পদ্মপাতা - পর্ব ২৫ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!৭৩!!

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ভালোবাসার মানুষটিকে চোখের সামনে দেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি। চোখে তার অভিমান। স্থানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাসরুম। আজ তাদের নতুন লেকচারার আসার কথা ছিলো। তাহলে এই নিষ্ঠুর লোকটি তাদের নতুন লেকচারার। পাশ থেকে সুমাইয়া বললো,
-চাঁদ, স্যার বোধহয় গম্ভীর। 

চাঁদ কোনো উত্তর দিলো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ব্যাক্তিটির দিকে। যিনি ক্লাসে নিজের পরিচয় দিতে ব্যস্ত। মৃদুল চৌধুরী আবির। লোকটি নামটা একবার উচ্চারণ করলেও চাঁদের কানে তা বাজলো হাজারবার। চাঁদকে লোকটি চিনবে না। চাঁদের সারা শরীর আবৃত কালো বোরকা আর হেজাবে। শুধু চোখ দুটি খোলা। চাঁদের গলা জ্বালা করছে, চোখ দুটো তার সাথে ছলনা করে বর্ষা ঝড়াতে চাইছে। তবে চাঁদের শক্ত আবরণের পাটাতনে পিষে যাচ্ছে সে ইচ্ছে। এই লোকটির জন্য সে কাঁদবেনা। একদম কাঁদবেনা। লোকটি আগের তুলনায় আরো গম্ভীর হয়েছে। চোখে চশমা, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। এই যা পরিবর্তন। লোকটি তো ভালো আছে। বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে তো ভালোই থাকার কথা। চাঁদ নাহয় একলা জীবন কাটিয়ে দিলো। এই লোকের স্মৃতি আর তার সন্তানের দিকে চেয়ে।

ক্লাস করাতে গিয়ে একজোড়া চোখে যেন আটকে গেলো আবির। ঠিক তার হরিণীর চোখ। সেই চিরচেনা দুটি চোখ। দেশে ফিরে একটা সত্যি জেনেছে আবির। সত্যিটা জানার পর বিগত ছয়মাসে পাগলের মতো তন্নতন্ন করে হরিণীকে খুঁজেছে আবির। কোথাও পায়নি কোথাও না। বুকটা হঠাৎ জ্বালা করছে কেন তার। ক্লাস শেষ হওয়ায় বাধ্য হয়েই বের হতে হলো আবিরকে। প্রথমদিন এসেই তো আর কাউকে ডাকতে পারেনা আবির। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলো আবির। নিতির আশার কথা। বাইরেই হয়তো। কাল পরিচয় জানবে সবার। তাহলে মেয়েটার নামও জানা যাবে।

আবিরকে বের হতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো চাঁদ। চাঁদতো সব ভুলে গিয়েছে। লোকটা কেন আবার তার জীবনে আসলো। আর কতো সইবে চাঁদ।
বাকি ক্লাসগুলো না করেই নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। শাহবাগেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে সে। তবে বাইরে বেরিয়ে থমকে গেলো চাঁদের চোখ দুটো। আবির নিতির সাথে কথা বলছে। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো চাঁদ।

!!৭৪!!

লিফটে উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো চাঁদ। বিষাদ লাগছে সবকিছু। কিশোরী বয়সের একটা ভুলে জ্বলতে হচ্ছে তাকে। 

দরজায় কলিং বেল বাজালে রত্না খুলে দিলেন।

-কিরে আজ এতো তাড়াতাড়ি? 
-এমনি মা ভালো লাগছিলো না।
-বেশি খারাপ লাগছে? তুই বস আমি লেবু শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি। 

রত্না চাঁদের কথা না শুনেই ছুটলেন শরবত বানাতে। বোরকাটা খুলে সোফায় গা এলিয়ে দিলো চাঁদ। মাথায় ডান হাতটা রেখে শুয়ে আছে সে। তখনই বছর চারেকের একটা ছেলে বল হাতে এগিয়ে এলো। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো চাঁদের দিকে। চাঁদ চোখ খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো। ছেলেটি খুশিতে গদগদ হয়ে চাঁদের কোলে বসতে যাবে এমন সময় তারই সমবয়সী একটা মেয়ে দৌঁড়ে এসে চাঁদের কোলে বসলো। ঘটনাটা এতো জলদি ঘটলো যে ছেলেটি হতভম্ব হয়ে বোনের কাজ দেখে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। চাঁদ উঠে দাঁড়িয়ে এক কোলে মেয়েকে নিয়ে আরেক কোলে ছেলেকে নিলো। অতঃপর ছেলের কপালে চুমু খেলো। মেয়েটিও মুখ বাড়িয়ে দিলো। যার অর্থ এই যে আহিররের কপালে চুমু খেলে মৃদুলার কপালেও খেতে হবে। চাঁদ হেসে মেয়ের কপালেও চুমু খেলো। মৃদুলা কোলে থেকেই ভাইয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। মুখে বললো,
-কাঁদে না।
আহির কান্না থামিয়ে আদো আদো বুলিতে বললো,
-পু পচা।

এরমানে হলো আপু পঁচা। মৃদুলা চোখ রাঙালো। আহির যেনো চুপসে গেলো। চাঁদ অবাক হচ্ছে মাত্র আধা ঘন্টা বড়ো ছোট মৃদুলা আহির। তবুও বড় বোনের প্রতি কতো ভয় তার। চাঁদের মনটা ভরে গেলো। ছেলে মেয়ে দুটি যেনো আবিরের কপি। কেবল চোখগুলো পেয়েছে তার।

!!৭৫!!

রত্না শরবত হাতে এসে দেখলো তার মেয়ে দুই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘুরছে।
-কিরে তোর না শরীর খারাপ? 
-সেরে গেছে মা।
-তুই আর মানুষ হলি না। নানুমনিরা আমার কোলে এসো। মা ক্লান্ত। 

বাচ্চা দুটো কি বুঝলো কে জানে সুন্দর করে নেমে গেলো। নিজেদের মতো খেলায় ব্যস্ত তারা। নানুমনির কোলে আর গেলোনা। চাঁদ সোফায় বসে শরবত টুকু শেষ করলো। আবার সোফায় মাথাটা এলিয়ে দিলো চাঁদ। অনলাইনে খাবারের বিজনেস, টিউশনি, রত্নার স্বামীর প্যানশন, নোয়াখালীর বাড়ি ভাড়া মিলিয়ে মাস শেষে বড়ো অংকের টাকা আসে চাঁদের হাতে। চাঁদ ভালো আছে। কারো জন্য থেমে নেই তার জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করছে। ছেলে মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য দুইটা ডিপিএস করেছে। চাঁদের এই শক্ত, সাবলম্বী হওয়াটা কি এতো সহজ ছিলো। উহুঁ, একদম না। চাঁদ হারিয়ে গেলো অতীতে। 

আবিরের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে চাঁদ যখন দিশেহারা তখন দেবদূতের মতোই চাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে রত্না। সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া মেয়েটা মা হওয়ার লড়াই লড়ছে যখন তখন ছায়ার মতো পাশে ছিলেন তিনি। গ্রামের মানুষের কথার তোয়াক্কা করেননি রত্না। চাঁদের ঘর আলো করে এলো জমজ দুই সন্তান। চাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিলো তাদের। নরম নরম হাত পা। ঠিক আবিরের চেহারা পেয়েছে বাচ্চা দুটি। সেই নাক, মুখ। শুধু চোখ দুটো তার। চাঁদের বিশ্বাস হচ্ছিলো না এই পুতুল দুটো তার। একান্তই তার। সকল কষ্ট ভুলে গেলো চাঁদ। খুশিতে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিলো তার। মনে জেগেছিল আবির যদি একবার দেখতো৷ পরক্ষণেই সে ভাবনা মন থেকে দূর করেছিলো চাঁদ। 

গ্রামে আসার পরই শুরু হলো মানুষের কটুক্তি। গ্রামের মানুষ জানতে চায় বাচ্চার বাবা কোথায়। চাঁদ উত্তর খুঁজে পায় না। ভর্তি হলো নোয়াখালী কলেজে। মানুষের কটুক্তি হজম করে, বাচ্চা সামলিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিলো সে। নানুমার দেওয়া গহনা গুলো বিক্রি করে দুইলাখ টাকা পেয়েছিলো চাঁদ। পঞ্চাশ হাজারের মতো খরচ হয়ে গিয়েছিলো তার চিকিৎসায়। এক লাখ ব্যাংকে রেখে বাকি টাকা দিয়ে খরচ চালিয়েছে সে। রত্না স্বামীর প্যানশনের টাকা, বাড়ির ভাড়ার টাকা খরচ করেছেন তার মেয়ে ও নাতি নাতনিদের পিছনে। এরাই যে তার সব। এই একলা জীবনে বাঁচার অবলম্বন পেয়ে তিনি খুশি। বেজায় খুশি। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ আসে চাঁদের। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। বাসায় বসে ছেলে মেয়ে সামলিয়ে প্রিপারেশন নেয় এডমিশনের। আর সে সফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী এখন চাঁদ। 

ঢাকা শাহবাগে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় চাঁদ। বছর দুয়েক হলো উঠেছে। ছেলে মেয়েকে রেখে ঢাকা থাকা জীবনেও সম্ভব না চাঁদের। একটা তার কলিজা আরেকটা হৃদপিণ্ড। দুটি অংশ ছাড়া সে বাঁচবে নাকি! ঢাকা এসে শুরু করে টিউশনি। সাথে জমানো টাকা দিয়ে নিজের অনলাইন বিজনেস। 

সব কিছু ছাপিয়ে চাঁদের মনে একজন থাকতো। হ্যাঁ, থাকতো। এখনো আছে তবে সে হাজারো রাত জেগে বালিশ ভেজানো কান্না, তীব্র অভিমানের নিচে চাপা পরে গিয়েছে। তার অস্তিত্ব চাপা পড়ে গিয়েছে। এখন চাঁদ সেই নরম মনের চাঁদ নেই। শক্ত হয়ে গিয়েছে৷ প্রিয় মানুষটা তার হাত ছেড়ে দিয়েছে। কতোশত ওয়াদা করেও বিপদের সময় সে ছেড়ে গিয়েছে। আজ চাঁদের আর তাকে প্রয়োজন নেই। কতদিন আগে শুনেছিলো লোকটি নাকি দেশে এসেছে। বেহায়া মনে একটা আশার আলো জ্বলে উঠেছিলো। সেই আলোটাও নিভে গেলো যখন শুনলো লোকটি নাকি বিয়ে করেছে। চাঁদ সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছে আর কোনোদিন কোনো বেহায়া ইচ্ছে সে পোষণ করবেনা। লোকটি ভালো থাকুক। সে তো ভালো আছে সন্তানদের নিয়ে। খালি মাঝেমধ্যে বুকটায় অদ্ভুত ব্যথা লাগে। এসব ভাবতে ভাবতে একফোঁটা জল গড়ানোর চেষ্টা করলো চোখ বেয়ে। তবে তা আগেই মুছে নিলো চাঁদ।
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন