পদ্মপাতা - পর্ব ২৮ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প


!!৮২!!

-আমার রাগ আমার বাচ্চাকে দয়াকরে দেখাবেন না মিস চাঁদ।
-আপনার বাচ্চা! আজ পাঁচ বছর পর মনে হলো আপনার বাচ্চা? 
-আমি তো জানতাম না।
-জানলেই কি করতেন আপনি? সত্যতা যাচাই করতেন? আমি উত্তর দিচ্ছি করতেন না। চরিত্রহীন বলতেন যেমনটা আপনার মা, আপনার পরিবার করেছে। এই কপালের পাশে ছোট কাঁটা কালো দাগটা দেখছেন? আপনার চাচির দেওয়া উপাহার। আমার চুলগুলো কেটে দিয়েছিলেন তিনি। আমার দোষটা কোথায় আবির স্যার?
-চাঁদ আমাকে ভুল বোঝানো 
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই চাঁদ চিৎকার করে উঠলো,
-ওহ, আপনাকে ভুল বোঝানো হলো আর আপনি তা সাদরে গ্রহণ করলেন। একবার যাচাই করলেন না? এই আপনার ভালোবাসা? এতোটা নড়েবড়ে? যে ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই এমন ভালোবাসা আমার চাই না। বেরিয়ে যান আপনি। আপনি একজন সম্মানিত ব্যাক্তি আমাকে পুলিশ ডাকতে বাধ্য করবেন না।
-চাঁদ। আমার সন্তান। 
-চুপ একদম চুপ। কিসের সন্তান? হ্যাঁ কিসের সন্তান? ওরা শুধু আমার। পাঁচ বছর ধরে কোথায় ছিলো আপনার এই দরদ। বাড়ি থেকে না পালালে আজ কিভাবে দাবি করতেন এদের? সদ্য আঠারোতে পা দিয়ে মা হয়েছি। কতোটা কষ্ট করে আমার সন্তানদের এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি কেবল আমি জানি। আপনি বেইমান হলেও আমি বেইমান নই স্যার। আপনার দিমা বোনকে একটা ধন্যবাদ দিবেন আমার তরফ থেকে। সেদিন ও যদি আপনার দেয়া প্যাকেট টা কূয়ায় ফেলে না দিতো তাহলে আমি আজ আমার দুইটা জান পেতাম না সাথে ভালোবাসার জঘন্য রূপটাও দেখতাম না। মানুষ যে মুখোশধারী বেইমান হয় তাও জানতাম না। 

চাঁদ রান্নাঘরের পাশে দাঁড়ানো রত্নাকে দেখিয়ে বললো,
-এই যে এই মানুষটিকে দেখছেন আজ কেবল এই ব্যাক্তিটির কারণে চাঁদ আর তার সন্তানেরা আছে নয়তো সে বিলীন হয়ে যেতো। 
-আমার কথাটা একটু শোন।
-কোনো কথা নেই। আপনি শুনেছিলেন? আমি কেন শুনবো? আপনি যদি এই মুহূর্তে এখান থেকে না যান তাহলে আমার মরা মুখ দেখবেন।

চাঁদের এহেন কথায় আবির স্তব্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। এটা কি তার চাঁদ? আবিরের একটা ভুলের কারণে এতোটা নিষ্ঠুর হয়ে গেলো চাঁদ। আবির বিল্ডিংয়ের সামনে রাস্তায় বসে পড়ে। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে চাঁদের ভুল না ভাঙিয়ে সে যাবেনা। সেসময় পরিস্থিতিটা কারো অনুকূলে ছিলোনা। 

আবির বেরিয়ে যেতেই চাঁদ ঘুমন্ত আহির আর মৃদুলাকে খাটে রেখে আসে। দুইটা বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছে।

!!৮৩!!

রত্না সোফায় বসে আছেন। চাঁদ এসে তার কোলে শুয়ে পড়লো। রত্না চাঁদের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন,
-কষ্ট হচ্ছে? 
-তোমার কাছে কখনো মিথ্যা বলতে পারি আমি মা। আমার বুকের বা পাশটায় জ্বালা করছে মা।
-ছেলেটার কথা একবার শুনতি।

চাঁদ ভেজা গলায় বলে,
-তুমি এই কথা বলছো মা। তুমি তো দেখেছো আমি কতোটা কষ্ট করেছি। ওই লোকটা মাঝ পথে হাত ছেড়ে দিয়েছে। 
-তোরা দুইজনই পরিস্থিতির স্বীকার ছিলিরে মা। হয়তো আবিরকে ভুল বোঝানো হয়েছে। 
-তাই বলে নিজের ভালোবাসাকে যাচাই না করে অবিশ্বাস করবে?
-তুই একবার ওঁর জায়গায় নিজেকে ভেবে দেখ। আমি স্পষ্ট আজ আবিরের চোখে অপরাধবোধ, ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা দেখতে পেয়েছি। ক্ষমা করা যায় না? 
-কি করে ক্ষমা করবো আমি? যে একবার হাত ছেড়ে দেয় সে কি দ্বিতীয়বার দিবে না? আমি ভালো আছি। কারো প্রয়োজন নেই আমার।
-চাঁদ মা আমার। তুই একবার ভাব তো আহির আর মৃদুলা বাবাকে কতোটা চোখে হারায়। কতোটা ভালোবাসে। তাদের পথ চলতে আবিরকে প্রয়োজন। কিছুদিন পর তারা যদি প্রশ্ন করে বাবা কোথায়? কি জবাব দিবি তাদের। তোরই বা বয়স কতো। এখনো তো অনেকটা পথ বাকি কিভাবে পাড়ি দিবি সে পথ? ক্ষমা করবি কি করবি না সেটা তোর ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কেবল একটা কথা মাথায় রাখিস চাঁদ তোর বাচ্চাদের তার বাবাকে প্রয়োজন। আমার মনে হয়না আবির আর কখনো তোর হাত ছাড়বে। 
-আমার এসব আর ভালোলাগে না মা।
-ক্ষমা করা মহৎ গুণ। আবির তার ভুলের জন্য শাস্তি পেয়েছে এবং পাচ্ছে। তুই এই ব্যাপারে ভেবে দেখিস।

চাঁদ কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে। ক্ষমা করলে কি আদো তার পাঁচ বছরের যন্ত্রণা কমবে?

________________

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে চারপাশে। আকাশটা থমথমে হয়ে আছে। ছাই রঙা মেঘগুলো আস্তে আস্তে কালো রূপ নিচ্ছে। আশেপাশে দমকা হাওয়া বইছে। ধূলাবালির ঝড় উঠেছে রাস্তায়। আজ বোধহয় অনেক বৃষ্টি হবে। অনেক। রাস্তার মানুষগুলো দৌঁড়ে যার যার গন্তব্যে ছুটছে। কতো তাড়া তাদের! তবে কিছু লোক অবাক হয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখছে। যার দৃষ্টি সামনে সাততলা বিল্ডিংটির পাঁচতলার ডান দিকটায়। 

!!৮৪!!

বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যায় আবিরের নীল রঙা শার্ট। চশমাটা ভিজে ঘোলা হয়ে যায় তবে সেটা বৃষ্টির পানিতে নাকি তার চোখের পানিতে তা বোঝা দায়। আবির আকাশের দিকে তাকায়। যদিও বৃষ্টির কারণে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে তবুও সে তাকায়। না, কোথাও চাঁদ নেই। চাঁদ হারিয়ে গিয়েছে। আবিরের মনে হয় না হারিয়ে যায়নি অভিমান করে লুকিয়ে আছে। এতো এতো মেঘের ভিরে। আবিরের মন বলে,
"তোর মেঘেদের আড়ালে ভয় লাগছে চাঁদ? চিন্তা করিসনা। তোর আবির ভাই আছে।"
তখনই আবির শুনতে পায় একটা হু হা হাসির শব্দ । যে হাসি ঝড় তুলে আবিরের মনে। 
"কিরে তুই হাসলি কেন?"
আবার জবাব আসে,
"এতোদিন কোথায় ছিলেন? এখন এতো দরদ দেখাতে হবেনা।"

আবির মাথা নিচু করে মলিন হাসে। কারেন্টের খুঁটিতে হেলান দিয়ে তার লাল লাল চোখ জোড়া বুজে আসে।

________________

একটা স্বচ্ছ সকাল। পরিষ্কার আকাশে সাদা মেঘের দলেরা হানা দিয়েছে। আকাশী রঙের মাঝে সাদা মেঘগুলোকে দেখে যে কেউ গুলিয়ে ফেলবে এটা আকাশ না সমুদ্র। 

বারান্দায় নিজের প্রিয় জুঁই, অর্কিড, বেলি, গোলাপ, টগর, দোলনচাঁপা ফুলগুলোতে পানি দিতে ব্যাস্ত চাঁদ। বিষণ্ণ মনটা যদি একটু স্বস্তি পায়। মানিপ্ল্যান্ট গাছের পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ চাঁদের নজর যায় রাস্তার পাশে কারেন্টের খুঁটিতে হেলান দেওয়া ব্যাক্তিটির উপর। চাঁদ ভালো করে তাকায়। বুকটা ছেৎ করে উঠে তার। এ যে তার আবির ভাই। দিন দুনিয়া ভুলে নিচের দিকে ছুটে যায় চাঁদ। চাঁদ অবাক হয় এই লোকটা কি সারারাত এখানে ছিলো। 
অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠে তার বুক। পিছন থেকে রত্নার ডাক কানেই তুলেনি দিশেহারা চাঁদ।

আবিরের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে যায় সে। শরীরের কাপড় লেপ্টে আছে। এরমানে সারারাতে এই লোকটা এখানেই ছিলো। চাঁদ আলতো করে ডাকে,
-এই যে শুনছেন। এই।
কোনো জবাব আসেনা। চাঁদ হকচকিয়ে আবার ডাকে। জবাব আসেনা। এবার চিৎকার করে ডাকে,
-আবির ভাই। আবির ভাই।

আবির চোখ মেলে তাকায়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে। তার চোখ জোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে। রাস্তার কৌতূহলী মানুষ ঘাড় ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখে এই যুগলকে। যদিও ঢাকার রাস্তায় এমন নাটক অহরহ হয়। এর মাঝেই এক অভাবনীয় কাজ করে বসে আবির। চাঁদের পা জাপটে ধরে ভেঙে যাওয়া ভেজা গলায় বলে,
-আমাকে ক্ষমা করে দে চাঁদ। আমার চাঁদের থেকে আমার দুইটা জানের থেকে আমাকে দূর করে দিসনা চাঁদ। আমি মরে যাবো। একদম মরে যাবো।
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন