আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ২৫ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ২৫তম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

অর্ণব তার পরিধেয় কাপড় গুলো ভাঁজ করছে। ভাঁজ করছে বললে অবশ্য ভুল হবে। ভাঁজ করার চেষ্টা করছে। পরিপাটি করে কাপড় ভাঁজ করা ছেলেদের কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন যথার্থ ট্রেনিং এর। কাপড়ের দোকানের কর্মচারীদের উপযুক্ত ট্রেনিং দেওয়া হয় বলেই তারা কাপড় ভাঁজ করায় পারদর্শী। অর্ণব কোনো কাপড়ের দোকানের কর্মচারী নয়। এতদিন এই কাজগুলো রুদালিই করে এসেছে। সে বাবার বাড়ি আছে। তাই বাধ্য হয়ে অর্ণবকেই ভাঁজ করতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদেই সে ঢাকার উদ্দেশ্যে আবার রওনা হবে। এবার যাচ্ছে দীর্ঘ সময়ের জন্য। মে মাস পুরোটা সে ঢাকায় থাকবে। জুনের মাঝের দিকে ফেরার সম্ভাবনা প্রবল। রুদালি বাবার বাড়ি গিয়েছে আজ দশ দিন হতে চললো। অর্ণব রুদালিকে ফিরিয়ে আনতে যায়নি। রুদালিও তেমন কোনো ইচ্ছা পোষণ করেনি। যেনো সে শ্বশুর বাড়ি ছাড়া ঢের ভালো আছে!
সাহেলা ছেলের ঘরে উঁকি দিলো। অর্ণব একমনে কাপড় ভাঁজ করারা ব্যর্থ চেষ্টায় মগ্ন।

‘আমি ভাঁজ করে দিচ্ছি।’

‘লাগবে না, মা। আমাকে কাপড় ভাঁজ করা শিখতে দাও।’

‘কাপড় ভাঁজ করা শিখে কি হবে?’

‘কিছুই হবে না। আবার অনেক কিছুই হবে। সুন্দর করে কাপড় ভাঁজ করতে জানাটাও একটা স্কিল। আর স্কিল ডেভেলোপমেন্টের জন্য প্র্যাকটিস করতে হয়। প্র্যাকটিস মেইকস এ ম্যান পার্ফেক্ট।’

এটুকু বলে অর্ণব হাসলো। সাহেলা ছেলের হাত থেকে কাপড় নিয়ে বললো,

‘এই স্কিল নিয়ে তুই পরে ভাবিস। কাপড় এভাবে ভাঁজ করলে লাগেজে বাকি কাপড়গুলো ভরতেই পারবি না।’

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘তাও ঠিক। আচ্ছা তুমিই ভাঁজ করে দাও।’

সাহেলা ছেলের কাপড় ভাঁজ করতে লাগলো। অর্ণব তার অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র ড্রয়ার থেকে বের করে গোছাতে লাগলো।

‘হ্যাঁ রে। তুই ঢাকা যাচ্ছিস। বউকে জানিয়েছিস?’

‘জানিয়েছি।’

‘এবাড়িতে রেখে গেলে ভালো হতো না?’

‘না মা। এ বাড়িতে থাকলে ও কারো সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। বিশেষ করে বাবার সামনে। তাছাড়া ও গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করুক সেটা আমিও চাই। কিন্তু ওকে নিয়ে যে ধরনের কথা উঠেছে, ওর মাঝে এক প্রকার জড়তা চলে এসেছে। এখানে থেকে সংশয় ছাড়া আর ভার্সিটি যেতে পারবে না।’

‘শুধু মাত্র এই কারণে ওকে বাবার বাড়ি রেখে এসেছিস তুই? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে? কিছু লুকাচ্ছিস?’

‘কি ব্যপার থাকবে! কি লুকাবো?’

‘আমাকে যতটা বোকা ভাবিস ততটা বোকাও আমি নই, অর্ণব। বিয়ের পর মেয়েরা বাবার বাড়ি ঘুরতে যায়। দিন কয়েকের জন্য থাকতে যায়। মাসের পর মাস কাটাতে যায় না।’

‘এই নিয়ম তো তোমারাই বানিয়েছো। একজন মেয়ে নিজের বাবার বাড়ি গিয়ে মাসের পর মাস থাকতে পারবে না শুধুমাত্র তার বিয়ে হয়েছে বলে?’

‘কথায় কথায় তর্ক করিস না। বৌমার সাথে যে ছেলেটা অটোতে করে সেদিন এসেছিলো তাকে তুই চিনিস। অভ্র না কি যেনো নাম ছেলেটার। বল চিনিস না তুই?’

‘চিনি।’

‘ওই ছেলের সাথে বৌমার কিসের সম্পর্ক?’

‘এতকিছু আমি জানি না মা।’

‘তুই জানিস কিন্তু আমাকে বলবি না।’

অর্ণব চুপ করে রইলো। সে জানে। সব জানে। অভ্রর সাথে রুদালির কি সম্পর্ক? শুরুটা কিভাবে হলো। শেষটা কেনো হয়েছিলো সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে আছে। তবে রুদালির ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে সম্মান করা এবং তা সংরক্ষণ করাও অর্ণবের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে সে অবশ্যই তার মায়ের সাথে আলোচনা করবে না। কিছু কিছু বিষয় স্বামী স্ত্রীর একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এ বিষয়গুলোতে তৃতীয় কারো উপস্থিতি কখনোই ভালো নয়। তৃতীয় ব্যক্তি যদি মা হয় তাও নয়।
সাহেলা কাপড় ভাঁজ করা শেষ করে বললো,

‘তৈরি হয়ে টেবিলে খেতে আয়।’

সাহেলা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর অর্ণব তার অফিস ব্যাগটা হাতে নিলো। মাঝারি সাইজের একটা ডায়রি বের করলো। ডায়রির প্রথম পাতায় তিন রঙের কলম দিয়ে ডিজাইন করে লিখা রুদালি। নামটি লিখতে নীল, সবুজ আর গোলাপি রঙের কলম ব্যবহার করা হয়েছে। পাতা কয়েকটি উল্টিয়ে একটি ছেলের ছবি পাওয়া গেলো। এই ছবিটা আগেও অর্ণব দেখেছে। এই ছবিটার পেছনেও ডিজাইন করে লিখা আছে ‘অভ্র’। ডায়রিটা অর্ণব পড়েছে। বার বার পড়েছে। রুদালির প্রতিটি ইচ্ছার কথা উল্লেখ করা আছে এই ডায়রিতে। অর্ণব তার সবটুকু উজাড় করে চেষ্টা করে যাচ্ছে রুদালির প্রতিটি ইচ্ছে পূরণ করতে। রুদালির কাছে অর্ণব সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষটি নয়। যার সাথে রাত জেগে জোছনা দেখা যায়। গহীন অন্ধকারে শুধুমাত্র জোনাকি পোকার আলোয় দুজনকে ভালোবাসা যায়। হাত ধরে সমুদ্রে পা ভিজিয়ে শত বছর বেঁচে থাকার খেয়ালে ডুবে যাওয়া যায়। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে একটি আইসক্রীমের স্বাদ দুজন মিলে নেওয়া যায়। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতে বাড়ির ছাদে হাত ধরে ভেজা যায়! তবুও সময় মানুষের ক্ষত শুকিয়ে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে। হয়তো তাই, অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ হয়েও রুদালির অদূরে তাকে বেশিদিন থাকতে হয়নি। খুব মিষ্টি একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তাদের মাঝে। এ সম্পর্ক দৈহিক সম্পর্কের চেয়েও মধুর।
তথাপি, কিন্তু। এই ‘কিন্তু’ নামক শব্দটি উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারো নেই। তাই একশ ভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করার সাধ্যও কারো নেই। ক্ষত শুকিয়ে যাবে, পুনরায় সংক্রামিত হবে না, এমন নিশ্চয়তা সময় দেয়নি। অর্ণব রুদালির বন্ধু হবে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হবে। এতে রুদালি অতীত ভুলে যাবে এমনটা কোথাও লিখা ছিলো না। অভ্র রুদালির জীবন থেকে একদম বিলীন হয়ে যাবে তার নিশ্চয়তাও ভবিষ্যত তাকে দেয়নি। তবে এত প্রত্যাশার আগমন হয়েছিলো কই থেকে?
অর্ণব বড় করে শ্বাস নিলো। তার মা সাহেলা পরিপাটি করে কাপড়গুলো ভাঁজ করে গেছে। লাগেজে এখনো অফুরান জায়গা। রুদালির বেশ কয়েকটা শাড়ি রাখার পরেও আরো কিছু জায়গা বাকি থাকবে। তাদের পরিবার সদস্য যদি আজ তিন সংখ্যার হতো তাহলে হয়তো লাগেজে আর জায়গা থাকতো না। প্রথমে অর্ণবের কাপড় থাকতো। তারপর রুদালির। তারপর তাদের সোনামণির কাপড়গুলো। কি সব এলোমেলো চিন্তা করছে সে! অর্ণব লাগেজ বন্ধ করে ফেললো।

অভ্র সিগারেট কিনতে গিয়েও কিনলো না। সে যে ভদ্রলোকের বাড়ি যাচ্ছে তিনি নিজের থেকেই অভ্রকে সিগারেট সাধবেন। খামোকা টাকা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। অভ্র শামসুর চৌধুরীর বাড়ি যাচ্ছে। তার সিদ্ধান্ত জানাতে। অভ্র কি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তা জানানোর কথা ছিলো এক দিন পর। সে একদিন পর জানায়নি। এমনকি ভদ্রলোকের সাথে কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেনি। এতদিন পর সিদ্ধান্ত জানাতে আসার যৌক্তিকতা নিয়ে অভ্র ভাবছে না। তাকে দেখেই বাড়ির দারোয়ান সালাম দিয়ে গেট খুলে দিলো। যেনো সে আগের থেকেই জানতো অভ্র এখন আসবে। অভ্র সেই অদ্ভুতুড়ে ঘরটিতে গিয়ে বসলো। তবে আজ এ ঘরের পরিবেশ কিছুটা আলাদা বলে মনে হচ্ছে। অদ্ভুতুড়ে লাগছে না। বুকসেলফ এর বইগুলোর প্রতি অভ্রর আগ্রহ জন্মেছিলো প্রথম দিন। সংকোচ ফেলে সেলফের কাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ চুপ করে বসে না থেকে সে সেলফ এর দিকে এগিয়ে গেলো। অনেক লেখকের বইয়ের কালেকশন রয়েছে। বিদেশী লেখকের বইও আছে। সেলফের মাঝখানে একটি উক্তি ফটো ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা আছে। তাতে লিখা,

‘সাফল্যের জন্য মনকে তৈরি করুন।’

উক্তিটি অভ্রর খুব পচ্ছন্দ হলো। সাথে একটি জিনিস অপচ্ছন্দও হলো। এই উক্তিটি কার তা লিখা নেই।

‘উক্তিটি সুন্দর তাই না?’

অভ্র পেছন ফিরে তাকালো।

‘জ্বি সুন্দর।’

শামসুর চৌধুরী সোফায় বসতে বসতে বললেন,

‘উক্তিটি কার জানো?’

‘না।’

‘ডেল কার্নেগির। তাকে চিনো?’

‘না।’

‘আমেরিকান রাইটার। গল্পের বই পড়া হয়?’

‘না। আগ্রহ খুঁজে পাই না। তবে বুকসেলফ ভর্তি বই দেখতে ভালোলাগে।’

‘আমারও এক সময় বইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিলো না। এখন প্রচুর আগ্রহ।’

অভ্র মুচকি হাসলো। সেলফের কাছ থেকে সরে এলো। ভদ্রলোকের সামনে বসলো।

‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি।’

‘সময় নিয়ে গেলে একদিনের। আসলে গুনে গুনে পঁয়ত্রিশ দিন পর।’

‘আমার সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগে।’

‘মানুষ দীর্ঘদিন কোনো বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে তার পজিটিভ দিকগুলো রেখে নেগেটিভ দিক গুলো অধিক পরিমাণে আবিষ্কার করতে পারে তা কি জানো?’

অভ্র কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

‘না।’

‘আমার ধারণা, তুমি তাই পেরেছো এবং তোমার সিদ্ধান্ত নেগেটিভ। তুমি ফার্মের দায়িত্ব নিচ্ছো না। ভুল বলেছি?’

অভ্র চুপ করে রইলো। শামসুর চৌধুরী হাসলেন। নীরবতা হলো সম্মতির লক্ষণ। অভ্রর যে ফার্মের দায়িত্ব নিবে না তা তিনি আগেই ধরতে পেরেছেন। তিনি এটাও জানেন, এই কাজটা অভ্রর অতি শিঘ্রই প্রয়োজন পড়বে এবং সে পুনরায় তার কাছে আসবে। তার আগ পর্যন্ত তিনিও ফার্মের কাজ শুরু করবেন না।

‘ঠিক আছে আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি তুমি এখন আসতে পারো।’

অভ্র বললো,

‘আচ্ছা।’

রাস্তায় নেমেই অভ্র সিগারেট কিনলো। ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাকে আজ সাধেনি। বিষয়টা নিয়ে অভ্র কিছুটা বিরক্ত। তার নিজের ওপর রাগও হচ্ছে। অবশ্য দুটোর কারন ভিন্ন।
ডেল কার্নেগীর উক্তির নিচে তার নাম কেনো নেই, একথা ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অথচ জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো। এটাই রাগের উৎস। একথা জিজ্ঞেস করার জন্য পুনরায় ও বাড়ির চৌকাঠের ভেতর যাওয়াটাও অযৌক্তিক। অভ্র সিগারেট খাওয়ায় মন দিলো।

← পর্ব ২৪পর্ব ২৬ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন