত। কারণটা কি আর্থিক ছিলো?’
‘জ্বি, স্যার।’
‘সেক্ষেত্রে সময়ের হাত থেকে তোমাকে একেবারে রক্ষা করতে পারলাম না। তবে পরিবার নিয়ে জীবনের বাকি অধ্যায়গুলো যেনো সুখে কাটাতে পারো সেই ব্যবস্থা আমি করে দিতে চাই।
এই মাসেই ছোটখাটো একটা এগ্রো ফার্ম দিতে চলেছি। দেখাশোনার দায়িত্ব তোমার। এতে পড়াশোনার ক্ষতিও হলো না, মাস শেষে মোটা অংকের টাকাও পেলে। কি বলো?’
অভ্র চুপ করে রইলো। শামসুর হেসে বললেন,
‘ভেবো না করুণা করছি। মানুষ হিসেবে সাহায্যের হাতটুকু বাড়িয়ে দিচ্ছি। তোমাকে বসিয়ে মাস শেষে টাকা দেওয়া হবে না। গায়ে গতরে খেটে টাকা রোজগার করতে হবে।’
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘আমি কি ভাবার জন্য আজকের দিনটা পেতে পারি?’
‘অবশ্যই। ভেবে দেখো।’
‘ধন্যবাদ।’
অভ্র শামসুর চৌধুরীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। তার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। কিছুদূর হাঁটার পর একটি ফার্মেসি চোখে পড়লো। অভ্র ওষুধ কিনলো মাথা ব্যাথার। হলে গিয়ে ঘুমাতে হবে। শামসুর চৌধুরীর এগ্রো ফার্মের বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে। পুরো ঘটনাটি কোনোভাবে অভ্রর আত্মসম্মানে আঘাত হানছে না তো?
রায়া নুরুল আলমের অফিস ঘরে বসে আছে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। তার সামনে টুটুল টাকলা বসে আছে। টুটুল টাকলা রায়াদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ঘটকালি করা তার পেশা। তিনি রায়ার জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। পাত্র আমেরিকা থাকে। আসার পর থেকেই তিনি পাত্রর গুণগাণ গাইতে ব্যস্ত। এক ফাঁকে নুরুল আলমকে বলে রায়াকে দোতলার অফিস ঘরে ডাকিয়ে এনেছেন। পাত্রর সম্পর্কে দেওয়া প্রতিটি তথ্য নুরুল আলম আগ্রহভরে শুনছেন। রায়ার মনে হচ্ছে তথ্যগুলো যদি খাওয়া যেতো তার বাবা গোগ্রাসে সেগুলো গিলতেন।
‘ছেলে খুবই ভালো আলম ভাই। শিক্ষিত মর্ডান ছেলে। সপরিবারে দেশের বাইরে থাকে। রক্তে আমেরিকা মিশা গেছে। এখন ব্লাড টেস্ট করাইলেও আমেরিকা পজিটিভ আসবো। কিন্তু বাংলাদেশী পোলা তো। দেশের প্রতি টান থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই খাঁটি দেশি পাত্রী চায়। আমার অনেক দেশী পাত্রীও আছে যারা খাঁটি আমেরিকা পজিটিভ পাত্র চায়। কিন্ত আমি ভাই তাগো কাছে না গিয়া আপনার কাছে আইছি। রায়া মামণির একটা ব্যবস্থা না কইরা কি অন্যরে মুক্তার মালা পরামু নাকি? আর এই পাত্র তো শুধু মুক্তা না। স্বর্ণের চেনে মুক্তা বসানো মালা। আমাদের রায়া মামণির জন্য সঠিক। খাপে খাপ।’
রায়া বলে উঠলো,
‘আমার খাপে খাপ কোনো জিনিসই পচ্ছন্দ না। কাজেই, এই স্বর্ণের চেনে মুক্তা বসানো মালা অন্য কাউকে পরান আংকেল।’
টুটুল বিস্মিত স্বরে বললো,
‘এডা কি কইলা মামণি? পোলার জন্য মেয়েরা লাইন দিয়া রাখছে। এমন পোলা হাজারে একটা! একবার মিস গেলে সারাজীবন আফসোস করা লাগবো।’
রায়া কিছু একটা বলতে চাইলো। নুরুল আলম তাকে থামিয়ে দিলেন।
‘তুই ওপর তলায় যা।’
‘বাবা, আমি এখন বিয়ে করবো না।’
‘এবিষয়ে পরে কথা হবে। তুই এখন তোর ঘরে যা।’
‘বাবা..’
নুরুল আলম চোখ লাল করে মেয়ের দিকে তাকালেন। রায়ার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। চোখের পানি আড়াল করার জন্য হলেও তার এখন উঠতে হবে। রায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। টুটুল নতুন উদ্যমে তার আমেরিকা পজিটিভ পাত্রকে নিয়ে বলতে শুরু করলো।
← পর্ব ২১ | পর্ব ২৩ → |