হাওয়াই মিঠাই |
মীরাকে যখন প্রীতিলতা হলের পাশের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ভয়ে তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আর যাই হােক একটা লােকের সাথে সে শক্তিতে পারবে কীভাবে? কে হতে পারে লােকটা? কোনাে এক্স বয়ফ্রেন্ড কি? যেই হােক না কেন তার কোনাে ক্ষতি করতে চায় বলেই জঙ্গলে নিচ্ছে! যখন জঙ্গলের বেশ খানিকটা ভেতরে চলে গেলাে তখনই মীরার মাথা খুললাে। লােকটা পেশাদার কোনাে ক্রিমনাল না হলে মুখের সাথে চোখ চেপে ধরতাে না। আর রুমালেও কিছু নেই, থাকলে এতক্ষণে সে অজ্ঞান হয়ে যেতাে। এসব ভাবতেই বুকে সাহস এলাে, সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সব শক্তি প্রয়ােগ করে নখ বসিয়ে দিল লােকটার হাতে। লােকটা না চাইতেও হাত আলগা করে ফেললাে। সেই সুযােগে মীরা তার হাতে প্রচন্ড জোরে কামড় দিলাে। লােকটা চিৎকার করে মীরাকে ছেড়ে দিলাে। নিজের হাত চেপে ধরে যখন ব্যাথায় কোঁকাতে লাগলাে তখন মীরা মােবাইলের টর্চ জ্বেলে দেখলাে ছেলেটা তৌহিদ। হাত কেটে রক্ত পড়ছে তার! মীরার অস্বস্তি লাগলাে রক্ত আবার ওর দাঁতে লাগেনি তাে! মীরা একটা ধমক দিয়ে বলল,
"এই তােমার হিরােগিরি?"
তৌহিদ বলল,
"মীরা তুমি কি একটা মেয়ে নাকি ড্রাকুলা? এভাবে কেউ কামড় দেয়? রক্ত বের করে ফেলেছাে!"
"খুব ভাল করেছি। তােমার সাহস কি করে হয় আমার গায়ে হাত দেয়ার?"
"দিয়েছি তাে কী হয়েছে? নিজের গার্লফ্রেন্ডের গায়ে হাত দিয়েছি, পরের গার্লফ্রেন্ডের না।"
মীরা আবার ধমক দিল,
"তােমাকে পারমিশন দিয়েছি আমি? বলেছি না প্রেমের নামে লুচ্চামি চলবে না আমার সাথে?"
"আরে বাবা কী করলাম আমি? চোখমুখ চেপে ধরেছি, আর তাে কিছু করিনি। এমনভাবে কথা বলছাে তুমি যেন তুমি একটা স্কুলে পড়া বাচ্চা।"
"তুমি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছাে! এত সাহস হয় কী করে তােমার? তাও আবার আমার ক্যাম্পাসের ভেতরে! তুমি জানাে আমি পােলাপান ডাকলে জান নিয়ে ফিরতে পারবে না তুমি।"
"আমার সাথেও লােক আছে মীরা। লােকটা কে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আমার গায়ে কেউ একটা টোকাও মারার সাহস পাবে না।"
মীরা তৎক্ষণাৎ তৌহিদের গালে একটা কষে চড় মারলাে। তৌহিদ গালে হাত দিয়ে বােকার মত চেয়ে রইলাে। মীরা আবার ধমক দিলাে,
"আনাে তােমার লােক। শুধু টোকা না, চড়ও মেরেছি। দেখি আমার কী করে?"
তৌহিদ হেসে বলল,
"আরে তােমার বেলায় সব বাদ।"
"কেন এমন করলে? তুমি জানাে না ক্যাম্পাসের ভেতর একটা মেয়েকে টেনে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া মানে কি?"
"সরি। অনেকদিন ধরে দেখা হছে না বলে আমার অস্থির লাগছিল। তাছাড়া আমি তােমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। এত রেগে যাবে বুঝিনি।"
"রাখাে তােমার সারপ্রাইজ। তুমি এই কয় মাসে এটুকুও বােঝােনি আমি খুব সিরিয়াস টাইপের একটা মেয়ে? এইসব ন্যাকামি আমার একদম ভাল লাগে না।"
"আচ্ছা বাবা সরি, আমার হাতটার কিছু করাে জান।"
"তােমাকে বলেছি না এসব রঙঢঙের নামে আমাকে ডাকবে না? আমার নাম মীরা। মীরা বলে ডাকবে।"
"আচ্ছা সরি মীরা। দেখাে হাত কেটে রক্ত বেরিয়েছে। কিছু করাে খুব জ্বলছে!"
"এর জন্য তুমি দায়ী। সমাধানও তুমিই করবে। আমি তােমাকে ক্যাম্পাসে আসতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও তুমি এসেছাে। এখন তুমি মরাে বা বাঁচো আমার কিছুই যায় আসে না তৌহিদ।"
মীরা গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলাে জঙ্গল থেকে। তৌহিদ অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাে একটা মেয়ের এতটা রাগ কিভাবে থাকে? বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে এতটা কেয়ারলেস একটা মেয়ে কি কখনাে হতে পারে? মীরা সত্যি ওকে ভালবাসে তাে? পরীক্ষার বেশিদিন বাকী নেই, মীরা রাতে শুয়ে শুয়ে পড়ছিল। হঠাৎ একটা গান শুনতে। পেলাে,
"তুমি চাইলে বৃষ্টি, মেঘও ছিল রাজী। অপেক্ষা শুধু বর্ষণের।"
গানের প্রথম লাইনটা শুনেই মীরা লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলাে। দৌড় দিয়ে খেয়াল হলাে গানটা তাহিয়ার মােবাইলে বাজছে। সুইটি জিজ্ঞেস করলাে,
"কী হলাে মীরা? এভাবে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিলি? আর হঠাৎ করে থেমেই বা গেলি কেন?"
"না, কিছু না।"
মীরা কেমন যেন চুপসে গেল। ডান হাতে সামনের চুলগুলাে পেছনে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের বিছানায় গেল, পানি খেল। তারপর বই খাতা সব টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লাে! সুইটি ও তাহিয়া বুঝলাে না মীরা এমন কেন করলাে! বসুন্ধরা সিটিতে একটা দোকানে মােবাইল দেখছিল মীরা। সুইটি আর তাহিয়াও সাথে ছিল। কিন্তু শান্তি নেই, তৌহিদ একটার পর একটা কল দিচ্ছে। একইসাথে মেসেজে মাফ চাচ্ছে। শেষমেশ এইসব থেকে মুক্তি পেতে মীরা দোকান থেকে বেরিয়ে ফোন ধরে বলল,
"তৌহিদ আমি তােমাকে মাফ করে দিয়েছি, কাল খুব মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তাই আর ফোন ধরিনি। এখন তাে ধরেছি তাই না? ফ্রি হয়ে আমি তােমাকে ফোন করবাে, প্লিজ এখন জ্বালিও না।"
"পাঁচ মিনিট কথা বলা যাবে না?"
"আমি একটা কাজে এসেছি। রিলেশনশিপের শুরুতেই কিন্তু বলেছিলাম সারাদিন রাত ফোনে কথা বলা আমার দ্বারা হবে না।"
তৌহিদ কি বুঝলাে কে জানে! বলল,
"আচ্ছা তুমি স্বাভাবিক হলেই হলাে, আমার আর কিছু চাই না। প্রমিস করছি আর কখনাে তােমার ক্যাম্পাসে যাব না।"
"থ্যাংকস, আই উইল কল ইউ।"
মীরা লাইন কেটে আবার দোকানে ঢুকলাে। পছন্দসই একটা মােবাইল কিনে ওরা খেতে গেলাে ফুডকোর্টে। খেতে খেতে সুইটি জিজ্ঞেস করলাে,
"আচ্চা মীরা তুই এই তৌহিদকে কিভাবে ছাড়াবি? ছেলেটা বড্ড ভালাে, আর খুব সিরিয়াসও, তােকে প্রচন্ড ভালোবাসে।"
মীরা বলল,
"হুরররর! ছেলেদের আবার ভালবাসা। ছেলেরা কখনাে সিরিয়াসলি ভালবাসে না। আর তাছাড়া ছেলেই কি মেয়েই কি। ভালাবাসা আপেক্ষিক একটা বস্তু। এই ভালবাসা নিয়ে আমি বেশি ভাবতে পারিনা, ভাবতে চাইও না।"
"তাহলে এত প্রেম করিস কেন?"
মীরা হেসে বলল,
"প্রেম করতে ভালবাসা লাগে নাকি? ছেলেদের ঘােরাতে ভাল লাগে, তাই ঘােরাই।"
তাহিয়া ছােট তাই চুপচাপ খাচ্ছে। সুইটিই আবার জিজ্ঞেস করলাে,
"তুই কি কখনাে কোনাে রিলেশনশিপে সিরিয়াস হবি না মীরা?"
"না। কখনাে দেখেছিস ৩/৪ মাসের বেশি কোন রিলেশনে? বেশিদিন হলে বিভিন্নভাবে ইনভলব হয়ে যাওয়া লাগে। যা আবার আমার সয় না। তার চেয়ে এই ভাল।"
"বিয়ে কাকে করবি?"
"যার সাথে বাবা মা বিয়ে দেবে।"
"একটা অচেনা অজানা ছেলেকে স্বামী বলে মেনে নিতে পারবি? অচেনা একটা মানুষ তাের শরীর স্পর্শ করবে মানতে পারবি?"
"পারবাে না কেন? মানুষের যখন প্রেম হয়। অচেনা একজনের সাথেই তাে হয়। তাের বয়ফ্রেন্ড যখন প্রথম তাের হাত ধরেছিল তখন কী সে তাের খুব চেনা ছিল? অচেনা ছেলের সাথে প্রেম করা যাবে আর বিয়ে করা যাবে না?"
মীরার এইসব দার্শনিক কথাবার্তা শুনে সুইটি হেসে উড়িয়ে দেয় কিন্তু তাহিয়া খুব ভাবে এসব নিয়ে। সত্যিই তার মীরা আপুর যুক্তিগুলাে অন্য সবার থেকে আলাদা হলেও যেন চিরন্তন সত্য!
খাওয়াদাওয়া শেষ করে সুইটি এটিএম বুথে ঢুকলাে টাকা ওঠাতে। মীরা ও তাহিয়া পাশেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। মীরা গল্প করতে করতেই আশেপাশে দেখছিল যা সে সবসময় করে। হঠাৎ নিচের বড় এস্কেলেটরে চোখ আটকে গেল একজনকে দেখে। সেই চেনা মুখ, চেনা অবয়ব। শুধু একটু সাস্থ্য ভাল হয়েছে তবু মানুষটিকে চিনতে অসুবিধা হয়নি মীরার। সে দৌড়ে লিফটের কাছে গেলাে। লিফট আসতে বহু দেরী। সে এস্কেলেটর দিয়ে নামতে শুরু করলাে। এস্কেলটরে উঠেও সে দৌড়ে নামছে। তাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে তাহিয়া হতবাক হয়ে গেলাে। ততক্ষণে সুইটি বেরিয়েছে বুথ থেকে। দুজন মিলে মীরাকে ফলাে করতে লাগলাে। মীরা যখন বড় এস্কেলটরে পা দিলাে ওই মানুষটি তখন প্রধান গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। মীরা দৌড়াতে দৌড়াতেই এবার চিৎকার করলাে,
"রাফি... রাফি দাঁড়াও। রাফি..."
কিন্তু মানুষটি বােধহয় শুনতে পেলাে না, বেরিয়ে গেলাে। এদিকে আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে দেখছে তাকে। দৌড়ে বেরিয়ে আশেপাশে আর দেখতে পেলােনা সেই মানুষটিকে। ওখানেই বসে পড়ে কেঁদে ফেললাে মীরা। ততক্ষণে সুইটি ও তাহিয়া এসে পড়েছে। তারা মীরাকে দেখে এত অবাক কখনাে হয়নি। সুইটি ৫ বছর ধরে চেনে মীরাকে, আর তাহিয়া ২ বছর। তারা দুজনের কেউই কখনাে মীরাকে কাঁদতে দেখেনি। মীরা খুব শক্ত মানসিকতার মেয়ে। কত বাধা, বিপদে পড়েও খুব স্বাভাবিক ভাবে সামলে নিতে দেখেছে মীরাকে তারা। কখনাে কোনাে কিছুতে ভেঙে পড়েনি যে মেয়েটি, সেই মেয়েটি আজ রাস্তায় বসে কাঁদছে! কিন্তু কেন? সুইটি মীরাকে ওঠাতে চেষ্টা করলাে। কিন্তু পারলাে না, মীরা পাগলের মত কাঁদছে। তাহিয়া একটা সিএনজি ডেকে নিয়ে এলাে। সুইটি ও তাহিয়া মীরাকে ধরে সিএনজিতে ওঠালাে। সিএনজি ওয়ালা জিজ্ঞেস করলাে,
"আপারা কই যাইবেন?"
এখান থেকে বেরিয়ে মীরাদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। সেই প্ল্যান অনুয়ায়ী তাহিয়া বলল,
"নাখাল পাড়া।"
মীরা তখনাে কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতেই সিএনজি ওয়ালাকে বলল,
"না, আসাদগেট চলেন।"
সুইটি বলল,
"আসাদগেট কেন?"
মীরা বলল,
"ক্যাম্পাসের বাস ধরব।"
সিএনজি ছেড়ে দিলাে, মীরা তখনাে কাঁদছে। সুইটি আর তাহিয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাে। তারপর সুইটি মীরার পিঠে হাত রেখে বলল,
"কাঁদছিস কেন? আর ওভাবে দৌড়াচ্ছিলি যে? কে রাফি?"
মীরা দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে, কিছু বলতে পারছে না। তাহিয়া বলল,
"থাক সুইটিপু। মীরাপুকে কাঁদতে দাও। কাঁদলে মন হালকা হবে।"
পর্ব ০১ | পর্ব ০৩ |