আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
ছেলেগুলো আজিজ সাহেবের পেলে পুষে বড় করা মাস্তান। ইলেকশনের পর থেকে এদের বেপোয়ারা ঘোরা ফেরায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মতো কেউ নেই। নালিশেও বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে না। যে সর্ষে ভর্তি ভূত, সে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়াবে এ সাধ্য কার? তাদের এই লাগাম ছাড়া ঘোরা ফেরায় ভার্সিটির স্টুডেন্টদের ভোগান্তি অন্তহীন। যতক্ষণ ক্যাম্পাসে আছে, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত। ক্যাম্পাসের বাইরে পদধূলি পড়লো কি পড়লো না মাস্তানদের উৎপাত শুরু। সেদিন রিক্সা থেকে নামিয়ে এক মেয়ের ওড়না ধরে টানাটানি। চলতি পথে নোংরা নোংরা কথা বলে হেনস্তা করা তো সাধারণ ব্যাপার।
বেশ কদিন ধরেই রুদালিকে মালেক এর বেশ মনে ধরেছে। মালেক আজিজ সাহেবের খাস মাস্তান। দলের বাকি সদস্যরা তাকে গুরু মানে। ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে অটো রিক্সার জন্য যে সময়টুকু অপেক্ষা করে রুদালি, ঠিক তখনই উচ্চস্বরে গান গাইতে শুরু করে মালেক।
‘যেও না সাথী। ও ও ও...’
পাশ থেকে দলের বাকিদের উচ্ছ্বাস যেনো দমিয়ে রাখার উপায় নেই। রুদালি ভয় পায়। কিন্তু চেহারায় ভেসে উঠতে দেয় না।
আজও ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসের বাহিরে অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে রুদালি। মালেক রাস্তার ওপাশের টং এর দোকানে বসে চা আর বনরুটি খাচ্ছিলো। রুদালিকে দেখা মাত্র সে গলা খাঁকারি দেয়। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়ার দেখা মিললো না। নাহ! শুধু মাত্র গান গেয়ে, বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে এই মেয়ের কাছ থেকে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। ডোজ আরেকটু বাড়াতে হবে। আজ যদি অভারডোজও হয়ে যায় সমস্যা নেই। মালেক রাস্তা পার হয়ে রুদালির পাশে এসে দাঁড়ালো। উঁচু গলায় গাইতে শুরু করলো,
‘চুমকি চলেছে একা পথে। সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?’
এবারো রুদালির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এবার মালেক তার ডোজ বাড়ালো। রুদালির গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। এ অবস্থায় চুপ করে থাকা যায় না। ঘেন্নায় রুদালির শরীর গুলিয়ে উঠলো। সে চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘সরে দাঁড়ান। গায়ের ওপর উঠে আসছেন কেনো? পাশে জায়গা নেই?’
মালেক নিষ্ক্রিয় কন্ঠে বললো,
‘আছে তো। ধারে কাছে এমন সুন্দরী রমনী থাকতে দূরে কেনো দাঁড়াবো?’
‘আমি বলেছি তাই দাঁড়াবেন। মেয়ে দেখলেই শুরু হয়ে যায় আপনাদের। লজ্জা করে না? পরিবার থেকে শিক্ষা দেয় নেই?’
‘এই যে ম্যাডাম। শুরুই তো করলাম না। পরিবারের কথা তুলে ফেললেন! তাহলে তো শুরু করতেই হয়।’
একথা বলে মালেক রুদালির কাঁধে হাত রাখলো। ঠিক সেসময় ভার্সিটির দ্বিতীয় গেট দিয়ে শেষ বর্ষের ছেলে মেয়েদের ক্ষিপ্ত অবস্থায় বের হয়ে আসতে দেখা গেলো। এতজন শিক্ষার্থী একসাথে দেখে মালেক কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। তার ধারণা সত্যি। ছেলে মেয়েগুলো তাদের দিকেই আসছে। সবাই সম্মিলিত স্বরে বলছে,
‘ইভ টিজিং থেকে মুক্তি চাই, নিরাপদে থাকতে চাই।’
মালেক রুদালিকে ছেড়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে নিলো। ক্ষিপ্র গতিতে বাইক স্টার্ট দিয়ে ভার্সিটির গন্ডি পেরোলো মাস্তানের দল। রুদালি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের কোণায় পানি। এই বিংশ শতাব্দিতে এসেও মেয়েরা কেনো এত অসহায়? অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোথায়? মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়?
পুনরায় কেউ রুদালির কাঁধে হাত রাখলো। সে কিছুটা চমকে উঠলো। পেছন ফিরতেই দেখলো অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। রুদালির চোখে চোখ পড়তেই অভ্র হাত সরিয়ে নিলো। রুদালিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে বললো,
‘চলো তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
‘না। সমস্যা নেই। আমি একা চলে যেতে পারবো।’
‘সেটা আমি জানি। মালেকের ছেলেপেলে ভার্সিটি এরিয়াটুকুর পরেই ওঁত পেতে বসে আছে। একা যাওয়া টা ঠিক হবে না।’
রুদালি কোনো উত্তর দিলো না। তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। রুদালির পরিস্থিতি অভ্র ঠাহর করতে পারলো। সে শান্ত স্বরে বললো,
‘যদি অতীত তোমায় বাধা দেয় তাহলে ভিন্ন বিষয়। তবে একজন বন্ধু তার বন্ধুর জন্য এটুকু করতেই পারে।’
‘বন্ধু’ শব্দটি শুনেই রুদালির সকল জড়িমা কেটে গেলো। এই শব্দটির মাঝে বিশেষ কিছু আছে। এই শব্দটি মিশ্র অনুভূতির জায়গা।
বিকালে পল্টনদা আসলেন রমজান খানের সাথে দেখা করতে। আজ তিনি এসেছেন বিশেষ এক কারণে। তা বোঝা গেলো কুশলাদি আদান প্রদানের পর।
‘একটা কথা বলি রমজান ভাই। কথাটা কিভাবে নিবেন জানি না। কিন্তু আপনি আমার কাছের মানুষ। ভালো চাই দেখেই বলতেছি।’
‘আরে দাদা, বলেন তো কি হয়েছে! এত বিভ্রান্তির কারণ নেই।’
‘ইয়ে মানে বাড়ির বৌকে আজ দেখলাম অন্য এক ছেলের সাথে অটো থিকা নামলো।’
‘অটোতে তো কত মানুষই বসে। এ আর এমন কি? এলাকার কেউই হবে হয়তো।’
পল্টনদা নিচু স্বরে বললো,
‘আপনি সবকিছু এত স্বাভাবিক ভাবে নেন দেইখাই সমস্যা ভাই। ছেলে এই এলাকার না। তাছাড়া ভাব ভঙ্গি আমার ভালো লাগে নাই। বাড়ির বৌকে নিয়া বলতে হয় না, তাও বলি ভাই! বিয়ার পর অন্য পুরুষের সাথে এত মাখামাখি কিসের? নেহাত আমি ঘরের মানুষ তাই আপনার কাছে খোলসা করে বললাম। বাইরের মানুষ কি বলবে? তারা তো ঘরের বৌ এর চরিত্রে আঙুল তুলবে।’
‘তা ঠিক বলেছেন। কিন্তু...’
‘কোনো কিন্তু না ভাই। সময় থাকতেই ঘোড়ার লাগাম ধরেন। আমি তো আগেও আপনাকে বলছিলাম। অল্প বয়স। তার মধ্যে অর্ণব গেলো ঢাকা। মৌমাছির চাকে কমবেশি সবাই ঢিল মারে। আর পুরুষ মানুষের স্বভাবই ঢেলাঢেলি করা। এখনো সময় আছে।’
সাহেলা কোনো এক কাজে ঘরে এসেছিলো। পল্টনের কথা সবই তিনি শুনে ফেললেন। জানালার পর্দা কিছুটা ফাঁক করে দেখলেন রমজান খানের মুখ স্বাভাবিক নেই। পল্টনদার কথা রমজান খানেরও মনে ধরেছে।
রুদালি ঘরে পায়চারি করছে। খানিকটা অস্থিরতা কাজ করছে তার মাঝে। আজ সারাদিন একবারও অর্ণবের সাথে তার কথা হয়নি। বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। কিন্তু বার বার নারীকন্ঠ একটি লাইনই বলে চলেছে, ডায়ালকৃত নম্বরটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এত দীর্ঘ সময় যোগাযোগ করে না থাকার মানুষ অর্ণব নয়। বাড়ির কারো সাথেই আজ তার যোগাযোগ হয়নি। ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ আগে বাসায় কেউ একজন এসেছে। কলিং বেল বাজানোর শব্দ শুনেছে সে। কিন্তু কে এসেছে তা জানার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই রুদালির। সে ব্যস্ত হয়ে অর্ণবের নাম্বারে পুনরায় ডায়াল করতে লাগলো।
রমজান খানের সামনে তার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেকে এখন এসব কথা বলা উচিত হবে কিনা তা উনার বোধগম্য হচ্ছে না। অর্ণব না জানিয়েই টাংগাইল ফিরে এসেছে। উদ্দেশ্য গোটা পরিবারকে চমকে দেওয়া। রুদালিকে একটু বেশি করেই চমকে দিতে চায় সে। ফলস্বরূপ সারাদিন মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করেনি। নিউ মার্কেট থেকে এক ডজন কাঁচের চুড়ি কিনেছে। লাল পাড়যুক্ত সাদা শাড়িও কিনেছে। একপাতা টিপও আছে। বাকি রইলো কাজল আর লিপস্টিক। সামনে নববর্ষ। বাঙালি সাজে রুদালিকে কি সুন্দর লাগবে অর্ণব কল্পনায় কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছে। রমজান খানের মুখ গম্ভীর। তিনি মোটা গলায় বললেন,
‘বসো। তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।’
অর্ণব অবাক হয়ে বললো,
‘কি হয়েছে বাবা?’
‘বসো বলছি।’
সাহেলা মাত্রই ছেলের জন্য কনকনে ঠান্ডা পানি হাতে ঘরে ঢুকেছে। তিনি রমজান খানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এসব বিষয়ে পরে কথা বললেও চলবে।’
রমজান খান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালেন।
‘আজ পল্টনদা বলেছেন। তিনি নেহাত ভালো মানুষ বলে সরাসরি আমাকে বলেছেন। অন্য কেউ হলে বলতো না। এলাকা জুড়ে রুদালির চরিত্রের বদনাম করে বেড়াতো!’
‘উনি তো বাড়িয়েও বলতে পারেন!’
‘তেমন লোক উনি নয়, সাহেলা। বাজে বকবে না।’
অর্ণব কথার আপাদমস্তক ধরতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে বললো,
‘আমাকে বলবে তো নাকি? নিজেরাই আলাপ করছো। হয়েছে টা কি?’
রমজান খান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
রুদালি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহাশূণ্যে। যতদূর চোখ যায় ঝকঝকে তারকারাজি। এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব।
‘রুদালি।’
অতি পরিচিত কন্ঠে রুদালির ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে রুদালির বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। তবুও সে প্রায় একছুটে অর্ণবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাকি রইলো জড়িয়ে ধরাটা।
উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
‘আপনি কখন এসেছেন? আমাকে তো কেউ বলেনি আপনি আসবেন?’
‘তোমার সাথে আজ অটোতে যে ছেলেটি এসেছিলো সে কি অভ্র?’
এমন প্রশ্ন শুনে রুদালি হতভম্ব। দুচোখে বিস্ময় নিয়ে অর্ণবের দিকে চেয়ে রইলো। অর্ণব অভ্রকে কিভাবে চিনে! আর অটোতে আজ অভ্র তার সাথে ছিলো সেটাও বা কিভাবে জানে?
‘তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেছি।’
‘হ্যাঁ।’
‘কি হ্যাঁ?’
‘অভ্র ছিলো।’
‘ঠিক আছে।’
রুদালি কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেনো? কি হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি।’
অর্ণব আর কথা এগুলো না। ব্যাগ পত্র ঘরে রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলো। জার্নি করে এসেছে সে। ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন।
← পর্ব ২২ | পর্ব ২৪ → |