আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - পর্ব ২৬ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ২৬তম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

নুরুল আলমের বাড়ি গতরাত থেকেই মেতে আছে সানাইয়ের সুরে। সানাই বাজাচ্ছেন হাড় জিরজিরে একজন বয়স্ক লোক। তার শরীর কাঠের মতো চিকন এবং পাতলা। নুরুল ভাবছিলেন, এই লোকটিকে ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। আসলেই উড়ে যায় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য তাকে বেশ কয়েকবার লোকটির আশে পাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ফুঁ দেওয়া সম্ভব হয়নি। যখনি ঠোঁট দুটো সূঁচালো করেছেন ঠিক তখনি কেউ না কেউ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে, এই ফুঁ দেওয়ার চিন্তা তার মাথা থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বের করতে হয়েছে।
আজ বাড়িতে মেহমানের সমাগম হবে । তবে দ্বিপ্রহরের পরে। তিনি রাতের খাবার আয়োজন করেছেন। সবকিছু তার পরিকল্পনা মতই এগুচ্ছে। রায়াও মতবিরোধ করেনি। নুরুল আলমের ধারনা পাত্রকে তার মেয়েরও পচ্ছন্দ হয়েছে। যখন বিয়ের কথা বার্তা চলে মেয়েরা দ্বিমত পোষণ করবে। পাত্র যোগ্যতা সম্পন্ন হলেও করবে। বিয়েতে আগ্রহ নেই বোঝাবে। এটাই নিয়ম এবং মেয়ে জাতির স্বভাব। এত কিছুর পরেও নুরুল আলমকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। অহেতুক চিন্তা করছেন ব্যাপারটা তাও নয়। চিন্তা করার মতো বিষয় নিয়েই চিন্তা করছেন। সকাল থেকে তার বাম চোখের পাতা লাফাচ্ছে। তার চিন্তা মগ্নতার এটি একটা কারণ। অপর কারণটি হলো তিনি ভয়ংকর একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। তিনি দেখেছেন, রায়া বিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এমন স্বপ্ন দেখলে যে কোনো বাবার কপালেই তিন চারটি ছোট বড় ভাঁজ একসাথে ফুটে উঠবে। আবার চোখের পাতা লাফানোর বিষয়টি কুসংস্কার হিসেবে ধরা হলেও নুরুল আলম হালকা ভাবে নেন না। তিনি যখন টগবগে যুবক তার বাবা মারা গেলেন। তিনি মারা গেলেন অত্যন্ত ভালো সময়। আসরের ওয়াক্তে। মাগরিবের আগে জানাজার কাজ সম্পন্ন করা হলো। সেদিন সকাল থেকেই নুরুল আলমের বাম চোখের পাতা বিরামহীন লাফিয়ে গেছে। আরেকবার, গ্রামে নদী ভাঙ্গন শুরু হলো। তাদের গ্রামের ভিটা জমি নদীর স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। সেবারও, তার চোখের পাতা লাফিয়েছে। অর্থাৎ, এই বাম চোখের পাতা লাফালাফি অবশ্যই কোনো দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। মেয়ের ওপর আলাদাভাবে নজরদারি রাখা প্রয়োজন। হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যাওয়াটা শুভ লক্ষণ নয়।
রায়া আয়নার সামনে বসে আছে। পরনে লাল কাতান শাড়ি। সাজুগুজুর পর্ব এখন শুরু হবে। আরও আগে শুরু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু যে মেয়ে তাকে সাজিয়ে দিবে তার পোঁছতে দেরী হয়ে গেছে। রায়া ভেবেছিলো মধ্যবয়স্ক কেউ আসবে হয়তো। কিন্তু এই মেয়ে বয়সে তার চেয়েও ছোট। সে এটাও ভেবেছিলো মেয়েটি হয়তো উপজাতি গোত্রের কেউ হবে। কিন্তু একে নিতান্তই গ্রামের সাধারণ মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। তাকে তুমি করে বলবে নাকি আপনি করে বলবে এই নিয়ে রায়ার মস্তিষ্কে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে অনেক আগে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রায়া খানিকটা ইতস্তত করে বললো,

‘আপনার আরো এক ঘন্টা আগে আসার কথা ছিলো।’

মেয়েটা সহজ গলায় বললো,

‘পার্লারে এত ভীড় ছিলো! কি আর কমু আফা। কাস্টুমার রাইখা কি আসা সম্ভব বলেন?’

‘আচ্ছা বুঝেছি। এখন চট জলদি শুরু করে দেন। টেবিলের ওপর সব রাখা আছে।’

‘আমি আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হবো। আপনি আমাকে তুমি করে বলেন।’

‘নাম কি তোমার?’

‘বেলী।’

‘সুন্দর নাম। আচ্ছা বেলী শোনো। আমাকে একদম হালকা করে সাজিয়ে দিবে। যতটুকু না দিলেই নয়।’

‘কোনো সমস্যা নাই, আফা। আপনি যেমন সাজতে চান তেমনই সাজায় দিবো। কেউ বলতে পারবে না এই বেলীর সাজ অসুন্দর হয়। পার্লারে বৌ সাজতে গেলে কাস্টুমার আমারেই খোঁজে। সেই ডিমান্ড আমার।’

এতটুকু বলে বেলী হাসলো। অহংকারী হাসি। রায়া কোনো উত্তর দিলো না।

‘আফা আপনার কি প্রেমের বিয়া?’

‘হুঁ।’

‘ও। ভাই কই থাকে?’

‘আমেরিকা।’

‘বিদেশী জামাই? আমারও ইচ্ছা ছিলো বিয়া করুম প্রবাসী। দেশের বাইরে ঘুরবার যামু। কিন্তু বাসা থিকা বিয়া দিলো এক বুইড়া বেটার সাথে। সেই বেটাও বিয়ার এক বছর পর গেলো মইরা। রাইখা গেলো এক বস্তা ঋণ। হের, ঋণ শোধ দিতে দিতেই জীবন যৌবন সব মাটিতে মিশা গেলো।’

রায়া এবারও কোনো উত্তর দিলো না। বেলী আবার বললো,

‘মাশা আল্লাহ। আপনার চেহারা দেইখাই বোঝা যায়। এই বিয়াতে আপনার মত আছে। চেহারা কেমনে গেলেস দিতাছে! কিছু কিছু কাস্টুমার তো সাজানোর সময়ও কান্দে! চেহারা দেইখাই বোঝা যায় জোর কইরা বিয়া বসতাছে।’

রায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘বেলী আমার মাথা ব্যাথা করছে। আমি চোখ বন্ধ করে থাকলে কি তোমার অসুবিধা হবে?’

‘না আফা। বরং আমার সুবিধা হইবো। আরামে চোখের মেকাপ করবার পারুম।’

‘ঠিক আছে করো।’

রায়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার বিয়েটা প্রেমের বিয়ে না। তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেদিন টিয়া রঙের শাড়ি পরে পাত্র পক্ষের সামনে গিয়েও কোনো লাভ হয়নি। কিভাবে লাভ হবে? শাড়িটি পরে রায়া যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিজেই নিজেকে দেখে চমকে উঠে। তাকে সুন্দর লাগছে! অথচ এই রঙটা তাকে একদমই মানায় না। পাত্রের নাম শিহাব। তাকে দেখে মোটেও আমেরিকা পজিটিভ বলে মনে হয় না। চেহারায় খাঁটি দেশী ভাব। ছেলে শ্যামলা। উঁচা লম্বা। চেহারা কাটিং ভালো। সামনা সামনি পাত্রকে দেখার পর নুরুল আলম একই বুলি আওড়াচ্ছিলেন,

‘ছেলে তো দেখতে রায়া মা ছবির চেয়েও সুন্দর। ফার্স্ট ক্লাস ছেলে! কি ঠিক বলছি না?’

‘জানি না বাবা। আমি ছেলের ছবি দেখিনি।’

‘হায় হায়! বলিস কি? এখুনি গিয়ে দেখ। ছবি আর সামনা সামনি আকাশ পাতাল তফাত!’

‘তুমি দেখেছো তাতেই চলবে। আমার আর দেখতে হবে না। তোমার শখ না মিটলে আবার ছবি বের করে দেখো।’

নুরুল আলম সত্যি সত্যি ছেলের ছবি আনতে নিজের ঘরে ঢোকেন।
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। আষাঢ় মাসের তিন তারিখ। দেখতে দেখতে মাঝের একমাস কেটে যায়। আজ সেই বিশেষ দিন। রায়ার বিবাহ একই সাথে আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস।

অভ্র পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সে সারাদিন পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে বলে পণ করেছে। আচমকা এরকম অদ্ভুত ইচ্ছে তার কেনো হয়েছে তা সে জানে না। গত বছর এখানটায় দাঁড়িয়েই সে রুদালির হাত ছেড়ে দিয়েছিলো। এ জায়গাটা তার প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদের সাক্ষী। তবে সেদিন আকাশে অজস্র মেঘ ছিলো। পেজো তুলোর মত মেঘ নয়! আষাঢ় মাসের মেঘ। ময়লা মেঘ। বৃষ্টিও হয়েছে। আজকে আকাশ একদম ফকফকা। সাদা মেঘও নেই। অবশ্য প্রকৃতির ওপর ভরসা করতে নেই। এখন রোদ্দুরে খাঁ খাঁ করছে সব, কিছুক্ষণ পরেই দেখা যাবে রোদের ছিটে ফোঁটাও নেই। আকাশ অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সেদিন সে কারো আগমনের প্রহর গুণছিলো। আজ সে গুণছে না। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য টানে সে আজ এখানে এসেছে। চাপা অনুভূতি কাজ করছে তার। এই অনুভূতি কিসের অনুভূতি? কেনো তার মাঝে আজ এত উত্তেজনা? অভ্র বুঝতে পারছে না। তবে তার মন বলছে, ক্ষণিক বাদেই বৃষ্টি নামবে। তার নোকিয়া বারশ ফোনে রিং বেজে উঠলো। অভ্র হ্যালো বলতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনি কোথায়?’

‘আমি পোস্ট অফিসের সামনে। কেমন আছেন আপনি?’

মেয়েটি অভ্রর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। ফোন কেটে দিলো। অভ্র ভ্রূ কুঁচকালো। তনিমা ফোন করেছিলো। কিন্তু মেয়েটা তো কখনো এভাবে ফোন কেটে দেয় না! আজ আবার কি হলো? এই তনিমা মেয়েটাকে তার ভীষণ রহস্যময়ী বলে মনে হয়। মেয়েটা কে? কোথায় থাকে? কি তার পরিচয় এসব কিছুই অভ্র জানে না। কখনো জানার চেষ্টাও করেনি। আগ্রহ খুঁজে পায়নি। অথচ মেয়েটা তার সম্পর্কে প্রায় সবই জানে। এ বিষয়টাও অভ্রকে আজকাল বেশ ভাবায়। এরপর ফোন দিলে মেয়েটার কাছ থেকে সব জেনে নিতে হবে। তার পরিচয়, কোথায় থাকে, কি সমাচার? ইত্যাদি।
অভ্রর ধারনা ঠিক ছিলো। প্রকৃতি তার রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। রোদ মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে। ঝলকে ঝলকে হিমেল হাওয়া তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে। অভ্রর শরীর অল্প অল্প কাঁপছে। ঠোঁট দুটিও কাঁপছে। তার উচিত এখান থেকে চলে যাওয়া। শীঘ্রই, বাতাসের ঝলকে বৃষ্টি ফোঁটাও তেড়ে এলো। টিপ টিপ বৃষ্টির বেগ দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগলো। কিছু দূরেই একটি অল্পবয়স্ক ছেলে কদম ফুল বিক্রি করছিলো। ছেলেটি প্রবল বর্ষণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে ছুটতে লাগলো। অভ্রর সামনে দিয়েই সে গেলো। অসাবধানতা বসত কয়েকটি কদম ফুল রাস্তায় পড়ে গেলো। অভ্র ছেলেটিকে ডাক দিলো। কিন্তু ছেলেটি পেছন ফিরলো না। ফুলগুলো খুব সুন্দর। তাজা এবং টসটসে। এভাবে অযত্নে রাস্তায় পড়ে থাকবে অভ্রর তা পচ্ছন্দ হলো না। সে এগিয়ে গিয়ে ফুলগুলো তুলতে লাগলো। গুণে গুণে পাঁচটা কদম ফুল সে কুড়িয়ে নিলো। ছয় নম্বর ফুলটি ছোঁয়া মাত্রই কেউ তাকে কাঁপা কন্ঠে পেছন থেকে ডাক দিলো,

‘অভ্র স্যার।’

অভ্র ফুলগুলো হাতে নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। রায়া! তার সামনে রায়া দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লাল কাতানের শাড়ি। গলায় হালকা গয়না। মেয়েটা কাঁদছে। বৃষ্টি তার চোখের পানি ধুয়ে নিচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার যে হেঁচকি উঠে গেছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অভ্র রায়াকে এভাবে আগেও একবার দেখেছে। ঠিক এভাবেই! লাল কাতান শাড়ি পরনে, শরীরে হালকা গয়না। সেদিনও মেয়েটা এভাবেই পাগলের মতো কাঁদছিলো। কবে দেখেছে? স্বপ্নে! হ্যাঁ স্বপ্নে তাকে ঠিক এভাবেই দেখেছিলো অভ্র। শুধু বৃষ্টি তখনো নামেনি। তবে আকাশে মেঘ ঠিক জমেছিলো!

← পর্ব ২৫অন্তিম পর্ব ২৭ →

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন