স্যালাইনের নল ও যন্ত্রপাতির কক্ষ থেকে নরমাল বেডে আনা হয়েছে পূর্ণতাকে। শরীরের মধ্যে দূর্বলতার রেশ এখনো কায়েম রয়েছে। খোদেজা কিছু ঔষুধ খাইয়ে পূর্ণতাকে রেস্ট নিতে বলেছে। কিন্তু পূর্বের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি একদমই। খোদেজা যেখানে কাউকে থাকতে নিষেধ করেছিলো, সেখানে অটল হয়ে বেডের পাশে পূর্ব বসে রইলো। এদিকে সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা পৃথিবীর তাপমাত্রার সাথে বজার রাখার জন্য খোদেজা পূর্বের কোল থেকে নাতীকে নিয়ে টেম্পেরেচার কক্ষে চলে যায়। পরপর সবাই যখন পূর্ণতার সাথে দেখা করে রুমের বাইরে চলে গেলো তখন পূর্ণতার বুকটা ধড়ফড়-ধড়ফড় করতে লাগলো। পূর্ব এখন পাশে, কিছুটা দূরত্বে, খুবই নিকটে। কিন্তু পূর্ণতার দীর্ঘদিনের ধৈর্য্য এখন চরম অভিমানে পরিণত হয়েছে। পূর্বের দিকে তাকাতে যেয়ে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায় ওর। ওমনেই পূর্ণতা দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেললো। পূর্বকে এইভাবে সামনে পেয়ে মনের অন্দরে প্রচুর তোলপাড় চলছিলো। নিজেকে শান্ত করার জন্য পরপর কয়েকবার ঢোক গিললো পূর্ণতা। মনেমনে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো, সে কিভাবে এই গুমোট পরিস্থিতিটা সামাল দিবে? পূর্ব যদি এভাবেই চুপচাপ বসে থাকে তাহলে পূর্ণতার অভিমান দুই মিনিটের মধ্যে ধূলো করে দিবে। চোখ বন্ধ করলেও পূর্ণতা স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিলো পূর্ব ওর দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সেই ধারালো দৃষ্টি, সেই শান্ত গভীর চাহনি, সেই সম্মোহন করার মতো বশীভূত ক্ষমতা নিয়ে পূর্ব যেনো পূর্ণতার সমস্ত মুখ ঘিরে রেখেছে।। এসব ভাবতেই পূর্ণতার বুকের ধড়ফড়ানি থামার বদলে আরো তীব্র উৎকন্ঠায় বেড়ে উঠছে। বেডে বসা পূর্ব কানের দুইপাশ থেকে রাবার টেনে মাস্কটা খুলে ফেললো। পান্ঞ্জাবীর পকেটে মাস্কটা ঢুকিয়ে সে পূর্ণতার দিকে ধীরগতিতে একধাপ এগুলো। পূর্ণতা তখনো চোখ বন্ধ করে ছিলো, হৃৎযন্ত্রের বেগতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য লম্বা-লম্বা শ্বাস টানছিলো। পূর্ব ধীরে-ধীরে পূর্ণতার মুখের কাছে গিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো।
পূর্বের দুইহাত পূর্ণতার কানের দুইপাশে সাদা বালিশের উপর রাখা। পূর্ণতার ক্লান্তিপূর্ণ মলিন চেহারার দিকে পূর্ব নিবিষ্টে তাকিয়ে থাকলে আচমকা পূর্ণতা চোখ খুলে ফেলে। যতোটা শান্ত হয়ে ও চোখ খুলেছিলো তার চেয়ে অধিক মাত্রায় অপ্রস্তুত হয়ে গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো পূর্ণতা। চোখ বড় বড় করে থরথর করে নরম ওষ্ঠজোড়া কাঁপাতে থাকলে পূর্ব পূর্ণদৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলাতেই পূর্ণতার বুকটা ধ্বক করে মোচড়ে এলো আবার। পুরোনো ব্যথায় আচড় লেগে পূর্ণতার চোখ অশ্রুতে ছলছল করে উঠলো। জোরে জোরে শ্বাসকার্য চালাতেই অকস্মাৎ বর্ষণের মতো চোখ খিচ মেরে নিচের ঠোঁট কামড়ে কেদেঁ দিলো পূর্ণতা। দেহের ব্যথায় কাতর হয়ে মানুষ আচমকা যেভাবে অঝোরে কেদেঁ উঠে, মনের ব্যথায় জর্জরিত হয়ে পূর্ণতার ছোট্ট বুকটা টুকরো-টুকরো হয়ে ছিড়ে যাচ্ছিলো যেনো। গর্ভাবস্থায় একবারের জন্যও দেখতে আসলো না পূর্ব। একটাবারও হাত ধরে চুমু খেয়ে বললো না, 'আমি আছিতো।' দিনগুলো সহ্য করা গেলেও রাতগুলো প্রচণ্ড দুঃসহ ছিলো। চারপাশ নিরব হয়ে গেলে মনের যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে শেষ করতো। পূর্ণতা ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলে পূর্ব ডানহাতে পূর্ণতার মাথাটা বালিশ থেকে খানিকটা উঁচুতে তুললো। কপালে পরম আবেশে ওষ্ঠযুগল ছুঁয়িয়ে দিয়ে পূর্ণতার কান্নারত মুখের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে কম্পমান ওষ্ঠের দিকে এগুতেই পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ পূর্বের ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে বসলো। কান্নাসুরে তেজ দেখিয়ে সে বললো,
- এখন এই দরদ কিসের? কেনো আমার প্রতি ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে? কে আমি? আমি তোমার কেউ? আধঘন্টা আগে যদি দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতাম বেশ শান্তি পেতে না? তুমি আর কক্ষনো আমার সামনে আসবেনা ওয়াসিফ পূর্ব! কোনোদিনও আমার সামনে আসবেনা। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আমি একটা পাষাণতুল্য মানুষের জন্য নিজের জীবনটা অন্ধকার করেছি। এইটুকু বুঝ আমার মধ্যে হয়নি যে, তুমিতো কোনোদিনও আমাকে প্রথম পর্যায়ে রাখোনা। রাস্তার ছ্যাঁচড়া কুকুরের মতোই আমাকে দেখো। একটা ভিখারির উপর মানুষও দয়া করে, আমার উপরে একটুখানি দয়া দেখিয়েছো? একবারের জন্য ভেবেছো জেল থেকে বের হয়ে সোজা বাড়ি যাই? আজ জ্যামের মধ্যে গাড়িটা যখন আটকালো তখন বারেবারে মনে হচ্ছিলো আমি হয়তো তোমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারবো না। ওই দমবন্ধকর পরিবেশে আমি মারা যাবো। আর জীবনেও তোমাকে দেখতে পাবোনা। আমার প্রচুর শ্বাস টান হচ্ছিলো ওয়াসিফ পূর্ব। ব্যথায় শরীরের হাড্ডি পযর্ন্ত চিনচিন করছিলো। যখন মনেহয় আমি একটা পাষাণের জন্য দিনরাত কেঁদেছি, শরীরের সব যন্ত্রণা মুখে তালা লাগিয়ে সহ্য করেছি, সেই পাষাণতুল্য মানুষ আমার সামনে এসে আজ দরদ দেখাচ্ছে, ভালোবাসা বোঝাচ্ছে, আদরে চুমু খাচ্ছে। আমি চিৎকার করেই কেদেঁছি পূর্ব, তোমার প্রতিটা যন্ত্রণা দেখে আমি কেদেঁ ফেলেছি। কিন্তু আমার যন্ত্রণা দেখে তোমার একটুও মায়া হয়নি। আমাকে চার-চারটা মাস তুমি কষ্ট দিয়েছো। আজ আমি কেনো বেঁচে রইলাম নিজেও জানিনা। সত্যিই জানিনা, জানা নেই...
শক্ত হয়ে গেলো পূর্বের মুখ। চোখের দৃষ্টিও কঠোর হয়ে উঠলো ওর। পূর্ণতার কাছ থেকে ধীরে-ধীরে মাথা তুলে বেড থেকে উঠে দাড়ালো। পূর্ণতা দুহাতের তালুতে মুখ ঢেকে তুমুল অশ্রুধারায় কাঁদছিলো। পূর্ব সেদিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পেছনের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিলো। দরজার কাছে যখন পিঠ ঠেকে গেলো তখন পূর্ব নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। ঠিক ওইসময় আয়মানের মুখোমুখি হয়ে যায় পূর্ব। অপ্রস্তুত হয়ে আয়মানের সামনে যখন দাড়িয়ে পরলো তখন আয়মান কৌতুহল পানে কেবিনের বদ্ধ দরজায় তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ পূর্বের দিকে দৃষ্টি ফেললো। পূর্বের হাবভাবে কোনো বিরূপ অবস্থা বোঝা না গেলেও আয়মানের মনে সুক্ষ কৌতুহল কাজ করছিলো।সে উদ্বেগপূর্ণ গলায় কিছুটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,
- পূর্ব ভাই, কিছু হইছে?
পূর্ব খুব সাবধানে গলা ভিজালো যেনো। তারপর খুব শান্ত সুরে বললো,
- না, কিছু হয়নি।
আয়মানের মন শান্তি পেলো না উত্তর শুনে। কিন্তু পূর্বকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না সে। পূর্ব হনহন করে করিডোর পেরিয়ে টেম্পেরেচার কক্ষে চলে গেলো। উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে আয়মান পূর্বের যাওয়া দেখে উশখুশ মনে শেষে চিন্তা করলো পূর্ণতার কেবিনে গেলেই হয়তো কাহিনির জট খুলবে। আয়মান সাথেসাথে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই হকচকিয়ে থমকে যায়। পূর্ণতা হাউমাউ করে মুখ ঢেকে কাঁদছে। তাড়াতাড়ি আয়মান দরজা চাপিয়ে পূর্ণতার কাছে দৌড়ে আসে। বেডের কাছে স্টিলের টুলটা টেনে বসতে-বসতেই প্রচণ্ড উত্তেজনায় আয়মান প্রশ্ন ছুঁড়ে,
- দোস্ত কি হইছে?কাঁদোস ক্যান? ভাই তোরে কিছু বলছে? ছেড়ি তুই এমনে কাঁদলে কি চলবো? আমারে বলবিনা? পূর্ণতা বল, কি হইছে? কাঁদিস না, চুপ কর।
আয়মানের জোড়াজুড়িতে অনেকক্ষন পর পূর্ণতা একটু শান্ত হলো। দুচোখ হাতের তালুতে মুছে আয়মানের দিকে দৃষ্টি দিলো। আয়মান টুলে বসে ওর দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা শুকনো গলা ভিজাতে গিয়ে একটু অপ্রসন্ন বোধ করলো। হাতের ইশারায় পানির বোতল দেখিয়ে দিলে আয়মান দ্রুত গ্লাসে পানি ঢেলে ওকে খাইয়ে দিলো। গ্লাসটা আগের জায়গায় রাখতেই আয়মান বলে উঠলো,
- এখন বল কি হইছে? ক্যান এইভাবে কাঁদতাছিলি? ভাই তোরে কিছু বলছে? আমার মনেতো হয়না,ভাই তোরে ওমন কিছু বলবো। ঠিক কইরা বলতো, কি হইছে?
পূর্ণতা আবার ভেজা চোখ মুছে নিলো। গলা একটু ঠিক করে হালকা কেশে ঠান্ডা গলায় বললো,
- কিছুই হয়নি।
আয়মান দারুণ রাগ দেখিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। চেঁচিয়ে বললো,
- আবার মিথ্যা বলোস কোন্ সাহসে? চটকানা না খাইয়া সোজাসাপ্টা বল তোর কি হইছে ভাইয়ের লগে? তুই ভাইরে কি বলছোস? আমি জানি তুই পাকনামি কইরা ভাইরে আজাইরা বকছোস, আর বইকা নিজেই দুনিয়া ভাসায়া কাঁদতাছোস। ঢপ না মারায়া তাড়াতাড়ি ক, কি বলছোস ভাইরে।
পূর্ণতা কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলো।সিলিংয়ের দিকে নিরবে তাকিয়ে থাকতেই অশ্রুপূর্ণ চোখে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,
- আমার সামনে থেকে ওই লোককে চলে যেতে বলেছি। আমি ওই লোকের মুখ দেখতে চাইনা।
পূর্ণতার ওইটুকু কথা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যায় আয়মান। ঝট করে টুল থেকে আকস্মিক দাড়িয়ে যায় সে। চোয়াল ঝুলিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে থাকলে ওই মূহুর্তেই আয়মান বিষ্ময়সূচকে বলে উঠে,
- তুই সত্যিই এইগুলা বলছোস ?
পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে ফেললো। বন্ধ করতেই অশ্রুগুলো দুকোল বেয়ে বালিশে গড়িয়ে পরলো। আয়মান হতবুদ্ধির মতো কতক্ষণ নির্বাক ছিলো জানা নেই, যখন সৎবিৎ ফিরে পেলো তখন পূর্ণতার উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বললো,
- তুই থাবড়া খাইলে সোজা হবি? তুই এগুলা কি করলি পূর্ণতা? কেন তোর ঘিলুর মধ্যে এইটা ঢুকেনা এই 'ওয়াসিফ পূর্ব' নামের পোলা তোরে ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝেনা! বারবার তুই একই তামশা ক্যান করোস? তুই কি জানোস ভাই এতোদিন কি করতে গেছিলো? ভাই এতোদিন...
তীব্র গলায় ঝরঝর করে শব্দ বর্ষন করতেই হঠাৎ থমকে গেলো আয়মান। মুখ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত কথাগুলো বেরিয়ে যেতেই নিজেকে অন্তিম মূহুর্তে সামলে নিলো। কিন্তু পার পাওয়া গেলো অবশ্য। পূর্ণতা শেষোক্ত কথা শুনে ওমনেই চকিতে দৃষ্টি ছুড়ে জোর গলায় প্রশ্ন তুললো। আয়মান কোনো উত্তর না পেয়ে দৃষ্টিনত করলো সাথে-সাথে । পূর্ণতার মধ্যে অন্যরকম চিন্তা তখন জেঁকে ধরেছিলো। তীব্র উৎকন্ঠা এবং মাতাল অবস্থা এই দুই পরিস্থিতিতে মানুষ না চাইতেই সত্য উগলে দেয়, আয়মানের ক্ষেত্রেও এখন তাই। পূর্ণতা বিষ্মিত দৃষ্টিতে উত্তরের জন্য অনবরত প্রশ্ন করলে আয়মান তাড়াতাড়ি সেগুলো না বুঝিয়ে প্রস্থান করে। অনেকটা চোরের মতো গা ঢাকা দিয়ে নিজেকে আড়াল করলো আয়মান। পূর্ণতার জিদ আরো প্রখর হয়ে উঠলো তখন। পূর্বের নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে আয়মান যেখানে সবই জানে, সেখানে পূর্ণতাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করেনি পূর্ব। তারমানে এখনো বিশ্বাসের ডোরটা দৃঢ় হয়নি পূর্ণতার জন্য। পূর্ণতা বুকভর্তি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। মনের গোচরে বহু প্রশ্নের আনাগোনা হলেও জিদের প্রভাবটা বেশি ছিলো। আয়মান সবটা জেনেও কেনো ওকে জানালো না? কি কারন? কি জন্য? কি উদ্দেশ্য?
.
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পূর্ণতা গাড়ির কাছে আসলো। এ কদিন খোদেজার পর্যবেক্ষণ ও নার্সদের যত্ন পেয়ে পূর্ণতা দূর্বলতা কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলো। নরমাল ডেলিভারির কেস হওয়ার জন্য হাসপাতাল ওকে পন্ঞ্চম দিনে ছেড়ে দিলো।
কবির, আয়মান ও পূর্বের গাড়ি পরপর সিরিয়ালে সাজানো ছিলো। খোদেজা পূর্ণতাকে পূর্বের গাড়িতে বসতে বলে কবিরের গাড়িতে উঠে বসলো। পূর্ব আজ ভিন্নবেশে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে এসেছে। দুহাত ভাঁজ করে গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে গম্ভীরতার ছাপ আজও বেশ স্পষ্ট। আজও শার্টের স্লিভ যথারীতি নামানো। আয়মান অফিসের ফরমাল পোশাকে থাকা সত্ত্বেও পূর্ণতার জন্য অপেক্ষা করছে। আয়েশা আজ আসেনি হাসপাতালে, তিনি পলাশের সাথে আছেন ওয়াসিফ ভিলায়। সাবিহা আয়মানের তুখোড় ধমক খেয়ে শিকদার বাড়িতে রয়ে গেছে। আসেনি পূর্ণতাকে দেখতে। পূর্ণতা ছেলেকে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতেই কবির প্রশ্ন করলো,
- আমার মেয়ে দাড়িয়ে আছে কেনো? পূর্বের গাড়িতে উঠবেনা?
পূর্ণতা বাবার দিকে সরল দৃষ্টিতে তাকালো। মৃদ্যু হেসে জবাব দিলো,
- বাবা, আমি তোমার গাড়িতে উঠি?
কবির আহাম্মক হয়ে গেলেন মেয়ের কথায়। পূর্বের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে তিনি দেখলেন, পূর্ব পকেট থেকে গাড়ির রিমোট বের করছে। ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে সে ইতিমধ্যে বসে পরেছে। পূর্ণতাও কথা শেষ করতেই কবিরের গাড়িতে উঠে বসেছে। দুইজন দুই গাড়িতে কিভাবে উঠলো এটাই তিনি ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না। সম্পর্কের মধ্যে কোনো ফাটল ধরলো কিনা, তিনি কিছুই মিলাতে পারছিলেন না। অন্যমনষ্ক হয়ে এসব ভাবতে লাগলে পূর্ণতা যাত্রার জন্য তাগাদা দিলো। কবির চুপচাপ গাড়িতে উঠে স্থির অবস্থা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তিনি ব্যাকসাইডের লুকিং মিররে দেখলেন, পূর্ব পেছন থেকে নিজের গাড়িটার গতি স্লো করে অন্য রাস্তায় ঢুকে গেলো। এদিকে গাড়ির মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, পূর্ণতার মুখও বিষণ্ণতায় লেপ্টে আছে। খুশির আমেজ নেই মুখটার মধ্যে।
.
ওয়াসিফ ভিলায় বহুদিন পর রমরমা অবস্থা ধারণ করলো। হাসি-ঠাট্টায় বাড়ির আনাচে-কানাচে স্বহাস্যে কলোরব উঠলো।পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো শূন্য বাড়ির কোণাগুলো। দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসলো। আয়েশা নিজ হাতে সবার জন্য খাবার পরিবেশন করলো । খোদেজা, কবিরের পাশাপাশি আয়মানের পরিবার হিসেবে আফিয়া, আনোয়ার ও সাবিহাও আসলো। দুপুর বারোটায় শাহজালাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট অবতরণের মাধ্যমে পূর্বিকাও এ আয়োজনে জমায়েত হলো। আসার কথা ছিলো সেই কবে, কিন্তু বিদেশের মাটিতে মাইগ্রেশনজনিত সমস্যার জেরে দ্রুত ফিরতে পারেনি পূর্বিকা। আদরের ভাইকে দুর্দশাগ্রস্ত দেখেও না ফেরার দুঃখে চোখের পানি ফেলেছে সেই অপরিচিত দেশে। আজীবন বড়বোন হিসেবে আগলে রাখার পরও এই প্রথম পারলোনা পূর্বের পাশে থাকতে। ভাতিজাকে কোলে তুলে খুশির আনন্দে কেদেঁ দেয় পূর্বিকা। এ যেনো আরেক পূর্ব, আরেক রাগীর আগমন।
দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে অতিথি কক্ষে একত্র হলো। সেখানে রেস্টের উছিলায় আড্ডার গুজব ঘন্টার-পর-ঘন্টা চলতে থাকলো। পূর্ণতা রুমে ফিরে গোসল সেরে দেখলো পূর্বের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকছে। সকালের সেই ঘটনার পর এতোক্ষনে সে বাড়িতে ফিরছে। পূর্ণতা সুস্থ হয়ে উঠলে আগের বেশভূষায় ফিরে আসে। ম্যাক্সি পড়া বাদ দিয়ে এখন শাড়ি পরে। আজ বাড়িতে বহু মানুষের ঢল দেখে বাসন্তী রঙের জামদানী শাড়ি পরে পূর্ণতা। বিকেলের জন্য হালকা নাস্তার তাগিদে সে রান্নাঘরে গিয়ে নূরানীকে নিয়ে নাস্তা বানিয়ে ফেলে। এদিকে ময়নাকে দিয়ে পূর্বের জন্য দুপুরের যে খাবার পাঠিয়েছিলো সেগুলো ফেরত এসেছে। পূর্ণতা কপাল কুঁচকে ময়নাকে প্রশ্ন করে,
- তোর ভাই খায়নি কেন?
ময়না প্লেটের উপর ঢাকনা দিয়ে বললো,
- ভাইয়ের বলে শরীল বেদনা করতাছে। খাইতো না।
শরীর ব্যথার কথা শুনে পূর্ণতা একটু চিন্তিত হয়ে উঠলো। সে আড় ভেঙে জিজ্ঞেস করলো,
- তোর ভাই কি করছে রুমে? বিছানায় শুয়ে আছে? নাকি ছেলে নিয়ে খেলছে?
ময়না ফ্রিজ থেকে ফল-ফলাদি বের করে অকপটে বললো,
- ভাইয়ে ধুমায়া সিগারেট টানতাছে ভাবী। ধুয়ার লিগা রুমে ঢুকা যায়না। বাবু ঘরে নাই। বড় আপার কাছে খেলতাছে।
সিগারেটের কথা শুনতেই তালগোল পাকিয়ে ফেললো পূর্ণতা। হাতের ছুড়ি ফেলে সে নূরানীকে কাজ বুঝিয়ে ওমনেই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। রুমের কাছে এসে যেই নব্ ঘুরাবে ওমনেই নিজেকে দমিয়ে ফেললো। পূর্ব যদি সিগারেট খায় তাতে ওর কি? ওর তো কিছু হওয়ার কথা নয়। যেই ব্যক্তি বেহায়ার মতো আচরণ শুরু করেছে তার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করাও পাপ! পূর্ণতা পা ঘুরিয়ে আবার চলে আসলো। রাগী মুখে প্রতিটা কাজ করতে লাগলো। ময়না ওর দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলেও নূরানী আড়চোখে প্রায় সবই বুঝলো। পূর্ণতার অবস্থা দেখে ও কিছু বলার সাহস পেলো না। আজ যে দুজনের মধ্যে কেমন সংঘর্ষ হবে কেউ জানেনা।
.
আয়েশার তোষামোদের জন্য খোদেজা সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুদিন তিনি মেয়ের সঙ্গে থাকবেন এবং নাতীর প্রতি খেয়াল রাখবেন। আয়েশা যথেষ্ট যত্নবান হলেও পলাশের দিকে খেয়াল রাখা আবশ্যক। পূর্বিকা আসার পর একবার-কি-দুইবার পূর্ণতার সাথে কথা বলেছে। কথার মধ্যে এটুকু বুঝে গেছে পূর্বের সাথে কোনোকিছুই ঠিক নয়। এদিকে পূর্ব রুমের দরজা আটকে রেখেছে বিকেলের পর থেকে। নূরানীকে বলে খবর পাঠিয়েছে, সে বেঘোরে ঘুমাবে ওই সময় কেউ যেনো ডিষ্টার্ব না করে। পূর্বিকা চালাকি করে ভাতিজাকে কোলে নিয়ে আবদার করলো, ভাতিজা তার ফুপির সাথে আজ রাতটুকু ঘুমাবে। যদি সে ভাতিজা মহাশয়কে না সামলাতে পারে তাহলে পূর্ণতার কাছে এসে দিয়ে যাবে। পূর্ণতা সেসব কথা যথাযথ মেনে ঠিক দশটার দিকে রুমের কাছে আসলো। নব্ মোচড়ে দেখলো সেটা লক।চরম বিরক্তিতে পূর্ণতা দরজায় পরপর নক করলো। রুমের ভেতর থেকে ক্রুদ্ধ গলায় বললো,
- কে বাইরে? আমি না করার পরও কেনো আসা হয়েছে?
পূর্ণতাও সেই সুরে তাল মিলিয়ে তেজ দেখিয়ে বললো,
- এটা আমারও রুম। যদি এখান থেকে বের করে দিতে চাও তাহলে আমার কাপড়-চোপড় নিতে দাও। আমি চলে যাবো।
কথাটুকু বলে ঠিক ' দুইমিনিট ' অপেক্ষার জন্য দাড়ালো পূর্ণতা। তবে সময় ততো অতিক্রম হলো না। ঠিক এক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলার শব্দ হলো। পূর্ণতা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই নাকে ভক করে বিষাক্ত ধোঁয়ার গন্ধ গেলো। ওমনেই পূর্ণতা আচঁলে মুখ চেপে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করলো। অন্ধকারে সবকিছু আরো ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছিলো। পূর্ণতা তাড়াতাড়ি রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখলো পূর্ব জলন্ত সিগারেট হাতে সোফায় বসে আছে। মাথাটা ফ্লোরের দিকে নিচু করে ঝুঁকিয়ে রেখেছে। নিকোটিনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে পূর্ণতার। সে দ্রুত দখিন দিকের জানালাটা খুলে বাকি দুটো জানালাও খুলে দিলো। এসি বন্ধ করে ফ্যান ছেড়ে দিতেই পূর্বের সামনে গিয়ে মৃদ্যু ভঙ্গিতে কাশতে-কাশতে পূর্ণতা রাগান্বিত স্বরে বললো,
- লজ্জা করেনা বাড়ির মধ্যে এইভাবে সিগারেট টানতে? আম্মা এসে দেখলে কি ভাববে এটুকু জ্ঞান নেই?
টনক নড়লোনা পূর্বের। যেভাবে বসেছিলো, সেভাবেই স্থির হয়ে বসে রইলো। বাঁ হাতের সিগারেটটা জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে ফ্লোরে পরছিলো। কোনো হেলদোল নেই ওর। পূর্বের ভাবগতি দেখে পূর্ণতা ক্ষুদ্ধ হয়ে হাত ঝাড়া মেরে সিগারেটটা নিচে ফেলে দিলো। সেটা ফ্লোর থেকে তুলে জানালা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করলো। পুনরায় পূর্বের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুগাল দুহাতে ধরে ওর মুখ তুলে বললো,
- আমি কি বলেছি শুনতে পাওনি? তুমি এইভাবে সিগারেট খাচ্ছো কেন? নিজের ছেলের কথা বাদই দিলাম! বাড়িতে যে তোমার অসুস্থ বাবা পরে আছে সেই খেয়াল নেই?
পূর্ব শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। যেই দৃষ্টিতে কষ্ট-বিষণ্ণ-কাতরতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলো। পূর্বকে কয়েক চোট বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে গিয়ে থমকে গেলো পূর্ণতা। শুকনো মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে কপালের ডানকোণায় নজর পরলো ওর। সেখানে সাদা ব্যান্ডেজ এখনো লাগানো। কিছু এলোমেলো চুলের কারনে ব্যান্ডেজটা একটু ঢাকা ছিলো। পূর্ণতা বৃদ্ধাঙ্গুলে চুল সরিয়ে দেখলো জায়গাটার ক্ষত কিছুটা শুকিয়ে এসেছে। হুট করে জেলের অত্যাচারগুলো মনে পরলো ওর। ধড়ফড় করে উঠলো সেই রক্তাক্ত অবস্থার কথা ভেবে। পূর্ণতার বিহ্বল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে পূর্ব অদ্ভুত সুরে বললো,
- সিগারেট খাইনি। চুমু খেয়ে দেখো আমি সত্যি সিগারেট খাইনি।
পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ পূর্বের গাল ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। আলমারির দিকে দৃষ্টি যেতেই ক্ষণিকের জন্য ভুলে যাওয়া কাজটি মনে পরলো। সে পা চালিয়ে আলমারি খুলে শাড়ির সবগুলো হ্যাঙ্কার বের করতে লাগলো। পূর্ব অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই নিরবে হেঁটে গিয়ে দরজার সিটকিনি তুলে দিলো। পূর্ণতা তখন আলমারি থেকে কাপড় বের করতে ব্যস্ত ছিলো। খেয়াল করেনি সে পূর্বের উপর। পূর্ব আবার সোফার জায়গায় চলে গেলো, কিন্তু স্থান একটু পরিবর্তন ঘটিয়ে ঠিক জানালার কাছে গিয়ে আকাশে দৃষ্টি রাখলো।
সাদা পর্দা বাতাসের মৃদ্যু ঝাপটায় উড়ছে। বাইরে থেকে মন-মাতানো বাতাস এসে দেহমন প্রশান্ত করে দিচ্ছে। পূর্ব প্যান্টের পকেটে দুহাত পুড়ে পরম শান্তি, পরম মায়ায় চোখ বুজে সুর তুললো।সেই সুরো যেনো কিছুটা আবেগমিশ্রিত, কিছুটা দুঃখপূর্ণ, কিছুটা আকাঙ্ক্ষীত। মনকে অতলস্পর্শ করে বেশ শান্ত ও ঠান্ডা গলায় গান গাইতে লাগলো ,
কি করি বলো, তুমি হীনা...
থেমে গেলো পূর্ণতার মূহুর্ত। আটকে এলো শ্বাস। পূর্বের মুখ নিঃসৃত সুর যেনো হৃৎযন্ত্র আবার বাড়িয়ে তুলছে পূর্ণতার। ঠিক সেইদিনের মতো, যেদিন দরজার বাইরে দাড়িয়ে সহসা পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো।
আমি পারিনি তোমাকে
আপন করে রাখতে,
আমি পারিনি তোমাকে
আবার আমার করে রাখতে।
তুমি বুঝনি, আমি বলিনি
তুমি স্বপ্নতে কেন আসনি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে
সব গেয়েছি।
গানে গানে সুরে সুরে কত কথা
বলেছি তোমাকে,
তুমি বুঝনি, বুঝনি।
কখনো যদি, আনমনে চেয়ে
আকাশের পানে আমাকে খুঁজো,
কখনো যদি, হঠাৎ এসে
জড়িয়ে ধরে বলো ভালোবাসো।
গানের শেষটুকুতে এসে গলাটা কান্নায় সিক্ত হয়ে গেলো পূর্বের। আকাশের পানে নিবদ্ধ দুইচোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো তখন। পকেটের ভেতর সিগারেটের শূন্য প্যাকেটটা দুমড়ে-মুচড়ে ফেলছিলো গানের প্রতিটি সুরে। একপর্যায়ে পকেট থেকে সেটা বের করে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলো বাইরে। মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে পূর্ব বলে উঠলো অসহন কন্ঠে,
- আমি সিগারেট খাইনি পূর্ণতা। আমি জেল থেকে বেরিয়ে খারাপ জায়গায় যাইনি। একবার চুমু খেয়ে দেখো আমি মিথ্যা বলছি কিনা। একবার আমার কথা শুনে দেখো আমি এতোদিন কোথায় ছিলাম। আমি আর সহ্যক্ষমতার মধ্যে নেই, হাপিয়ে গিয়েছি, প্রচুর ক্লান্ত হয়েছি, সব হারিয়ে ফেলেছি। একে-একে সব। আমার রূহটা বাদে বাইরের সবকিছু আমার হারিয়ে গেছে। আমার দীর্ঘ সাধনার ইচ্ছাটা কবরে স্থান নিয়েছে। আমার জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিছুই নেই...
.
.
.
চলবে.........................................