আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
অভ্রদের ভার্সিটিটা খুব সুন্দর। মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বাম পাশে ছোট্ট একটি পুকুর। পায়ে হাঁটা রাস্তার দুইপাশে মাঝারি আকারের গাছ। পুকুর পাড়ের রাস্তাটুকু পেরোতেই চোখে পড়বে ‘প্রত্যয় ৭১’ ভাস্কর্য। ভেতরে আবার ছোট্ট একটি জমিদার বাড়িও আছে। অভ্র অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। টাকার অভাবে রিচার্জ করার উপায়ও নেই। অথচ বাড়িতে ফোন করা প্রয়োজন। মা-বাবার খোঁজ নেয়া প্রয়োজন। নয়তো মা ঠিক বুঝে ফেলবেন অভ্রর হাত খালি। অন্যের চোখকে ধূলো দেয়া সহজ। কিন্তু মায়ের চোখকে ধূলো দেয়া যায় না। কিছুদূর হেঁটে যেতেই অভ্রর চতুর্থ বর্ষের মকবুল ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। মকবুল ভাই তাদের হলেই থাকে। অভ্রদের ঠিক দুই ঘর পরে। অভ্র তাকে সালাম দিলো,
‘আসসালামু আলাইকুম মকবুল ভাই।’
‘কে অভ্র নাকি?’
‘জ্বি ভাই।’
‘কই গেছিলি?’
‘একটু শহরে গেছিলাম ভাই।’
‘তোর চেহারা এমন শুকনা শুকনা লাগতেছে কেন? চোখমুখ দেখি একদম বইসা গেছে!’
অভ্র চুপ করে রইলো। এই মানুষটির চোখেও ধূলো দিয়ে লাভ নেই। মিথ্যা বললে ঠিক বুঝে ফেলবে। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। মকবুল কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘দুপুরে খাইছোস?’
অভ্র নিচু স্বরে বললো,
‘না ভাই। ক্ষুধা নাই।’
মকবুল উঁচু গলায় বললো,
‘কানটার নিচে থাপ্পড় লাগাইলে ঠিকই ক্ষুধা লাগবে। চল আমার রুমে চল।’
অভ্র বাধা দিয়ে বললো,
‘না ভাই। সত্যি আমার ক্ষুধা নাই।’
‘আরে তুই দেখি দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাইতেছিস! বড় ভাইয়ের মুখে মুখে তর্ক করস!’
‘সর্যি ভাই।’
‘হুঁ। হইছে। এখন আয় আমার সাথে।’
মকবুল বগলদাবা করে অভ্রকে নিয়ে হলে ফিরে এলো। ক্যান্টিন থেকে ভাত কিনে আনলো। অভ্রর পাতে ভাত বেড়ে দিয়ে খাটের নিচ থেকে ঝুড়ি বের করলো। ঝুড়িতে দুটো আম পাওয়া গেলো। একটি আমে পোকা। অপরটি ভালো। ভালো আমটিকে দুইখন্ড করা হলো। আমের আঁটি অভ্রর পাতে দেওয়া হলো। অভ্র সামান্য আপত্তি করলো। মকবুল শুনলো না। বোতলে একটুখানি দুধ ছিলো। সেই দুধটুকুও ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। তাদের দুপুরের খাবার আম দিয়ে দুধ ভাত। পাকা আমের সময় এই খাবার বড়লোকদের বাড়িতে ডিনার টেবিলে প্রায় প্রতিদিনই খুঁজে পাওয়া যায়। মকবুল বড়লোক না। তার বাবা গ্রামের সরকারি স্কুলের একজন সাধারণ কেরানি। তাই তার খাওয়ায় কোনো বাদবিচার নেই। বড়লোকদের মতো প্রতিদিন সে আম-দুধ খেতে পারে না। দুদিন আগে সে গ্রাম থেকে ঘুরে এসেছে। ফেরার দিন মকবুলের মা পরম যত্নের সহিত ব্যাগে তিনটে আম ভরে রেখেছিলো! এক বোতল গরুর খাঁটি দুধ ছেলের হাতে দিয়ে বলেছিলো,
‘বাজান আমে দুধে মিশাইয়া খাইয়ো?’
মকবুল অশ্রুসিক্ত চোখে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,
‘খামুনি মা।’
মকবুল জানে মা নিজের ভাগের আমটুকুও চটের ব্যাগে রেখে দিয়েছে। মকবুলদের জীবনে মায়ের ভালোবাসার প্রকাশ এমন করেই হয়। খাবার সামনে পেয়ে অভ্র এক মুহূর্ত দেরী করে না। গোগ্রাসে গিলতে থাকে। ক্ষুধার কুটকুটানি থামতেই চাইছে না। এক গামলা ভাত খেলেও যেনো থামবে না! মকবুল খাওয়ার মাঝে শুধুমাত্র একবার অভ্রর দিকে তাকালো। বারবার তাকিয়ে ছেলেটাকে সে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছে না। পেটের ক্ষুধা মেটাক না সে প্রাণভরে! আম দুধ খেয়ে মাতাল হয় এমন মানুষ দুনিয়াতে আছে? অবশ্য মকবুল তো মানুষই। ভিন্ন গ্রহের কোনো প্রাণী নয়। মাতাল হওয়ার জন্য তার কোনো নেশাদ্রব্যের প্রয়োজন পড়ে না। সে আম দুধ খেয়েই টাল হয়ে যায়। অদ্ভুতুড়ে আচরণ শুরু করে। অকারণে হাসে। হাসতেই থাকে। আবার হঠাৎ করেই খুব গম্ভীর হয়ে যায়। আশেপাশে কেউ থাকলে তার সাথে যুক্তিতর্কে মেতে ওঠে। রুমে কেউ না থাকলে অন্য রুম থেকে জুনিয়রদের ধরে নিয়ে আসে। সিনিয়র হিসেবে উপদেশ দেয়। সব উপদেশ তিনি দেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। তার এই উপদেশ পর্বে বেশিরভাগ ছেলেদেরই কোনো আগ্রহ থাকে না। তবুও বড় ভাই বলে মুখ শক্ত করে তার সামনে বসে থাকতে হয়। আজকে মকবুলের রুমে অভ্র আছে। কাজেই উপদেশ দেয়ার জন্য অন্য রুম থেকে কাউকে তুলে আনার দরকার নেই।
‘বুঝলি অভ্র? এ দুনিয়ায় মানুষের সুসম্পর্ক টিকা থাকে টাকায়। তোর টাকা নাই, মানে তোর সম্মানও নাই। একসময় দেখবি তুই নিজেও নাই! হা হা হা…’
হাসি থামিয়ে আবার মকবুল বলা শুরু করলো,
‘আমার চাচা। দুবাই থাকে। আমার বাপ নিজে টাকা পয়সা ধার দেনা কইরা তারে বিদেশ পাঠাইলো। সেইখানে গিয়া চাচা ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করলো। লাভও করলো। এখন আমার বাপেরে সে চিনেই না। এর থিকা কি বুঝলি? যারে সাহায্য করবি সে তোরে আজ বাদে কাল ঠিকই ভুইলা যাবো। হা হা হা।’
অভ্র চুপ করে মকবুলের কথা শুনছে। তার সবগুলো কথাই সত্যি। শুধু সত্যি নয়। নিখুঁত সত্যি। মানুষ মাতাল অবস্থায় যুক্তিহীন কথা বলে। কিন্তু মকবুল ভাই মানুষটা আলাদা।
রুদালি রান্নাঘরে তার শাশুড়ির হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছিলো। সাহেলার অবশ্য নতুন বউয়ের রান্নাঘরে আসাটা পচ্ছন্দ হচ্ছে না। রান্নাঘরের কাজ তিনি আর কমলা মিলেই গুছিয়ে ফেলেন। তার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা খুব দ্রুত এই সংসারের ওপর খবরদারি শুরু করে দিবে। হয়তো বলবে_ আজ এই পদটা রান্না না করে ওই পদটা রাঁধলে ভালো হবে। জানালার পর্দাগুলো এই রঙের না হয়ে অন্য রঙের হলে ভালো হবে। অথবা ড্রইং রুমের সোফার জায়গা পরিবর্তন করতে বলবে। আসবাবপত্র এদিক সেদিক করবে। মোটকথা তার গোছানো ঘর বাড়ির ওপর হস্তক্ষেপ করবে।
এজাতীয় চিন্তাগুলো সাহেলা ইচ্ছা করে করছে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। তিনি সবজি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘বাড়িতে রান্নাবান্না করতে?’
রুদালি নিচুস্বরে বললো,
‘করেছি। কিন্তু খুব কম। সারাদিন তো ভার্সিটিতেই থাকা হতো।’
সাহেলা খুব বিশ্রিভাবে ‘ওঁ’ বললেন সাথে তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠে হাসলেন।
‘মেয়েদের পড়াশোনা করে আসলে লাভ নেই। শেষ মুহুর্তে এসে এই হেঁসেল ঠেলতে হয়। জজ ব্যারিস্টার আর হওয়া হয় না।’
রুদালি তার শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মরিচ বেছে রাখছিলো। তার মুখে এমন কথা শুনে সে কিছুটা থমকে গেলো। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতে রুদালির এখনো দুবছর বাকি। বিয়ের সময় সে একটি মাত্র শর্তই ছুঁড়ে দিয়েছিলো। তার পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটানো চলবে না। রুদালির বাবা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, পড়াশোনার ক্ষেত্রে ছেলেপক্ষের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এখন তার শাশুড়ির কথার হাবভাব যথেষ্ট সন্দেহজনক। এবিষয়ে অর্ণবের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু সেতো এখন বাইরে। ফিরবে রাতে। দিনের বাকি সময়টুকু রুদালির যথেষ্ট উদ্বিগ্নচিত্ত হয়ে কাটলো।
রাতে অর্ণব বাড়ি ফিরলো দুটো ট্রেনের টিকিট হাতে। রুদালির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘তুমি তো আর জানালে না কই যাবে। তাই নিজের থেকেই ঠিক করে ফেললাম। দেখো আমাদের ভ্রমনস্থান কোথায়।’
‘চট্টগ্রাম! আমরা চট্টগ্রাম যাচ্ছি?’
‘প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর কক্সবাজার। কি ভালো হবে না?’
রুদালি বেশ অবাক হলো। সে কখনো ট্রেন জার্নি করেনি। প্রয়োজনে বাসে চড়ে যাতায়াত করেছে। তার খুব ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সে দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণে বের হবে। তাদের গন্তব্যস্থান হবে কক্সবাজার। যেহেতু ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের সরাসরি ট্রেন নেই। তাই তারা আগে চট্টগ্রাম যাবে সেখান থেকে বাসে করে কক্সবাজার। অর্ণব চাইলেই বিমানের দুটো টিকিট কেটে ফেলতে পারতো। কিন্তু সে তা না করে ট্রেনের টিকেট কেটেছে। আশ্চর্যজনক বিষয়! ঘটনাটি পুরোপুরি কাকতালীয় হিসেবে বিশ্বাস করতেও রুদালির কষ্ট হচ্ছে।
← পর্ব ০৬ | পর্ব ০৮ → |