আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস |
ট্রেন চলছে তার আপন গতিতে। রুদালির মাঝে খানিকটা ঝিমুনি ভাব চলে এসেছে। অর্ণবও কোনো কথা বলছে না। ল্যাপটপ অন করে বসে আছে। সম্ভবত অফিসিয়াল কাজ করছে। রুদালির শরীর ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছে। চোখের পাতাগুলো এক হয়ে মিলছে। এক পর্যায়ে সে সত্যিই ঘুমিয়ে গেলো। অর্ণব তখনও ল্যাপটপে মগ্ন। গভীর মনযোগ দিয়ে একটি মেইল লিখছে। হঠাৎ তার কাঁধে কারো মাথা এসে ঠেকলো। সে হকচকিয়ে পাশে তাকালো। রুদালি ঘুমাচ্ছে। চুল বাঁধা। তবুও চলন্ত ট্রেনের বাতাসে তার সামনের দিকের কয়েকটা চুল এলোমেলো ভবে উড়ছে। শ্যাম্পুর খুব ক্ষীণ ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেই ঘ্রাণ নাকে এসে লাগতেই কেমন নেশাগ্রস্ত হয়ে গেলো অর্ণব। সে বুক ভরে শ্বাস নিলো। দীর্ঘায়িত শ্বাস। একবার নয়। দুবার নয়। বার বার। বারবার সে মাতালের মতো রুদালির চুলের ঘ্রাণে হারিয়ে যেতে লাগলো। কি আশ্চর্য! মেয়েটা কি শ্যাম্পুতে কোনো মাদকদ্রব্য মিশিয়ে রেখেছে? আফিম জাতীয়? নয়তো এমন আসক্তি ছুটে চলছে কেনো শরীরের প্রতিটি কোণে? অর্ণব ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিলো। মেইল পরে পাঠালেও চলবে। কিন্তু এরকম আবেগ পূর্ণ পরিবেশ একবার হারিয়ে গেলে ফিরে না আসার সম্ভাবনা প্রকট। তাই পরিপূর্ণতার সাথে উপভোগ করাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
ট্রেনে যাতায়াতের সময় দুইপাশে নানাধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ে। কিন্তু রাতের জার্নিতে সে সকল দৃশ্য বোঝার উপায় নেই। ট্রেন যখন মেঘনা রেইলওয়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলতে শুরু করলো তখনই আকাশ ফুঁড়ে শুরু হলো বৃষ্টি। অর্ণব পড়ে গেলো মহা ঝামেলায়। রুদালি এখনো গভীর ঘুমে। ট্রেনের জানালা লাগিয়ে দিতে হবে। মেয়েটাকে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। এদিকে চিন্তা করার সময়ও নেই। বৃষ্টির বেগ ট্রেনের গতির বেগকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। উপায় না দেখে অর্ণব খুব সাবধানে ট্রেনের জানালা লাগিয়ে দিতে হাত বাড়ালো। এতো সাবধানতা অবলম্বনেও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। রুদালি ঠিকই জাগনা পেয়ে গেলো। অর্ণবও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে ঠিকই সামলে নিলো। হেসে বললো,
‘বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিলো বুঝলে। তাই জানালা লাগিয়ে দিলাম’।
রুদালি উত্তর না দিয়ে একটু নড়ে চড়ে বসলো। তার শাড়ির আঁচল ভিজে গেছে। ট্রেনের জানালায় টিপ টিপ শব্দে বৃষ্টি ফোঁটা আছড়ে পড়ছে। আচমকা রুদালি কাশতে শুরু করলো। অর্ণব ব্যস্ত হয়ে রুদালির দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। সে ঢকঢক করে হাফ লিটার বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করলো। বৃষ্টির পানি মাথায় লাগলেই রুদালির প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হয়। এখনো হচ্ছে। সে করুন চোখে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি কি এক কাপ কফি পেতে পারি?’
অর্ণব অবাক হয়ে বললো,
‘কথাটা এতটা আনুষ্ঠানিকতা মিশিয়ে না বললেও চলতো।’
‘আমি আনুষ্ঠানিকতা মিশিয়ে কোথায় বললাম?’
‘এই যে বললে, আমি কি এক কাপ কফি পেতে পারি? এটাই আনুষ্ঠানিকতা। বন্ধুত্বের সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকতা কিন্তু মানানসই নয়।’
‘তাহলে আমার কিভাবে বলা উচিত ছিলো?’
‘অনেকটা এভাবে, আমি এক কাপ কফি খাবো। দ্রুত ব্যবস্থা করুন।’
‘ঠিক আছে। আমি এক কাপ কফি খাবো। একটু দ্রুত ব্যবস্থা করুন।’
অর্ণব হেসে ট্রেনের ক্যান্টিনে চলে গেলো। রুদালি মনে মনে হাসলো। ছেলেটা একটু পাগলাটে ধরনের। এরকম পাগলাটে ধরনের ছেলেরা বউকে প্রচন্ড ভালোবাসতে জানে। আচ্ছা, অর্ণব যদি রুদালির জীবনে দুটো বছর আগে আসতো, তাহলে হয়তো রুদালির জীবনটা অন্যরকম হতো। অর্ণবই হতো তার প্রথম ভালোবাসার মানুষ। রুদালি সিদ্ধান্ত নিলো সে আর রাতে ঘুমাবে না। এরকম বৃষ্টি ভেজা রাত জেগে কাটানোর মাঝে অন্যরকম আনন্দ আছে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ট্রেনের দুই পাশে এখন শুধু সবুজ আর সবুজ। এদিকেও মনে হয় রাতে বৃষ্টি হয়েছে। গাছপালা সব ভিজে আছে। রোদের মৃদু আলোয় চিকচিক করছে গাছের পাতাগুলো। মাঝে মাঝে কিছু ফসলি জমিও চোখে পড়ছে। কোনো সন্দেহ নেই ট্রেন এখন সীতাকুন্ডের আশে পাশে। থেকে থেকে মাঝারি আকারের পাহাড়। ধোঁয়াশার মাঝে শির উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই পাহাড়ের মাঝের ভি শেপের জায়গা থেকে চলছে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। রুদালির ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপছে। হিমশীতল বাতাসে সে যেনো জমে যাচ্ছে। ফুলতোলা চাদরটা বড় লাগেজের ভেতর। বেশ কয়েকটি শাড়ির নিচে। এখন লাগেজ খুলে চাদর বের করা সম্ভব না। বিষয়টা অর্ণবের দৃষ্টিগোচর হলো। সে তার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা শার্ট বের করলো। কিছুটা কুঁচকে আছে। তবে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। রুদালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরম যত্নে শার্টটি তার গায়ে লেপ্টে দিলো অর্ণব। রুদালি বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকালো। অর্ণব ফিসফিস করে বললো,
‘এখন ঠান্ডা একটু কম লাগবে।’
কথাটা শুনে রুদালির চোখ ভিজে উঠলো। পুরোনো কোনো স্মৃতি তার গহীনে কড়া নাড়লো। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের একটি উক্তি আছে। History repeats itself. ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সত্যিই তাই। কোনো এক শীতের সকালে অভ্রও তার গায়ে একখানা পুরোনো ব্লেজার চাপিয়ে দিয়েছিলো। রুদালি চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে,
‘ব্লেজার কোথায় পেলে?’
অভ্র সহজ কন্ঠে উত্তর দেয়,
‘কিনেছি।’
‘কোথা থেকে?’
‘কোনো শো রুম থেকে কিনেছি এমন ভাবার কারণ নাই। রাস্তার পাশে বড়লোকদের ব্যবহৃত ব্লেজার সস্তায় বিক্রি করছিলো। সেখান থেকে কিনে নিয়েছি।’
পুরোনো স্মৃতি গুলো কেনো যে বারবার ফিরে আসে! রুদালি পাহাড় দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠলো,
‘জায়গাটা ভীষণ সুন্দর।’
অর্ণব রুদালির উদাসীন চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সামনে স্টেশন। তাহলে চলো এখানেই নেমে যাই?’
রুদালি হেসে বললো,
‘মন্দ হবে না বলেন? খানিকটা এডভেঞ্চারও হয়ে যাবে!’
‘বুঝে বলো। এখানে কিন্তু ফাইভ স্টার হোটেল নেই, ম্যাডাম।’
‘আমার কোনো সমস্যা নেই। বাকিটা আপনার ইচ্ছা।’
অর্ণব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,
‘একটা শর্ত আছে।’
‘কি?’
‘মা বাবাকে কিন্তু বলতে পারবে না।’
‘কেনো? আপনি ভয় পান নাকি?’
অর্ণব অসহায় কন্ঠে বললো,
‘বাবাকে পাই না। বাবা আমার অনেক ভালো একজন বন্ধু। তবে মাকে ভীষণ ভয় পাই। ছোট বেলায় বেতের বাড়ি কম পড়ে নি তো। সেখান থেকেই ভয় ঢুকে গেছে।’
অর্ণবের কথা শুনে রুদালি মুখ চেপে হাসতে লাগলো। অর্ণব মুখ শক্ত করে বসে রইলো।
সীতাকুন্ড রেলস্টেশনে এসে ট্রেন থামতেই অর্ণব রুদালিকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি ম্যাডাম? তৈরি তো? নাকি মত পাল্টিয়েছেন?’
রুদালি বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,
‘মত পাল্টাইনি। আমি তৈরি।’
রুদালি আর অর্ণব ট্রেন থেকে নেমে গেলো। জায়গাটি রুদালির অপরিচিত। সীতাকুন্ডে অর্ণবও আগে আসেনি। নতুন একটি জায়গায় নববিবাহিত এক দম্পতীর এই এডভেঞ্চার উতকন্ঠিত বটে, তবে কম হৃদয়গ্রাহী নয়!
← পর্ব ০৮ | পর্ব ১০ → |