আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস - অন্তিম পর্ব ২৭ - আতিয়া আদিবা - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা'র লেখা একটি ধারাবাহিক গল্প আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস'এর ২৭তম অন্তিম পর্ব
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস
আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস

‘তুমি এখানে কি করছো রায়া?’

জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অভ্র।

‘স্যার, আজ আমার বিয়ে।’

অভ্রর বিস্ময় ইতিমধ্যে সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।

‘আজ তোমার বিয়ে?’

‘জ্বি স্যার।’

‘তো তুমি এই বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় কি করছো?’

রায়া হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,

‘আমি বিয়েটা করবো না, স্যার।’

‘বিয়ে করবে না! কিন্তু কেনো?’

রায়া এবার রেগে গেলো। উচ্চস্বরে বললো,

‘আপনি কি বোকা? আপনি জানেন না আমি কেনো বিয়ে করতে চাইছি না?’

‘না।’

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি, স্যার। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?’

‘কি সব উলটো পালটা কথা বলছো রায়া? বাড়ি ফিরে যাও। চলো তোমাকে বাড়ি এগিয়ে দিয়ে আসি।’

‘আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’

‘আমি তোমার সাথে মজা কেনো করবো? এখন কি মজা করার মতো পরিস্থিতি? তুমি পাগলামি করছো রায়া। চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’

রায়া হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্র স্যার সত্যি তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন! তার অনুভূতির কানা কড়ি দামও তার কাছে নেই। অভ্র এগিয়ে আসলো। রায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘চলো। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’

‘প্রয়োজন নেই। আমি নিজের পায়ে ভর দিয়েই চলে যেতে পারবো। কিন্তু আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন এভাবে?’

অভ্র মাথা নিচু করে বললো,

‘বাস্তবতা অনেক কঠিন রায়া। আমি দিবা স্বপ্ন দেখতে জানি না।’

কঠিন স্বরে রায়া বললো,

‘আপনি স্বপ্ন দেখতে জানেন স্যার। কিন্তু ভালোবাসতে জানেন না। কতই না ভালো হতো যদি শিক্ষার পাশাপাশি ভালোবাসার মূল্যটুকু দেওয়াও শিখে নিতেন!’

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে রায়া উলটো ঘুরে হাঁটা শুরু করলো।

রুদালি বাড়ির ছাদে এসেছে। এই ভর দুপুরে কেউ ছাদে আসে না। সে এসেছে। ছাদে রোদ নেই। আকাশ মেঘলা। জর্জেটের শাড়ির আঁচল এই এলোমেলো বাতাসে ছন্ন ছাড়া হয়ে উড়ছে।

‘এই সময় কেউ ছাদে আসে নাকি?’

পুরুষ কন্ঠে রুদালি চমকে উঠলো। বাসায় তার বাবা ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ মানুষ নেই। এই কন্ঠ তার বাবার নয়। এরকম ভরাট কন্ঠ শুধুমাত্র একজনেরই আছে। রুদালি পেছন ফিরে তাকালো। অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি মুচকি হাসছে। তার চোখে চশমা। এই ছেলেটা আবার চশমা পরা শুরু করলো কবে থেকে? আগে তো পরতো না। শীঘ্রই নিয়েছে বোধ হয়। রুদালি অর্ণবকে আপাদমস্তক একবার দেখে পুনরায় উলটো ঘুরলো। ভাবখানি এমন, অর্ণবকে দেখে তার মাঝে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না। ডোন্ট কেয়ার ভাব মুখে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো সে। কিন্তু উত্তেজনা চাপিয়ে রাখার ক্ষমতা মেয়ে মানুষকে দেওয়া হয়েছে ক্ষণিককালের জন্য। অনুভূতি খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করে সর্বক্ষণ। ফাঁক পেলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। আর অনুভূতির জন্য সেই ফাঁক-টা হলো চোখ। ফুড়ুৎ করে চোখ দিয়ে বের হয়ে আসে। সাধে কি আর মানুষ বলে? চোখ যে মনের কথা বলে!

‘কথা বলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছো নাকি?’

রুদালি শান্তভাবে উত্তর দিলো,

‘না। এমন কনো প্রতিজ্ঞা করিনি।’

‘তবে প্রশ্নের উত্তর দিলে না যে?’

‘যে প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছে নেই, সেই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দেই কি করে?’

‘আমার ওপর রাগ করে আছো রুদালি? মাথাটা একটু ঘুরে গেছিলো। বৌ টাকে অনেক ভালোবাসি তো। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।’

রুদালি এবার অভিমানী স্বরে বললো,

‘আমি কি একবারো সুযোগ পেয়েছি সেদিন কি হয়েছিলো তা বলার? মেয়রের ছেলে পেলে আমায় রাস্তায় কিভাবে হেনস্তা করছিলো আপনি জানেন? জানেন না। জানার চেষ্টাও করেননি। আমাকে বের করে দিলেন বাড়ি থেকে!’

অর্ণব দ্রুত পায়ে রুদালির দিকে এগিয়ে এলো।

‘এসব কি বলছো তুমি রুদালি! বের করে দিবো কেনো? তোমার পরীক্ষা ছিলো। আমার মনে হয়েছে পল্টন কাকার ওই কথাগুলোর পর তুমি ও বাড়ি থেকে স্বাচ্ছ্যন্দে ভার্সিটি যেতে পারবে না। তাই ভাবলাম_’

‘থাক! আমি এতটাও বোকা না। আমি একটু হলেও বুঝি।’

অর্ণব রুদালির চোখের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ ভর্তি পানি। অর্ণব রুদালির চোখের পানি মুছে দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে রুদালিকে জড়িয়ে ধরলো। রুদালিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অর্ণবকে।

‘মাফ করে দাও আমায় রুদালি। আমার ভুল হয়ে গেছে। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।’

রুদালি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

‘ভুল ছাড়া কি মানুষ হয় বলো? তাছাড়া এটুকু ভুল না করলে আমি তো ফেরেশতা হয়ে যেতাম!’

‘মরন!’

নাক সিঁটকালো রুদালি।

‘হা হা হা। আচ্ছা শুনো, আর কান্নাকাটি নয়। এবার নিচে চলো। তৈরি হতে হবে।’

‘এখনি কেনো? খেয়ে যাবেন না?’

‘বিয়ের দাওয়াত আছে। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।’

‘কার বিয়ে?’

‘নুরুল আংকেলের মেয়ের বিয়ে।’

রুদালি একটু চিন্তিত মুখে অর্ণবের দিকে তাকালো।

‘রায়ার বিয়ে আজ? ছেলে কি করে?’

‘ছেলে আমেরিকায় থাকে। বিয়ে করে ভেটকিকে নিয়ে আমেরিকা চলে যাবে।’

রুদালি হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেয়েটা নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এমন সময় অর্ণবের ফোনে ফোন এলো।

‘হ্যাঁ বাবা বলো।’

ফোনের ওপাশ থেকে রমজান খান কি বলছিলেন রুদালি শুনতে পেলো না। তবে কথা বলতে বলতে অর্ণবের কপালে ভাঁজ পড়লো। ফোন রাখার পর রুদালি জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে?’

অর্ণব হতাশ গলায় বললো,

‘রায়া পালিয়ে গেছে।’

‘পালিয়ে গেছে?’

‘হুম।’

‘তার মানে বিয়ে ক্যান্সেল?’

‘হুঁ। কনে ছাড়া বিয়ে কিভাবে হবে?’

‘তাহলে আর তৈরি হয়েও বা কি হবে?’

‘তাই তো ভাবছি।’

রুদালি মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। রায়া পালিয়ে কার কাছে গিয়েছে তাও সে জানে। তবে যার কাছে গিয়েছে তার সিদ্ধান্ত কি হবে তা নিয়ে রুদালিরও বেশ চিন্তা হচ্ছে। রায়া মেয়েটার জন্য তার মায়া হয়। তার এক পক্ষীয় ভালোবাসার একটি সুন্দর উপসংহার রুদালি মনে প্রাণে চাইছে। এমন সময় আকাশ গর্জে উঠলো। রুদালি বললো,

‘বৃষ্টি নামবে মনে হয়।’

‘হুম।’

‘আপনার হাত ধরে এখনো বৃষ্টিতে ভেজা বাকি।’

‘আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতে?’

‘হুম।’

অর্ণব হাসলো। চারিদিকে ঝমঝম বৃষ্টি। রুদালি আর অর্ণব হাত ধরাধরি করে হাঁটছে।

‘মেয়েটা কই গেলো বলো দেখি, রুদালি?’

‘আমি মনে হয় জানি ও কই গিয়েছে।’

অর্ণব আগ্রহ ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘কই গিয়েছে?’

‘এখন বলতে ইচ্ছা করছে না। পরে বলবো।’

‘ঠিক আছে পরে বলবে। কিন্তু তুমি আমায় আপনি করে বলা ছাড়ো নইলে রাগ করবো।’

‘আচ্ছা। তুমি করেই বলবো।’

‘এখনি বলো।’

‘কি বলবো?’

‘যে কোনো কিছু। তোমার ইচ্ছা। শুধু তুমি করে বলবে।’

রুদালি লজ্জামিশ্রিত হাসি হেসে বললো,

‘তোমার হাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে।’

অর্ণব হেসে ফেললো। দুজনেই ভাবছে, এমন আষাঢ় যেনো তাদের জীবনে বার বার ফিরে আসে।

ঝুম বৃষ্টি রায়া এবং অভ্রর মাঝে যেনো হালকা সিল্কের পর্দা তৈরি করে ফেলেছে। এই বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে রায়ার চলে যাওয়া দেখে হঠাৎ অভ্রর বুকে হু হু করে উঠলো। জেলা সদর রোডে চটপটি আর ফুচকার প্লেটে গড়ে ওঠা ভালবাসা সে হারিয়ে ফেলেছে। বাস্তবতা সে ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে। তবে টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি ভালোবাসা আরও একবার তার জীবনে এসেছিলো। এ ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে তার কি খুব বেশি অসুবিধা হবে? রায়ার প্রতি তারও জমানো আবেগ ছিলো। শুধু আবেগের বশে সে আসতে চায়নি। কারণ মধ্যবিত্তদের জন্য প্রেম নয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? অভ্র ভাবলো। গভীরভাবে ভাবলো। এদিকে রায়ার সাথে তার শারীরিক দূরত্ব বেড়েই চলছে! যদি এখন না হয়, তবে কখনোই হবে না। অভ্র সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

‘রায়া?’

এই ডাকটাই যেনো মন প্রাণ দিয়ে প্রার্থনায় চাইছিলো রায়া। সে ভেজা চোখে পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো তার অভ্র স্যার ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তার হাতে অংক বইয়ের পরিবর্তে একগুচ্ছ কদম। তাকে মোটেও অংক স্যার বলে মনে হচ্ছে না। তাকে দেখাচ্ছে প্রেমিক পুরুষের মতো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে এগিয়ে আসছে। ক্লান্ত দুপুরে কল্পনার আসরে রায়া তার অভ্র স্যারকে যেভাবে পেতে চাইতো ঠিক সেভাবে। রায়ার একদম সামনে এসে অভ্র থামলো।

‘অংকে পাশ করেছো?’

রায়া কোনো কথা না বলে অভ্রর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। অভ্র নিচু স্বরে বললো,

‘সর্বনাশ করেছো। বৌ এস এস সি পাশ না করলে চলবে নাকি? মুখ দেখাবো কিভাবে?’

অভ্রর কথার মানে বুঝতে রায়ার বেশ সময় লেগে গেলো। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তখন আর অপেক্ষা কিসের? অভ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

‘পাশ করেছি। আমি এবার অংকে পাশ করেছি।’

অভ্র পরম ভালোবাসায় রায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেনো ওর জন্যই অবচেতন মনে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলো আজ।

‘আমি এখানে আছি তা তুমি কিভাবে জানলে?’

রায়া মুখ টিপে হেসে বললো,

‘তনিমা বলেছে।’

অভ্র চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে রায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুরো কাহিনী মাথায় ধরা দেবার পর সে চোখ পাকিয়ে বললো,

‘কি দুষ্ট তুমি!’

রায়া খিলখিল করে হাসছে। আর অভ্র সেই হাসিতে আজীবন মুগ্ধ হয়ে থাকার পরিকল্পনা পাকা পোক্ত করছে।
কি ভেবে অভ্র রায়ার হাত ধরলো? কেনো শামসুর সাহেবের এগ্রো ফার্ম! যখন জীবন তাকে ভালোবাসা আর সুযোগ দুটোই একসাথে দিতে চাইছে, তবে তা গ্রহণে সমস্যা কোথায়? অহং ভুলে জয় হোক না প্রতিটি মধ্যবিত্ত ভালোবাসার। আষাঢ়ের তৃতীয় দিবসে।



—(সমাপ্ত)—

← পর্ব ২৬

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন