অনিমার কথা শুনে আদ্রিয়ান কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গেলো। ওর হাত আলগা হয়ে এলো। কিছুক্ষণের জন্যে যেন জমে এলো ওর শরীর। অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে রেখে দিয়েছে তাই বুঝতে পারছেনা। আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
" স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারবে আমায়?"
অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলল। আদ্রিয়ানের বুক থেকে মুখ তুলে বলল,
" এভাবে কেন বলছেন?"
আদ্রিয়ান অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ওর মাথাটা আবার নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। বুক ভরে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
" কিছুনা। জানো কতটা মিস করছিলাম। দুপুরের পরে শো করতে গেছিলাম। যেতে সাড়ে তিন ঘন্টা, শো এ নষ্ট হয়েছে দু ঘন্টা, ফিরতে সাড়ে তিন ঘন্টা। এরমাঝে এক সেকেন্ডও রেস্ট করিনি। এরপর সোজা চলে এসেছি এখানে। আজকে তোমাকে দেখতে না পেলে মরেই যেতাম।"
অনিমা কিছু বলল না, শুধু হালকা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আদ্রিয়ানও কোন শব্দ না করে অনিমার চোখ মুছে দিচ্ছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অনিমা মাথা তুলে তাকিয়ে বলল,
" আপনি তাহলে নিশ্চয়ই দুপুরের পর থেকে আর কিচ্ছু খান নি?"
আদ্রিয়ান না বোধক মাথা নাড়ল। অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর অস্হির কন্ঠে বলল,
" এইজন্যই আপনাকে এরকম লাগছে। এতক্ষণ না খেয়ে থাকে কেউ? আপনি বসুন আমি এক্ষুনি আসছি।"
অনিমা আদ্রিয়ানের কোল ছেড়ে উঠে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে ফেলল। এরপর ভ্রু কুচকে বলল,
" এতোরাতে কিচেনে তেমন কোন খাবার পাবেনা, জানপাখি! চুপচাপ বসো। আমার ক্ষিদে পায়নি। শুধু তুমি কাছে থাকলেই হবে।"
অনিমা কপট রাগ দেখিয়ে হাত ছাড়িয়ে বললেন,
" আপনার রোমান্টিক ডায়লগ আপাতত আপনার পকেটে রাখুন। একদম চুপচাপ এখানে বসে থাকবেন আমি আসার আগ পর্যন্ত একদম নড়বেন না বলে দিচ্ছি।"
বলে অনিমা হনহনে পায়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। এরপর আস্তে আস্তে কিচেনে গিয়ে পরলো আরেক মুশকিলে। রান্নাকরা খাবার শেষ। এখন কিছু করেই দিতে হবে। মাছ বা মাংস রান্না করা অনেক সময়ের ব্যাপার। লোকটা এতক্ষণ না খেয়ে থাকবে? অনিমা একটু ভেবে দ্রুত কয়েকটা পরোটা আর বেশ ঝাল করে আলুর তরকারি করল। আদ্রিয়ান ঝাল খেতে বেশ ভালোবাসে। রান্না করে খাবারটা নিয়ে আস্তে আস্তে আবার নিজের রুমে গিয়ে দেখল আদ্রিয়ান আসাম করে বসে আছে। ওপরের টিশার্ট খুলে ফেলেছে। অনিমার আসার আওয়াজ পেয়ে আদ্রিয়ান তাকালো অনিমার দিকে। কী করে এসছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। অনিমা গম্ভীর মুখে দরজা লাগিয়ে আদ্রিয়ানের সামনে এসে বসল। ঢাকনা সরাতেই আদ্রিয়ান বলল,
" এতোরাতে এগুলো কোথায় পেলে? রান্না করেছো? কী দরকা___"
অনিমা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আদ্রিয়ান থেমে গেলো। এই মেয়ে কবে থেকে আবার ওকে চোখ রাঙাতে শুরু করলো? তবে বউয়ের চোখ রাঙানী খাওয়ার এক্সপিরিয়েন্সটা মন্দ নয়। অনিমা চুপচাপ পরোটা ছিড়ে আলু দিয়ে আদ্রিয়ানের মুখের সামনে ধরল। আদ্রিয়ান একটু অবাক হলেও অনেক খিদে পেয়েছে তাই চুপচাপ অনিমার হাতেই খেতে শুরু করে দিলো। আদ্রিয়ান একদম শান্ত-ভদ্র বাচ্চার মতো আসাম করে বসে অনিমার হাতে খাচ্ছে। আল অনিমা গম্ভীর মুখ করে ওকে খাইয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ অনিমা বলল,
" এমন করে কেউ? সেই দুপুর থেকে এখন অবধি কত ঘন্টা জানেন? এমনিতেতো টাইমের খুব হিসেব রাখেন। এমনিতেই আপনার সুগার ফল হয়। যদি কিছু হয়ে যেতো? সবকিছুতেই আপনার অতিরিক্ত কিছু করা লাগবে। নিজেকে সবসময় স্পেশাল এন্ড এক্সেপশনাল দেখাতে হবে। ঐ ডায়লগটার মত, প্রাণ যায় পার এটিটিউড না যায়। আর ভুগতে হয় আমাকে।"
আদ্রিয়ান মুচকি মুচকি হাসছে আর বউয়ের শাসন উপভোগ করছে। আদ্রিয়ানকে হাসতে দেখে অনিমা রেগে বলল,
" একদম হাসবেন না বলে দিচ্ছি। মজা হচ্ছে না?"
আদ্রিয়ান সাথেসাথেই মুখটা সিরিয়াস করে নিয়ে বলল,
" আমি কী হাসছি? কই নাতো! আমিতো খাচ্ছি।"
অনিমা আর উত্তর দিলোনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদ্রিয়ান বলল,
" আজকে না তোমাকে একদম বউ বউ লাগছে, বউ!'
আদ্রিয়ানের বউ ডাকটা অনিমার মধ্যে হালকা কাঁপন ধরালেও ও বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল,
" তো এতোদিন কী বোন বোন লাগতো না-কি?"
" না। এতোদিন প্রেমিকা, প্রেমিকা লাগত। একদম পিওর প্রেমিকা ইউ নো।''
অনিমা আর কথা না বাড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে রেখে আদ্রিয়ানকে খাওয়ানো শেষ করল। এরপর বিছানা করে নিলো। কারণ ও জানে এই ছেলে আজ রাতে আর যাবেনা। অনেক রাত হয়েছে তাই কথা না বাড়িয়ে দুজনেই শুয়ে পরল। আজ আদ্রিয়ান বলার আগেই অনিমা ওর বুকে মাথা রেখে শুয়েছে। এতোদিন পর আদ্রিয়ান অনিমাকে কাছে পেয়ে কিছু বলনি না শুধু শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রেখে দিয়েছে।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অনিমা দেখলো আদ্রিয়ান ওর পাশে নেই। আর ব্যালকনির দরজা খোলা। ঘুম ঘুম চোখেই দ্রুত ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো মই টাও সরিয়ে রাখা। বুঝতে পারল যে ভোর ভোরই আদ্রিয়ান চলে গেছে। এখন ওরও ভালো লাগছে না। কবে শেষ হবে এই পরীক্ষা? আর ওর অপেক্ষাই বা কবে শেষ হবে।
________
সকাল সকাল স্নান করে জাবিন কাপড় মেলে দিতে ছাদে এসছে। কিন্তু ছাদে এসে দেখে অভ্র ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। এতো সকাল সকাল এভাবে নিরবে এসে কার সাথে কথা বলছে ভাবতেই কপাল কুচকে এলো ওর। এই কয়েকমাসে একটু একটু দুর্বল হয়ে পরেছে অভ্রর প্রতি। এখন এটা শুধু দুর্বলতা নয়। ও এখন এটা নিশ্চিত যে ভালোবেসে ফেলেছে ও অভ্রকে। কাপড় মেলতে মেলতে বারবার সরু চোখে দেখছে অভ্রকে। কিন্তু অভ্রর সেদিকে খেয়াল নেই ও একমনে কথা বলে চলেছে। এতো মনোযোগ? কার সাথে কথা বলছে? গার্লফ্রেন্ড? জাবিন আর ধৈর্য্য রাখতে পারল না। কাপড় মেলা শেষ করে জাবিন হাত ঝাড়তে ঝড়তে অভ্রর পেছনে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো! অভ্রর কথা ততক্ষণে শেষ। ও 'আচ্ছা বাই' বলে ফোনটা রেখে পেছনে ঘুরতেই চমকে উঠল। পরে যেতে নিয়েও পিলার ধরে নিজেকে সামলে নিলো। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে গলা ঝেড়ে বলল,
" এভাবে সামনে এসে দাঁড়ায় কেউ? আরেকটু হলেতো আমার ওপরের টিকিট বুকড হয়ে যেতো।"
অভ্রর কথায় কোনরকম কর্ণপাত না করে জাবিন বলল,
" কার সাথে কথা বলছিলেন?"
অভ্র একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে তারপর জাবিনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
" সেটা জেনে তুমি কী করবে?"
" গার্লফ্রেন্ড?"
জাবিনের কথা শুনে অভ্রর ভ্রু আরও কুচকে গেল। ইদানীং মেয়েটা ওর পেছনে বেশিই ঘুরঘুর করছে। ওর যেটা মনে হচ্ছে, ও যেটার ভয় পাচ্ছে সেটা হলে ভীষণ সমস্যা। ও আবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,
" যদি হয়েও থাকে। তো? আমার গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারেনা।"
হঠাৎ করেই জাবিন একটা ভয়াবহ কাজ করে বসল। অভ্রর টিশার্টের কলার ধরে বলল,
" না, থাকতে পারবে না। তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড থাকবে না। আর যদি থেকে থাকে এখনই সব ডিসমিস করে দাও। আমি ছাড়া অন্যকারো দিকে তাকালে না চোখ তুলে ফেলবো একদম। আমি কোন ন্যাকামি ট্যাকামি করতে পারব না। তাই ডিরেক্টলি বলছি, আই লাভ ইউ। সো এসব গার্লফ্রেন্ড এন্ড অল সব ঝেড়ে ফেলে দাও। একদম ঝেড়ে ফেলে দাও।"
বলে অভ্রর কলার ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো। অভ্র অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জাবিনের যাওয়ার দিকে। এটা মেয়ে না অন্যকিছু? কিন্তু রেগে গেলে দারুণ লাগে তো! দূর! কী ভাবছে এসব ও? চোখ বন্ধ করে বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে অভ্র বলল,
" কন্ট্রোল অভ্র! কন্ট্রোল!"
__________
দেখতে দেখতে আরও দুটো মাস কেটে গেছে। অনিমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। সব ঝামেলা মোটামুটি শেষ। শীতকাল কেটে গিয়ে আবারও বসন্ত এসেছে। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হচ্ছে আবার। সবকিছু বদলে গেলেও বদলায় নি ওদের জীবনযাত্রা। অনি-আদ্রিয়ান এখনো বেশ লম্বা দূরত্বেই আছে। সীমিত যোগাযোগ, আর সাক্ষাৎ এতেই ওদের দিন কেটেছে। রিক ওপর দিয়ে একদম স্বাভাবিক হলেও ভেতর ভেতর এখানো গুমরে মরে। তবে স্নিগ্ধার সংস্পর্শে ওর কষ্টগুলো অনেকটাই লাঘব হয়ে যায়। বাকি সব সম্পর্কের সমীকরণও একই রকম আছে। তবে কবির শেখকে ওরা দেখতে পায়নি, আর কোথায় আছে সেটাও জানেনা। তবে আপাতত ওরা সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাচ্ছেনা কোনরকম।
মিসেস রিমার আজ প্রচন্ড শখ হয়েছে বাড়ির সবাইকে একসাথে আনতে। নিজে রান্না করে খাওয়াবে। তাই আবরার মেনশনে অনেকদিন পর আজ আবারও সবাই ইনভাইটেড হয়েছে। অনিমা আর আদ্রিয়ানের বন্ধু বান্ধবদেরও। অনিমার মামা-মামি অর্ককেও বলা হয়েছে। হাসান কোতয়ালের কঠোর ব্যবহারে ওনাদের অবস্থা শোচনীয়। এমন মনে হচ্ছে যেন পাঁচ বছরের জমে থাকা সব রাগ মেটাচ্ছেন ওদের ওপর।
রাতে বেশ ভরপেট খাওয়াদাওয়া করার পর ওরা সবাই ছাদে গিয়ে বসেছে কিছুটা আড্ডা দিতে। এরমধ্যে আরেকটা খুশির খবর হচ্ছে রাইমা প্রেগনেন্ট। মানে আদিব বাবা হতে চলেছে। এটা নিয়ে সবার হৈ হুল্লোড়ে রাইমা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল একদম। আদ্রিয়ান গিটার নিয়ে গান গাইছে সবাই বেশ চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তীব্র-স্নেহা আজ বেশ মাখোমাখো মুডে আছে। কারণ কালকেই ওদের প্যাচ আপ হয়েছে। আশিস বারবার অরুমিতার দিকে আড়চোখে তাকালেও অরুমিতা ভুল করেও তাকাচ্ছেনা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্হির লাগছে ওকে। নাহিদ গান শুনতে শুনতে তনয়ার সাথে চ্যাট করছে। অনিমা, রিক, স্নিগ্ধা তিনজনেই চুপচাপ গান শুনছে। বেশ অনেকক্ষণ হাসি-ঠাট্টা করার পর আস্তে আস্তে সব চলে গেলো নিচে। তখনও আদ্রিয়ান, অনিমা, রিক আর স্নিগ্ধা আছে। এরমধ্যে আদ্রিয়ান বলে উঠল,
" রিক, তুই হসপিটাল জয়েন করছিস কবে?"
রিক চমকে উঠল। কিছুক্ষণ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে অপ্রস্তুত হয়ে পরল বেশ। স্নিগ্ধা বলল,
" দু-মাস যাবত বুঝিয়ে যাচ্ছি কিন্তু শুনছেই না।"
অনিমা একবার রিকের দিকে তাকালো। কেন জানি মাঝেমাঝে এসবের জন্যে ওর নিজেকে দায়ী মনে হয়। যেখানে ও নিজেই পরিস্থিতির স্বীকার। আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ রিকের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গিয়ে ওর পাশে বসলো। এরপর বলল,
" কোনকিছুর জন্যে নিজের প্যাশেনকে ছাড়তে নেই। যখন তোর পাশে কেউ থাকবেনা। একদম একা হয়ে যাবি। তখন এই একটা জিনিস তোর সাথে সবসময় থাকবে, প্যাশন! এটাকে ছাড়িস না।"
রিক একপলক তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। এরপর মুচকি হেসে বলল,
" আরেকটু সময় লাগবে।"
আদ্রিয়ান চট করেই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রিককে। কয়েক সেকেন্ড পর রিকও ধরল। অনিমা আর স্নিগ্ধা দুজনেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে এই দুজনকে। এই দুই ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার জন্যে অনেকগুলো বিশাল বিশাল কারণ ছিলো। কিন্তু ওরা একটা কারণকেও ওদের সম্পর্কের মধ্যে জায়গা পেতে দেয়নি। এরকমটাই হওয়া উচিত। সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে সম্পর্কটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর এটার জন্যেই হয়তো এতো কিছুর পরের ওদের দুই ভাইয়ের বন্ধন এখনো মজবুত।
.
.
.
চলবে...........................................