পদ্মপাতা - পর্ব ২৭ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!৭৯!!

চাঁদকে দেখেই মৃদুলা ছলছল নয়নে তাকিয়ে থেকে কেঁদে দিলো। চাঁদ কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে তবে মেয়ের কান্না থামছেই না। ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর পাপা পাপা করছে। 
-মা, ও কাদছে কেনো?
-তখন থেকে খালি বলছে পাপা পাপা। তুই ই বল দোয়েল চত্বরে ওদের পাপা আসবে কোথা থেকে। এদিকে তোরও ভার্সিটি যেতে হবে। তাই নিয়ে এলাম। সে কি কান্না আর হাত পা ছুড়াছুড়ি। 

চাঁদ এবার স্তব্ধ হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়েই সোফায় বসে পড়লো। ওরা কি তবে আবিরকে দেখেছে? একি বিপদে পড়লো চাঁদ। এবার ছেলে মেয়েকে কি করে বুঝ দিবে। এই ছোট দুই প্রাণ তো বাবা বলতে পাগল। তবে তাদের বাবা হয়তো তাদের স্বীকারও করবেনা। 

আবির আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে করেই হোক সেই হরিণী চোখের মেয়েটার সাথে কথা বলবে। মেয়েটা আসছেনা কেন। আবির আর ধৈর্য ধরতে পারছেনা। তখনই ক্যাম্পাসে ঢুকলো চাঁদ। আবির দৌঁড়ে গেলো তার দিকে। চাঁদ হকচকিয়ে গেলো আবিরকে দেখে সে পিছনে ফিরে জলদি হাঁটা দিয়েছে। আবির পিছন থেকে ডাকছে,
-চাঁদ দাঁড়া। চাঁদ।

ক্যাম্পাসের সবাই হা করে তাকিয়ে দেখছে। অনেকে অবাক হচ্ছে, অনেকে মজা পাচ্ছে। রাস্তায় এসে চাঁদ ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো। আবির উদভ্রান্তের মতো তাকে খুঁজছে। কখনো এদিক তো কখনো ওদিক। এমন সময় একটা সিএনজির সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায় সে। মুহূর্তেই জ্ঞান হারায় আবির। এদিকে চাঁদ গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকে লিফটে উঠে ছাদে চলে গিয়েছে। আজ যে তাকে কেঁদে গা ভাসাতে হবে। লোকটা নিজে তাড়িয়ে দিয়ে আবার কেনো আসতে চাচ্ছে? কি চাই তার?

_________________

চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালে দেখে অবাক হয় আবির। হাতে, মাথায় আর পায়ে সাদা ব্যান্ডিজ। পাশেই বসা নিতি।
-এখন কেমন লাগছে তোর?
-ভালো। আমি এখানে কিভাবে?
-কিছু লোক তোকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে এসেছিলো।
-আমাকে যেতে হবে।
-পাগল নাকি তুই? রাত দশটা বাজে। আর তোর যে অবস্থা হাঁটতেও তো পারবি না।
-আমাকে যেতেই হবে। আমি চাঁদকে খুঁজে পেয়েছি। 
-মানে কিভাবে?
-সেসব পরে বলবো। আগে চাঁদের দেখা পাই। 
-আচ্ছা, এতোরাতে তো আর খুঁজে পাবি না। কাল না হয় খুঁজিস।

আবির আর কথা বাড়ালো না। শরীরটাও সায় দিচ্ছে না। খেয়ে ঘুমিয়ে যায় আবির।

পুরো ভার্সিটি তন্নতন্ন খুঁজেও চাঁদের দেখা পায়নি আবির। তার এহেন পাগলামি তে সবাই অবাক। ক্লাসের মেয়েদের কাছে জিজ্ঞেস করেও চাঁদের ঠিকানা পায় নি আবির। অফিসে চাঁদের তথ্য খুঁজ করে দেখতে পেলো নোয়াখালীর ঠিকানা দেওয়া। তবে আবির জানে চাঁদ ঢাকাতেই আছে।

!!৮০!!

-স্যার, আসতে পারি।

চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথাটা চেপে বসেছিলো আবির। একটা মেয়েলি কন্ঠে চোখ মেলে সোজা হয়ে বসে বললো,
-আসো।
-স্যার আপনি নাকি চাঁদের খোঁজ করছেন। 

হঠাৎ করেই আশার আলো খুঁজে পেলো আবির। উৎফুল্ল হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-তুমি জানো?
-জ্বি।
-কোথায়?
-শাহবাগেই থাকে। 
-ঠিকানাটা দাও।

সুমাইয়ার কাছে ঠিকানা নিয়ে আবির ছুটলো সে ঠিকানায়। তার স্ত্রী, তার সন্তান। আবিরের খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার দশা। রিকশা থামলো সাততলা একটা বিল্ডিংয়ের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে বিল্ডিংটার দিকে তাকালো আবির। হঠাৎই তার কানে বাজলো অতীতে চাঁদের বলা একটা কথা,

"আপনিও ভবিষ্যতে কোনোদিন আমার সামনে স্বামীর দাবী নিয়ে আসবেন না।"

আবিরের মধ্যে যে খুশিটা ছিলো তা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। চাঁদ কি তাকে মেনে নিবে?
পরক্ষণেই ভাবলো মেনে না নিলে আবির ক্ষমা চাইবে দরকার হলে পায়ে ধরবে তবুও চাঁদকে তার চাই। আর এখন তো চাঁদ একা না। সাথে আবিরের দুইটা জানও আছে। 

দাড়োয়ান প্রথমে ঢুকতে না দিলেও এক হাজার টাকার নোটের লোভে ঢুকতে দিলো আবিরকে। পাঁচ তালায় এসে লিফটটা থেমেছে। আবিরের বুকটা ধুরু ধুরু করছে। শরীরে অসহনীয় কাঁপনি হচ্ছে। ডানপাশের ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা কাঁপা হাতে চাপলো আবির। 

!!৮১!!

চাঁদ মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে সোফায়। ছেলেটা কোলে। সেদিনের পর আজ আর ভার্সিটি যায়নি সে। এদিকে কাজের চাপ বেশি। অনেকগুলো অর্ডার এসেছে। বাচ্চাগুলোকে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে কাজ করবে বলে মনস্থির করেছে সে। মেয়েটা ঘুমিয়ে গিয়েছে। এই মেয়েটার খালি এক কথা পাপা কে চাই আর পাপা কে চাই। রত্না রান্নাঘরে। এমন সময় কলিং বেলের শব্দে উঠে দাঁড়ায় চাঁদ। রহিমের আসার কথা ডেলিভারি নিতে। এতো তাড়াতাড়ি চলে এলো। চাঁদ আহিরকে কোলে নিয়েই দরজা খুলতে খুলতে বললো,
-রহিম ভা

কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলোনা আর। সামনে থাকা ব্যাক্তিটাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তবে হাতে, মাথায় ব্যান্ডিজ দেখে বুকে ছেৎ করে উঠলো চাঁদের। আবির অস্ফুট স্বরে বললো,
-চাঁদ।

চাঁদ দরজা খুলেই ভিতরে ছুটে গেলো। আবিরও ছুটলো পিছু পিছু। রত্না রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন চাঁদের কান্নার শব্দে। আহিরও মায়ের কান্না শুনে জেগে উঠে কান্না করছে। আবিরকে দেখে অবাক হলেন রত্না। তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন আবির যেনো নিজের ভুল বুঝতে পারে। তার এই অভাগী মেয়েটা যেনো সুখি হয়। আবির বললো,
-চাঁদ। আমার চাঁদ। 

এগিয়ে আসতে চাইলো চাঁদের দিকে। তবে চাঁদ দূরে সরে গেলো। কোলে থাকা ছোট আহির হাত বাড়িয়ে দিলো,
-পা পা। পাপা।

ছেলের আদো আদো বুলিতে বলা পাপা শব্দটা শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো আবিরের। হাত বাড়িয়ে বললো,
-এই তো বাবা। আসো সোনা।

আবিরের কন্ঠ ভেজা। চাঁদ দিলো না। চাঁদের ধমকে চুপ হয়ে গেলো আহির। মাথাটা এলিয়ে দিলো চাঁদের কাঁধে। মুখ ফুলিয়ে রাখালো। মাম্মার সাথে আর কথা বলবেনা সে। 

-ওকে বকিস না চাঁদ।
-আপনি এখন আমাকে বলবেন আমার সন্তানকে আমি কি করবো।
কান্না থামিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বললো চাঁদ। ভেবে রেখেছিলো এই নিষ্ঠুর লোকটার জন্য কাঁদবেনা। তবে মন তার কথা শুনলো না। তবে এবার নিজেকে শক্ত করলো চাঁদ। আবির বিস্ময় নিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চাঁদ কখনো তার সাথে এভাবে কথা বলতো না। তবে এই শাস্তিটা তার প্রাপ্য।

-সন্তান কিন্তু আমারো।
-একদম অধিকার ফলাতে আসবেন না। এতোদিন আপনার দরকার লাগতে দেই নি আর ভবিষ্যতেও লাগতে দিবোনা আবির স্যার।
-চাঁদ।
-আমার নাম আপনার মুখে নিবেন না। 
-আমাকে ক্ষমা করে দে চাঁদ।
-আপনি আমাকে তুই করে কেন বলছেন স্যার? কোন অধিকারে বলছেন?

আবিরের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
-আমার কথা একটু শুনুন চাঁদ। 
-আপনি আমার কথা শুনেছিলেন? তাহলে আজ আমি কেন শুনবো? কতোটা কষ্ট করেছি জানেন? আপনাকে বলে লাভ নেই। আপনি আসতে পারেন।

আবিরের চোখ গেলো সোফায় ঘুমন্ত মৃদুলার দিকে। কি মিষ্টি! একেবারে পুতুল। 
-কি হলো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

চাঁদের বজ্রকন্ঠে ঘুম ভেঙে গেলো মৃদুলার। ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করেছে। চাঁদ এগিয়ে গেলো সেদিকে। তবে আবিরকে দেখে ছোট মৃদুলার কান্না থেমে গেলো। দৌঁড়ে যেতে চাইলো আবিরের কাছে। তবে চাঁদ তার হাত ধরে রেখেছে। ছেলেটা শান্ত হলেও মেয়েটা বড্ড অশান্ত। হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে সে। চাঁদ রেগে একটা থাপ্পড় বসালো মেয়ের গালে। অথচ ছেলে মেয়ে যতই দুষ্টামি করুক। কখনো বকা বাদে তাদের গায়ে হাত তুলেনি চাঁদ। আবির কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন