বিভ্রম - চন্দ্রিকা চক্রবর্তী - অনু গল্প


----শোনো, বাসায় পৌঁছে তাড়াতাড়ি একটা ফোন দিবা। আকাশের অবস্থা ভালো না। নেহাৎ আব্বা অসুস্থ তোমার, নয়তো আজকে যেতে দিতাম না আমি। হুট করে ছুটিও নেয়া যায় না। বস কে বলেছিলাম, দিলো না। এই ভর সন্ধ্যায় রওনা দিচ্ছো। যেতেও তো সময় লাগবে। 

----আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। দিয়ে দিবো ফোন পৌঁছেই। একটু শ্বাস ছাড়ো এবার। এতোগুলো কথা এক নিশ্বাসে বলে গেলা! 

----আলবাত বলবো। দশটা না, পাঁচটা না। একটা মাত্র বউ আমার! 

----হয়েছে হয়েছে। বউ সবারই থাকে। তোমার একার না কী? আর এতো চিন্তা করেই বা কী করবা? আল্লাহ না করুক, যদি আমার ভালো-মন্দ কিছু হয়েও যায়, এতো দূর থেকে এসে বাঁচাতে পারবা? তাই এসব চিন্তা বাদ দাও। আমি সাবধানে যাবো। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। 

----আমি তোমাকে কখনো বিপদে একা ছাড়বো না অনা, কক্ষনো না।

----এই, কী শুরু করলা বল তো? এমনিতেই আমার দেরি হয়ে গেছে, তুৃমি আরও দেরি করাচ্ছো। রাখো তো ফোন!

ব্যাগ প্যাক গুছিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে অনাহিতা বেরিয়ে পড়লো বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আহাদ টা এতো অস্থির সবকিছুতে! বিশেষ করে তাকে নিয়ে সবসময়ই একটা চিন্তার রেখা কপালে দৃশ্যমান থাকে। 

বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো অনাহিতা। সময় তখন সন্ধ্যা সাতটা। বাস চলে এলে দ্রুত পায়ে বাসে উঠে মালপত্র রেখে জানালার পাশে বসলো সে। জানালা খোলাই ছিলো। বাস ছেড়ে দিলো কিছুক্ষণ পর। বাসে করে দু'ঘন্টা সময় লাগবে। এরপর অটো বা রিকশা নিয়ে তাদের বাড়ি পৌঁছাতে হবে। প্রায় আড়াই ঘন্টার পথ যদি জ্যাম না পড়ে। 

জ্যাম পড়লো না ঠিকই। তবে তার থেকেও বেশি কিছু হলো। অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হওয়ার পর গাড়ি গেল নষ্ট হয়ে। উফ! এর কোনো মানে হয়? বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো অনাহিতার। ফোন হাতে নিলো হ্যান্ডব্যাগ থেকে বের করে। এই যাহ্! চার্জ তো দেখি একেবারেই নেই! মাত্র ৩%! তাড়াতাড়ি পাওয়ার ব্যাংক এর জন্য খোঁজ করলো ব্যাগে। বিপদ বুঝি আসলে সবদিক থেকেই আসে। পাওয়ার ব্যাংকও বাসায় ফেলে এসেছে। ওইদিকে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতে শুনলো বাস কখন ঠিক হবে। কিন্তু আশানুরূপ কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। আজকে দুপুর থেকেই আকাশটা মেঘলা। এখন আবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে। সাথে দমকা হাওয়া। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল আকার ধারণ করবে সবকিছু। 

একে একে বাস থেকে নেমে যাচ্ছে যাত্রীরা। অনাহিতা উপায় না পেয়ে তাদের সাথে নামতে নিলো। তখনই তার ফোনে কল আসলো। তার আম্মুর নাম্বার থেকে। ততোক্ষণে চার্জ ২% চলে এসেছে। আম্মুর ফোন পেয়ে অনাহিতা বেশ খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। তার আব্বুর কিছু হলো না তো আবার! দ্রুত ফোন রিসিভ করে অপর প্রান্তের মানুষকে কিছু বলতে না দিয়েই চরম উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো

----আম্মু, কী হয়েছে? ফোন দিলে কেন? আব্বু ঠিক আছে? কোনো সমস্যা হয় নি তো?

শুনতে পেল তার আম্মুর কান্নাভরা কন্ঠ 

----অনা রে....ও অনা.... সে আর নেই রে অনা...

----আব্বু? আব্বুর কী হয়েছে আম্মু? বলো আম্মু? হ্যালো? হ্যালো?

কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখলো ফোন এবার অফ হয়ে গেছে। চার্জ একেবারেই শেষ। 
এই তো বললো আব্বু অসুস্থ। এর মধ্যেই চলে গেল! 

বাস থেকে নেমে সেখানে বসেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো অনাহিতা। প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। সেদিকে খবর নেই তার। সে কেঁদেই যাচ্ছে। তবে কারোর সেদিকে তাকানোর সময় নেই। যে যার রাস্তা দেখছে। এই ঝড়বৃষ্টিতে আগে নিজের চিন্তা করবে না কী অন্যদের? অবশ্যই নিজের। অন্তত আজকালকার সিংহভাগ মানুষের এটাই মনোভাব। ঠিক হলোও তাই। 

অনাহিতা যখন একটু স্বাভাবিক হলো, তখন তাকিয়ে দেখলো তার সহযাত্রীরা সবাই চলে গেছে। তার দিকে শুধু দুই জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে। একজোড়া ড্রাইভারের, আরেক জোড়া কন্ট্রাক্টরের। বৃষ্টিতে অনেকটাই ভিজে গিয়েছে অনাহিতা। শাড়ি শরীরে লেপ্টে আছে। সেদিকে কেমন চাহনি জানি লোক দু'টোর। লোলুপ দৃষ্টি! 

কিছুক্ষণ পর তার দিকে তাকিয়ে মারাত্মক বিশ্রী একটা হাসি দিলো দু'জনেই। অবস্থা কোন দিকে মোড় নেবে সেটা আগে থেকেই বুঝতে পেরে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করলো অনাহিতা। গন্তব্য জানা নেই, এলোমেলো ছুটছে সে। শুধু এতোটুকু জানে, তাকে এই নারী মাংস লোভীদের কাছ থেকে বাঁচতে হবে। সেটা যেভাবেই হোক।

অনেকটুকু পথ যাওয়ার পর পিছনে ফিরে সেই দু'জনের কাউকেই দেখতে পেল না সে। হঠাৎ পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখলো কেউ একজন। চিৎকার দিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো আহাদ দাঁড়িয়ে। ভিজে একাকার। তাকে দেখামাত্রই দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরলো অনাহিতা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। 

----কিচ্ছু হবে না অনা, আমি আছি না?

----তু..তুমি এখানে কী..কী করে এলে?

----বস থেকে অনেক কষ্টে ছুটি ম্যানেজ করেছি বউ। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছিলো না। তাই তো বসের ঝাড়ি খেয়েও ছুটে চলে এলাম। 

----কিন্তু এতোটুকু পর্যন্ত কীভাবে আসলে? গাড়ি তো নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের। 

----সব বলবো, কিন্তু বাসায় গিয়ে। এখন এই বৃষ্টিতে ভিজে এতো কথা বলার মানেই হয় না।

বাসার কথা বলাতেই আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো অনাহিতা। 

----বাসায় গিয়ে আর কী করবো আহাদ। আব্বু যে আর নেই! 

----তবুও যেতে তো হবেই। চলো, আসো আমার সাথে। 

অনেকটুকু জায়গা হেঁটে পার করে আসলো তারা। পুরোটা সময় এক মুহুর্তের জন্যও আহাদ অনাহিতার হাত ছাড়ে নি। বেশকিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর একটা রিকশা দেখতে পেল তারা। ব্যাস, আর বেশি সময় লাগবে না। আধ ঘন্টার মতো। অনাহিতা রিকশাওয়ালা কে ঠিকানা বলে আহাদকে নিয়ে উঠে বসলো রিকশায়। রিকশায় উঠার পর আহাদ অনাহিতাকে বললো তার কাঁধে মাথা রাখতে। অনাহিতা মাথা এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ রাখতেই কেন জানি ঘুমিয়ে গেল।

সেই ঘুম ভাঙলো রিকশাওয়ালা'র ডাকে

----আপা, আপনের বাসার সামনে আইয়া পড়ছি। নামবেন না?

চোখ খুলে কিছুক্ষণের জন্য অনাহিতা এদিক সেদিক তাকালো। আহাদকে দেখতে পেল না। রিকশা থেকে নেমে গেল না কী?

রিকশাওয়ালাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নেবে, তার আগেই কানে এলো তার আম্মুর বুক ফাটা আর্তনাদ। চিল্লিয়ে দৌড়ে এসে অনাহিতাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।

----এটা কী হইয়া গেল রে অনা! কেমনে হইলো! আল্লাহ এটা কী দিন দেখাইলো!

অনাহিতাও তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। 

----নিজেকে সামলাও আম্মু। আব্বু কোথায়?

----তুই এখন তোর আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করোস!

----আব্বুকে দেখতে চাই আমি আম্মু। আমাকে নিয়ে চলো।

----মানে কী বলতেছোস তুই বুঝ.....

রিকশাওয়ালা'র ডাকে তাদের কথোপকথনে ব্যাঘাত ঘটে।

----আপা, আমার ট্যাকা দিয়া দেন। আমি যাই গা। মেলা রাইত হইছে। 

----আপনাকে আহাদ টাকা দিয়ে যায় নি?

----কোন আহাদ আপা? আপনিই তো উঠলেন শুধু রিকশায়।

----কী বলছেন আপনি এগুলো? আহাদ তো ছিলো।

----অনা, তুই কী কইতাছোস এগুলা? আহাদ কেমনে আইবো রে? আহাদ তো দুই ঘন্টা আগে এক্সিডেন্ট কইরা মারা গেছে। স্পটড্যাথ না কী!

আর বেশি কিছু শুনতে পারলো না অনাহিতা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করার আগে শুধু দেখতে পেল তার আম্মু বারেবারে তার মুখের সামনে কী যেন বলছে। গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলছে। মুখ নাড়াচ্ছে। তবে সেসব কিছুই কানে দিয়ে ঢুকছে না তার। কোনো কথাই সে শুনতে পাচ্ছে না। কানে শুধু একটা কথাই বাজছে এখন

----আমি তোমাকে কখনো বিপদে একা ছাড়বো না অনা, কক্ষনো না। 
.
.
.
সমাপ্ত......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন