!!৭৬!!
টিউশনি থেকে ফিরে আবার খাবার বানাতে রত্নাকে সাহায্য করতে ব্যস্ত চাঁদ। একটু পর রহিম আসলে খাবার দিতে হবে ডেলিভারি করার জন্য। ছেলেটার কান্না শুনে কাজ ফেলে শোবার ঘরে গেলো চাঁদ। আহির ফ্লোরে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করছে আর মৃদুলা তার চুল টানছে। চাঁদ দৌঁড়ে গিয়ে আহিরকে ছাড়ালো। মেয়েটার স্বভাব পুরো বাবার মতো আর ছেলেটা হয়েছে ঠিক তার মতো। আবির ছোটবেলা বেণী ধরে টানলে চাঁদও কেঁদে গা ভাসাতো।
মেয়েকে বকে বারান্দায় গিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো সে। ছেলেটা কোলে চুপচাপ শুয়ে আছে। মাথাটা চাঁদের কাঁধে হেলানো। সামনে ব্যস্ত রাস্তা। সন্ধ্যার পর রাস্তার ধারে প্রতিদিনকার মতো আজও কিছু বন্ধুর দল আড্ডা দিচ্ছে। চাঁদের বয়সী তারা কিংবা তার বড়। তখনই চাঁদের কানে বাজলো একটা গান। রাস্তায় মৃদু লাইটের আলোয় বন্ধু দলের একজন গিটারে সুর তুলেছে অপর জন গলায় সুর তুলেছে,
একটা ছিল সোনার কন্যা
মেঘ বরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছায়া
তাহার কথা বলি
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌঁড়াইয়া চলি
কন্যার ছিল দীঘল চুল
তাহার কেশে জবা ফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল
কন্যা ভুল করিস না
ও কন্যা ভুল করিস না
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না
হাত খালি গলা খালি
কন্যার নাকে নাকফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল
এখন নিজের কথা বলি
নিজের কথা বলতে বলতে
নাও দৌঁড়াইয়া চলি
সবুজ বরণ লাও ডগায়
দুধসাদা ফুল ধরে
ভুল করা কন্যার লাগি
মন আনচান করে
আমার মন আনচান করে
চাঁদ যেনো ফিরে গেলো অতীতে। নিষ্ঠুর লোকটা ও তো উত্তাল পদ্মায় নৌকায় বসে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে এই গানটি করেছিল। নিজের ভাবনায় বিরক্ত চাঁদ। ঘুরে ফিরে কেনো সেই লোকটার কথাই ভাবে সে। কেন? মেয়ের কান্নায় ঘরে দৌঁড়ে যায় সে। মেয়েটা বড় অভিমানী। কিছু বললেই গাল ফুলোবে পরে কেঁদে গা ভাসাবে। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে চাঁদ চুমো খেলো তার গালে। মেয়ে তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চাঁদ মিষ্টি হেসে গালে গাল ছুঁয়ালো। নরম কন্ঠে বললো,
-আমার সোনাটা কে? আমার হৃদপিণ্ডটা কে?
বিছানায় বসা আহির বললো,
-আমি।
মৃদুলা চোখ রাঙালে বেচারা চুপসে গেলো। চাঁদ যেনো অতীতে ফিরে গেলো। আবিরও তাকে এভাবে চোখ রাঙাতো আর চাঁদ ভয়ে চুপসে যেতো। আবার লোকটার কথা ভেবে নিজের উপর রাগ জন্মালো চাঁদের। তবে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-তুমি আমার কলিজা আহির সোনা। আমার হৃদপিণ্ড হলো মৃদুলা।
ব্যস, সব রাগ গলে পানি। মায়ের গালে চুমো খেলো ছোট মৃদুলা। চাঁদ ভাবলো এই যে সে তো সুখে আছে আর কি চাই তার। বাবার ছবি দেখিয়ে ছেলে মেয়েকে ঘুম পাড়ালো চাঁদ। আজ হয়তো ছেলে মেয়ে বুঝে না তবে ভবিষ্যতে তাদের কি জবাব দিবে তাই নিয়ে চিন্তিত চাঁদ। মেয়েটা একেবারে বাবা পাগল। আবিরের ছবিতে দিনে রাতে কতো চুমো যে দেয় পাগলী মেয়েটা। চাঁদ দেখে অবাক হয়। কখনো না দেখেও বাবার প্রতি এতো টান!
!!৭৭!!
কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ। চাঁদ ইচ্ছে করে আবিরের ক্লাস করেনি। এক প্রকার আবির থেকে নিজেকে লুকিয়েছে সে।
_______________
সকালবেলা উদাসমনে দোয়েল চত্বরে বসে আছে আবির। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে। সবুজের মাঝে লাল রঙের আগুনের ন্যায় ফুটে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো। মন্টুদার চায়ের দোকানে দু একজন লোক দেখা যাচ্ছে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে চা পান করছেন তারা। বকুলগাছ গুলো নিজেদের মধ্যে আলাপে ব্যস্ত।এই যে সকালবেলা রাস্তা দিয়ে এতো এতো মানুষ হাঁটা চলা করছে এতে যেনো বকুল গাছগুলোর কোনো মাথা ব্যথাই নেই। তারা এসব দেখে অভ্যস্ত। আবারও কৃষ্ণচূড়া গাছটায় মনোযোগ দিলো সে।সেই হরিণী চোখের মেয়েটিকে সে খুঁজে পায়নি। এসব ভবতে ভাবতেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার মগডালে একটা শালিক পাখি খেয়াল করলো আবির। পাখিটাকে ভিষণ দুঃখী মনে হলো আবিরের। তবে তার থেকে বেশি কি? চোখ বুজে নিজের জীবনের পাঁচ বছরের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
চাঁদের সাথে রাগ করে নিজ দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলো সে। ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই। তবে আবির যে এই প্রথা মানতে পারেনি। ইংল্যান্ডে তার রুম, তার বিছানা, তার বালিশ, ইংল্যান্ডের আকাশ, আকাশের মেঘ, রাতের তারা, ডানা মেলে বেড়ানো পাখির দল সবাই স্বাক্ষী হয়েছিলো আবিরের কান্নার। কি করুণ সে কান্না! কি নিদারুণ সে যন্ত্রণা!
আবির সিদ্ধান্ত নেয় আর কোনোদিন দেশে ফিরবেনা। কোনোদিন না। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো সে পাখি তো খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে। তবে বিপত্তি ঘটলো মাস দশেক আগে। আবির নিজের পড়াশোনা শেষ করে চাকুরিতে যোগ দিয়েছে মাত্র। একদিন মা ফোন দিয়ে বললেন তার বাবার অবস্থা খারাপ সে যেনো দেশে ফিরে আসে। মায়ের করুণ আবদার আর বাবার স্বাস্থ্যের কথা শুনে সব কিছু ছেড়ে দেশে ফিরে আবির। তবে বাড়িতে ফিরে জানতে পারে মা তাকে মিথ্যে বলে দেশে এনেছেন। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। আবির হতবিহবল হয়ে পড়লো। যতোই রাগ কিংবা অভিমান থাকুক চাঁদকে সে ভালোবাসে। তার পক্ষে আর কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মা অনেক জোড় করলেন। বাবা শাসন করলেন। তবে কিছুই হলোনা। অতঃপর না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দিতে লাগলেন মোহনা। আবির নিতিকে না করলেও নিতি সে না শুনলোনা। মোহনা তাকে আগেই কসম দিয়ে রেখেছে সে যেনো আবিরের কথা না শুনে। হলুদের অনুষ্ঠান হলো। মোহনা না খেয়েই অনুষ্ঠান করলেন। তার ধারণা ছিলো আবির কাল বিয়ে করবেই। ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে মায়ের ঘরে যাওয়ার সময় এক নিদারুণ সত্যের মুখোমুখি হলো আবির। মোহনা আর তিলোত্তমার কথোপকথনে তার হাত থেকে ভাতের প্লেট পড়ে গেলো। কি শুনছে সে এসব! চাঁদ তার বাচ্চার মা হয়েছিল! চাঁদের পেটে আবিরের সন্তান! কেবল মাত্র চাঁদ যেনো কখনো এসে নিজের অধিকার দাবী না করতে পারে তাই এই নোংরা খেলা খেললো তার মা। ভরা বাড়ির সকলের সামনে সব কিছু তছনছ করে দিলো আবির। গ্লাস, প্লেট সব ভেঙে পড়ে রইলো মাটিতে। আবিরের চিৎকার আর কান্নায় উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কেবল একটা কথাই প্রতিধ্বনি তুলছিলো,
"চাঁদ আমার স্ত্রী। কেন এমন করলেন মা? কেন?"
মতিন নিজের আত্মসম্মানে ভরা ছেলের এই রূপে স্তব্ধ। সাথে নিজের স্ত্রীর কাজে অনুতপ্ত। কাজলের মতো একটা খুনীর সাথে বিয়ে দেওয়ার কথা কি করে ভেবেছিলো তার স্ত্রী। কাজল যে আনোয়ারাকে মেরেছে তা কেউ দেখেনি তবে আল্লাহ দেখেছিলেন। আর বিচারও করেছেন ছয়মাসের মাথায় পদ্মায় ডুবে মারা যায় সে।
আবির পরদিনই বাড়ি ছাড়ে। পরিবার, মা-বাবা সব সম্পর্ক ভুলে বিগত মাসগুলোতে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে চাঁদকে। আগে বুকে একরকম জ্বালা হতো আর এখন হয় আরেকরকম। আগেরটা সহ্য করতে পারলেও এখনকার জ্বালা সহ্য করতে পারেনা আবির।
এ জ্বালা যে তীব্র অপরাধবোধের। এ জ্বালা যে কথা দিয়েও কথা না রাখার। এ জ্বালা বিশ্বাস ভাঙার, ভালোবাসার মানুষটির পাশে না থাকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে পড়ানোর সুযোগ পেয়েও আবির খুশি না। নিজের স্বপ্ন পূরণের কোনো খুশি তার মধ্যে নেই। আবিরের মনে হয় নিজের ক্যারিয়ার সাজাতে গিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বনটা সে হারিয়ে ফেলেছে। সে যদি বিদেশে না যেতো তাহলে এতো কিছু ঘটতো না।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো আবির। সেই হরিণী চোখের মেয়েটা কি তার চাঁদ? কোথায় তার চাঁদ। বিক্ষিপ্ত মন প্রশ্ন ছুঁড়ে,
-তুই কই চাঁদ। আমি যে হাঁপিয়ে গিয়েছি। আমি তো এবার বাঁচবো না আর। ক্ষমা করে দে আমায়।
কেউ উত্তর দেয় না।
!!৭৮!!
-পা পা। পাপা।
আবিরের সামনে বছর চারেকের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। গোলাপী রঙের ফতোয়া আর সাদা হাফপ্যান্ট গায়ে। হাতে একটা খেলনা বন্ধুক। অবিকল আবিরের মতো দেখতে। আবির একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। চোখ দুটো তার হরিণীর মতো। সে কি বলবে ভেবে পেলো না। আশেপাশে তাকালো। ছেলেটি আবার ঠোঁট ফুলিয়ে আদো আদো বুলিতে বললো,
-পাপা আইকিম।
তার ছোট হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে কিছুদূরে দাঁড়ানো আইসক্রিমওয়ালাকে দেখালো।
তখন আরেকটি মেয়ে এগিয়ে এলো।মেয়েটিও অবিকল তার মতো দেখতে। আবির হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। মেয়েটিও ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। খুশিতে গদগদ হয়ে মেয়েটি বললো,
-পা পা। পাপা।
আবির এবার অবাকের পাশাপাশি বিস্মিত। সে কি জেগে স্বপ্ন দেখছে? এগুলো কি তার কাল রাতে না ঘুমানোর ফল?
ছেলেটি আবার বললো,
-পাপা আইকিম।
আবির তখনও বিস্মিত। রাস্তার উপাশে আইসক্রিম পার্লার। সে বাচ্চা দুটিকে রেখেই আইসক্রিম আনতে গেলো। আস্তে আস্তে তার অবচেতন মস্তিষ্ক খুলে গেলো। চিৎকার করে বললো,
-আবির ভেবে দেখ বাচ্চা দুটো তোকে পাপা বলছে। চাঁদ প্রেগন্যান্ট ছিলো। ক্লাসে সেই হরিণী। দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে না?
রত্না সকালে নাতি নাতনিকে নিয়ে মর্নিং ওয়াকে এসেছিলেন। আলীর মায়ের সাথে কথা বলছিলেন। আর পাশেই খেলা করছিলো মৃদুলা আহির। পরে কথা শেষ করে মৃদুলা আহিরকে নিয়ে বাসায় রওনা দেন তিনি।
এদিকে আবির আইসক্রিম নিয়ে এসে বাচ্চা দুটোকে না দেখে মাটিতে বসে পড়লো। পেয়েও কি হারিয়ে ফেললো আবার?
.
.
.
চলবে.........................