আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
রহমান সাহেব মাত্রই কবজি ডুবিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে উঠেছেন। ভালো করে হাত ধুয়ে তিনি সোজা ড্রইং রুমে চলে এলেন। সোফায় আয়েশ করে বসে টিভি ছাড়লেন। আজ নববর্ষ। টেলিভিশনে ভালো ভালো প্রোগ্রাম দেখানোর কথা। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে, তিনি থেকে থেকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। ঢেঁকুর দিয়েও কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজের আস্বাদন। রহমান সাহেব কিছুটা বিরক্ত হলেন। স্ত্রী সুরমা ডায়নিং এর আশে পাশেই ছিলেন। তিনি হাঁক ছাড়লেন,
‘রুদালির মা, এক কাপ চা খাওয়াও দেখি।’
‘দিচ্ছি।’
একথা বলে সুরমা রান্নাঘরে চলে গেলো। টেলিভিশনে স্বমসুরে গান গাইছে একদল ছেলেমেয়ে। এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। রহমান সাহেব চোখ বন্ধ করে বুকের ওপর হাত দিয়ে তাল দিচ্ছেন। মাথা নাড়ছেন। গানটি তার বেশ পচ্ছন্দ। দলীয় কন্ঠে শুনতে আরো ভালো লাগছে। তিনি যথেষ্ট উপভোগ করছেন। তার তাল কেটে গেলো কলিং বেল এর শব্দে। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই তিনি বললেন,
‘রুদালির মা। দেখো তো কে আসছে?’
প্রত্যুত্তরে সুরমা রান্নাঘর থেকেই কিছু একটা বললেন। তবে তা রহমান সাহেবের বোধগম্য হলো না। একে তো উচ্চ শব্দে টেলিভিশন চলছে। তার ওপর সুরমা বরাবরই কিছুটা অস্পষ্ট স্বরে কথা বলে। রহমান সাহেব আরো একবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি বললে?’
সুরমা পুনরায় কিছু একটা বললো। এবারো তার কথা বোঝা গেলো না। রহমান সাহেব অসন্তোষ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। লুঙ্গি মোড়াতে মোড়াতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজা খোলার সাথে সাথে তিনি কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলেন। তার সামনে রুদালি দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন পর মেয়েকে দেখে রহমান সাহেবের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি খুশি হতে পারলেন না। রুদালির হাতে লাগেজ দেখে সন্দেহের দৃষ্টি মেলে রাখলেন। মেয়ে ঘুরতে আসলে লাগেজ নিয়ে আসবে কেনো? তাছাড়া মেয়ের জামাই কই? আশেপাশে তার টিকিটা পর্যন্ত নেই!
‘বাইরেই দাঁড়া করিয়ে রাখবে? ভেতরে ঢুকতে দিবে না, বাবা?’
‘আয় ভেতরে আয়।’
রুদালি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
‘আমি আশাতে মনে হয় তুমি খুশি হওনি। তাই না বাবা?’
‘এসব কি বলছিস? খুশি হবো না কেনো?’
রহমান সাহেব কথার ফাঁকে বারবার রুদালির হাতের লাগেজ দেখতে লাগলেন। তার এই কৌতূহল মিশ্রিত চাহনী রুদালির দৃষ্টি এড়ায়নি। রুদালি সহজ কন্ঠে বললো,
‘তোমাদের জামাই বললো, কটা দিন বাবার বাড়ি ঘুরে আসতে। তাই চলে এলাম।’
রহমান সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
‘ও তাই বল। আমি ভাবলাম কি না কি!’
‘কি ভেবেছো? শশুড় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে?’
‘না তা ভাববো কেনো?’
‘ভাবা উচিত ছিলো। ভাবো নি কেনো?’
‘এরকম অলুক্ষুণে কথা কেনো ভাববো? কি আজেবাজে বকছিস এসব?’
রুদালি হেসে বললো,
‘আমাকে শশুড়বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নেহাত ভদ্র পরিবার বলে সরাসরি বলতে পারেনি। কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও দেওয়া হয়েছে। আর কোনো প্রশ্ন করো না। আমি ঘরে গিয়ে একটু ঘুমাবো। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। বাসায় মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট আছে?’
‘আছে।’
‘মা কোথায়?’
‘রান্নাঘরে।’
‘কি করছে?’
‘চা বানাতে বলেছিলাম। মনে হয় চা বানাচ্ছে।’
‘পানি বেশি দিয়ে থাকলে আমাকেও একটু চা দিতে বলবে। সাথে মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট।’
রুদালি নিজের ঘরে চলে গেলো। অবিলম্বে সুরমাও রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে বের হয়ে এলেন। রহমান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘কে এসেছে?’
‘রুদালি।’
সুরমার দুচোখ চিকচিক করে উঠলো।
‘ওমা তাই! জামাইও এসেছে?’
‘না। ওকে নাকি বের করে দিয়েছে ও বাড়ি থেকে।’
সুরমা ভয়ার্ত গলায় বললো,
‘মানে?’
রহমান সাহেব রাগন্বিত স্বরে বললেন,
‘জানি না আমি। তোমার কণ্যাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। সে অঘটন ঘটন পটীয়সী। কে জানে কি কান্ড ঘটিয়ে এসেছে যে ব্যাগপত্র সমেত পাঠিয়ে দিয়েছে! আগে বিয়ের জন্য মানুষের হাত পা ধরতে হতো, এবার মেয়ের সংসার টেকানোর জন্য হাত পা ধরতে হবে। শান্তি নাই!’
‘আচ্ছা। আমি গিয়ে কথা বলে দেখছি।’
‘এক কাপ চা নিয়ে যেও। সাথে মাথা ব্যাথার ট্যাবলেটও নিও।’
সুরমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
রুদালি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দরজা খোলার আওয়াজে সে চোখ মেলে তাকালো। সুরমা এসেছেন। রুদালি মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। সুরমা মেয়ের পাশে গিয়ে বসলো।
‘কেমন আছিস মা?’
রুদালি উত্তর দিলো না। শোয়া থেকে উঠে বসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। সুরমা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘তোর বাবা বললো, জামাই আসেনি।’
‘হুঁ।’
‘কিছু হয়েছে?’
রুদালি এবারো উত্তর দিলো না। মায়ের কাছ থেকে মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট নিয়ে পানি দিয়ে গিলে খেলো। সুরমা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘ও বাড়ি থেকে নাকি তোকে বের করে দিয়েছে! কি হয়েছে খোলসা করে বলতো আমাকে।’
রুদালি শান্তভাবে বললো,
‘ভুল বোঝাবোঝি হয়েছে মা।’
‘সংসার জীবনে একটু আধটু ভুল বুঝাবুঝি হবেই। জামাইয়ের সাথে কথা বলে সব মিটমাট করে ফেল। এভাবে চলে আসাটা কি কোনো সমাধান?’
‘আমি তো চলে আসতে চাইনি। আমাকে চলে আসতে বলা হয়েছে। তাছাড়া এই ভুল বুঝাবুঝি অনেক বড় তো! চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মতো বড়। এত সহজে মিটবে না।’
সুরমা ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রুদালি এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বললো,
‘জানালাটা লাগিয়ে দাও তো মা।’
‘এই ভ্যাপসা গরমে জানালা লাগিয়ে থাকবি কিভাবে?’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে।’
সুরমা অবাক হয়ে বললো,
‘আকাশে মেঘের ছিটে ফোঁটাও নেই! বৃষ্টি কিভাবে নামবে?’
‘না থাকুক। তারপরেও বৃষ্টি নামবে। তুমি লাগিয়ে দাও। পর্দাও টেনে দিও।’
সুরমা মেয়ের কথা মতো জানালা লাগিয়ে দিলো। পর্দা টেনে দিলো। পুরো ঘর এখন আবছা অন্ধকার। রুদালি আধ শোয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে আছে। ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। সুরমা বললো,
‘তুই তাহলে বিশ্রাম নে। আমি পরে আসবোনি।’
‘চা নিয়ে যাও মা। খেতে ইচ্ছে করছে না।’
সুরমা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বেশি নয়, মাত্র মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানে আবহাওয়া বদলে গেলো। কে জানে কই থেকে? দলে দলে কালো মেঘেরা এসে জমা হতে শুরু করলো ঈশান কোণে। দেখতে দেখতে কালো মেঘের আলোড়ন গগণ জুড়ে। প্রচন্ড গতিতে বাতাস শুরু হলো। ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। সুরমার কেনো যেনো মনে হলো তার মেয়েটা কাঁদছে! আর সেই কান্না আড়াল করতেই প্রকৃতি তার মাঝে এনেছে এই ভিন্নতা।
নুরুল আলম হাসিমুখে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে চারটি শাড়ির প্যাকেট। তিনি মেয়ের দিকে প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এখান থেকে তোর পচ্ছন্দ মতো দুটো শাড়ি আলাদা করে ফেল তো।’
রায়া বাঁকা স্বরে বললো,
‘কেনো? আলাদা করে ফেলবো কেনো?’
‘দুটো শাড়ি তুই নিজের জন্য আলাদা করে রাখবি।’
‘বুঝলাম। কিন্তু কি উপলক্ষে জানতে পারি?’
নুরুল আলম ইতস্তত করে বললেন,
‘কি উপলক্ষে আবার! এমনি। তোকে দিতে মন চাইলো।’
রায়া হেসে বললো,
‘সোজা সাপ্টা বলো না এই শাড়ি পরে, সেজে গুজে সার্কাসের ভাঁড় সেজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হবে!’
‘কথা না বাড়িয়ে যা বললাম তাই কর।’
এই বলে নুরুল আলম স্থান ত্যাগ করলেন।
রায়ার সামনে রঙ বেরঙের শাড়ি রাখা। সবগুলোই রায়া ফ্যাশনের নিজস্ব ডিজাইনের শাড়ি। যে কোনো দুটো শাড়ি রায়াকে এখন আলাদা করতে হবে। এইতো! আজ বাদে কাল তাকে দেখতে আসবে। রায়া আড়ি পেতে সবই শুনেছে। সে উপলক্ষেই নতুন শাড়ি দেওয়া হচ্ছে তাকে। নুরুল আলম একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে পিছপা হোন না। টুটুল টাকলার সেই আমেরিকা পজিটিভ পাত্রর সঙ্গেই কথা বার্তা এগোচ্ছে। নুরুল আলমকে পাত্রর ছবি দেখানো হয়েছে। দেখতে মন্দ নয়! চেহারায় বিদেশী ভাবও আছে। রায়ার পাশে এই ছেলে চলনসই। রায়াকেও ছবি দেখানো হয়েছে। ছবিখানি দেখে সেকি ভণিতা। নুরুল আলম বেশ কয়েকবার বলেছেন, এমন ছেলে হাজারে একটা পাওয়া যায়। রায়ার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বিছানায় মেলে রাখা শাড়িগুলো থেকে দুটি শাড়ি বাছাই করে নিলো। একটির রঙ গোলাপি অপরটির রঙ সবুজ। এই রঙ দুটোতে রায়াকে মানায় না। শাড়ি দুটোর রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বার্থকতা এটাই। রায়া শাড়ি দুটো আলমারিতে যত্ন করে তুলে রাখলো। তারপর ফোন হাতে বারান্দায় চলে এলো। অভ্রর নাম্বার ডায়াল করলো।
‘আমাকে চিনেছেন?’
‘নম্বরটা সেভ ছিলো বলেই হয়তো চিনেছি। নচেৎ চেনার সম্ভবনা ছিলো না। দীর্ঘদিন পর কই থেকে উদয় হলেন?’
‘যেখান থেকে সবসময় উদয় হই সেখান থেকেই। আচ্ছা আমার নম্বরটা কি নামে সেভ করা?’
‘তনিমা।’
রায়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে_ 'স্যার আমি তনিমা নই। আমি রায়া। খুব শিঘ্রই আমার বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। বিয়ের পর আমায় নিয়েও আমেরিকা চলে যাবে। কিন্তু আমি যেতে চাই না। স্যার আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন? আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।' কিন্তু রায়া একথাগুলো অভ্রকে বলতে পারবে না। সব কথা সবাইকে চাইলেও বলা যায় না।
← পর্ব ২৩ | পর্ব ২৫ → |