গভীর রাত।
ভায়োলেট ঘুমানোর চেষ্টা করছে। জাহ্নবী ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল, 'তোকে একটা পারসোনাল কথা বলি?'
ভায়োলেট ঘুমের ঘোরে উত্তর দিলো, 'কাল শুনবো।'
জাহ্নবী উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আবহাওয়া শীতল বলে আজ দ্রুতই রাত নেমেছে এই শহরে। ভায়োলেট আজ আরাম করে ঘুমোবে। কিন্তু জাহ্নবীর ঘুম আসছে না। মনের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় বইছে তার।
ভায়োলেট পাশ ফিরে জাহ্নবীর কাছে জানতে চাইল, 'আপু, কী বলবে বলো?'
'তুই ঘুমাবি না?'
'আগে তোমার কথাটা শুনবো, হজম করবো, তারপর ঘুমাবো। বলো?'
উচ্ছ্বসিত হয়ে জাহ্নবী ভায়োলেটের গায়ে হাত রাখল। মৃদু স্বরে বলতে লাগল, 'শোন তাহলে। আমি একটা খারাপ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। কীভাবে যে বলি! তুই আমার ছোট বোন। তোকে বলতে আমার লজ্জা করছে।'
ভায়োলেট জাহ্নবীকে ছুঁয়ে বলল, 'মনে করো আমি তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমাকে বলো।'
'জানিস তোর কথা শুনে আমার কান্না পাচ্ছে। আমার কোনো ভালো বন্ধু নেই। আমার তো কোনো বন্ধুই নেই।'
ভায়োলেট জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আমি তোমার বন্ধু। একদম কাছের বন্ধু। আমাকে বলো তোমার কী হয়েছে?'
জাহ্নবী কিছুক্ষণ সময় নিলো নিজেকে প্রস্তুত করতে। কখনো মন খুলে কাউকেই কিছু বলতে পারেনি সে। তাই হয়তো জড়তাটুকু বেশি আলিঙ্গন করছে ওকে। কথাটা বলতে গিয়ে ওর বুক ধকধক করতে লাগল।
'জানিস ভায়োলেট, আমি প্রেমে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে আছি।'
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল জাহ্নবীর। কথাটা সে নিজের মুখে বলেছে এটা বিশ্বাস করতেও নিজের সময় লাগল। চোখ বন্ধ করে আছে জাহ্নবী।
ভায়োলেট জানতে চাইলো, 'কার প্রেমে?'
জাহ্নবী বলল, 'তা জানিনা রে। তবে আমার মনটা এত উতলা হয়ে আছে! মনে হচ্ছে যখন তখন আমি কারও প্রেমে ধপ করে পড়ে যাবো। আমার ভীষণ প্রেমের স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে। কারও ভালবাসা পাবার সাধ জেগেছে অনেক। আমি যদি কাউকে ভালবাসি, আর সে যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়, আমার কী অনেক কষ্ট হবে ভায়োলেট?'
ভায়োলেট জাহ্নবীকে আরও শক্ত করে চেপে ধরল। যেন নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ না করে জাহ্নবীর। আজ যখন সে নিজে থেকে ভায়োলেটের কাছে মনের কথা বলতে চায়, ভায়োলেটের উচিৎ ওর প্রতি যথেষ্ট সম্মান রাখা।
ভায়োলেট বলল, ' আগে এমন হয়নি কখনো?'
জাহ্নবী মাথা নাড়িয়ে বলল, 'উহু কখনো না। আমি তো আজীবন ভাবতাম, বিয়েই করবো না। আমার ছেলেদের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। প্রেম, ভালবাসা, সংসার এসব ভালো লাগত না। এমনকি কিছুই ভালো লাগে না আমার। আমার মনেহয় আমি একজন মৃত মেয়ে। যার কোনো সাধ নেই, কোনো শখ নেই। আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারিনা, কারও সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না। আমি ভাবতাম, ভালবাসা জিনিসটা আমার হয়তো কখনোই হবে না। আগে তো কত বিয়ের প্রস্তাব আসতো। আমার বিয়ে করার আগ্রহই জাগে নি কখনো। অথচ জানিনা কয়েক মাস ধরে আমার কী যেন হয়েছে, শুধু কারও প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। কারও সাথে ভালবাসার ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করে। সংসার করতে ইচ্ছে করে।'
ভায়োলেট শান্ত হয়ে জাহ্নবীর বুকে লুকিয়ে রইল। আপুর শরীর থেকে মায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। ভালো লাগছে জাহ্নবীর কথা শুনতে। চোখ বন্ধ করে তার সব কথা শুনছিল সে।
জাহ্নবী বলল, 'আমার তো অনেক বয়স হয়ে গেছে রে। আমাকে কী কেউ এখন বিয়ে করবে? কেউ ভালবাসবে?'
'ধুর। এসব ভেবো না তো। বয়স আবার কী হ্যাঁ? জীবন তো সবে শুরু। টেনশন কোরো না। তুমি শুধু চারপাশে মন দিয়ে খেয়াল রাখো কাকে তোমার ভালবাসতে ইচ্ছে হয়। সবার জন্য তো আর ফিলিংস হয় না।'
'ঠিক বলেছিস। একদম ঠিক বলেছিস। আমাকে কী দেখতে বুড়ি বুড়ি লাগে ভায়োলেট?'
'উহু একদমই না। বুড়ি লাগবে কেন? এই বয়সে কেউ বুড়ি হয়?'
'আমার তো মনেহয় আমাকে দেখতে তিন বাচ্চার মা লাগে। আমি বিয়ে করলে এখন সত্যি সত্যি তিন বাচ্চার মা হতাম।'
'বাংলাদেশী সোসাইটিতে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাইরের দেশগুলোর দিকে তাকাও? ওরা কিন্তু বিয়ে নিয়ে এত মাথা ঘামায় না। ওদের জীবনে প্রেম আসে বসন্ত আসার মতো। যেকোনো বয়সে, যে কারও সঙ্গে। চল্লিশ বছর বয়সেও নতুন করে জীবন শুরু করা যায় আপু।'
জাহ্নবী ভায়োলেটের গালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল, 'আমার লক্ষী বোন। তুই এত ভাল কেন রে? আমার মাঝেমাঝে তুই হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ভায়োলেট, তোর স্বপ্নটা আমাকে বলবি না?'
'বলবো। অন্য একদিন।'
'আজকে বলা যাবে না?'
'না। আজকে বলতে ইচ্ছে করছে না।'
জাহ্নবী আর জোর করল না। প্রত্যেকের নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার গুলো সিক্রেট রাখার অধিকার আছে। সময় মতোই সে তার কথা বলুক। জাহ্নবীর এখন বেশ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে সে একটা পাখি। হাত দুটো তার পালক হয়ে গেছে। যেন হাত মেলে দিলেই উড়ে উড়ে সূদূর প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে পারবে সে।
জাহ্নবী সত্যি সত্যিই উড়ছে। আকাশে তুলোর মতো মেঘ ফুঁড়ে উড়ে যাচ্ছে সে। মেঘগুলো হয়ে যাচ্ছে ফুল, মেঘের ফুল। গায়ে নরম মেঘের স্পর্শ পেয়ে সে আনন্দ পাচ্ছে। মেঘের ভেতর হতে হঠাৎ উঁকি দিলো অর্ণব। জাহ্নবীর দিকে তাকিয়ে অর্ণব হাসতে লাগল। জাহ্নবী হাসতে যাবে এমন সময় হঠাৎ নিচে পড়ে গেল অর্ণব। জাহ্নবী নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল অকূল দরিয়া। সেখানে অর্ণব একটা মেয়ের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে। জাহ্নবী দ্রুত সেখান থেকে উড়ে অন্যদিকে চলে এলো। এই আকাশে হঠাৎ স্বাস্থ্যবান এক সুপুরুষ, পরনে সাদার মতো একটা পাঞ্জাবী। সেও মেঘের মতো উড়ছে। উড়তে উড়তে জাহ্নবীর একদম কাছে চলে এলো সে। জাহ্নবী হাসছে, অনেক শব্দ করে হাসছে। মনে হচ্ছে এই সুপুরুষ মেঘের মতোই ওর শরীর স্পর্শ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই স্পর্শ তাকে অন্যরকম এক শীতল অনুভূতি দান করল। জাহ্নবী বলতে লাগল, চলে যেও না। আরও কিছুক্ষণ থাকো। থাকো..
কলিং বেল বেজে উঠল কয়েকবার। ভায়োলেট পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল। জাহ্নবী মেঘের ভেতর উড়তে উড়তে কলিং বেলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। শব্দের তালে তালে হারিয়ে যেতে লাগল সেই মেঘের পুরুষ। স্বাস্থ্যবান, সাদা পাঞ্জাবীর সেই নাদুসনুদুস লোকটা। কলিং বেলের শব্দ আরও তীব্র হল। ঘুম ভেঙে গেল জাহ্নবীর।
ঘড়ির দিকে তাকাল সে। রাত তিনটা পঞ্চাশ। এত রাতে কে এলো! পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল সামারের কথা। গত রাতে তার বাসে ওঠার কথা ছিল। সে এসেছে নিশ্চয়ই। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। জাহ্নবী চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলতে এলো।
সামার জাহ্নবীকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল, 'আপু! ডিংকাচিকা। ওয় ইয়ে ইয়ে, হেয়ে হেয়ে।'
ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল সামার। জাহ্নবী সশব্দে হাসতে লাগল। সামার আজ এত আনন্দিত কেন! জাহ্নবী দ্রুত দরজা আটকিয়ে সামারকে নিয়ে ঘরে চলে এলো।
দুই বোনের কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল ভায়োলেটের। সামার ব্যাগের চেইন খুলে জামাকাপড় গুলো মেঝের ওপর ফেলে দিচ্ছে আর বলছে, 'ইয়াক কী বিশ্রী গন্ধ! এগুলো কাল ধুতে হবে। কিন্তু আমার যে পরিমাণ ঘুম পেয়েছে। মনে হচ্ছে আমি কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাবো। আর ট্যুর থেকে এসে টানা বারো ঘন্টা না ঘুমালে আমার ভালো লাগে না। অনেক হেঁটেছি, খুব ক্লান্ত। গায়ে কী যে ব্যথা.. এই ভায়োলেট, ওঠ। আরে ওঠ না?'
ভায়োলেট বিছানার ওপর উঠে বসল। চোখ মুখ মুছে জানতে চাইলো, 'এত ভোরে কীভাবে এলি আপু?'
সামার হাসতে হাসতে বললো, 'উহহু, বলবো না। একজন বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। সামার, আমাদের তো প্রেম হয়ে গেছে। আররে প্রেম হয়ে গেছে। ওঠ, পার্টি দে।'
নিজেই দাঁড়িয়ে একটা ডান্স দিলো সামার। জাহ্নবী হাসতে হাসতে ঢলে পড়তে লাগল। সামার ব্যাগ থেকে সব জিনিসপত্র বের করে রাখল। ব্যস্ত ভঙ্গীতে কী যেন খুঁজছে সে। জাহ্নবী ভাবল, হয়তো তাদের জন্য কিছু এনেছে।
সামার গুপ্তধন পাওয়ার মতো কিছু একটা পেয়ে যাওয়ায় মহা খুশি। এরপর হাতে একটা ক্লিনজিং অয়েল নিয়ে বাথরুমে যেতে যেতে বলল, 'আগে ফেস ক্লিন করে শাওয়ার নিয়ে ফেলি। বড় আপু, খাবার কিছু থাকলে আমাকে দাও তো।'
ভায়োলেট বলল, 'তুই গোসল করতে করতে খাবি?'
'খাওয়া যায়। কিন্তু খাবো না। আমি নাচতে নাচতে গোসল করবো। আমার গামছা ধুলাবালি দিয়ে শেষ। কেউ একটা পরিষ্কার গামছা ধার দাও আমাকে।'
জাহ্নবী নিজের ঘর থেকে নতুন একটা তোয়ালে এনে বাথরুমের দরজায় শব্দ করল। সামার তোয়ালে নিয়ে ধন্যবাদ জানালো জাহ্নবীকে।
ভায়োলেট অবাক হয়ে সামারের এলোমেলো কাপড়চোপড় ও ব্যাগের জিনিসপত্র গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আনন্দ হচ্ছে তার। সামারের আনন্দ দেখে মাঝেমাঝে তারও ভীষণ নাচতে ইচ্ছে করে।
জাহ্নবী ফ্রিজ থেকে মাংস ও পোলাও বের করে গরম করে রাখল। ঘরে এসে দেখল আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে ভায়োলেট। সামার খাবার টেবিলে গিয়ে জোরে জোরে ডাকল জাহ্নবীকে। জাহ্নবী টেবিলে আসতেই সে বলল, 'তুমিও খাও। বসো। একা একা খেতে ভালো লাগে না।'
ফজরের আযান হয়ে গেছে। নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল জাহ্নবী। সামারের সঙ্গে বসে সে-ও খাবার খেলো। খেতে খেতে সামারের ভ্রমণের গল্প শুনছিল সে। সামার খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে চলে গেল ঘরে। জাহ্নবী একা টেবিলে বসে খাচ্ছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সামারের। জাহ্নবী মুচকি হাসল। আজকের সকালটা সুন্দর।
খাবার খাওয়া শেষে নামাজ আদায় করে জানালা খুলে দিলো জাহ্নবী। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সে এখন কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাকবে। তার মনটা অনেক ফুরফুরে। দারুণ একটা স্বপ্ন দেখেছে আজ। মেঘের ভেতর একটা নাদুসনুদুস মানুষ। একগুচ্ছ মেঘের ফুল। ওর ইচ্ছে করছে আবারও সেই স্বপ্নটা দেখতে। কিন্তু স্বপ্ন তো চাইলেই দেখা যায় না। আচ্ছা, কে সেই মেঘের মানুষ? কেনই বা সে আমার স্বপ্নে এলো? কিন্তু মানুষটার মুখচ্ছবি বা চেহারা কিছুই তো মনে নেই। শুধু মনে আছে, সে একজন সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান, পাঞ্জাবি পরিহিত একটা মানুষ। মাথায় কালো কুচকুচে চুল, গায়ের রং ফর্সা। মেঘের ভেতর ফুলের মতো উড়ছিল সে! জাহ্নবী'র ঘুম এলো না। সে ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকাল হওয়া দেখল।
তার মোবাইল ফোনটা বাজছে। কল দিয়েছে জাভেদ আলী। তিনি নিরাপদে পৌঁছে গেছেন অর্ণবের বাসায়। জাহ্নবী অর্ণবের নামটা জোর করে মুছে ফেলল মাথা থেকে। সে এখন শুধুই মেঘের মানুষটাকে খুঁজবে, আর কাউকে নয়।
.
.
.
চলবে........................................................................